পর্বঃ ৩

চোখ খুললেন নিবেদিতা। একি! চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল গালে! না না এ তাকে মানায় না! মাঝি টানছে নৌকা। নৌকা এগোচ্ছে আস্তে। স্রোতের বিপরীত। ভাঁটার টান। দ্রুত জল মুছলেন। এই ভারতবর্ষে এসেছেন যাঁর ডাকে, যিনি ভয়ঙ্কর এক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন এতদূর! তিনি গুরু, তিনি স্বামী, তিনি পিতা! প্রতি পদক্ষেপে ছিলেন তিনি! আজ নেই! কেউ ‘নেই’ হয়ে যেতে পারে না কর্মের মধ্যে থেকে যায় ছায়া! ছায়া দীর্ঘতর হতে হতে…!
আজ আকাশ ঘোলাটে। সকালে সূর্য উঠার সময় যদিও একটু পরিষ্কার ছিল আকাশ। এখন কেমন গুমরে আছে। ভ্যাপসা হয়ে উঠছে। চোখও ঝাপসা। ব্রহ্মচারী তরুণ তাকাল নিবেদিতার দিকে। নিবেদিতা চোখ সরালেন। কান্না তো প্রদর্শনের বিষয় নয়। দুঃখ প্রকাশিত হলে প্রসন্নতা জাগ্রত হয়। দুঃখ গ্রহণের, প্রকাশের নয়। জীবনকে সহজ করে নেবার পাঠ নিয়েছেন স্বামীজির কাছে। পিছনে তাকালেন। বাগবাজার ঘাট। প্রথম যখন এসেছিলেন, বোঝেননি যে,এই বাগবাজারই হবে তাঁর যাপনভূমি।

টিকটক টিককরর টিক টিক। গায়ে উঠে পড়বে নাকি! একদম কাছেই মনে হচ্ছে টিকটিকিগুলো। ঘুরে বেড়াচ্ছে দেওয়াল থেকে দেওয়াল। উফ্? ‘হোঁশিয়ায়ায়ার’ চিৎকার করে লাঠি ঠুকছে চৌকিদার। চৌকিদার এ-বাড়ির সামনেই কি এমন চিৎকার করছে? মাথায় পাগড়ি, গালজুড়ে চকচকে ঘোড়ানো গোঁফ, গায়ে খাকি শার্ট ধুতির উপর বেল্টে গোঁজা। কুচকুচে কালো, কুতকুতে চোখ। সর্বদা নেশাতুর লাল চোখে কর্তৃত্বের বাহাদুরি। বাহাদুরিই সার। চোর কিন্তু সিঁদকেটে ঠিক চুরি চালিয়েই যাচ্ছে। আর ছিঁচকে চোরগুলো ঘটি-বাটি হামেশাই নিয়ে পালাচ্ছে। ‘চোরেদের অ্যালার্ম বেল এই চিৎকার’ — যোগানন্দ মজা করে। আসলে চিৎকার করে জানিয়ে দেয় যে সে এদিকে আছে ওদিকে যাতে চোর চুরি করতে পারে! মৃদু হেসে ওঠে নিবেদিতা। গালে টোল পড়ে।

ডানদিকটা ব্যথা হয়ে গেছে। শক্ত সিমেন্টের মেঝে। একটা মাদুর তার উপর একটা কম্বল। এটাই শোবার বিছানা। বাঁ-পাশ ফিরলেন। আবার টিকটিকি ডেকে উঠল। একদম মাথার কাছে। চিকচিক চিকচিকচিক। ইঁদুর বা ছুঁচোর কথোপকথন শুনছেন নিবেদিতা। কান সজাগ। কালো অন্ধকার ঘরে মরা আলো ছড়িয়ে আছে। আবছা সবকিছু। সোজা হয়ে শুলেন এবার। মাথার উপরে সার সার কালো কড়িকাঠ যেন নেমে আসছে। বেশ বড় ঘরের দু’পাশে দুটো কেরোসিনের কুপি জ্বলছে। কালো ঢিপি ঢিপি মতো আপাদমস্তক কম্বলমুড়ি দিয়ে সবাই ঘুমোচ্ছে মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে সার সার। ঘরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত মাটিতে বিছানা পাতা। প্রত্যেকটি বিছানার মাথার উপর একটা করে টিনের বাক্স। হালকা আলোয় একমাত্র বাক্সগুলো অল্প চকচক করছে। নিবেদিতার চোখে ঘুম নেই। সারা গায়ে ব্যথা। নরম বিছানায় শুয়েছেন এতদিন। একটি বালিশ শুধু তাঁর জন্যই দেওয়া হয়েছে। বিদেশিনী বলেই। নিবেদিতার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। দুটি কম্বল। একটি মাটিতে পাতার জন্য। আরেকটি গায়ে দেবার জন্য। রাত আর কাটে না।

