প্রথম পর্ব

নবদ্বীপ৷ নদীয়া জেলার এই শহরটি যে ইতিহাস প্রসিদ্ধ তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ এই শহর এমন এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শহর যাকে এক সময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বা বাংলার অক্সফোর্ড বলা হত৷ চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান এই শহর সেনরাজাদের রাজধানী ছিল৷ বখতিয়ার খিলজি নবদ্বীপ জয় করার পরই বলা যায় বঙ্গে মুসলিম সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। এই শহরেই ছিলেন বাসুদেব সার্বভৌম , রঘুনাথ শিরোমণি বুনো রামনাথ বা তারও অনেক আগে জীবঠাকুরের মত সেই সব পন্ডিতরা। যাঁদের সময় নবদ্বীপ সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল৷
নব নব দ্বীপপুঞ্জের একটি ‘নবীন দ্বীপং’ নবদ্বীপকে নরহরি চক্রবর্তী নবদ্বীপকে নয়টি দ্বীপের সমাহার বলে উল্লেখ করেছেন। নামকরণ নিয়ে অনেক মতামত থাকলেও এশহর যে নবজাগরণের শহর তা বলার অপেক্ষা রাখে না ৷ এ শহর সেন রাজাদের সময় ধর্মীয় রাজধানীর রূপ পেয়েছিল ৷ কিন্তু ১২০২ এ বখতিয়ার খিলজির আক্রমনের পর এ শহর তার সমৃদ্ধি হারায় ৷ বহু পন্ডিত শহর ছেড়ে ছেড়ে চলে যান৷ কিন্তু চৈতন্যদেবের জন্মের পর চৈতন্য সমকাল ও তারপরে নবদ্বীপ আবার সংস্কৃত চর্চা ও বিদ্যালাভের পীঠস্থান হয়ে ওঠে আবার জৌলুস ফিরে আসে অনেকটাই।


এই শহরেই আছেন পোড়োমা এবং বুড়ো শিব। আছেন আরো নানা দেবদেবী।
এই শহরের যোগনাথতলায় ১৭৫৭ সালে তৎকালীন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর কাঁঠালিয়া থেকে এসে বসবাস শুরু করেন পূর্ববঙ্গের ঢাকার মিতরা গ্রামের রাঘব ও অর্দ্ধকালীর বংশের মানুষ শিবনাথ ভট্টাচার্য।
যে বংশের মানুষেরা বিশ্বাস করেন তাঁদের মধ্যে সূক্ষ্মভাবে সঞ্চারিত আছে মা দুর্গা স্বরূপিণী মা অর্দ্ধকালীর রক্তধারা। এই বাড়িতে পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয় শিবনাথ চতুষ্পাঠী।
শিবনাথ ও বামাসুন্দরীর চার কন্যা ও চার পুত্র। কেদারনাথ , উপেন্দ্রনাথ , যোগেন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ।
শিবনাথেফ তৃতীয় পুত্র যোগেন্দ্রনাথ ও বিন্দুবাসিনীর ছিল এক পুত্র ও দুই কন্যা। পুত্র সোমনাথ ও কন্যা ভারতী ও চিন্ময়ী। যোগেন্দ্রনাথ অতি পন্ডিত ছিলেন। অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত যোগেন্দ্রনাথ যোগনাথতলার বাড়িতে টোলে শিক্ষা দিতেন ও অনেকগুলি সংস্কৃতের পুস্তকও রচনা করেন। তাঁর অগ্রজ কেদারনাথের কাছে পড়াশোনা করে যোগেন্দ্রনাথের পুত্র সোমনাথ প্রয়োগরত্নমালা ব্যাকরণের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও পরবর্তীকালে ১৯৪৫ এ কাব্যের উপাধিও লাভ করেন।
লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে শিবনাথের চার পুত্রের নামই শিবের নাম অনুসারী এবং যোগেন্দ্রনাথও পুত্রের নাম রেখেছিলেন সোমনাথ। ভারতী ও চিন্ময়ী নামদুটিও শিবশক্তির নামানুসারেই।
যোগেন্দ্রনাথের মায়ের নাম বামাসুন্দরী।
ভাতৃবধুদের নামও ছিল কৈলাশবাসিনী , হেমন্তকামিনী ও সুপ্রভা। নিজ স্ত্রীর নাম বিন্দুবাসিনী।
অতি রক্ষণশীল এই পরিবারে ধুতি পাঞ্জাবী ও শাড়ীই ছিল পরিধানেরবস্ত্র। চামড়ার জুতো নয় কাঠের পাদুকা অথবা খালি পায়ে চলতে হত।
অর্দ্ধকালীর বংশের এই পরিবারে লালরঙের দুর্গা পুজাই রীতি। যোগনাথ তলার বিরাট বাড়িটি তাই পন্ডিতবাড়ি বা লালদুর্গা বাড়ি নামেই পরিচিত। যৌথ পরিবারে থাকা মানুষ যোগেন্দ্রনাথ বিষয় সম্পত্তি বিষয়ে খুবই উদাসীন ছিলেন। প্রচুর আঘাত ও শোক পেয়েও যোগেন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন বিপুল শোক ও আঘাত মহতের মনকে দীর্ঘসময় ধরে ব্যাকুল রাখতে পারে না “আগম প্রধানানি সুলভ পর্য্যবস্থানি মহাপুরুষ হৃদয়ানি ভবন্তি “। তাঁর স্বভাবই ছিল মনকে দ্রুত স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনা এবং অল্পে সন্তুষ্ট থেকে অন্তরের সম্পদকে সমৃদ্ধ করা।
জেষ্ঠ্য পুত্র ও কন্যাকে বিবাহ দেবার পর তিনি অতি আদরের একাদশ বর্ষের কন্যা চিন্ময়ীর বিয়ে দেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। কারন তিনি তখন ভিতরে ভিতরে বুঝতে পারছিলেন তাঁর দিনশেষে ঘরে ফেরার সংকেত এসে গেছে।

( ক্রমশঃ)

[লেখকের অন্য রচনা]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, আগস্ট ২৪, সূচিপত্র]