কলম-বাসি কথা
পর্ব ২
মেয়েটা হু হু করে কাঁদছে। আমেরিকান এম্ব্যাসির ভিসা ইন্টারভিউয়ের জানলায় যখন গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, মুখটা উজ্জ্বল। বুকের ওপর যত্ন করে ধরে রাখা একটা মাঝারি মোটা ফাইল। ইন্টারভিউয়ের ডকুমেন্টস। বাকি সবই বাইরে রেখে আসতে হয়। খেয়াল রাখছিলাম, কারণ ওই জানলাতেই আমার মেয়েরও ডাক পড়বে। মেয়েটি কথা বলছে। শুরুতে শান্ত বাক্যালাপ। ক্রমে মেয়েটির অস্থিরতা বাড়ল। মাথা নাড়িয়ে, হাতের নানা ভঙ্গি করে বলা কথায় কেমন একটা হতাশার বাতাস বইছে। কিছু কি গোলমাল? বড়জোর পাঁচমিনিট। তারপরেই জানলার ওপার থেকে ফিরিয়ে দেওয়া কাগজের তাড়া হাতে নিয়ে পাশে সরে এসে যখন দাঁড়াল, মুখে কে একরাশ কালি ঢেলে দিয়েছে। চোখের কোল ওপচানো জল। আমাদের থেকে অল্প দূরে দাঁড়িয়ে। হন্তদন্ত হয়ে কাছে এসে দাঁড়াল ওইখানেই গ্রুপ–ডির কাজ করা একটি ছেলে। বলল, আপনার পেপারের পুরো নামাটা বলেছেন কি? মেয়েটির উত্তর – বলতে তো হবেই! ছেলেটি বলল – তখনই পই পই করে বললাম, কসমিক, নিউক্লিয়ার, কেমিক্যাল – এইসব শব্দ ভুলেও উচ্চারণ করবেন না, করলে আর ভিসা দেবে না। তারপর গলা নামিয়ে বলল জানলার ওপারের লোকগুলো তো হাফ–এডুকেটেড। নিউক্লিয়ার-এর পাশে ওয়ারফেয়ার, কেমিক্যাল-এর পাশে ওয়েপন ছাড়া অন্য কোন কথা এরা ভাবতে পারে না’।
সন্ত্রাসবাদের আঁচটা ভালই টের পাওয়া যাচ্ছে। ৯/১১ এদের ভাবনার ভিতটাকেই নড়িয়ে দিয়েছে। কেউ যখন নিজেকে অপরাজেয় বলে ভাবে, তখন এটাই তার বিশ্বাস হয়ে দাঁড়ায় যে তার গায়ে আঁচড় দেওয়া কারোর সাধ্যের বাইরে। আমেরিকার সাধারণ মানুষ তার দেশকে, দেশের সরকারকে সেইভাবেই দেখতে অভ্যস্ত ছিল। টুইন টাওয়ারের ধ্বংসলীলা শুধু ইটকাঠের ইমারতটাই ধ্বংস করেনি, আপামর জনসাধারণের মনে তাদের সরকারের অজেয় ভাবমূর্তিটাকেও টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। বিরাট উচ্চতা থেকে পতনের অভিঘাতটাও বিরাট। প্রশাসনের পক্ষে তাই আর একটাও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটতে দেওয়ার বিলাসিতা দেখানো সম্ভব নয়। সেই বজ্র আঁটুনির প্রতিফলন ভিসার অনুমতিতে এই যুক্তিহীন সতর্কতার ছাঁকনির জালবিস্তার।
মেয়েটি আমেরিকায় একটা কনফারেন্সে যাচ্ছিল তার পেপার পড়তে। পদার্থবিদ্যার উজ্জ্বল ছাত্রী। দোষের মধ্যে তার পেপারের নামকরণে ‘কসমিক রেডিয়েশন’ – এই কথাটি লেখা আছে। কনফারেন্সে পড়ার অনুমতি পাওয়ার পর খুশির অন্ত ছিলনা। টিকিট কাটা হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবারের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সকলে জেনেছে ওর বিদেশযাত্রার কথা। তাদের কাছে মুখ দেখানো দায় হয়ে উঠবে। তাও কিনা এমন একটা হাস্যকর কারণে, যার ওপর তার নিজের কোন হাত নেই। সেই সব ভেবেই হয়ত মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল কান্নার দমকে।
