পূর্বাভাস
আমের পাতায় শিশির নামে। জমতে জমতে জলবিন্দু। টপটপিয়ে পড়তে থাকে। মাটিতে শোয়া শুকনো পাতায় আওয়াজ ফোটে।
এখনও ভাল করে ভোর হয়নি। সাবিত্রী নারকেল পাতার ঝাঁটা নিয়ে উঠোনে নেমেছে। বিরাট উঠোনের একদিকে আম কাঁঠালের বাগান।
“রোজ রোজ এত পাতা ঝরাস কী করে? বুঝিনা বাবা!” আম গাছটাকেই কষে বকে দেয় সাবিত্রী।
বোবা গাছ নিশ্চয় বোঝে সাবিত্রীর কথা। সেই নতুন বউ হয়ে আসা ইস্তক সাবিত্রীকে দেখে যাচ্ছে। নুপূর পায়ে ঘোমটা টানা ছোট্ট মেয়ে, দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গেল। আমের পাতার মতোই খসে গেল তার সময়, যৌবন, সংসার। স্বামী রতন চলে গেছে বছর পাঁচেক, ওদের একমাত্র সন্তান স্বপ্ননীল ভেসে গেছে মহাসাগর পেরিয়ে অন্য দেশে। জেলা স্তর, রাজ্য স্তর, জাতীয় স্তর পেরিয়ে স্বপ্ননীল, এখন আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী। সেখানে সবাই তার কৃতিত্বের কদর করে।
সূর্যের আলোর খবর পেয়ে পাখ পাখালি ডাকতে শুরু করে। কাছে দূরে নানা সুরের ডাক, শুকনো পাতা মাড়িয়ে কাঠবিড়ালীর ছুটে যাওয়া, পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকা লালু কুকুর, রান্নাঘরের মাটির উনোনের পাশে ঘুমন্ত ধলা বেড়াল। এরাই সাবিত্রীর পরিবার। পাঁচিলের ওপারে রতনের দাদার বাড়িও আছে, তবে সেখানেও ফাঁকা ফাঁকা, সম্পর্কের আঠা সময়ের সঙ্গে ফিকে।
ঝাঁটার টানে আওয়াজ ওঠে, খস খস, খস খস। আম কাঁঠালের ঝাঁকড়া ডালের ভেতরে ছোট ছোট শব্দে একটা পাখির ডাক শোনা যায়। খুব কাছেই। অজস্র কাকলি থেকে সাবিত্রী আলাদা করে শোনে সেই ডাক। ঝাঁটা ফেলে আগ্রহী চোখে ওপরে তাকায়। কোন ডাল? কোন পাতা?
“আঃ মড়া! বল না, পাখিটা কোথায়? কোন পাতার আড়ালে লুকিয়েছিস?” আবার আম গাছটাকে বকে দেয় সাবিত্রী। আম গাছ, কী আর করে? পাতা নাড়ায় কতক। কিছু শুকনো পাতা খসে পড়ে। সাবিত্রী কিছু বোঝে? হয়তো আমগাছের এই ইশারা সাবিত্রীই বোঝে। সে তখন পাখি খোঁজে, খুঁজতেই থাকে। ডাকটা খুব চেনা।
পাখিটা চুপ করে যায়। সাবিত্রীর উৎকন্ঠা যেন বুঝতে পেরেছে। সাবিত্রী রেগে যায়।
“আমি বুঝিনি ভেবেছিস? তোর গলা ঠিকই চিনি। শুধু একবার দেখা দে।”
এবারে পাখির উদ্দেশ্যে সাবিত্রী কথা বলে। মনে মনে আম গাছ নিশ্চয়ই হেসে ওঠে। এ তল্লাটে মন দিয়ে শোনার মতো আর কেইবা আছে?
