পর্বঃ ১

জুলাই মাসের ভোর। ভ্যাপসা গরম। বৃষ্টিও হচ্ছে। গুমোটও যাচ্ছে না। কাল সারারাত ঝিরিঝিরি বৃষ্টির পর ভোরবেলায় থেমেছে। আকাশ এখন কিছুটা পরিষ্কার। ভেজা হাওয়া গঙ্গার। পুবের আকাশ ধীরে লালচে হচ্ছে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে। এই সময় এই অঞ্চলের মেয়ে-বউরা গঙ্গাস্নানে যায়। নিচু গলায় তাদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে এই ছাদ থেকেই। পাখিরা জেগে উঠছে। চারপাশের গাছগাছালি থেকে পাখির ডাক শুনতে ভাল লাগে এই ভোরে। দোতলা পুরোনো বাড়ি। কালো কর্কশ ছাদ। মোরাম উঠেছে এখানে-সেখানে। খালিপায়ে চলা যায় না। কোথাও কোথাও শ্যাওলা ধরেছে। কোথাও পাঁচিল ক্ষয়ে বেরিয়ে এসেছে লাল ইটের গাঁথনি, যা কিনা এক রঙিন বৈচিত্র্য এনেছে একঘেয়ে ধূসর ছাদে। এই ছাদটা তাঁর খুবই প্রিয়। সামনেই সার দিয়ে আছে নারকেল গাছ। একটু বাদেই সূর্যের আলো এসে পড়বে। ঝিরিঝিরি শব্দের সঙ্গে শুরু হবে ঝিকিমিকি আলোর খেলা। শান্ত চারপাশ। শহরের এই দিকটায় গাছগাছালি অনেক বেশি।

চোখে পড়ে চওড়া বড় বড় বারান্দাওয়ালা সুরম্য বাড়ি। বাড়ির সামনে লোহার বড় গেট, কেয়ারি করা বাগান, তারপর গাড়িবারান্দা। বাড়ির পেছনে নানা ফলের বাগান। মালি, দারোয়ান, পাইক, পালকি নিয়ে এলাহি ব্যাপার! এসব বাবুদের বাড়ি।

পাশেই মধ্যবিত্তদের পাকাবাড়ি দেখা যায় ছড়ানো ছেটানো। যত্রতত্র। অগোছালো। গাছগাছালির ফাঁকে, সরু কাঁচা রাস্তার ধারে একতলা, দোতলা বাড়ি। নোনাধরা দেওয়াল, ভাঙা লালচে পাঁচিল, পাঁচিল ঘেঁষে রাস্তার কল। ছড়ছড় করে জল পড়ছে। তার পাশেই জঞ্জালের স্তূপ।

আর আছে ছাগল-গরু-কুকুর-মশা-মাছি নিয়ে চালাবাড়ি। ছোট ছোট চালাবাড়ির সংখ্যাই এ অঞ্চলে বেশি। মাটির দেওয়াল, খড়ের বা কাঠের টুকরোর চালাঘরের মাঝে উথলে উঠা আদুল সংসার। তাদের প্রেম-প্রীতি-সুখ-দুঃখ-ঝগড়া-বিবাদময় সংসার রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে যেন। রাস্তাটাই ওদের রোজকার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ময়লা শাড়ি শুকোচ্ছে রাস্তায়। ন্যাংটো, হাড়জিরজিরে কালো কালো অপুষ্ট ছেলেপুলের দল সার দিয়ে বসে পড়েছে সরু রাস্তার ধারের কাঁচা নর্দমায়। প্রাতঃকৃত্য করার কলকাকলিতে সকাল হচ্ছে। রাস্তার ধারে উনুনে আগুন দেওয়া হয়েছে। একটু বাদেই শহর জেগে উঠবে। ভিখারি আর ফেরিওয়ালার দল বেরিয়ে পড়বে। তাদের অদ্ভুত সুরের আওয়াজে পাড়া সরগরম হবে। গেরুয়া, লাল বা সাদা পোশাকে, কেউ-বা শুধু এক টুকরো কাপড় পরে গলায় হরেকরকম মালা, হাতে কমণ্ডলু বা ত্রিশূল বা দণ্ডী নিয়ে সন্ন্যাসীরা এ-পথ দিয়েই যাবেন গঙ্গাস্নানে। লালপাড় শাড়ির ঘোমটায় মুখ ঢেকে দ্রুত পায়ে ‘গঙ্গা নাইতে’ যাবে অল্পবয়সি এয়োরা। বয়স্ক মহিলা বা বিধবারা গঙ্গার ঘাট থেকে জল ছেটাতে ছেটাতে বাড়ি ঢুকবে। ছোঁয়াছানির ব্যাপার।