খুব খারাপ লাগছে। পাশাপাশি ভাবছি আমার মেয়ের কথা। তারও বিষয় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ওকেও কি তবে…? আশঙ্কা সত্যি হল অনেকটাই। সব যাচাই করে ভিসার বদলে মিলল পিঙ্ক স্লিপ, অর্থাৎ আরও বেশ কিছু তথ্য সরবরাহ করতে হবে। তাদের তদন্তসাপেক্ষে ভিসা পাওয়া যাবে। ইউনিভার্সিটির বিভাগীয় প্রধানের থেকে লিখিত শংসাপত্রে জানাতে হবে সে কি ধরণের কাজ করবে, কি কি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করবে, কোন বিস্ফোরক নিয়ে কাজ আছে কিনা ইত্যাদি।
এইবার আমাদের মাথায় বিস্ফোরণ হল। পি.এইচ.ডি-তে কি বিষয়ে কাজ করবে তা তো ঠিক হবে যাওয়ার পর, আরও নির্দিষ্টভাবে গাইড ঠিক হলে। আর চেনা নেই জানা নেই, বিভাগীয় প্রধানের কি দায় পড়েছে এত কৈফিয়ত দেবার? সময়ও সীমিত। একমাস পড়েই যাওয়ার টিকিট।
বাড়ি ফিরেই একগলা উৎকণ্ঠা নিয়ে ই-মেলে পিঙ্ক স্লিপের বক্তব্য জানানো হল তাঁকে। তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটের পাতায় সীমাবদ্ধ। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জগতে আক্ষরিক অর্থেই তিনি এক দানব (giant)। তার সঙ্গে স্থানীয় বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। একটা আপার কাটেই উড়িয়ে দেবেন, এই আশঙ্কা নিয়ে বসে আছি যখন, তখন দু দিনের মাথায়ই উত্তর এল ই-মেলের। প্রফেসর ম্যাকেনা জানাচ্ছেন, এটা নতুন নয়, তাঁর বিভাগের অনেক ছেলেমেয়ের জন্যই এটা করতে হয়েছে। টেমপ্লেট তৈরিই আছে। কিছু অদলবদল করে তিনি আমার মেয়ের উপযুক্ত করে পাঠিয়ে দেবেন অচিরেই। দিলেনও। পাসপোর্টে ভিসার ছাপ পড়া এরপর মাখনের মসৃণতায় সম্পন্ন হয়েছিল।
Morning shows the day প্রবচনটি আমার মেয়ের ক্ষেত্রে এরপর থেকে জারি থেকেছে। শিক্ষার বাকি পর্বে ঝাঁকি হয়ত এসেছে, কিন্তু দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিল কেউই তুলতে পারেনি। ঠিক সাড়ে চার বছর পর যেদিন সমাবর্তন, সেদিন আর একবার ঝাঁকিদর্শন হয়েছিল বটে, তবে সেকথায় আজ নয়, পরে আসব।
আমেরিকায় উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় বিদেশের ছেলেমেয়েদের একটা বিরাট ভূমিকা থাকে। বস্তুত তাদের অস্তিত্বের সঙ্গেই এই ছেলেমেয়েরা জড়িয়ে আছে। আসলে ওই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়দের নিজেদের আর্থিক ব্যয়ভারের অনেকটাই নিজেদের বহন করতে হয়। ওদেশের মোটামুটি ৬৫০০র মত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬০০র একটু বেশি সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি। তবে ‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি’ কথাটার সঙ্গেই যে তাচ্ছিল্য আমাদের দেশের মানুষের মনে জড়িয়ে আছে, যার উৎসে আছে আমাদের দেশের একসময়ের প্রাইভেট কলেজ ইউনিভার্সিটির আর্থিক আর অন্যান্য দুর্নীতি, তার সঙ্গে আমেরিকার ব্যবস্থাটা মেলে না। এটা শুনলে আমাদের আশ্চর্যই লাগবে হয়ত যে আমেরিকার বাঘা বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন হাভার্ড এম.আই.টি, প্রিন্সটন, ইয়েল – এরা সকলেই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। নিজেদের আর্থিক সংস্থান তাদের নিজেদের করতে হয়। বস্তুত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপকদের সমস্ত খরচ সরকারের নয়। তাঁদের নিজেদের কাজ ও ভবিষ্যৎ কাজের প্রস্তাবনা বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থার কাছে পেশ করে, তাদের অনুমোদনের ভিত্তিতে পাওয়া টাকায় তাঁদের সংসার চালাতে হয়। সংসার অর্থে নিজেদের মাইনের অংশ, তাঁর পি.