২০২৩ এর ২৫ জুন আমেরিকার পোর্টল্যান্ডের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভিভাসন কাউন্টারের মহিলা ইমিগ্রেসন অফিসার যখন আমাদের পাসপোর্টে আমেরিকায় প্রবেশের ১৯তম ছাপটি দিলেন, তখন মনে হল, আমেরিকা নিয়ে অভিজ্ঞতা তো কম হল না, গল্পরা স্বল্প হলেও জমল তো ঝুলিতে। তার কিছু যদি ভাগ করি পাঠকের সঙ্গে, তাতে ‘কি যা তা লিখেছে’ বলে ছি ছি হতে পারে, কিন্তু অনধিকার চর্চায় অভিযুক্ত হয়ত করবেন না কেউ।

ইমিগ্রেসনের লাইনে দাঁড়ানো সবচেয়ে খর্বকায় মানুষটি সম্ভবত আমি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আর কয়েকটি ভারতীয় পরিবারের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজনকে আমার চেয়ে নিচুতে রাখা যায়। বাকি সাদা চামড়ার দলের লোকেরা এক ইঞ্চি থেকে এক হাত – এর যে কোন মাত্রায় উঁচুতে আছেন। আর আমার চেয়ে আরও কালো যারা, তাদের পাহাড়সদৃশ মাপ সবদিক থেকেই আমাকে ছাপিয়ে যাওয়া। তবু এই দিনটায় নিজেকে সবচেয়ে লম্বা মনে হয়। মনে পড়ে, আজ থেকে ঠিক চল্লিশ বছর আগের এই দিনটায় কপিল দেব নামের এক ভারতীয় খেলোয়াড় এই দুই দলের মানুষদের মাথা ছাপিয়ে লর্ডসের বারান্দায় ক্রিকেটের বিশ্বকাপটা হাওয়ায় উড়িয়ে আমার দেশের নামটিকে সবার ওপরে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি আর তাঁর দলের সদস্যরা সেদিন সাহেবদের থোতা মুখ ভোঁতা করেই (ইংল্যান্ডের প্রেসের ছদ্মমার্জিত গালি, আর সেমিফাইনালে ভারতের কাছে হারার দুঃখে ইংল্যান্ড সমর্থকদের অমার্জিত গুন্ডামি) যে দেশের পতাকাটা সবচেয়ে উঁচুতে পতপত করে উড়িয়েছিলেন, আমি সেই দেশের লোক, এটা ভাবলে অন্তত এইদিন বাকি পৃথিবীর দিকে চোখ নিচু করে তাকানোই যায়।

তবে আমেরিকায় এতবার যাওয়ার পাশাপাশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষদের সঙ্গে বিনিময়ের সুত্রে এটা মনে হয়েছে, বিদেশি মানুষকে নিজেদের ব্যবহারিক ও কিছুটা হলেও সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক বৃত্তে প্রবেশধিকার দেবার ক্ষেত্রে আমেরিকানরা তুলনায় উদার। সেটা তারা নিজেরাই যে মূলত বহিরাগত, সেই স্মৃতিবাহিত উপলব্ধির ফসল কিনা, তা ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের পন্ডিতদের গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে আমার এই উপসংহার একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ। তাই ডিসক্লেমারটি দেওয়া রইল যে অন্য কারোর ‘রাইট টু ডিফার’-কে সম্মান দিয়েই আমার বক্তব্যটি পেশ করেছি। তার উৎস উল্লেখের বাধ্যবাধকতায় আমাকে ফিরতে হবে এখানে আসার প্রথম দিনটিতে, যেদিন টেক্সাসের লাবক শহরে অনিশ্চিত পা রেখেছিল এক সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা মেয়ে আর তার বাবা, লক্ষ্য টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটি, ডিপার্টমেন্ট অফ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। দ্বিতীয়জনের বাইরের চেহারায় একটা ‘কোন ব্যাপার নেই’ ভাব থাকলেও তার ভেতরটা কিন্তু তখন তিরতির করে কাঁপছে।