ঠিক তখন গাছের পাতায় পাতায় হাততালি দেওয়ার মতো সোনালী রোদ জড়িয়ে সূর্য উঠতে শুরু করেছে। রাতের আঁধার কাটিয়ে পৃথিবী জেগে ওঠে নতুন জীবন পাওয়ার আনন্দে। প্রতিদিনের সূর্য ওঠা দেখতে সাবিত্রীর ভাল লাগে। হাত জোর করে বলতে থাকে, “ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং। ধ্বান্তারিং সর্ব পাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।।”
এই উচ্চারনের সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট শিস দিতে দিতে পাখিটা পাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। সূর্যের আলো মেখে কাঁচা সোনার বরণ, মাথায় কালো ঘোমটা।
“ঠিক ধরেছি। তুমি ইষ্টিকুটুম! তা এই খা-খা ভিটে তে কোন কুটুম আসার খবর আনলে?”
Sourav writes on AI based forecasting system, which effect the life
পাখিটা এ ডাল ও ডাল ধরে নেচে নেচে ছোট ছোট টুকরো তে শিস দিতে দিতে উড়ে বেড়ায়। বহুদিন পর বালিকা বধূর মতো দুহাত উপরে তুলে হেসে ওঠে সাবিত্রী। আম গাছটাও ঠিক অবাক হয়ে ডালাপাতা নাড়িয়ে আহ্লাদ করে ওঠে।
উঠোন ঝাঁট দেওয়া শেষ করে সাবিত্রী প্রতিদিনের মতো নদীতে যায়, স্নান করতে। গ্রামের পাশ দিয়ে গলানো স্নেহ মেখে নদী চলে যায়, আঁকা বাঁকা ধুলো কাদা মাখা।
নদী থেকে স্নান সেরে ফিরতে গিয়ে দেখে, উঠোনে গাড়ি দাঁড়িয়ে। বুকটা ধ্বক করে ওঠে, তবে কি সত্যিই কুটুম এল? পায়ে পায়ে কাছে যেতে চোখ জুড়িয়ে গেল সাবিত্রীর।
স্বপ্ননীল দাঁড়িয়ে! “এমনি করে ভয় দেখাতে হয়?” কোন রকমে হাতের ভেজা কাপড় দাওয়াতে রেখে, ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।
“কী করে জানাবো? একটা সেমিনারে এসেছি। সেটা শেষ পর্যন্ত হবে কিনা, ঠিক ছিল না। বলার পর, যদি না আসতে পারি?”
ছেলেকে পাওয়ার আনন্দে সাবিত্রীর গুটিয়ে থাকা ডানা খুলে যায়। প্রায় উড়ে উড়ে কাজ করতে থাকে। ঘরে তো তেমন কিছু মজুত থাকে না, কী দিয়ে যে ছেলেকে খাওয়াবে, বুঝতে পারে না। কোন রকমে ডিমভাজা, মুড়ি, শশা, দুধ এইসব সাজিয়ে দেন।
হাতমুখ ধুয়ে খেতে খেতে দুজনের অনেক কথা।
“জানিস, ইষ্টিকুটুমের ডাক শুনে তখনই মনে হয়েছে, কেউ আসবে। ওরা ঠিক বুঝতে পারে।”
“কী যে আজগুবি কথা বল!”
“তোরা এখনকার ছেলে, এসব বিশ্বাস করবি না। কিন্তু সব সত্যি। পিঁপড়ে ভূমিকম্প বলে দেয়, ব্যাঙ বলে, বৃষ্টি হবে কিনা, শালিক বলে দিন ভাল কিনা। আরও কত কী আছে!”
স্বপ্ননীল হাসে, “হ্যাঁ, হাঁচি কাশি টিকটিকি সব আছে। আমি নতুন একটা অ্যালগোরিদম বানিয়েছি, যেটা থেকেও অনেক কিছু আগাম বলে দেওয়া যাবে, যেমন কোন কারখানার কোন বিশেষ মেশিন খারাপ হবে কিনা? কোন মানুষের বিশেষ কোন অসুস্থতা আসছে কিনা?”
“সে আবার হয় নাকি? তুই বিজ্ঞান ছেড়ে হাত গুণতে শুরু করলি? তোর যন্ত্র বলে দেবে, আমার অসুখ হবে কি না?”