হঠাৎ একটা কম্বলের পুঁটুলি নড়ে উঠল। পুঁটুলি থেকে দু’হাত বেরিয়ে টান-টান হল মাথার দিকে। এবার মাথা বেরিয়ে এল কম্বলের ভেতর থেকে। তারপর হাই তোলা। সঙ্গে সঙ্গে একে একে সবাই উঠে পড়ল। তখনও অন্ধকার। সব মেয়েরা উঠে নিঃশব্দে দেয়ালের দিকে মুখ করে ঘোমটা টেনে বসে গেল জপমালা নিয়ে। কারও কোনও নড়াচড়া নেই। স্থির, নিশ্চুপ। দু’ঘণ্টা এভাবেই চলল। ধীরে ভোর চুঁইয়ে ঢুকল জানালা দিয়ে। নড়াচড়া শুরু হল। দিনের কাজে নেমে গেল মেয়েরা। বিছানা গুটিয়ে ঝাঁট। বালতিতে জল আর কাপড় নিয়ে ঘর মোছা। নিবেদিতা দেখছেন সব। অদ্ভুত কায়দায় একটা কাপড়কে জলে চুবিয়ে, নিংড়ে সেই কাপড়টা দিয়ে বসে বসে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুছে ফেলছে ঘর। বাসনের ঝনঝন শব্দে সকাল এল বোসপাড়া লেনের এই ঘরে। একে একে চান করে এসেছে মেয়েরা কখন, নিবেদিতা খেয়ালই করেননি। মেয়েদের ভেজা লম্বা চুল পাট করে পিঠের উপর ফেলা। ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলের মতো জলবিন্দু সাদা শাড়ি শুষে নিচ্ছে পিঠে। শাড়ি যাচ্ছে ভিজে। বিধবাদের তো মাথা ন্যাড়া। দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। চোখ জ্বালা করছে। নিবেদিতা উঠে রাস্তার ধারের জানালার ধারে এই সময়টা দাঁড়ান। এখন কিছুটা অভ্যাস হলেও কষ্ট হয়, সহ্য করতে পারেন না ধোঁয়ার উগ্রতা। উনুনে আঁচ দেওয়া হয়েছে। জলখাবারের প্রস্তুতি চলছে। কয়েকদিন হল নিবেদিতা এ-বাড়িতে এসেছেন। এটা বোসপাড়া লেন, উত্তর কলকাতায়, স্বামীজির নেওয়া ভাড়াবাড়ি। মা সারদাদেবী যখন কলকাতায় থাকেন তখন এই বাড়িতেই ওঠেন। এই বাড়িতেই প্রথম যেদিন এসেছিলেন মা সারদাকে দেখতে, সেটা ডায়েরি অনুযায়ী ভারতে আসার মাস দু’য়েক পরে, মার্চ মাসের ১৭ তারিখ, ১৮৯৮। তখনও সে মার্গারেট নোবেল। স্বামীজি সংক্ষেপে ডাকেন ‘মার্গট’।

