পর্বঃ ২

‘অত মোটা মোটা বই পড়ে কী লাভ, যদি হৃদয়ে না থাকে? হোয়াই আর ইউ সো ক্রুয়েল?’ বলেই সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন জগদীশ। টিনের কৌটো থেকে একটা সিগারেট বার করে দ্রুত পায়ে চলে গেলেন বারান্দায়। বেশ রেগে গেছেন।
নিবেদিতা একটু হতবাক। অবলা কাপে চা ঢালতে ঢালতে থমকে গেলেন। তাকালেন। টি-পটটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। ডানহাতে নিবেদিতার হাতটা ধরলেন, ‘আসলে ও প্রাণীহত্যা একদম পছন্দ করেন না, তুমি কিছু মনে কোরো না নিবেদিতা।’
‘না না। আমি বলতে চেয়েছিলাম যে, আমার ইচ্ছা ছিল বন্দুক নিয়ে শিকারে যাওয়ার। সে একসময়ের কথা। কিন্তু…’
‘তুমি হয়তো এইখানে এইসব স্টাফড অ্যানিমাল দেখে ভাবছ মি. বোস শিকারি ছিলেন। করেছিলেন একসময়ে শিকার। সে ছেলেমানুষির বয়সে। জানো তো তিনি ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধু রক্তপাত সহ্য করতে পারেননি বলে। একবার তো আসামে বন্ধুদের সাথে শিকার করতে গিয়ে কালাজ্বর বাঁধিয়ে ফিরলেন।’ অবলা চায়ের কাপটা নিবেদিতার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
‘ধন্যবাদ,’ চায়ের কাপটা নিয়ে মুখ তুলে তাকালেন নিবেদিতা।
‘আমি কিছু মনে করিনি বো। আমি দেখছিলাম বেয়ার্নের আবেগের স্বচ্ছতা আর মহত্ত্ব।’
নিবেদিতার এই ‘বো’ বলে ডাক! বেশ মজা লাগে! ‘বউ’ উচ্চারণটা ও করতে না পেরে সহজভাবে ‘বো’ বলেই ডাকে হয়তো! আর মি. বোসকে ‘বেয়ার্ন’। অবলা একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘বেয়ার্ন’ শব্দের মানে কী! নিবেদিতা হেসে বলেছিলেন, ‘এটা একটা স্কটিশ শব্দ, মানে খোকা, ছোট ছেলে।’
দু’জনেই হেসে উঠেছিলেন। ছোট ছেলেই বটে। জেদ, খেয়াল, আবেগের বিস্ফার, দাবি-চাহিদা সব সবকিছুই তার বালকের সরলতায় পূর্ণ। স্বচ্ছ। এখন তিনি যে প্রতিক্রিয়া দেখালেন, তার ব্যাখ্যা নিবেদিতার এই সম্বোধনেই আছে। ‘বেয়ার্ন’! খোকা!
সিগারেট শেষ করে ঘরে ফিরে এলেন মি. বোস। বসলেন নিবেদিতার বিপরীত সোফায়।
অবলা চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়।
‘আমি দুঃখিত, এরকম ব্যবহারের জন্য। Sorry Miss Noble।’
‘আমাকে নিবেদিতা বলে ডাকলে আমি বেশি খুশি হই। ঠিক এক বছর হল আমি ওই নাম ত্যাগ করেছি।’