স্ট্যাচু অফ লিবার্টি

কলকাতায় বি–টেক পাশ করার পর চাকরির প্রলোভন (সেই ২০০৯ সালে পাশ করে কোর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কোম্পানিতেও অন্তত ক্লাসের ভাল ছেলে মেয়েদের সম্মানজনক বেতনের চাকরি অলভ্য ছিল না।) কাটিয়ে ‘উচ্চশিক্ষার্থে বিলাতযাত্রা’-র ইচ্ছেয় যখন শেষ বছরের শুরু থেকেই কিছু কিছু প্রস্তুতি চলছে, তখন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন আমেরিকার বিশিষ্ট অস্থি চিকিৎসক ড. দিলীপ পাল। কথায় কথায় বলেন,
– ভাস্কর, তুমি মেয়েকে ইংল্যান্ডে পাঠানোর কথা ভাবছো, আর আমাদের দেশের কথাটা একবার ভাবছো না? আমেরিকা কিন্তু খারাপ দেশ নয় পড়াশোনার জন্য।

স্যারের চন্দনগরের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ছিল ওনার বোনের বাড়ি, যেটি আমার বাড়ি থেকে ছিল পাঁচ মিনিটের দূরত্বে। সেখানে এলেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। অনাত্মীয় আমেরিকায় অভাব ছিল কথা বলার মানুষের, মানে সেই ধরণের মানুষের যাদের কাছে মনের কথাকে এটিকেটের জামা পড়িয়ে সামনে আনতে হয় না। সে ঘাটতি পূরণ করতে এখানে এলেই আসতেন আমাদের বাড়ি। আমার প্রয়াত বাবা, যার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি, তাঁকে দাদা মেনে আমার মা’কে ডাকতেন বৌদি বলে। শুরুর দিনগুলোর আড়ষ্টতা কাটিয়ে মা-ও তাঁর আমেরিকান দেওরের সঙ্গে গল্প করতেন খুব। নানা প্রসঙ্গে কথা হলেও বাড়ির কথা, একমাত্র মেয়ের কথা খুব যে একটা বলতেন, বলতে চাইতেন, এমন নয়। কারণটা কিছুটা স্পষ্ট হয়েছিল আমেরিকা গিয়ে। সে কথা ক্রমশ প্রকাশ করা যাবে নাহয়।

এমনই এক দীর্ঘ সান্ধ্য আড্ডার শেষে আমার মেয়ের গন্তব্য পাল্টে গেল আমেরিকায়। স্যারের কথায় আমার মা কনভিন্সড। আর ঠাকুমার ওপরে কথা বলার কথাই ওঠেনা এ বাড়িতে। অতএব সেখানে যাওয়ার ছাড়পত্র প্রাপ্তির আয়োজন শুরু হল। জি. আর. ই. পরীক্ষার প্রস্তুতির ঢাউস বই এল বাড়িতে। তার কোচিং, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্ট ইত্যাদির পর্ব চলল ধাপে ধাপে। বছরের প্রায় শেষে পরীক্ষাগুলোর ফলাফল আশা জাগালো যে রসদের সংগ্রহ পর্যাপ্তই হয়েছে।

আমেরিকার কয়েকটি ইউনিভার্সিটিতে আবেদনের ফলাফল আসতে দেখা গেল গোটা তিনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ স্কলারশিপ সহ পি এইচ ডি করার সুযোগ মিলেছে। তার মধ্যে ডা. পালের শহরে টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে। মা’কে আর অন্য কোন জায়গায় তাঁর একমাত্র নাতনিকে ছাড়তে রাজি করানো গেল না। ডা.পালও উচ্ছ্বসিত, মায়ের ফোনের উত্তরে একটা ‘হাম হ্যায় না!’ বার্তা পাঠিয়ে ইউনিভার্সিটি নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় ইতি টানলেন।

মেয়ে চলল বড় হতে বিদেশে। ততদিনে ইউনিভার্সিটির প্রথম হবার সোনার পদকটি গলায় উঠেছে। এইবার ভিসা, প্লেনের টিকিট ইত্যাদির বন্দোবস্ত করার পালা। আর সেইখানেই বাঁধল যত গোলযোগ।

ক্রমশঃ

[পরম্পরা ওয়েবজিন, মে ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
5 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
আইভি চট্টোপাধ্যায়
আইভি চট্টোপাধ্যায়
5 months ago

পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ।
ভালো লাগছে।

BHASKAR DAS
BHASKAR DAS
4 months ago

ধন্যবাদ।

কাকলি দেবনাথ
কাকলি দেবনাথ
4 months ago

পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

BHASKAR DAS
BHASKAR DAS
4 months ago

আসছি যথাসময়ে।

Sampa Sen
4 months ago

চমৎকার শিরোনাম। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার চলতে থাকুক। বাসি কথার টাটকা
ঘ্রাণ প্রথম পর্ব থেকেই পাঠকের রসনায় আরও পড়ার লোভ জাগিয়ে তুলছে…