গাড়ি থেকে নামতেই পাড়ার ছেলে-বুড়ো গাড়ি ঘিরে ফেলল। হুলুস্থুলু কাণ্ড। মেমসাহেবরা স্বামীজির সঙ্গে! চোখে মানছে না। ম্লেচ্ছদের সঙ্গে এত মাখামাখি! স্বামীজি ভিড় সরিয়ে এগিয়ে চললেন তিন বিদেশিনীকে নিয়ে। মার্গট, মিসেস ওলি বুল ও মিস ম্যাকলাউড। দরজা ভেজানো ছিল। ঠেলতেই খুলে গেল। এক ঝলক রোদ্দুরের সঙ্গে বিবেকানন্দ প্রবেশ করলেন আধো-অন্ধকার ১০/২ বোসপাড়া লেনে। স্বামী যোগানন্দ শুধু একবার বললেন, ‘জুতো এখানে ছেড়ে দোতলায় চলুন, এই এই সিঁড়ি দিয়ে আসুন আসুন।’ যোগানন্দকে অনুসরণ করলেন তিনজন। সার সার জালা-কলসিতে ভর্তি আছে জল। গঙ্গার জল। মেমসাহেবরা চলে যাবার পরেই সব ধুয়ে ফেলতে হবে। সৌদামিনী গোবর-ছড়ারও ব্যবস্থা করে রেখেছে। চলে গেলেই সব নিকোতে হবে। ছোঁয়াছানি’র ব্যাপার আছে। বিধবা মোক্ষদা চাকর বিশেকে দিয়ে লোক ডাকিয়ে যাতায়াতের আশেপাশের সব আসবাব সরিয়ে ফেলেছে। কোথাও কোনও আসবাব নেই। ফাঁকা প্যাসেজ। স্বামীজি চারিদিক দেখে মনে মনে হাসলেন। সে হাসি আলগা ছড়াল গালে। হ্যান্ডব্যাগ-ছাতা-টুপি নিয়ে কী করবেন ভাবছেন তিনজন। এদিক ওদিক তাকাতেই নজরে এল দরজার আড়ালে সিঁড়ির আড়ালে মহিলাদের কৌতূহলী বিস্মিত চোখ। চাপা হাসি আর কানাকানি। খালি পায়ে সংকোচে উঠে গেলেন তিনজন দোতলায়। উঠেই খোলা দরজা। আট-দশজন মহিলা মাটিতে বসে। তাদের মাঝে চাটাইয়ের উপর বসে আছেন সারদাদেবী। সামনে ছড়ানো পা। সাদা শাড়ি। লাল পাড়। লাল পাড়ের নীচ দিয়ে ছোট্ট দু’টি ফরসা পা। ঘোমটায় ঢাকা মাথা। এক ঢাল কালো চু্‌ল, সাদা কাপড়ের স্বচ্ছতা ছাপিয়ে নেমে গেছে পিঠ বরাবর। মুখে সরল স্নিগ্ধ হাসি। চোখে শান্ত ডাক, এসো কাছে এসো। এই ভাষার কোনও মাধ্যম লাগে না। হৃদয় থেকে হৃদয়ে বাহিত হয়। মার্গটরা আস্তে আস্তে বসলেন মাদুরে। বসে থাকা মেয়েরা অনেকেই উঠে গেল। দু’-একজন মায়ের পাশে গিয়ে ঘেঁসে দাঁড়াল। বসল দু’-একজন। নত হয়ে প্রণাম করলেন বিদেশিনীরা। সারদাদেবী হাতজোড় করে নমষ্কার করলেন। সবাই তাকিয়ে আছে তিনজনের দিকে। গোরাদের দেখা যায় কখনও সখনও রাস্তায়, কিন্তু অন্দরমহলে তিন বিদেশিনীকে দেখে মহিলারা বাক্যহারা। তার ওপর ছোঁয়াছানির ব্যাপার তো আছে। ওরা ম্লেচ্ছ। বেজাত। অস্বস্তি হচ্ছে মার্গটদের। চুপচাপ সবাই। তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। একটি মেয়ে তিনটি থালায় ফল-মিষ্টি রাখল ওদের সামনে। চা আনা হল। কাপে। সারদাদেবীর জন্যও দেওয়া হল। চারিদিকে একটা চাপা নিষেধ। মা কী করবেন? খাবেন? সবাইকে অবাক করে সারদাদেবী বিদেশিনীদের ইশারায় খেতে বলে নিজেও খাওয়া শুরু করলেন। একসঙ্গে খাওয়া! আশেপাশে ঘোমটার আড়ালে থাকা চোখগুলোতে তখন ঘোর। মা এদের সঙ্গে একাসনে বসে…? ছি ছি শব্দটাও কারও কারও ঠোঁটের ডগায় এসে গিয়েছিল প্রায়। ততক্ষণে স্থানীয় ঘোষবাড়ির মেয়ে কাদম্বিনী চলে এসেছে। একটু-আধটু ইংরাজি জানে। ওকে দিয়েই সারদাদেবী আর মার্গটের আলাপ দিব্যি জমে উঠল। সারদাদেবীর সরল কৌতূহল – তোমরা পুজো-আচ্চা কেমন করে করো? ইত্যাদি ইত্যাদি। সারদাদেবীর হাসিতে যে স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ আছে তা যেন স্পর্শ করতে পারছিলেন মার্গট। এই বিমল আনন্দ দেখাতে চাইছিলেন স্বামীজিকে। কিন্তু তিনি যে কোথায় চলে গেলেন! নিবেদিতা নিজেই উঠে ডেকে আনবেন বলে ভাবছিলেন। উসখুস করছিলেন। তাঁর যে ভাল লাগছে, এই ভাল লাগাটা দেখাতেও ভাল লাগত যে! কিন্তু আশেপাশে তো নেই। এদিক-ওদিক দেখলেন একবার। সেই সময় চারপাশে ব্যস্ততা শুরু হল। টপাটপ ঘোমটায় ঢাকা পড়ল মুখগুলি। যন্ত্রের মতন সব আড়ষ্ট হয়ে উঠল। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। প্রথমে যোগানন্দ গলা খাকারি দিয়ে ঢুকল। তারপর বিবেকানন্দ ঢুকলেন। হাঁটু গেড়ে উবু হয়ে বসে প্রণাম করলেন বিবেকানন্দ সারদাদেবীকে। তাঁর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন মা। সবাই বিদায় নেবে। এরা তিনজনও। বিবেকানন্দ নিতে এসেছেন। মার্গটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন সারদা মা। নিবেদিতা অপলক। ‘আবার এসো মা’, সারদা মায়ের ঠোঁট থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল ক’টি শব্দ।

মার্গটের মনটা কেমন নির্ভার হয়ে গেল। গঙ্গার জলে রঙের হোলি। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। কোনও রং স্থায়ী হচ্ছে না স্রোতে। ঢেউ গড়ছে। ভাঙছে। গড়ছে। ভাঙছে। মার্গট তাকিয়ে আছে। অপার্থিব। তবু জীবন্ত। নিত্য। চেতনায় ঘা দিচ্ছে। চারপাশে কোনও কলরব নেই। ওলি বুল আর মিস ম্যাকলাউডের কথাবার্তা নেই। মুহূর্তের জন্য বিবেকানন্দও নেই। গোপালের মা ওদের সঙ্গেই বেলুড় যাচ্ছে। তার কোনও ভাষা নেই। মুখে তার অপার্থিব মৃদু হাসি। নিবেদিতার ফর্সা নরম হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে সে হাত বোলাচ্ছে শুধু পরম মমতায়। গোপালের মায়ের হাতের স্পর্শে একটা বার্তা বুকের গভীরে পৌঁছে যাচ্ছে নিবেদিতার — আত্মিক গ্রহণ। স্পর্শের ভাষা খুব স্পষ্ট ও তীব্র। বিবেকানন্দ তৃপ্ত। হিন্দু বিধবা গোপালের মা, রামকৃষ্ণের চরণ-স্পর্শে দীক্ষিত সংস্কারাচ্ছন্ন মহিলা, সে নিবেদিতাকে এমনভাবে গ্রহণ করতে পারায় বিবেকানন্দের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। হিন্দু মহিলাদের অন্দরমহলে ঢুকতে হবে নিবেদিতাকে। শিখতে হবে তাদের আচার, আচরণ, পূজা, সংস্কার, সব, সবকিছুই। তাই এই গ্রহণ করাটা ভীষণ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিবেকানন্দের কাছে। নিবেদিতার সামনে শব্দহীন চারপাশ। নিবেদিতার সামনে চরাচর জুড়ে লালপাড়, সাদা শাড়ি, কালো চুল, আর ওই মৃদু হাসি। একটা ঘোর।