‘জানি। এবং এটাও সত্যি যে মিস নোবলের পরিবর্তে সিস্টার নিবেদিতা বলে ডাকতে পারছি না। যথেষ্ট আত্মপীড়ন ঘটে। একটা, একটা dreadful narrowness, যা আপনার মানবিক সম্পদকে ছোট করে।’
‘Dreadful narrowness! narrowness বলছেন! আমি শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা।’
‘কিছু মনে করবেন না, আমি খুবই বিরক্ত যে, বিবেকানন্দ অযথা রামকৃষ্ণের উপর দেবত্ব আরোপ করছেন। রামকৃষ্ণ একজন সংকীর্ণ মানু্‌ষ, যিনি মেয়েদের প্রায় আধা শয়তানি মনে করেন – তাই মহিলা দেখলেই মূর্ছা যান।’
অবলা চায়ের কাপ-প্লেট গোছাতে গোছাতে পরিবেশটা সহজ করার চেষ্টা করে।
‘আহা বেচারা! ওকে এসব বলছ কেন? নিবেদিতা তুমি আজ ডিনার এখানেই করে যাবে। কেমন? আর তর্ক নয়, এবার ডাইনিং এ চলো।’
‘না না শোনো, আমি বিবেকানন্দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। যেদিন উনি বললেন, আমার জীবনের উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌরুষ আনা- সেদিন থেকে আমি তাঁর প্রতি আগ্রহী হই। পড়লাম তাঁর ভাষণগুলি। দেখলাম উনি ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন। মানুষের কল্যাণ ও সত্যের কামনায় তিনি একাগ্রচিত্ত। বিশ্বাস করুন মার্গারেট, আমার ভীষণ ভাল লাগল যখন দেখলাম উনি সমাজের নিচুস্তরের মানুষদের কাছে টেনে নিচ্ছেন!’
‘সেটাই তো তাঁর কাজ বেয়ার্ন। উনি সেটাই করছেন। তাঁর আদেশেই আমি আর্ত ভারতবাসীর জন্য কাজ করতে চাই।’
‘কিন্তু উনি করছেন কী? গুরুপূজা আর মূর্তিপূজায় ডুব দিলেন। একজন বীর সৈনিক শেষ পর্যন্ত এক ধর্মসম্প্রদায়ের নেতা হয়ে উঠলেন। আমি নিজেকে সেই কারণেই সরিয়ে নিয়ে এসেছি।’
অবলা কথার মাঝে ঢুকে পড়ে, ‘খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, চলো চলো।’
নিবেদিতা নিজের মত জোরালো ভাবে প্রকাশ করার স্বাভাবিক অভ্যাস ত্যাগ করে শান্ত করলেন নিজেকে। সংযত হলেন। অবলার সঙ্গে ধীরে উঠে গেলেন ডাইনিং-স্পেসের দিকে।
অবলা বলে যাচ্ছিলেন বিদেশ থেকে আসার পরে বিবেকানন্দ মাঝে মাঝেই চলে আসতেন এই বাড়িতে। নিজের হাতে তিনি বিদেশি কায়দায় মাংস রাঁধতেন। ভীষণ ঝাল খেতে পছন্দ করতেন। নানারকম পদ বানাতেন। তার অসাধারণ স্বাদ। তার ব্যবস্থাপনা, পরিবেশনের কায়দা – ঝরনার মতো বলে যাচ্ছেন অবলা। কিন্তু নিবেদিতা কোনও আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তিনি ভাবছেন বেয়ার্ন আর স্বামীর কাজের দর্শন কি সত্যিই আলাদা? দু’জনেই কি একই কাজ করছেন না? দু’জনের আধার আলাদা। একজন বিজ্ঞানের মধ্যদিয়ে যা প্রমাণ করতে চাইছেন, আরেকজন সেটাই কি মানুষের মাঝে সংগঠনের মধ্য দিয়ে প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন না? দু’জনেই যোদ্ধা।