এসবই দেখা যায় এই ছাদ থেকে। এ-গলির জীবন। দোতলা ছাদের এই জায়গাটা অতি প্রিয় তাঁর। চারপাশে বড় বড় গাছের সার। পশ্চিমে বয়ে চলেছে গঙ্গা। গঙ্গা এই বাড়িটা থেকে একদম হাঁটাপথ। খুব কাছেই। ছাদে ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া। ছাদের পশ্চিম কোণে একটা সিমেন্টের ধাপি। ধাপির উপর আসন পাতলেন। চটের আসন, তার উপর উলের নকশা তোলা। আসনটি বানিয়েছিল উল্টোদিকের সেনবাড়ির বড় বউ। মেয়ের হাত দিয়ে পাঠিয়েছিল। ধীরে বসলেন আসনটির উপর ধ্যানে তিনি। গঙ্গার দিকে মুখ করেই বসেন। ঠান্ডা জলজ হাওয়া আসছে। বুক ভরে শ্বাস নিলেন। বীজমন্ত্র জপ করবেন।
গঙ্গার পুবে শহরের মাঝে বরাবর সমান্তরালে উত্তর-দক্ষিণে একটা চওড়া রাস্তা চলে গেছে। শহরের কেন্দ্রে যাবার মূল রাস্তা। সেই রাস্তা থেকেই কাঁচা সরু গলি এই বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে পশ্চিমে গঙ্গার দিকে। বাড়ি থেকে ডানদিকে কয়েক ঘর ডিঙিয়ে সেই বড় রাস্তা। শহরের কেন্দ্র থেকে এই অঞ্চলের দূরত্ব তা ক্রোশ খানেকের বেশিই হবে। ওই বড় রাস্তা ধরে সোজা দক্ষিণে হাঁটলেই শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে যাওয়া যায়। সে রাস্তা শহরের বুক চিরে যাবতীয় কোলাহল সঙ্গে নিয়ে চলেছে কেন্দ্রের দিকে। ঘোড়ায় টানা ডবল ডেকার, ঘোড়ার গাড়ি, জুড়িগাড়ি, গরুর গাড়ি, পালকির বেহারাদের কালো কালো দড়িপাকানো পা, হাঁটু অবধি তোলা ধুতি, খালি গা-পাঞ্জাবি-পাগড়ি-গামছা-পিরান সে এক রঙিন বেসামাল হট্টগোলময় জীবনযাত্রা চলেছে। আরেকটু দক্ষিণে এগোলেই আরেক ছবি। বিরাট বিরাট চামড়া রাস্তার ধারে লাইন দিয়ে পাতা। তার উপর কতগুলো জোয়ান ছোকরা জল দিয়ে ধামসাচ্ছে আঁচড়াচ্ছে লাফাচ্ছে। জলে জলাকার কাঁচা রাস্তা। দুর্গন্ধ চর্বিগলা জল বয়ে চলেছে মানুষের পায়ে পায়ে। চিৎকার চেঁচামেচির মাঝে ঠুকঠাক ঠকাঠক মুচিদের হাতুড়ির আওয়াজ উঠে আসছে। রাস্তার ধারে সার দেওয়া ছোট ছোট গুমটি। তাতে জোড়ায় জোড়ায় হরেক রকম জুতো ঝুলছে। এই অঞ্চলে নাক থ্যাবড়া চোখ বোজা হলদেটে ফরসা মানুষের বাস বেশি। এরা চিনা। চিনাপাড়া পেরোলেই রাস্তাটা একটু চওড়া হয়ে মিলছে এক বড় মসজিদের সামনে। ঝুড়ি ভর্তি করে লোহালক্কর রাস্তার ধারে রেখে ব্যাপারীরা ব্যাবসা করছে। তার পাশেই মিষ্টি-বরফ, বরফ-জল, মিঠাইয়ের পসরা। চারপাশে ডাবের খোলার স্তূপ, ছাগল-গরু আরামে চিবোচ্ছে। আর ডাবের স্তূপের উপর প্রায় নগ্ন একজন সিঁটকে লোক হাতে ধারালো কাটারি নিয়ে বসে আছে। অর্ডার হলেই ছপছপ করে কাটছে ডাব। ডাবের খোলায় উপচে পড়ছে কাঁচা নর্দমা