সরল স্বচ্ছ দু’টি চোখ, চোখের সরল ডাক, ‘আবার এসো মা’, আর ছোট্ট ছোট্ট ফরসা আলতা-পরা দু’টি পা – চোখের ওপর লেপটে রয়েছে। বিবেকানন্দ বলে চলেছেন বেলুড় মঠের পরিকল্পনা। কিছুটা কিছুটা শুনছেন নিবেদিতা। গঙ্গার ধারেই একটা ভাঙা বাড়িসমেত জমি কেনা হয়েছে। টাকা পয়সার হিসাব করছে মিস বুল। উনিই কিনে দিয়েছেন পুত্রসম বিবেকানন্দকে। একটা আশ্রম তৈরি হবে। তার নানা পরিকল্পনা। ওলি বুলের পরামর্শমতো সেই ভাঙাবাড়ি সারানো হয়েছে। গঙ্গার ধারেই। একটি ভাঙা ঘাটও ছিল। সেটাও ঠিকঠাক করে নেওয়া হয়েছে। সেই ঘাটের দিকেই চলেছে নৌকা। ওই সারিয়ে তোলা বাড়িতেই এখন মার্গটরা থাকছে। আর বিবেকানন্দ তাঁর সন্ন্যাসীদের নিয়ে থাকছেন আরও কিছুটা দূরে নীলাম্বর মুখার্জ্জীর বাড়িতে। সেখানেই চলে পূজা-ধ্যান সহ মঠের কাজকর্ম। ঘাটে নৌকা ভিড়ল। পুরনো ঘাটের গঠনটা আছে। তার ওপর ইট-সিমেন্টের মেরামতি। ঘাটের দু’প্রান্তে দু’টি বাঁশ বাঁধা। একে একে সবাই সেই বাঁশ ধরে ধরে কাঠের পাটাতনে পা দিয়ে ঘাটের সিঁড়িতে পা দিল। অনেকটা লন্ডনের উইম্বলডন কমনের মতো জায়গাটা মনে হয় মার্গটের। সুন্দর বড় বড় গাছের ছায়া। আম-জাম। লাইন দিয়ে বাবলা গাছের ঘন সবুজ আড়াল। পায়ের তলায় নরম মোলায়েম ঘাস। আর অজস্র লতানো ফুলের দোলায় মৃদু ঠান্ডা গঙ্গার বাতাস। প্রথম যেদিন এসেছিলেন, সেদিন বিবেকানন্দ একটি পিকনিকের মতো আয়োজন করেছিলেন বিদেশিনীদের জন্য। সেইদিন থেকেই মার্গট ভালবেসে ফেলেছেন জায়গাটিকে। এখন অনেক ঝোপ-ঝাড় কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। পায়ে চলার রাস্তা। আরেকটি ঘর করা দরকার অতিথিদের জন্য। সেই আলোচনাই করতে করতে ফাঁকা জমি পেড়িয়ে নতুন রং করা বাড়ির দোরগোড়ায়। বিবেকানন্দ আর যোগানন্দ বিদায় নিলেন। যাবেন কিছুটা দূরে নীলাম্বর মুখার্জ্জীর বাড়িতে অস্থায়ী মঠে। বিবেকানন্দ কোনও কথা বললেন না মার্গটের সঙ্গে। অন্যদের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলেন, মার্গট লক্ষ করেছে তার সঙ্গে যেন দূরত্ব রাখছেন। কেন? বুঝতে পারছেন না। কঠোরতা? কেন? আত্মনিয়ন্ত্রণ? ঠিক বুঝতে পারেন না মার্গট। নিবেদিতা লক্ষ করেছেন এই কলকাতার মাটিতে পা দেওয়ার দিন থেকেই একটা দূরত্ব রেখে চলছেন বিবেকানন্দ। অনেক কথা তাঁকে বলার আছে। ভিড় করে আসছে মাথায়। কিন্তু সময় নেই তাঁর। আর সময় যখন হচ্ছে তখন তিনি অনেক দূরে রাখছেন নিজেকে। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে দিচ্ছেন না, মনে চাপ বাড়ছে নিবেদিতার। বিদ্রোহ তাঁর আইরিশ রক্তে। তবু তিনি সমর্পণে বিলীন থাকার সংকল্পে থাকছেন। পরীক্ষা‍! ঠিক আছে। ঠোঁট কামড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ান নিবেদিতা। গঙ্গার জলজ বাতাস তাঁর ছোট করে ছাঁটা চুল অবিন্যস্ত করে দেয়। জোরে শ্বাস নেন তিনি।