পরিবেশ স্বাভাবিক করার অবলার আপ্রাণ চেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হল না। স্যুপ-কাটলেট আর নাহুমের ব্রেড দিয়ে নিবেদিতার সংক্ষিপ্ত ডিনার শেষ হল। মার্চ মাস। সন্ধেবেলা গঙ্গার দিক থেকে সুন্দর হাওয়া আরাম ছড়িয়ে দেয় শহরের বুকে। রাস্তায় রাস্তায় কেরোসিনের ম্লান আলো এই এক বছরে অভ্যাস হয়ে গেছে নিবেদিতার। এখন স্নিগ্ধ লাগে। জগদীশ ওঁর সঙ্গে সঙ্গেই নেমে এসেছেন রাস্তায়।
‘এখন সাড়ে সাতটা। চলুন কিছুটা এগিয়ে দিয়ে আসি।’
‘চলুন। তবে আমি জুড়িগাড়ি করেই যাব বেয়ার্ন!’
‘এখানে তো পাবেন না! কিছুটা যেতে হবে, সেইটুকু সঙ্গে গেলে নিশ্চয় আপত্তি নেই আপনার?’
আলো-অন্ধকার কলকাতার রাস্তা। দূরে দূরে কেরোসিন তেলের আলো ধিকি ধিকি জ্বলছে। গাছে গাছে জোনাকির খেলা। কাছে দূরে মুহুর্মুহু শেয়ালের সমস্বর চিৎকার। দু’-চারজন পথচারী হেঁটে চলেছে। বেশিরভাগ মদ্যপ সাহেব-মেম। কিছুক্ষণ বাদে বাদে ঘোড়ার গাড়ি চলে যাচ্ছে। সওয়ারির অশ্লীল চিৎকার, স্খলিত হুঙ্কার।‌ জগদীশচন্দ্র এবং নিবেদিতা পায়ে পায়ে চলেছেন লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে। শুধু পায়ের তলায় শুকনো পাতার আওয়াজ। জগদীশচন্দ্র নীরবতা ভাঙলেন।
‘আপনার বিদ্যালয়ের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে! লাবণ্যের কাছ থেকে খবরাখবর পাই সব!’
‘লাবণ্যদেবী কেন? প্রতি শুক্রবারই তো আমি আসছি এখানে!’
‘লাবণ্য খবর দিলে অসুবিধা আছে?’
‘সুবিধা-অসুবিধার কথা জানি না। লাবণ্যপ্রভা আপনার বোন, এই সুবিধা নেওয়াটা কিন্তু ঠিক নয়। বিদ্যালয়ের ব্যাপারে সবাই খুব উৎসাহ দিচ্ছে।’ নিবেদিতার গলায় উচ্ছ্বাস ধরা পড়ে।
‘বাঃ। কোনও সাহায্য করতে পারলে খুশি হব!’
‘সবার সাহায্য সহযোগিতাই তো বড় কিছু গড়ে তোলে। একীভূত শক্তিই তো মানবোন্নয়নের চালিকাশক্তি। সেই শক্তিই তো মুক্তি আনে ব্যক্তির ও সমগ্রের। সেই শক্তিই প্রাণ… ওই তো জুড়িগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে… চলি। গুড নাইট। ভাল থাকবেন। ওহ্ হ্যাঁ, স্কুলের উদ্বোধনে নিমন্ত্রণ করব। আসবেন কিন্তু!’


