পর্ব ৩

নিবিড় ঘন আঁধারে, জ্বলিছে ধ্রুবতারা।

আমি এরোপ্লেনের ট্রিপল লেয়ার জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তাকে খুঁজে চলেছি। মাটি থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উঁচুতে উড়তে উড়তে দেখতে পাচ্ছি নিচে মেঘের গালচে পাতা, সেখানে চাঁদের আলোর রুপোলি সুতোয় বোনা জমিতে আমাদের স্বপ্ন ফলে আছে। আমেরিকার মাটিতে প্রথমবারের জন্য পা ফেলার স্বপ্ন।
পাশের সিটে আমার রোগা মেয়েটার মাথা ঘুমে ঢুলে পড়েছে একদিকে। প্রায় তিনঘণ্টার ওপর ওড়া হয়ে গেল। মুম্বাই থেকে জেট এয়ারওয়েজের ফ্লাইট ন’ঘণ্টারও কিছু পরে পৌঁছবে ব্রাসেলস।

ব্রাসেলস এয়ারপোর্ট

প্লেন পাল্টে এরপর নেওয়ার্ক। দ্বিতীয় এই প্লেন ধরার অবসরে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। প্লেনে ওঠার লাইনে গেট থেকে যেমন ডাকা হচ্ছে, যেমন ধরা যাক সিট নাম্বার এক থেকে ষোলোর ডাক পড়েছে, তো তারাই শুধু উঠে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। বাকিদের অপেক্ষা করার ধৈর্যের খামতি নেই মোটেই। তার মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক ভারতীয়ও আছেন। অথচ এরাই যখন ভারতের মাটিতে, তখন একজনের ঘাড়ে আর একজন উঠে প্রায় মারামারি করে প্লেনে ওঠার চেষ্টা করছেন, এটাই প্রতিদিনের চিত্র। যেন সিটে রুমাল পেতে জায়গা রাখতে হবে অথবা প্লেন তাকে ফেলেই ছেড়ে যাবে। তখন মনে পড়ল আমার মেডিকেল কলেজের এক অধ্যাপকের কথা। এমারজেন্সির সিড়ি দিয়ে উঠছি ওঁর সঙ্গে, সিড়ির দেওয়ালে বিবিধ ঘনত্বের পানের পিকের ছোপ। স্যার বললেন, যে লোকগুলো এখানে এই কাজ করেছে, তারাই যখন কোন সাজানো প্রাইভেট হাসপাতালে যাবে, তখন কিন্তু পিকটা গিলে নেবে। তফাতটা পরিবেশের আর প্রশাসনের। নানা প্রসঙ্গে আজকের বাংলায় তথা ভারতে এই কথাটা খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয় না?