নভেম্বরের প্রথম। দিন ছোট হয়ে গেছে। ঝুপ করে রোদ সরিয়ে আঁধার নামবে বোসপাড়া লেনের এঁদো গলিতে। বেলা তিনটে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া বলরাম ঘোষের বাড়িতেই হয়েছে। হাওড়া থেকে মালপত্র সমেত সোজা চলে এসেছিলেন বাগবাজারের বলরাম ঘোষের বাড়ি। এখানেই কিছুদিন আছেন বিবেকানন্দ তাঁর কয়েকজন সন্ন্যাসীদের নিয়ে। সেই প্রথমদিনের জড়তা আজ আর তেমন নেই। তার উপর স্বামীজি ও তাঁর দলবলের সঙ্গে দীর্ঘদিন হিমালয় ভ্রমণের ফলে এক ধরনের সহজতা এসে গেছে। অনেকটাই বোঝেন এখন। স্বরূপানন্দ ভাল ইংরেজি বলেন। এখন নিবেদিতার মেন্টর বলা যায়। প্রথম দিনের বাংলার সেই লাজুক টিচার থেকে আজ সর্বক্ষণের বন্ধু। যে প্রশ্ন স্বামীজিকে করতে বাধে, সেই কথা স্বরূপানন্দকে অক্লেশে বলা যায়। বাংলাটাও অনেকটা বুঝতে পারেন নিবেদিতা এখন, ওই আকার-ইঙ্গিতের সাহায্য লাগে। থেমে থেমে একটু একটু মামুলি কথা স্বরূপানন্দ তাঁকে শেখাচ্ছেন। বাগবাজারে মায়ের কাছে বেশ কিছুদিন থাকবেন বলেই এসেছেন। আরেকটা ভাড়াবাড়ি খোঁজা হচ্ছে। এই পাড়াতেই পাওয়া গেলে ভাল।

সারদাদেবীর পাশেই বসে আছেন নিবেদিতা। শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিতে শিখেছেন। একবার তাকালেন নিবেদিতা। আজও সেই সারল্যে স্নিগ্ধ তাঁর মুখ প্রথম দিনের মতোই। তাকালেই শান্তি নামে চেতনায়। গোল হয়ে সবাই বসেছে এ-ঘরে। অনেকক্ষণ বসে আছে মেঝেতে নিবেদিতা। অনভ্যাস একধরনের বাধা তৈরি করে মনে ও শরীরে। ক্লান্তি কাটাতে এদিক-ওদিক তাকান। দেওয়ালে নোনা ধরেছে, স্যাঁতাপড়া দাগ। নানা ছবি ঝুলছে। কোথাও হিমালয়ের মাথায় শিবের স্থিরমূর্তি, কোথাও উচ্ছ্বসিত গঙ্গা হারিয়েছে দেওয়ালে। কল্পনা বৈচিত্র্য আনে। সামনেই দরজা। এই দরজার সামনেই সবাই বসেছে। সামনে বসা মেয়েটির পিঠে কালো ভেজা চুল। কালো চুল এত লম্বা! ভেজা চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে সাদা কাপড় ভিজছে। চুলের ডগায় মুক্তোবিন্দু-জলে হালকা ভোরের আলো। নিবেদিতাও সাদা শাড়িতে শরীর ঢেকেছেন। ক’দিনে একটু অভ্যেস হলেও নড়াচড়া করতে অসুবিধে হচ্ছে বেশ। একইভাবে বসে থাকার জন্য আড়ষ্টতা বোধ হচ্ছে শরীর ও মন জুড়ে। কষ্টের বিরক্তি। অধীরতা স্নায়ুতন্ত্রের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে। এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে যেন। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়তে চায়।

সামনের খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দেওয়ালে টাঙানো দু’টি তাকে পাশাপাশি রামকৃষ্ণের ছবি। একই ছবি, তবে দু’টি। ফুলে ফুলে ঢাকা। তার সামনে ছোট তক্তপোশ। তক্তপোশের উপর অজস্র দেবদেবীর মূর্তি। নিবেদিতা সবটা জানেন না। শিবলিঙ্গ চেনেন, শালগ্রামশিলা চেনেন. চেনেন জগদ্ধাত্রী, সারদামায়ের আরাধ্যা জগদ্ধাত্রী আর মা কালী। ঠং ঠং করে ঘণ্টা বাজিয়ে পুজো করছে একটি মেয়ে। আশেপাশে বসা সব মহিলাদের সামনেই দু’টি করে তামার পাত্র। একটি ছোট, একটি বড়। অনেকটা নৌকার মতো দেখতে। বেলুড়-দক্ষিণেশ্বরেও দেখেছেন নিবেদিতা। যেদিন তাঁর নামকরণ হয়. স্বামীজি তাঁকে দিয়ে প্রথম পুজো করান, সেদিনই প্রথম দেখেছিলেন। দেখেছেন ঘণ্টা। প্রদীপ। পঞ্চপ্রদীপ। ধুনুচি। আরও কত কী! সবই তাঁর কাছে নতুন। শিশুর চোখে দেখা। যোগানন্দই বলেছে এই তামার নৌকার মতো ছোট দু’টি পাত্রকে ‘কোষাকুষি’ বলে। সে উচ্চারণ করতে গিয়ে কী বিপত্তি! সবাই পূজার কাজে ব্যস্ত। মাঝে সবাই উবু হয়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছে। নিবেদিতা রপ্ত করতে পারেনি এখনও। হাত জোড় করে প্রণাম করছে। আরতি অঞ্জলি সব শেষ হল। একেকজন উঠে গিয়ে কাজ করে আসছে। কেউ কেউ ধ্যানে বসেছে। কেউ দুলে দুলে মৃদস্বরে ধর্মের বই পড়ছে। অখণ্ড নীরব ব্যস্ততা। নিবেদিতার কোমরে ব্যথা করছে। ব্যথা ছড়াচ্ছে সারা শরীরে।