‘গুড নাইট। শীঘ্রই আমাদের দেখা হচ্ছে।’
‘অবশ্যই। গুডনাইট।’
কোচোয়ান বিদঘুটে হাঁক দিয়ে গাড়ি ছাড়ল। ঘড়বড় ঘড়বড় করে নিস্তব্ধতা ভেঙে ঘোড়া দৌড় শুরু করল বাগবাজারের দিকে।
অন্ধকার নামলে এই শহরটাকে আর ভুতুড়ে লাগে না এখন। মায়াবী লাগে। যেন গোটা শহরটা ঘোমটার আড়ালে লজ্জাবতী প্রদীপ হাতে চলেছে তুলসীতলায়। সন্ধ্যাবেলা এ দৃশ্য একরকম আশ্চর্য নরম মায়া তৈরি করে। এ শহর তেমনই মায়া ছড়ায় সাঁঝবেলায়। সাহেবপাড়ার চাকচিক্য পেরিয়ে গেল কখন! পেরিয়ে গেল সাজানো দোকানসম্ভার ঘিরে ছোট্ট ছোট্ট হই-হুল্লোড়। ঘোড়ার খুরের ঠক ঠক শব্দ ঢুকে পড়েছে অন্ধকার শহরে, ব্ল্যাকটাউনে। মি. বোসের সঙ্গে তর্কাতর্কি হতেই পারত। সাজানো যুক্তিসহ শব্দের পর শব্দ চলে এসেছিল স্বভাবমতো জিভের ডগায়। কিন্তু সংবরণ করেছেন নিবেদিতা। কেন? এখনও সময় আসেনি, বলছে মন। কিসের সময়? কেন বাধা পেলাম ভেতর থেকে? এরকম তো হয় না কখনও, এটা তো স্বভাববিরুদ্ধ। স্বামীর বিরুদ্ধে, রামকৃষ্ণের বিরুদ্ধে তাঁদের ভাবান্দোলনের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মদের আক্রমণে তিনি তো লজ্জাজনকভাবে প্রতি-আক্রমণ করেন। এটা সুবিদিত। সে যত সম্মানীয় হোন! ছি ছি, মি. রায়ের বাড়িতে যা ঘটেছিল! আজও ভাবলে খারাপ লাগে নিবেদিতার। কিন্তু আজ? এই তো সেদিন, মাসকয়েক আগে মি. রায়ের বাড়িতে ডিনারের নিমন্ত্রণে এরকম পরিস্থিতিই তো হয়েছিল। উনি অত মান্যগণ্য একজন মানুষ। ড. পি কে রায়, প্রসন্নকুমার রায়কে একডাকে সবাই চেনে। প্রেসিডেন্সীর প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ। অবলা বোসের ভগ্নীপতি। গোড়া ব্রাহ্ম। কেশব সেনের কাছে দীক্ষিত। তাঁর স্ত্রী সরলা রায় নিবেদিতার বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছে। সরলাও উচ্চশিক্ষিত, সমাজসংস্কারক, নারীশিক্ষার প্রবক্তা। সবার সামনেই প্রসন্ন রায় শ্রীরামকৃষ্ণ ও সনাতন হিন্দুধর্মের আন্দোলন নিয়ে যাচ্ছেতাই সমালোচনা শুরু করলেন। ঘোড়ার গাড়ির দুলুনিতে তো বটেই, নিবেদিতা মাথাটা একটু বেশি নিচু করলেন। আজও লজ্জা পান। মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। খুব দৃঢ় এবং রূঢ়ভাবে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভাবনার পক্ষে, তথা দেব-দেবী পূজার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তাঁর রণংদেহী মূর্তি দেখে সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর স্বভাবই তো এরকম। কিন্তু আজ কিভাবে মি. বোসের কথাগুলোর পৃষ্ঠে কোনও কথা তেমনভাবে মুখে এল না? কেন মনে হল এখনও সময় আসেনি?