ব্রাসেলস এয়ারপোর্টের দোকান

যাই হোক, ব্রাসেলস থেকে আরেকবার ওঠানামা করে নেওয়ার্কমুখো প্লেনে বসা গেল। সেখান থেকে যাব টেক্সাসের ডালাস। শেষ লপ্তে সেখান থেকে প্রপেলার ঘোরা আর একটা ছোট প্লেন আমাদের ইউনিভার্সিটি শহর লাবকে পৌঁছে দেবে। ওখানেই টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটি আগামী কয়েক বছরের জন্যে আমার মেয়ের ঘরবাড়ি। মোট তিরিশ ঘণ্টার ওপর উড়তে হবে, এই ঘটমান ভবিষ্যতের মানসিক ধকলটাই বিরাট। ইতিমধ্যেই ওঠার আগে শারীরিক ধকলও কম হয় নি। কলকাতা থেকে আসা। মুম্বাইতে চূড়ান্ত ভিড়ের লাইনে চেক-ইন করে মালপত্র স্ক্যান করে (তখন চেকড-ইন ব্যাগেজ আগে এক্স-রে স্ক্যান করতে হত) ওজন করে হাতে কোমরে ব্যথা হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে চলে আসার সময় অতগুলো মানুষের চোখের জলের সম্মিলিত স্মৃতিভার, তার ওজনই বা কম কি? দুইয়ে কাহিল বাপ বেটির এরপর ইমিগ্রেশনের ছানবিন, সিকিউরিটির নামে কয়েদির তল্লাশি সব শেষ করে প্লেনে ওঠা। আর সেই থেকে প্লেনেই বসা, আধশোয়া, ইনটেক, আউটপুট সবকিছু। একঘেয়ে যাত্রায় খুচরো বিনোদন সামনের সিটের পেছনে লাগানো টিভি স্ক্রিনের দেশি বিদেশি ফিল্ম বা গান বাজনার ভিডিও, এয়ারহোস্টেসদের সহাস্য খাদ্য পানীয় বিতরণ অথবা আশপাশের যাত্রীদের ম্যানওয়াচিং করা। শেষের কাজটা বেজায় মজার। যেমন দেখছি ওই দূরের ডানদিকের সিটে মোটাসোটা গুজরাটি মাসিমা আমেরিকা যাবেন বলে তার বিপুল শরীরে জিন্সের প্যান্ট আর টপ চড়িয়েছেন, হয়ত বৃদ্ধ বরের শখ। কিন্তু সংস্কার বড় বালাই, ওর ওপরেই একটা ওড়না চাপিয়ে ইস্ট ওয়েস্টের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন, আর অভ্যেসবশত সেটা আঁচলের মত বারবার ছড়িয়ে দিচ্ছেন টপের সামনে। অথবা এক দক্ষিণী ভদ্রলোক এয়ারহোস্টেস খাবার দিতে এলেই প্রায় আর্তনাদের মত বলছেন, ভেজ ম্যাডাম, ভেজ। কেউ নিশ্চয়ই বলে দিয়েছে ওনাকে যে না বললে ছদ্মবেশে গরুর মাংস পাতে পড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে যে কোন মুহূর্তে।
এই করতে করতেই এসে গেল নেওয়ার্ক এয়ারপোর্ট। আমেরিকায় এটাই আমাদের ‘পোর্ট অফ এন্ট্রি’। অতএব এন্ট্রি ডকুমেন্টস পরীক্ষা করে মালপত্র নিয়ে নিতে হবে, তারপর ডোমেস্টিক এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে সেগুলোকে আবার দেবার পালা। সেই কাউন্টার লাগেজ বেল্টের কাছেই। বেল্ট থেকে নামানোর কষ্টটুকু স্বীকার করতে হল বটে, কিন্তু ডোমেস্টিক কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা কালো চামড়ার বিশালবপু হ্যান্ডলার প্রায় দেশলাই বাক্সের মত আমাদের ছাব্বিশ কেজির স্যুটকেশগুলো তুলে নিয়ে পরের প্লেনের বেল্টে পাঠিয়ে দিলেন।


মজা দেখাল কাস্টমস চেক। ভারত থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের ওরা বিলক্ষণ চেনেন। জানেন যে আদরের নাতির সঙ্গে ঠাকুমার সাধ করে পাঠানো চারখানা আম, কিম্বা নাতনির সঙ্গে এক টিফিন ক্যারিয়র নারকোলের নাড়ু থাকাটা খুবই সম্ভব। তবে এগুলোর আমেরিকার সীমানা পেরোনোর অধিকার নেই। অতএব ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের ওপর বিশেষ নজর, অন্যরকম তল্লাশি যার শেষে তাদের লাগেজ হাল্কা আর মন ভারি করে একটু আদরের বকুনি দিয়ে তাদের দেশের সীমানায় ঢুকিয়ে নিচ্ছেন তারা। প্রায় কেঁদে ফেলা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর মন খারাপ ওদেরও যে ছুঁয়ে যাচ্ছে, তা তাদের মুখ দেখলে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু ওদেশে নিয়ম আর আইন বড় বালাই। দেখছেন না, প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকেও তার খাঁড়ার ঘা খেতে হচ্ছে! আইন আইনের পথে চলবে-র আশ্বাস নয়, তাকে চালিয়ে উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করাই সেখানে দস্তুর, অন্তত সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন যাপনের স্তরে। অনিয়ম, দুর্নীতি নিশ্চয়ই আছে, তবে তা অনেক উচ্চকোটির। বিলিয়নের হিসেবে করা সেই সব স্ক্যামের প্রত্যক্ষ প্রভাব মানুষ অনুভব করতে পারে না। যদিও অন্তিমে মানুষই তার শিকার হয়।