এ কী ধরনের কাজ তার! তিনি এসেছেন আর্ত মানুষের জন্য কাজ করতে। আর তাঁর ভেতরেই আর্তি ফেটে পড়ছে। যাঁর দিকে তাকিয়ে বা বলা ভাল যাঁর কাছে ভাল-মন্দ সঁপে দিয়ে এই অচেনা জায়গায় আসা, তাঁর কাছ থেকেই কেমন নিরাসক্ত আজ্ঞা ছাড়া কিছুই আসে না। তাঁকে দেখাতে ইচ্ছা করে, দেখো আমাকে ‘মা’ কেমন সুন্দরভাবে মেয়ের মতো গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তিনি কোথায়! তাঁর সময়ই বা কোথায়! আলমোড়ার কথা মনে আসে তাঁর।

প্রকৃতির কোলে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন তিনি। এই তো কয়েক মাস আগের কথা। ভীষণ একা লেগেছিল নিজেকে। যদিও সারা বুল আর মিস ম্যাকলাউড সঙ্গে ছিলেন, তবুও একা। তিনি সবাইকে নিয়ে আছেন বটে কিন্তু কোথায় যেন নিজেকে ব্রাত্য মনে হতে থাকে। কিছুতেই নিবেদিতা সহজ হতে পারছিলেন না। ভেতরে, একদম গভীরে হিমশৈল ভাঙার আওয়াজ। স্বামীজি তাঁকে ত্যাগ করলেন আলমোড়ায় এসে। আলমোড়ায় স্বামীজি তাঁর সন্ন্যাসীদের নিয়ে চলে গেলেন অন্য জায়গায়। আর নিবেদিতা, মিসেস বুল আর মিস ম্যাকলয়েডের জন্য অন্য একটা বাড়ি ভাড়া করা হল। মিসেস বুল ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ছবি আঁকা আর প্রকৃতি দর্শনে। মিস ম্যাকলয়েড সামলান ভ্রমণকারীদের হেঁসেল, তাঁবুতে তাঁবুতে ঘুরে। নিবেদিতার কোনও কাজ নেই। হঠাৎ কেমন ফাঁকা হয়ে গেলেন। একা তিনি ও প্রকৃতি। প্রকৃতিতে আত্মস্থ হবার মাধ্যমটিই যেন হারিয়ে ফেলেছেন। অবলম্বন দরকার ছিল। নেই। অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি অপেক্ষায় অপেক্ষায় দগ্ধ হতে থাকেন। একটা যন্ত্রণা ভেতরে ভেতরে তীব্র হতে থাকে। গুরু তাঁকে ফেলে রেখে গেছেন। ভাবেন নিজে নিজেই, সমর্পণ মানে তাঁর কাছে হল গুরুর নির্দেশিত কাজে প্রশ্নাতীত ঝাঁপ দেওয়া। গুরুকে ভালবেসেই তো এই আত্মবলিদান! কী কাজ? কাজের প্রতি থাকতে হবে উদাসীন! কামনাবর্জিত কর্ম! বুঝতে পারেন না নিবেদিতা এইসব কথা। কর্মযোগ অযৌক্তিক মনে হয়। দ্বন্দ্বদীর্ণ হয় মন। স্বামীজির কাজে সাহায্য করতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। কথা বলেন না তেমন! স্বামীজি যেন দু’হাতে বন্ধনগুলি ছিঁড়ছেন। তিনি মাপা কাজের কথা শুধু বলেন নিবেদিতার সঙ্গে। বাড়তি কথা একটাও বলেন না। নিবেদিতা যত তাঁর কাছে যাবার চেষ্টা করছেন তত একা হয়ে পড়ছেন। শূন্য। শূন্যতার যন্ত্রণাময় গহ্বরে ঢুকে পড়ছেন একা। রিক্ত মনে হয়। চোখ ফেটে জলের ধারা নামে রাতের পর রাত। ভেতরটা ছেঁড়াখোঁড়া হয়ে গেছে আলমোড়া সফরে।

একাই একার সঙ্গে লড়াই করে করে ক্লান্ত নিবেদিতা সারদা মায়ের পাশে বসলেন। কিছুটা শান্তি পান এখানে। আলমোড়া থেকে ফিরেও একা হবার যন্ত্রণা ভোলেন এই বাগবাজারে এসে। বিশেষ করে এই সন্ধ্যাবেলায়। মা বসে আছেন। সন্ধারতি হয়ে গেছে। সবাই মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে রাতের খাবারের তোড়জোড়ে চলে গেছে। হঠাৎ হঠাৎই মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়েন নিবেদিতা। দু’চোখে জল। মা মাথায় হাত রাখেন, ‘তোর কাজে নেমে পড়ার সময় এসেছে, এবার নেমে পড়।’ নিবেদিতা ভেজা চোখে তাকালেন মায়ের দিকে। শুনলেন উল্টোদিকেই কাছেই একটা পুরনো বাড়ি পাওয়া গেছে। ওটাই একটু রং করে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে নিবেদিতার জন্য।