নিবেদিতা স্থির জলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। গঙ্গা বয়ে চলে। সমস্ত মৃত্যু ও জীবনের সাক্ষ্য নিতে নিতে চলে, চলে আর চলে!

‘আমি বিদ্যুৎ-তরঙ্গের গ্রাহক যন্ত্র নিয়ে কাজ করতে করতে লক্ষ করলাম ধাতব গ্রাহক যন্ত্রের রেসপন্স কমে যাচ্ছে। বিশ্রাম দিলাম ধাতবকে। আবার বিদ্যুৎ-তরঙ্গ পাঠালাম, দেখলাম রেসপন্স আগের মতোই ফিরে এসেছে। আমি দুই অবস্থার গ্রাফ সংগ্রহ করলাম। তার যে গ্রাফ আর আমাদের পেশির রেসপন্স গ্রাফ একই। জীবিত পেশিকে বিশ্রাম দিলে যে মাত্রায় সে কর্মক্ষমতা ফিরে পায়, ধাতুও একই মাত্রায় একই রকম আচরণ করে।’

জগদীশ বোস একটু থামলেন। চশমার ফাঁক দিয়ে দেখে নিলেন দুই বিদেশিনীর মুখ।
নিবেদিতা আর সারা বুল। অবাক হয়ে দেখছিলেন আপার সার্কুলার রোডের ছোট্ট ল্যাবরেটারি। একটা সাদামাটা ঘর। চারিপাশে ছড়ানো ছেটানো যন্ত্রপাতি, টেস্টটিউব, অণুবীক্ষণ যন্ত্র আর কাগজপত্র। সারা বিশ্ব যে বিজ্ঞানীকে স্বীকৃতি দিচ্ছে তাঁর এই অনাড়ম্বর তপস্যায় নিবেদিতা যথেষ্ট বিহ্বল। দারিদ্র ও কৃচ্ছ্রসাধন সঙ্গে নিয়ে এই বিজ্ঞানী অসাধ্য সাধন করছেন। আস্তে আস্তে টুপি খুলে রাখলেন একটা ছোট তিনপায়ার উপর। মার্চ মাসের আবহাওয়া কলকাতার মানুষদের কাছে আরামদায়ক হলেও বিদেশিদের কাছে বেশ গরম। ১৮৯৮ সালের ৩০ মার্চ সকালেই রোদের তেজে বিদেশিনীদের গাল লাল হয়ে উঠেছে। অবলা বেলের সরবত করে কখন নিয়ে এসেছেন লক্ষ করেননি কেউই। দু’জনেই বিজ্ঞানীর গবেষণাগার দেখে স্তম্ভিত।
‘প্লিজ, মিস নোবল, প্লিজ মিস সারা বুল,’ মিষ্টি হেসে ঢাকা দেওয়া পাথরের গ্লাস এগিয়ে দিলেন দুই অতিথির দিকে। রেকাবিতে রাখলেন বাড়ির তৈরি ক’টা সন্দেশ। দিনপাঁচেক আগে তাঁর নামকরণ হয়েছে ‘নিবেদিতা’। ২৫ মার্চ ১৮৯৮, ‘The day of Annunciation’। নিবেদিতার জীবনে পরম সার্থকতার দিন। সবাই এই নামে এখনও সড়গড় হয়নি। তাঁকেই মনে করিয়ে দিতে হবে সকলকে।এই মুহূর্তে এই বিষয়ে তাঁর মন নেই। তাঁর মন মি. বোসের গবেষণার ব্যাখায়। কী বলছেন মি. বোস?
এই কথা, এই ব্যাখ্যা, এক মুণ্ডিতমস্তক গেরুয়া বসন পরিহিত সন্ন্যাসী বলছিলেন। অদ্বৈত দর্শনের কথা। মন্দ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করছিলেন স্বামীজি উপনিষদ থেকে– যদিদং কিঞ্চ জগৎ প্রাণ এজতি নিঃসৃতং। এই জগতের সমস্তকিছু প্রাণ থেকে নিঃসৃত। সর্বভূতে চৈতন্যের প্রকাশ। ড. বোস তো স্বামীজির বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ করতে চলেছেন! নিবেদিতা নির্বাক। তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে তার ভেতরে। ব্রহ্ম আর ব্রাহ্মের বিরোধ কোথায়? একই নদীর দুই পাড়। সাঁকো চাই মাঝে। একটা ব্রিজ।
‘অদ্বৈত দর্শনের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ চাইছেন মিস নোবেল?’ জগদীশচন্দ্রের প্রশ্নে সম্বিত ফেরে নিবেদিতার।
‘ঠিক তাই!’ বলেই তাকালেন মি. বোসের দিকে। ঝকঝক করছে দু’টি চোখ। উজ্জ্বল আগ্রাসী চোখ গোল মেটাল ফ্রেমের চশমার ভেতর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। অথচ শান্ত। ধীর। কী যেন খুঁজে পাওয়ার তৃপ্তি তার স্মিত হাসিতে।
‘জ্ঞান আর বিজ্ঞানের অনুভব কি এক?’ জগদীশ তাকান তীক্ষ্ণ।
‘উপনিষদে এইরকমই তো বলা আছে!’ নিবেদিতা শান্ত।
‘আপনি বিশ্বাস করেন?’ জগদীশচন্দ্র ভ্রু কোঁচকান।
নিবেদিতা চকিতে তাকালেন। প্রশ্নকর্তার চোখ স্থির। পিঙ্গল চোখে ব্রহ্ম আর ব্রাহ্ম নয়, একটা অনুভব দু’জনকে এক পরম সত্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। ব্যাখ্যাতীত সে পাঠ কয়েক মুহূর্তের।

নিবেদিতা তাকিয়ে দেখেন। আজ বেলুড়ের ওই বাঁশের ঘাটে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবেন না। চোখ বন্ধ করেন। চোখের কোণে টলটলে জল উপচে গড়িয়ে নামতে থাকে গাল বেয়ে।