পাখির চোখে ডালাস

ডালাস থেকে এবার ছোট্ট প্লেনে লাবক যাত্রা। যেন দুন এক্সপ্রেস থেকে ব্যান্ডেল স্টেশনে নেমে ব্যান্ডেল হাওড়া লোকালে চড়েছি। টু বাই টু সিটার প্লেন। বয়স্কা মাসিমাসুলভ এক মহিলা একমাত্র এয়ারহোস্টেস। অনেক যাত্রীই তাঁর পরিচিত। উচ্চগ্রামে গল্প করছেন তাদের সঙ্গে। একটা বাড়ি বাড়ি গন্ধ বেড়িয়েছে। প্যান্টের মধ্যে গুঁজে পড়া শার্ট বাইরে বের করে গলার বোতাম খুলে হাওয়া লাগাচ্ছি গলায় বুকে। বাড়ি থেকে দশ হাজার মাইল দুরেও যখন ভাবছি যে আমাদের জন্য সেখানে হাসি হাসি মুখে অপেক্ষা করছেন ডা. দিলীপ পাল, তখন এই পরবাস যেন অন্য মায়ায় জড়িয়ে নিচ্ছে আমাদের।


উই শ্যাল স্টার্ট আওয়ার ডিসেন্ট ইন ফাইভ মিনিটস – তীব্র টেক্সান অ্যাকসেন্টে ঘোষণা হল। জানলা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি সবুজ ক্ষেত। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে নানা মাপের ক্ষেত নকশিকাঁথার মত পাতা আছে জমি জুড়ে। খুব নির্দিষ্ট তাদের আকার। কিছু বর্গক্ষেত্র, কিছু আয়তক্ষেত্র আর বাকিরা বৃত্তাকার। প্রত্যেকেটি নিখুঁত জ্যামিতিক নকশা।

জ্যামিতিক নকশার তুলোর ক্ষেত

এই হল টেক্সাসের তুলোর ক্ষেত, যেখানে সারা আমেরিকার সবচেয়ে বেশি তুলোর চাষ হয়। এখনও ফল আসেনি। এলে মাঠ ভরে যাবে সাদা তুলোয়।
পরে এসে দেখছিলাম সেই সাদা ক্ষেতের বিস্তার।
আর জেনেছিলাম তার শুভ্র সৌন্দর্যের নিচে চাপা পড়ে থাকা ক্রীতদাস প্রথা আর তার সঙ্গে সম্পৃক্ত শোষণ বঞ্চনা আর মধ্যযুগীয় বর্বর অত্যাচারের ইতিহাস।
আগামী পর্বে আমরা ফিরব সেই কয়েক শতাব্দির পুরনো আমেরিকায়।

আপাতত লাবকের ছোট্ট এয়ারপোর্টের থেকে বেড়িয়েই দেখি ডা.পাল দাঁড়িয়ে আছেন, দু হাত প্রসারিত। পেছনের একটা বড় হোর্ডিং–এ জ্বলজ্বল করছে Welcome to Lubbock – the friendliest city in America.

লাবকের অভ্যর্থনা

[ক্রমশঃ]

[পর্ব – ২]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জুলাই ২৪, সূচিপত্র]