“যন্ত্র নয়, অঙ্ক। পরিসংখ্যানের নানা মাপের অঙ্ক বলে দিতে পারে। তবে স্যাম্পেলটা বড় করে জানতে হবে।”
সাবিত্রী বড় বড় চোখে ছেলের বিদ্যা বোঝার চেষ্টা করে, “স্যাম্পেল কী?”
“যেকোন বিষয়ের অন্ততঃ পঞ্চাশ থেকে ষাট লক্ষ তথ্য কম্পিউটারে ভরা থাকবে। সে মানুষ বা কারখানা যা কিছু হতে পারে, সেটাই স্যাম্পেল। সেই তথ্যগুলোকে যাচাই করে অঙ্কের ফর্মুলা বলে দেবে, আমার সামনে কোন বিপদ আছে কিনা? এগুলো প্রবাবিলিটির অঙ্ক, আর কিছুই না।”
সাবিত্রী কিছু বোঝে না। তবে এটুকু জেনে যায় যে, স্বপ্ননীল কোন গভীর অঙ্কের ভেতর ডুবে গেছে। স্বপ্ননীল বলে চলে, “জানো, এবারের সেমিনারটা এই নিয়েই ছিল। সকলে তাদের শহরে আমার তৈরী মডেল পরীক্ষা করতে চেয়েছে।”
“ভাল তো! দেশে দেশে তোর কাজ ছড়িয়ে পড়ুক।”
“আমি নিজেও চাই পরীক্ষা করতে।”
“সে তো করছিস।”
“আমার কাজের জায়গায় করি, সেটা আমার প্রজেক্ট ওয়ার্ক। আমি এখানে করব।”
“এখানে মানে?”
“এই বাড়িতে, তোমার সঙ্গে।”
“আমার সঙ্গে?”
“বলব, সব বলব। সে জন্যেই তো আসা। তার আগে, একটু বরুণদার কাছে যাবো। ”
“বরুণ? সে কী করবে?”
“ও তো ইলেকট্রিশায়ান, ওকে আমার দরকার।”
এই পাড়াতেই দুতিন ঘরের পর বরুণদের বাড়ি। বরুণ বিয়ে করেনি। ভাইএর সংসারেই থাকে। সাবিত্রী বরুণের কথা শুনে বলে, “ছেলেটা বিয়ে করল না। এখন নিজের বাড়িতেই অতিথির মতো থাকতে হয়। অরুণের বউ-এর দাপটে বেচারা সব দিন খেতেও ঠিকঠিক পায় না। আমার কাছে এলে, চিঁড়ে মুড়ি যখন যা থাকে খাইয়ে দিই।”
নিজের দেশে ফিরলে সকলেরই ভাল লাগে। স্বপ্ননীল যে এসেছে, এতক্ষণে পাড়ায় খবর হয়ে গেছে। ওর খোঁজ নিতে অনেকেই চলে এসেছে। উঠোনে লালু কুকুর পেট উল্টে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে, কয়েকটা শালিক পালক ফুলিয়ে খুব গম্ভীর ভাবে কিছু আলোচনা করছে। ধলা বেড়ালটা ঘুমিয়েই রয়েছে। নারানদা, আশু, বিজলি মাসি অনেকেই দাওয়ার ধারে এসে বসেছে।
সবিত্রী খুব খুশি! আশুকে ডেকে বাজারের ব্যাগ আর টাকা ধরিয়ে দেয়। “তোদের বন্ধু এসেছে, কী খাওয়াবি দেখ। আর হ্যাঁ, সবাই দুপুরে এখানেই খাবি কেমন? বিজলি, তুই চলে আসিস, এত জনের রান্না আমার একার দ্বারা হবে না।”
স্বপ্ননীলের ভাল লাগে। এক মাত্র দেশের ধুলোর মধ্যেই লুকোনো থাকে এই আন্তরিকতা। এমন অকপট উষ্ণতা বিদেশে পাওয়া যায় না। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে, স্বপ্ননীল বরুণদের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। একটা ফিঙে সজনে ডাল থেকে লাফিয়ে উঠে একটা পোকা ধরে।
বাঁশের কঞ্চির দরজা ঠেলে উঠোনে ঢোকার মুখেই, ঘরের ভেতর থেকে নারী কন্ঠের চিৎকার ভেসে আসে। অরুণের স্ত্রী মনে হচ্ছে। স্বপ্ননীল দাঁড়িয়ে যায়। এভাবে কারও কথা শোনা অনুচিত, কিন্তু বরুণের সাথে দেখা না করে ফিরে যেতে চায় না। ওকে খুব দরকার।
“আপনার কোন কান্ডজ্ঞান আছে? বসার ঘরে বসে বিড়ির ছাই ছড়িয়েছেন? আমাকে না হয় পছন্দ হয়না, বাচ্চাগুলোর কথা তো ভাববেন। আর সোফার ওপর নোংরা জামা গেঞ্জি ডাঁই করে রাখা। বাড়িতে শুভ অশুভ বলে তো কিছু মেনে চলতে হয়। বাসি পোশাক রাখার আলাদা জায়গা করা আছে, আপনি জানেন না?”