হঠাৎ চিৎকৃত কান্নার শব্দে ফিরে আসেন নিবেদিতা। জুড়িগাড়ি বোসপাড়া লেনে ঢুকে পড়েছে। আর দু’-একটা বাড়ির পরেই তাঁর বাড়ি। কিন্তু তিনি কোচোয়ানকে গাড়ি থামাতে বললেন। গাড়ি দাঁড়াতেই দ্রুত নামলেন। পা চালালেন সামনের কুঁড়েঘরগুলোর দিকে। প্রদীপের আলো আর কেরোসিনের লম্ফ নিয়ে ভিড় করেছে কয়েকজন। অন্ধকার তালপাতার ছাউনি দেওয়া মাটির ঘর। কালো কালো মহিলারা ভিড় করে আছে ঘরের ভেতর। এদের কিছু করার নেই, মৃত্যুকে দেখা ছাড়া। বিলাপ ছাড়া আর কিছু জানে না। তাই কান্নায় ভেজা চিৎকার। নিবেদিতা ঘরে ঢুকে পড়লেন মাথা নিচু করে। এই মেমদিদির সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচয় হয়েছে এতদিনে স্থানীয়দের। নিবেদিতাকে দেখে মেয়েটির মা’র কান্না আরও বেড়ে গেল। মায়ের কোলে হাড়-জিরজিরে মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে আছে। নাড়ি দেখলেন নিবেদিতা। প্রাণ আছে। ছোট্ট ঘরটা ধোঁয়া আর লোকে গুমোট হয়ে আছে। খোলা হাওয়া দরকার। নিবেদিতা নিচু হয়ে দু’হাতে কোলে তুলে নিলেন বাচ্চাটিকে। মাকে ইশারায় বললেন সঙ্গে আসতে।

সদানন্দ বাইরের ঘরেই থাকে। বোসপাড়া লেনের এই বাড়িটা ভাড়া নেওয়ার পর থেকেই সদানন্দ তার সাথি। সারদাদেবীর বাড়িতে যেমন যোগানন্দ থাকে সদা সর্বদা। তেমনি নিবেদিতার এই ভাড়াবাড়ির একতলার সদর দরজার পাশে সদানন্দর ঘর। মঠ সন্ন্যাসী। সদানন্দ নিবেদিতাকে পাড়ায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সবার কাছে নিবেদিতার পরিচয় করিয়েছে সদানন্দই। নিবেদিতা ম্লেচ্ছ। তাই একজন সন্ন্যাসী সঙ্গে থাকলে সুবিধা হয়। একটি মাদুর আর দু’টি কম্বল তার সম্বল। ঘরের কোণে একটি কুঁজো, একটি থালা-বাটি-গেলাস। আরেক কোণে কিছু বই-পত্তর, হাতপাখা, দোয়াত ও পেনদানি। রোজ সন্ধেবেলা উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে তার কাজ হল নিবেদিতাকে ডাকা – ‘এবার আর কাজ নয়, চলে আসুন নীচে।’ নিবেদিতাও নেমে আসেন বালিকার মতো। স্বামীজির নির্দেশে নিবেদিতার বৈরাগ্য সাধন চলছে। অনাড়ম্বর জীবনকে যাপনে অভ্যাস করতে হবে। কোনও পুরুষ বা মহিলা, সে দেশের হোক বা বিদেশের, বাড়ির বৈঠকখানা পেরিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন বিবেকানন্দ। অন্দরমহল হোক বৈরাগ্য আর একাকিত্বের শান্ত ক্ষেত্র। সেখানে বাইরের কোলাহলের প্রবেশ নিষিদ্ধ। একটি আসন পাতা। ধ্যানের আসন। আর কোনও আসবাব নেই। শোবার ঘরে, একটা তক্তপোশ, তার উপর তোষক-বালিশ-চাদর। একটি টেবিল ও চেয়ার। বিলাসিতা বলতে, টেবিলের একধারে একটি ট্রেতে টি-পট ও কাপ-প্লেট। বিবেকানন্দ মুচকি হেসে ফেলেন টি-পট দেখে। থাক ওইটুকু।
‘এখন তুমি সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ছেড়ে দিয়ে অন্তঃপুরবাসিনী হও, নিজের ভেতরে ডুব দাও। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে নিজেকে দেখতে চেষ্টা করো। মনের উচাটন দমন করো। নির্বিকার হও।’ স্বামীজি তাকালেন নিবেদিতার দিকে। ‘নিজেকে নির্জনে মৌনী থাকার অভ্যাসে মনের সংকীর্ণতা দূর হয় নিবেদিতা, আত্মার বিকাশ ঘটে।’
নিবেদিতা ব্যাকুল হয়, ‘আমি কাজে নামব কবে?’
‘প্রস্তুত করো নিজেকে। মায়ের বাড়িতে সব দেখভালের জন্য যেমন যোগানন্দ আছে, তোমার বাড়িতে সদানন্দ থাকবে। যা প্রয়োজন ওকেই বোলো।’
নিবেদিতা নীরবে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন।