গোপালের মা বেশ শক্তপোক্ত মহিলা। দোহারা চেহারা। কর্মঠ। নিবেদিতার হাত ধরে রাস্তায় নেবেই চিৎকার করে পাড়ার বউদের ডাকতে শুরু করে দিল, ‘ও মোক্ষদা মাসি দেকে যাও গো, ও ইন্দির বৌ এসো এসো।’ দুপুরবেলা। সবাই উঠোনে বা ছাদে চুল শুকোচ্ছে আর পান ঠুসেছে মুখে। কারও কারও দোক্তার নেশাও আছে। চিৎকারে সবাই সদরে উঁকি দেয়। ‘ছ্যা ছ্যা ছ্যা,’ করে ওঠে মোক্ষদা মাসি ঠোঁট ব্যাঁকায়, ‘এ কী করলে গো গোপালের মা, তুমি পুজো-আচ্চা করা বেদবা, মেলেচ্চ’র হাত ধরে ড্যাং ড্যাং করে চললে!’ গোপালের মা কী বলতে যায়, থামিয়ে দিয়ে ঘোষগিন্নি ঘোমটা সরিয়ে পানের পিক ফেলে, ‘এ ফিরিঙ্গি কোত্তেয়ে নেয়ে এলে গ, শুনচিলাম বটে, এ তো চাক্কুস মেম গ, ও ক্ষেন্তি এক ঘড়া গঙ্গাজল ঢাল মা পথে, গঙ্গা নাইতে যেতে হবে ত! কী অনাচ্ছিস্টি রে! ম্যাগো!!’ ছোটরা ভিড় করে পেছন পেছন ছোটে — ‘মেম মেম মেম’ বলে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করছে। নিবেদিতার ভাল লাগছে না। প্রতিটি বাড়ির সামনে দরজার ফাঁকে ফাঁকে কৌতূহলী চোখ। নিবেদিতা কিছুই বুঝছে না। স্মিত হাসি নিয়ে সবার দিকে তাকায়। মাথা নিচু করে হাতজোড় করে নমস্কার করে। গোপালের মা বেশ শক্তপোক্ত শরীরে ও গলায়, ‘আরে হা হা করে উঠলে সবাই, আমাদের ‘মা’ ওকে মেয়ে বলে মেনেচে, মাকে ‘মা’ বলে ডাকে, নিরামিষ খাবার খায়, পুজো করে, রোজ দু’বেলা জপ করে…আমরা একসঙ্গে বসেই জপ করি গ, ও মেয়ে, আমাদের মেয়ের মতোই একানে থাকবে গো, থাকবে…।’ থামার আগেই সবার বিস্ময়ের ঘোরের মাঝেই পাড়ার খনখনে বুড়ি, ‘এ কী অনাচ্ছিস্টি শুরু করলি গা গোপালের মা, জাত কুল সব শিকেয় তুলে দিলি রে…!’ চিৎকার, ব্যঙ্গ, আপত্তি এই সমস্ত কিছুর মাঝখান দিয়েই গোপালের মা এক পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে এসে আঁচলে বাঁধা চাবি দিয়ে দরজা খোলে। নিবেদিতা বাড়িটাকে দেখেন। এটাই তাঁর সেবাশ্রম!

সাদামাটা দোতলা বাড়ি। সোজা দেওয়াল উঠে গেছে ছাদ বরাবর। সাদা চুনকাম করা দেওয়াল। ছোট ছোট কালো রং করা জানালা। কাঠের পাল্লা বন্ধ। মনে হচ্ছে সাদা পর্দায় কেউ কালো রঙের চৌখুপ্পি কেটেছে। কালো কাঠের দরজায় বড় বড় লোহার কড়া। কড়ায় লাগানো বড় তালা এইমাত্র গোপালের মা খুলল। গোপালের মা পাড়া থেকেই এক বুড়িকে ডেকে এনেছে। সে ঘোমটা টেনে তফাতে তফাতে থাকছে। সে ঝি। রান্নাবান্না, বাসনমাজা, ঘরদোর মোছা এইসব করবে। ভেতরে একটা উঠোন। উঠোন ঘিরে বারান্দা। বারান্দায় তফাতে তফাতে থাম । ধাপ ধাপ সিঁড়ি। একপাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। উঠোনের মাঝে দাঁড়ায় নিবেদিতা। উপরে বিকেলের ম্লান আকাশ। নারকেল গাছের পাতায় পড়ন্ত সূর্যের আলোর চলাচল।
‘১৬নং বোসপাড়া লেন’ — চিঠির মাথায় লেখেন তাঁর নতুন স্থায়ী ঠিকানা।

এখন সন্ধ্যা নেমেছে বাগবাজারে। শীতকাল। জানুয়ারি মাস পড়েছে। দূরে দূরে শিয়াল ডেকে উঠছে সমস্বরে। কোনও কোনও মন্দির থেকে কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছে। মাঝে মাঝেই ঘোড়ার গাড়ির শব্দ বাগবাজারের নৈঃশব্দ্যকে ছারখার করে দিয়ে চলে যাচ্ছে। খোলা জানালায় নড়াচড়া করছে ছায়া। অদ্ভুত আঁধার ঘিরে আছে। সেজবাতির সামনে বসেছেন নিবেদিতা। এখন তাঁর লেখাপড়া করার সময়। আজ ভীষণ উত্তেজিত। ভেতরে তোলপাড় করছে এক দামাল হাওয়া। প্রবল শীতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মিস্ ম্যাকলয়েডকে লিখতেই হবে আজকের কথা। লেখার প্যাড, দোয়াত, কালি, ডাস্টার, খাগের কলম সব সাজিয়ে নিয়ে বসলেন। শীতের হাওয়া এক ঝলক ঢুকে গেল ঘরে। চাদরটা টেনে নিয়ে বসলেন চেয়ারে।
“Your letter entered in a blaze of glory as I returned from an hour with the King – who came last night and sent for me at 8 morning. He was divine – looking splendid – though he told me that he stood 3 nights battling for breath, but full of plans. I never saw him in such a mood before – Saradananda and I are to carry on a Crusade and enthuse Calcutta with lectures in theatres. “Make inroads into the Brahmos” Was this just a passing spirit?” (letters, vol-I, P- 31)