আরও অনেক শব্দ ভেসে আসে। স্বপ্ননীল গেট থেকে পিছিয়ে যায়, ওর এ সব কিছুর সাক্ষী থাকার কোন ইচ্ছে নেই। ফিরে যাবে, তখনই গেট খুলে, এক মুখ বিরক্তি ঠেসে বরুণকে বেরিয়ে আসতে দেখে। একভাবে নিজের মনে গজগজ করছে।
স্বপ্ননীলকে দেখে নিজেই এগিয়ে আসে, “গুচ্ছ গুচ্ছ স্বার্থপর মানুষে, পৃথিবী ভরে গেছে। সব শালা নেমক হারাম।” হাতের বিড়িতে তখনও আগুন জ্বলছে।
স্বপ্ননীল অপ্রস্তুত। এতদিন পর দেখা হওয়ার সময়, যদি এইসব কথা হয়, তাহলে কারও ভাল লাগে?
কী উত্তর করবে বুঝতে পারে না। ওদের পারিবারিক সমস্যাতে নাক গলানো ঠিক হবে না। স্বপ্ননীলকে চুপ করে থাকতে দেখে, বরুণ নিজেই বলে চলে, “এরা নিজেদের মানুষ বলে পরিচয় দেয়? স্কুল হাসপাতাল কোন কিছুই বাদ দিচ্ছে না! সব জায়গাতেই বোমা ফেলছে! তুই ভাব একবার! এটাই কি সভ্যতা!”
স্বপ্ননীলের তালগোল পাকিয়ে যায়, কার সম্পর্কে এ সব বলছে? বরুণ নিজেই জবাব দেয়, “টিভিতে কাগজে মোবাইলে শুধু ইউক্রেন রাশিয়া প্যালেস্টাইন ইজরায়েল! ঘেন্না ধরে গেল।”
এত সব বলার পর, বরুণ একটু দম নেয়, “সকালে কে যেন বলল, তুই এসেছিস। বল, কেমন আছিস?”
স্বপ্ননীল একটু দম নিয়ে বলে, “তুই খুব ভাল রে! বরুণদা।”
বরুণ একগাল হেসে নেয়, “কেন রে? তুই ভাল না? কত নাম ডাক তোর! আমি জানি। আমাদের কাগজেও তোর কথা লিখেছে, বাঙালি তথ্য-বিজ্ঞানী।”
স্বপ্ননীল, বরুণকে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে আসে, আর নিজের পরিকল্পনার কথা ওকে বুঝিয়ে বলে।
পুরো বাড়িটা বিশেষ ধরনের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে মুড়ে ফেলতে হবে। এই ক্যামেরাগুলো অন্যান্য বাজারচলতি ক্যামেরার মতো নয়, এর ফার্মওয়ার-এ স্বপ্ননীলের সৃষ্ট অ্যালগোরিদম যোগ করা আছে। এর সাহায্যে চলমান ছবি ও শব্দকে মুহূর্তের মধ্যে নানা প্রকার কার্যকরী তথ্যে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারে। সেই সব তথ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে চলে যায় সার্ভারের মগজে, যেখানে আরও তথ্য সমুদ্র মন্থন হতে থাকে। সেই মন্থনের ফলে তৈরী হয় অভূতপূর্ব পূর্বাভাস। মানুষকে চমকিত করে, সাবধান করে।
গ্রামের সাধারণ ‘কারেন্ট’ মিস্ত্রি বরুণ। স্বপ্ননীলের এই সব শুনে কতক বোঝে, কতক ঘোরের মধ্যে চলে যায়, যেন কোন কল্পবিজ্ঞানের গল্প পড়ছে!