নিবেদিতা তন্ময়। মাটিতে পা জড়ো করে বসে পৌরাণিক কাহিনী শোনেন। সদানন্দ অভিনয় করে বলে চলে অভিমন্যুর করুণ মৃত্যু বা সীতার দুর্দশা অথবা সতীর দেহচ্ছেদ। সদানন্দের গল্প বলার ধরনটির মধ্যে একরকম বিশ্বাস ঝরে পড়ে। ঠিক তখনই গোধূলি ঝরে পড়ে সন্ধ্যার কোলে। নারকোল পাতায় সরসর আওয়াজ তোলে হাওয়া। তুলসীমঞ্চে সন্ধ্যাপ্রদীপ দেবার সময় চলে এসেছে টের পান নিবেদিতা যখন আশেপাশের বাড়ি থেকে শঙ্খধ্বনি হয়। আজ নিবেদিতার দেরি হয়েছে। সদানন্দ একা সন্ধ্যারতি করে পায়চারি করছিলেন ঘরে। আজ গল্প বলা হয়নি। রোজকার কাজ একদিন না হলে যেমন হয়। অস্বস্তি। তার উপর নিবেদিতা একা ফিরবেন। প্রতি শুক্রবারই তিনি ড. বোসেদের বাড়ি যান বিকেল-বিকেল। সন্ধ্যা হতে না হতে ফিরে আসেন। ডিনারের নেমন্তন্ন থাকলে বলেই যান। রাতের খাবার করতে বারণ করেন। আর প্রতি বৃহস্পতিবার যান ব্রাহ্মদের বালিকা বিদ্যালয়ে। সে তো পাশের পাড়ায়। কাছাকাছি। আজ গিয়েছিলেন আপার সার্কুলার রোড। অনেকটাই দূরে। হঠাৎই চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পায় সদানন্দ। বেরিয়ে এসেছে সে ঘর থেকে হই-হট্টগোলে। সামনেই নিবেদিতা। তাঁর কোলে রোগা একটি মেয়ে। অজ্ঞান। পেছনে মেয়ে-বউয়ের ছোট জটলা। তার পেছনে কয়েকজন পুরুষ।
সদানন্দের ঘরেই মাটিতে বসে পড়লেন নিবেদিতা। হাতের ইশারায় যোগানন্দকে বললেন সবাইকে চলে যেতে বলো। ভিড় কমে গেল। মেয়েটির মা তখনও গুমরে গুমরে কাঁদছে। উঠোনের কোণে অন্ধকারের সঙ্গে মিশে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে বাবা। কী করতে হবে বুঝতে পারছে না। ম্লেচ্ছ বলে ক’দিন আগেও দূরে দূরে থাকত ওরা। সদানন্দ মেয়েটির গায়ে হাত দিয়ে দেখল ধুম জ্বর। নিবেদিতা মেয়েটির মাথায় জলপটি লাগাচ্ছে যত্নে।
ঘরের বাইরে হেলান দিয়ে বসে থাকার ফলে একটু চোখ লেগে গিয়েছিল সদানন্দের। উঠোনের কোণে বসে থাকা লোকটা ঢুলছে ঘুমে। সদানন্দ ঘরের ভেতরে তাকাল। প্রায় অন্ধকার ঘর। কোণে একটা মাটির প্রদীপ জ্বলছে। শ্বেতপাথরের মূর্তির মতো নিবেদিতা স্থির। সোজা বসে আছেন। জলপটি পাল্টে দিচ্ছেন নীরবে। মা মেরীর মতো লাগছে। কোলে যীশু। অপার্থিব। স্বামীজির শিষ্যা। সদানন্দের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে নামল। দু’টি হাত উঠে এল বুকের উপর।