এইচ.ডি ছাত্রছাত্রীদের স্টাইপেন্ড, ল্যাব থাকলে তার খরচ ইত্যাদি। অন্যদিকে এখানে বিজ্ঞানের ও কারিগরির শাখায় এম.এস করতে যারা বিদেশ থেকে আসে, তাদের কোন স্টাইপেন্ড নেই, উল্টে মোটা টাকা খরচ করতে হয় তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক পেশীর পুষ্টির বড় উৎস তারা। তবে পি.এইচ.ডি-র ছাত্রছাত্রীদের আংশিক বা পুরো খরচ বহন করে বিশ্ববিদ্যালয়। যাদের মান আর সম্ভাব্য কাজ সম্পর্কে তারা নিশ্চিন্ত বোধ করে তারা শুরু থেকেই পূর্ণ জলপানির আশ্বাস পেয়ে যায়। আংশিক সুবিধেভোগীরা প্রথম বছর শেষে সন্তোষজনক কাজের সাপেক্ষে সাধারণত ফুল বা প্রায় ‘ফুল-স্কল’ পেয়ে যায়।
এম.এস-এর ছেলেমেয়েদের জীবন তুলনায় অনেক কঠিন। শুরুতে দেওয়া টাকার ওপরে আছে প্রতিদিনের খরচ চালানোর বিপুল চাপ। এদের জন্যে ইউনিভার্সিটিতে কিছু কাজের সংস্থান থাকে, যার বিনিময়ে অল্প আর্থিক সুরাহা হয়। তাই বেআইনিভাবেই এরা স্থানীয় মল, রেস্ট্যুরেন্ট, ইত্যাদিতে কাজ করে। এই ধরণের কাজের লোক আমেরিকানদের মধ্যে খুব কম, তাছাড়া সেক্ষেত্রে নূন্যতম মজুরির বাধ্যবাধকতা আছে। কম সুবিধে দিয়ে কাজ পেতে আমেরিকান মালিকরা মোটেই অপছন্দ করে না। ঠিক ভারতীয় মালিকদের মতই এই বিষয়ে দুই প্রভুই সমদর্শী। ইউনিভার্সিটিও চায় না অর্থের অভাবে ছাত্র দেশে ফিরে যাক, তাই এই বিষয়ে চোখ বন্ধ রাখে। কিছু সমস্যা হলে ছাত্র অনুমতি নেয় নি-র হলফনামার আড়ালে তো দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলাই যায়!
তবে এটা মানতেই হবে যে তাদের সংসারের সংস্থানে কিছু আপস জড়িয়ে থাকলেও তার ভাত রুটি ডালে কোন ভেজাল নেই। কী সরকারি, কী বেসরকারি, সমস্ত ইউনিভার্সিটি লেখাপড়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রতিটা আগামীদিনকে আজকের দিনের তুলনায় বেশি আলোকিত করতে বদ্ধপরিকর।
[ক্রমশঃ]
[পর্ব – ১]
বেশ অন্যরকম লেখা। ভাল লাগছে
আমেরিকার ভাল মন্দ নানা দিকের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করানোর চেষ্টা আরকি।
খুব ভালো লাগছে! আরো লিখুন।
হ্যাঁ, অনেকটাই লেখার ইচ্ছে, যদি আপনারা সহ্য করেন। 😀
বেশ ভাল এবং তথ্যবহুল
বার বার যাওয়ার সুবাদে যাকে বলে first hand experience, সেটা কিছুটা হয়েছে। সেই সব তথ্যই এর উপজীব্য।
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মোটের উপর বছরে ন’মাস এর বেতন পান অধ্যাপকরা। বাকি তিন মাসের খরচ, গবেষণা সবই নানা প্রতিষ্ঠানের থেকে সংগৃহীত ফান্ডিং এ চলে। ফান্ডিং জোগাড় করাটা শিক্ষকদের কাছে বিরাট চ্যালেঞ্জ।
নানা তথ্য সম্বলিত এ লেখায় শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। আকর্ষণীয় ও বহুমাত্রিক লেখা।
আমেরিকার নানা বিষয় নিয়েই নাড়াচাড়া করার ইচ্ছে রইল।
পড়ছি। অনেক কিছু জানতে পারছি। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার সঙ্গে মিল পাচ্ছি। আরও পড়তে চাই। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
চেষ্টা করব আপনার ইচ্ছের উপযোগী হয়ে ওঠার।