মুগ্ধ শ্রোতা পেয়ে স্বপ্ননীল আরও বলে, “আমাদের শরীর যেমন সব তথ্য মগজে পাঠিয়ে, সিদ্ধান্ত নেয়, এও তেমনি। আবার শরীরে কিছু সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়ার প্রয়োজন হয়, সেগুলো মগজ অবধি না গিয়ে সুষুম্নাকান্ডেই নিষ্পত্তি হয়, তেমনি আমার অ্যালগোরিদম ক্যামেরা স্তরেই বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।”
“পূর্বাভাস বলতে কী?”
“যেমন আবহাওয়া অফিস বলতে পারে কবে বৃষ্টি হবে, কিম্বা কোন শেয়ার মার্কেট পন্ডিত বলে দিতে পারে কোন স্টকের দাম বাড়ার সম্ভাবনা বেশি, তেমনি আমার এই অ্যালগোরিদম বলতে পারে, কোন মানুষের কবে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে, বা কিডনি খারাপ হতে পারে, কিম্বা কোন কারখানার যন্ত্র কখন বিগড়াতে পারে।”
“কী ভাবে বলবে?”
“অঙ্ক কষে। অনেক অনেক তথ্যকে পিষে ভেতরের রস বের করে আনে।”
অনেকদিন পর বরুণকে কেউ এমন গুরুত্ব দিয়েছে। খুব যত্ন করে ক্যামেরার ওয়ারিং করেছে, রাউটার লাগিয়েছে।সে সব ক্যামেরা ল্যাপটপের সাহায্যে সার্ভারের সাথে সংযোগ করেছে স্বপ্ননীল। বরুণ মুগ্ধ চোখে ওর কাজ দেখছে। বরুণের মুগ্ধতা লক্ষ্য করে স্বপ্ননীল নিজের ল্যাপটপে ছুটে চলা তথ্য মন্থনের স্ক্রিন দেখিয়ে বলে, “এটাকে বলে কম্পিউটার ভিশন। এতদিন খুব ভারী ভারী অ্যালগোরিদম ব্যবহৃত হতো। আমার তৈরী অ্যালগো অনেকটা লামা-র মতো, লো অটো মেশিন লার্নিং। ভীষণ শক্তিশালী। এটাই বিশ্ব ডাটা সায়েন্স ফোরামে প্রসংশিত হয়েছে। হয়তো কোন আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেতে পারি।”
বরুণ লামা বলতে তিব্বতী সন্ন্যাসী বা দলাই লামা জানে, উটের মতো এক ধরণের প্রাণীও ছবিতে দেখেছে, কম্পিউটারে সে লামা-র কী সম্পর্ক? কিছু বোঝে না। শুধু হাঁ আরেকটু বড় হয়ে যায়।
যে কোন কাজকে, যখন বড় কোন উদ্দেশ্যের সাথে জুড়ে দেওয়া যায়, তখন সেই কাজ, যত সামান্য হোক না কেন, তার তুচ্ছতার সীমারেখা পার করে, মহত্বর আসনে উন্নীত হয়। বরুণ আজ শুধু মিস্ত্রি নয়, ও নিজেকে বিশ্ববন্দিত অ্যালগোরিদমের অংশ হিসেবেই মনে করছে।