উত্তেজিত নিবেদিতা লিখে চলেন। গতকাল রাতে বিবেকানন্দ ফিরে এসেছেন। সকালে নিবেদিতাকে ডেকে পাঠিয়ে এ কী বললেন! ব্রাহ্মদের ভেতরে অনুপ্রবেশ করার নির্দেশ। ‘ব্রাহ্মদের মধ্যে ঢুকে পড়ো!’ বুঝতে পারছেন না নিবেদিতা। বসু দম্পতির সঙ্গে সখ্য। বিশেষ করে জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান সাধনায় নিবেদিতার কুণ্ঠাতীত আগ্রহ। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে নিত্য উঠাবসা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আভিজাত্য, পাণ্ডিত্য ও কবি প্রতিভায় উদ্দীপ্ত নিবেদিতা — অস্বীকার করার জায়গা নেই। ব্রাহ্ম সমাজের মহিলাদের শিক্ষা, চেতনা, ভাবনা নিবেদিতার ভাল লাগে। প্রতি বৃহস্পতিবার তিনি ওঁদের সঙ্গে বসে আলোচনা করেন স্ত্রী-শিক্ষা নিয়ে। সরলা, অবলা, লাবণ্যপ্রভা সবাই থাকেন। খুব ভাল লাগে নিবেদিতার তাঁদের প্রীতিময় উদার সংস্কারমুক্ত সাক্ষাৎগুলি। বিপরীতে আদুল গা, কর্কশ ভাষা, সংস্কার, পুজো, পাঠ, মন্ত্রোচ্চারণ ইত্যাদি ইত্যাদি মেঠো ব্যবহারের সমাহার। ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও ইদানিং নিমন্ত্রিত হচ্ছেন নিবেদিতা। দেখা যাচ্ছে তাঁকে প্রাণখোলা। সমস্ত কিছুর কেন্দ্রে আছেন রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্র। দুই প্রতিভাময় ব্যক্তিত্ব। নিবেদিতা রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে ব্রাহ্মদের যোগাযোগ তৈরি করার চেষ্টা শুরু করার অনুমতি পেলেন কি স্বামীজির কাছ থেকে! কারণ, ওই চিঠিতেই লিখছেন, “Anyway he told me to get up a tea party and invite my Brahmo friends and he would come and talk!!!” নিবেদিতার ব্রাহ্ম বন্ধুদের চায়ের নিমন্ত্রণ করতে বলছেন স্বামীজি। সেখানে উনিও থাকবেন!

সেই বহু-আকাঙ্ক্ষিত, আকর্ষণীয় ‘টি-পার্টি’ হয়েছিল ২৮ জানুয়ারি সোমবার। রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ মুখোমুখি। দুই বিরুদ্ধ মতের দুই কান্ডারির মুখোমুখি সাক্ষাৎকার নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নিবেদিতা চুপ। স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই চুপ। অনর্গল আবেগের উচ্ছ্বাস দেখা গেছে নিবেদিতার চিঠিতে চিঠিতে ডায়রির পাতায় পাতায়। সেখানে এই সাক্ষাৎকার নিয়ে, কী কী কথা হল, কেমন হল কথোপকথন! স্বভাববিরুদ্ধ নিশ্চুপ নিবেদিতা।
মেঘ ছিল!

কলকাতার শিক্ষিত সমাজ তখন ব্রাহ্ম মতবাদের ভেতরে খুঁজে চলেছে সমাজ-মুক্তির পথ। বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত যুবসম্প্রদায়কে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রভাবে নিয়ে আসতে হলে একটা সাঁকো দরকার। নিবেদিতা কি সেতু নির্মাণের কাজটি নিজেই তুলে নিলেন? না কি উৎসাহিত হয়েছিলেন বিবেকানন্দের প্রশ্রয়ে?

আবার মেঘ এসে ঢেকে ফেলেছে সূর্যের তেজ। ঘোলাটে হয়ে গেছে গঙ্গার রং। নিবেদিতা মাথা নিচু করে বসে আছেন নৌকায়। নৌকা এগিয়ে চলেছে বেলুড়ের দিকে। বিগত চার বছর ধরে কত অসংখ্য বার তিনি গেছেন বাগবাজার থেকে বেলুড়, আবার বেলুড় থেকে বাগবাজার! কোনওদিন এত দীর্ঘ মনে হয়নি এই জলপথ। চলেছেন এক শূন্যতার সাক্ষী হতে! কী দেখবেন! কীভাবে দেখবেন! শায়িত বিবেকানন্দ। নিথর বিবেকানন্দ। চোখ বন্ধ করলেন নিবেদিতা। নৌকা এগিয়ে চলে।

[ক্রমশঃ]

[পর্বঃ ২]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জুলাই ২৪, সূচিপত্র]

5 1 ভোট
Article Rating
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
3 months ago

দারুন, ইতিহাস ভিত্তিক লেখা! খুব সুন্দর!
Margot, মা সারদার সঙ্গে দেখা করার প্রথম তারিখ এ
টাইপ ভুল করে ১৯৯৮আছে, সংশোধন করে দিন।

menterprisekolkata
Admin
3 months ago

সঠিক পর্যবেক্ষণ। শুধরে দেওয়া হল। অনেক ধন্যবাদ।

Rajat Chakraborti
Rajat Chakraborti
2 months ago

অনেক ধন্যবাদ। সঙ্গে থাকুন।🙏