জগদীশচন্দ্র বসু তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন তাঁর গুরু তথা স্বামী বিবেকানন্দকে, আক্রমণ করেছেন পরমপূজ্য শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে, ভুলতে পারেননি নিবেদিতা ৩১ মার্চ ১৮৯৯-এর রাতকে। জগদীশচন্দ্র, নিবেদিতার ‘বেয়ার্ন’, ব্যক্তি নিবেদিতার কাছে অতি বিশ্বাসের সঙ্গে স্বীকার করলেন কোথায় কোথায় বিরূপতা।
সারারাত শিশু মেয়েটিকে শুশ্রূষা করে ক্লান্ত নিবেদিতার বারবার মনে ভেসে উঠেছে ‘বেয়ার্ন’-এর কথাগুলো। সকালে সুস্থ বোধ করছে শিশুটি। কিছুটা স্বস্তি। কিছুটা বিশ্বাস ও ভালবাসার আসন পাতা হল এই মানুষগুলোর ভেতরে।
ভুলতে পারছেন না তিনি। কয়েকদিন পরেই, ৫ এপ্রিল নিবেদিতা চিঠি লেখেন মিস ম্যাকলাউডকে। সমস্ত কিছু খুলে বলেছেন সেখানে। বলেছেন সেই রাতের কথা‌। অপমান ও সংযমের কথা। তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন চিঠিতে খুব সহজ ও সাধারণ কথা — “The event of the week has been my talk with Dr. Bose on Friday night. I love that man.” ( Letters of Sister Nivedita, Vol.I, Pg.102, Ed: Sankari Prasad Bose, Navabharat Publishers, 1982)

বলছেন মিসেস বুলকে, “তুমি, আমি, আর য়ুম আমরা বসুদের চারপাশে প্রীতির একটা উষ্ণ পরিবেশ রচনা করে দেবো। দেবো শক্তি, সারা দুনিয়াকে ওদের ঘর করিয়া তুলিব। এখনও তার সময় আছে। স্বামীজিকে ভালবাসিলে অন্যকে ভালবাসিতে বাধা নাই। আর অন্যদের ভালবাসিলে তাঁর কাছে তা মিথ্যা হইয়া যায় না।” ( লিজেল রেমঁ। ভারতকন্যা নিবেদিতা ( অনু: নারায়ণী দেবী) প্রকাশক : সোমলতা,
পৃ: ১৯০)।
রাত গভীর হয়ে গেছে। সেজবাতির সামনে নিবেদিতা লিখে চলেছেন চিঠি। আগলহীন আবেগের প্রকাশ। উজাড় করে বলছেন তাঁর প্রিয় ‘জো’ কে। মিস জে ম্যাকলাউড। “I see what has happened – Tagores are won and perhaps the modern Brahmo Samaj are trembling on the verge but I have not yet sent an arrow into the family and church of K.C.Sen.” কেশবচন্দ্র সেনের কথা বলে একটু ভাবলেন। আরও কিছু কথা লিখে চললেন। নানা খবরাখবর। চিঠি শেষ করলেন — Your own own own loving child Margot. নিবেদিতা লিখলেন না। লিখলেন মার্গট!

নিবেদিতা তাকিয়ে আছেন বয়ে চলা গঙ্গার দিকে। এখন ভাঁটার টান। স্রোতের বিপরীতে মাঝিকে দাঁড় টানতে হচ্ছে। তার ঘামে ভেজা পিঠে রোদ পড়ে পিছলে যাচ্ছে। রোদ পড়েছে নিবেদিতার লাল হয়ে যাওয়া গালে। মেঘ ছেঁড়া সকালের রোদ।
উথালপাথাল করে ভেতরের সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ এসে জমা হচ্ছে যেন! কেন? কেন? তাঁর তো অতীত নিয়ে চলা উচিত নয়। তবে কেন? ছেঁড়া ছেঁড়া অতীত পাতাগুলি কেন ভেসে ভেসে আসছে চোখের সামনে?

[ক্রমশঃ]

[পর্বঃ ১]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জুন ২৪, সূচিপত্র]

3 2 ভোট
Article Rating
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
প্রতিভা
প্রতিভা
4 months ago

খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সূচিত হয়েছে, কীভাবে তার অবসান হয় তা জানবার আগ্রহ।

RAJAT KANTI CHAKRABORTI
RAJAT KANTI CHAKRABORTI
4 months ago

খুব ভালো লাগলো আপনার আগ্রহ।

Ivy Chattopadhyay
Ivy Chattopadhyay
3 months ago

আগ্রহ এবং কৌতুহল নিয়ে পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম । মুগ্ধ হয়ে পড়ছি ।

RAJAT KANTI CHAKRABORTI
RAJAT KANTI CHAKRABORTI
3 months ago

ভালো লাগলো। সঙ্গে থাকুন। পড়ান বন্ধুদের।