খুটিনাটি সব কিছু সাজিয়ে, রক্ষণাবেক্ষণের নিয়ম কানুন বরুণকে বুঝিয়ে স্বপ্ননীল কয়েকদিন পরই বিদায় নেয়। এবারে সাবিত্রীর জন্য, ও অনেক বেশি নিশ্চিন্ত। ওর এই অত্যাধুনিক কৃত্রিম মেধা সম্পন্ন যান্ত্রিক ব্যবস্থা মায়ের যে কোন বিপদের পূর্বাভাস জানাতে সক্ষম হবে। স্বপ্ননীল আশা করে, মায়ের সুবিধা অসুবিধার কথা, আগে থেকে বুঝে ডাক্তার বদ্যি করতে পারবে।
নিজের জায়গায় ফিরে, তুমুল উৎসাহ আর আবেগ নিয়ে দেশ থেকে আসা তথ্যগুলোর ওপর পরীক্ষা করতে থাকে। এমনই একদিন বিকেলের দিকে, মায়ের ঘরের দরজার ক্যামেরা জানান দেয়, সেখানে কোন মানুষকে দেখা গেছে। অথচ ঘড়ির নিয়মে, দেশে এখনও রাত কাটেনি, সাবিত্রী আরেকটু পর বিছানা ছাড়বে।
তড়িঘড়ি বরুণকে ফোন করে। সম্ভবত সেও গভীর ঘুমে আছে। ফোন ধরতে সময় নিচ্ছে। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। ফোন বেজে বেজে থেমে যায়।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই বরুণ ফোন করে, “আমায় খুঁজছিলি?”
“হ্যাঁ, মানে চট করে আমার বাড়িতে যাবি?”
ভোর রাতে বরুণ কে দেখে সাবিত্রী অবাক, “কী হয়েছে? কোন খবর আছে?”
“না এমনিই।”
সাবিত্রীর ঘর সরেজমিনে দেখে, ফেরত চলে আসে বরুণ, স্বপ্ননীলকে বুঝিয়ে বলে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
বরুণের আশ্বাস শুনে, স্বপ্ননীল কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারে না। দেশ থেকে আসা তথ্য ভান্ডারে গভীরভাবে ডুব দেয়। ওকে খুঁজে পেতেই হবে, কেউ নেই অথচ ওর সিস্টেম বলছে মানুষের গতিবিধি হয়েছে। এ কীসের পূর্বাভাস? উত্তর না পেয়ে, মা-কেই ফোন করে স্বপ্ননীল। সব শুনে সাবিত্রী অবাক হয়ে যায়, “এই জন্য তুই এত উতলা হয়েছিস? অত ভোরে বরুণকে আসতে দেখে, তখনই মনে হয়েছে, নিশ্চয়ই তুই কিছু বলেছিস।”
“মা, বুঝতে পারছো না, আমার এই অ্যালগোরিদম মিথ্যা নয়, পুরোটাই অঙ্ক। এখানে কোন পাখি বা ব্যাঙের ডাকের ওপর পূর্বাভাস হয় না। আমার সিস্টেম বলছে, কেউ ঘরে ঢুকেছে।”
“তুই চিন্তা করিস না। ঘরে প্রথম-আলো আসা-র অর্থ, স্বয়ং তিনি ঘরে এলেন।”
“তিনি? সে আবার কে?”
“তিনিই পরম, তাঁকে দেবতা, সূর্য, ব্রহ্ম, শক্তি, ঈশ্বর যা খুশি নামে ডাকতে পারিস।”
“কী যে বল! আমি বলছি অঙ্কের কথা।”
“এটাই তো চিরন্তন সত্য। তোর অঙ্ক মিথ্যে বলেনি। হয়তো আমার পরম আমাকে নিতে এসেছে।”
“বড্ড বাজে কথা বল।” খানিক অভিমান করে ফোন রেখে দেয় স্বপ্ননীল। এত দূর থেকে এমন কথা শুনলে কষ্ট হয়, মা কি সেটা বোঝে না?
সেদিন মায়ের কথায় তৃপ্ত হয়নি স্বপ্ননীল। রাতারাতি দেশে ফেরার প্লেন-এ চড়ে। ওকে নিজে দেখতে হবে, তথ্যে কোন ভুল আছে কিনা? প্লেন থেকে নেমে ফোন অন করতেই একরাশ মিসড কল ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার মধ্যে বরুণের নাম বহুবার। খুব ভয়ে ভয়ে বরুণকে কল-ব্যাক করে, “এতবার ফোন করছিলি কেন?”
“তুই কোথায়?”
“এই তো দেশে ফিরেছি। এবার ট্যাক্সি ধরব। কী হয়েছে?”
“তুই আয়, সাবধানে আয়।”
আর কিছু না বলে, ফোন রেখে দেয় বরুণ।
প্রায় ছুটতে ছুটতে গ্রামে এসে দেখে বাড়ির সামনে লোকজনের ভীড়। গাড়ির শব্দ পেয়ে বরুণ এগিয়ে এসে স্বপ্ননীলকে ধরে ঘরে নিয়ে যায়।
আজ আম গাছটাও নিশ্চুপ হয়ে আছে। পাখিগুলোও যেন অন্য কাজে ব্যস্ত। লালু ধলা সকলেই দাওয়ার কাছে বসে, অবাক দৃষ্টিতে লোকজনকে দেখছে।
নিজের বিছানায় চিরনিদ্রায় সাবিত্রী। সকালের নিষ্কলুষ আলোর দাগ জানলা দিয়ে এসে, ওর শরীর ছুঁয়ে আছে।
[বিগত সংখ্যাতে এই লেখকের গল্প]
[পরম্পরা ওয়েবজিন, ফেব্রুয়ারি ২৪, সূচিপত্র]
[শেয়ার করতে নিচের আইকন ব্যবহার করুন]
বা: ব্রেশ,ব্রেশ।
ভালো লাগলেই খুশি
অপূর্ব লেখা! সৌরভ অভিনন্দন, সকালে গল্প টা পড়ে খুব ভালো লাগলো! সুন্দর করে বিজ্ঞান, দর্শন মিলিয়ে দিয়েছ!
অনেক ধন্যবাদ স্যার। আপনার লেখাটিও বেশ লেগেছে।
খুব ভালো লেখা,মনটা টেনে নিয়ে গেল।
আরও লেখা চাই
অনেক ধন্যবাদ স্যার। আপনি পড়ছেন জেনেই সুখ।
খুউব ভালো লাগলো…..
Excellent!!
ধন্যবাদ ভাই। পড়তে থেকো…
খুব সুন্দর লিখেছিস।
অনেক ধন্যবাদ। খুব খুশি হলাম।
বর্ণনার সুক্ষতায় বিভূতিভূষণকে মনে করিয়ে দিলো। প্রযুক্তি বিজ্ঞান ও লোকশ্রুতির এমন যুদ্ধহীন অজাতশত্রু পারস্পরিক আশ্রয়কাহিনী সৌরভের কলমের নরম মুন্সীয়ানায় আকর্ষণীয় হয়ে উঠলো।
এমন লেখা, যা মন ভালো করে দেয় ইদানিং বড়ো বিরল।
তুমি পড়েছ জেনেই সুখ। ভাল থেকো দাদা।
অসাধারণ এক কল্পবাস্তবিক জগতে টেনে নিয়ে গেলে। টানটান শিহরণে প্রতিটি লাইন পড়তেই হলো। সুক্ষ্ম তুলির টানে আঁকা ছবি, লেখার আয়তন বাড়ালেও বাহুল্য মনে হয়নি তেমন। সাবলীলভাবে এগিয়ে চলেছে গল্পরেখা.. শেষের মোচড়ে থেমে যাওয়াও এক কুশলী তুলির টান। অসংখ্য শুভেচ্ছা দিলাম।
তুমি পড়েছ জেনেই সুখ।
খুউব ভালো লাগলো…..
অনেক ধন্যবাদ
খুউব ভালো লাগলো
অপূর্ব।
অনেক ধন্যবাদ