রাস্তা। অনেকদিনই অলস বেলায় হাঁটতে হাঁটতে চলে আসতেন তিনি লোকের কৌতূহলী চোখ এড়িয়ে। এরপরেই রাস্তাটার ধারে দেখা যেত তালপাতার ছাতা। অনেক ছাতা, মাচা বা টুলের ওপর শক্ত করে বাঁধা। তার নীচে বসে আছে ইয়া গোঁফ-দাড়ি-পাগড়ি-লুঙ্গি-ঝকমকে পোশাকের বিশাল চেহারার কাবুলিওয়ালারা। তাদের ঝোলা প্যাঁটরা সামনেই রাখা। সুদের কারবারি। বিক্রি করে আখরোট, কাজু, কিসমিস এইসব। পায়ে পায়ে এই জায়গাটা পেরিয়ে গেলেই কানে আসে হারমোনিয়ামের সুর, তবলার ঠেকা, তানপুরা ছাড়ার মিহি আওয়াজ। সারেঙ্গী-বেহালা-সেতার সব মিলেমিশে এক এতোল বেতোল সুর-লহরী আছড়ে পড়েছে রাস্তায়। রাস্তাই এখানে জীবন। জীবনের টানা-পোড়েন, তার সুর-তাল-ছন্দ, সব সব কিছুই নেবে এসেছে রাস্তায়। তাই রাস্তা এত জীবন্ত। শুধু মাত্র বুকে ঠিকানার লেবেল আটকে প্রাণহীন প্রদর্শক নয়। রাস্তা এখানে জীবনের অপর নাম। এই শহরে আসার কিছুদিন বাদেই এই বোধ তাঁর হয়েছিল। দু’পাশে সার দেওয়া দোকানে বিক্রি হচ্ছে তানপুরা, সেতার, তবলা, খোল, করতাল এইসব। ছন্দ-সুর পেরিয়ে গেলেই মিষ্টির দোকান। ভিয়ানের গন্ধ, ছানার জল নাবছে রাস্তায়। কালো মোটা ময়রারা মাথায় গামছা বেঁধে বিরাট কড়াতে দুধ ফোটাচ্ছে। কাচের তিনথাকের আলমারি, তার ভেতরে পেতলের বড় বড় রেকাবিতে সাজানো মিষ্টি। মন্ডা, মেঠাই, সন্দেশ ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপরেই কাঁসা-পেতলের বাসনের পর্ব। তানপুরা-কাঁসা-পেতল-মিষ্টি সব মিলেমিশে তা মাইলখানেক। এরপর রাস্তাজুড়ে ফুলের গন্ধ। রজনীগন্ধা-জুঁই-বেলের গন্ধে ম ম করছে। একই রাস্তার কত গন্ধ কত বৈচিত্র্য। ভারত-দর্শন হয়ে যায় তাঁর। ফুলের পরেই বেদেদের খুপরি। আফিম আর পানের দোকান। শুকনো ব্যাং, গিরগিটি, কুমিরের চামড়া, মাছের আঁশ, গাছগাছড়া নিয়ে বেদেরা আছে কয়েক ঘর। তারপর কিছুটা ফাঁকা। ব্ল্যাকটাউন আর হোয়াইট টাউনের মাঝে যেন হাইফেন। কিছু গাছ। বড় বাগান ঝোপঝাড় নিয়ে নো-ম্যান্স ল্যান্ড। তারপরই এক বিপরীত ছবি। পাথর বাঁধানো রাস্তা। প্রত্যেক মোড়ে মোড়ে লাল পাগড়িওয়ালা পুলিশ। তাদের সাদা পোশাক। কোমরে মস্ত ছাতা আটকানো। পুতুলের মতো নড়াচড়া। মোটা মোটা থামের বড় বড় প্রাসাদ। শহরের এই অঞ্চলটি অনেক বেশি সাজানো-গোছানো। এখানে খালিগায়ের মানুষ খুব কম দেখতে পাওয়া যায়। সাহেবদের চলাফেরা বেশি। কেতাদুরস্ত ঘোড়ার গাড়িও এদিকে বেশি। সুন্দর বাগান নানান রকম ফুলের কেয়ারি করা। দোকান-পাট বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। নানা জিনিসের সম্ভার। মাঝে একটা বড় দিঘিকে ঘিরে সুরম্য অট্টালিকায় সুসজ্জিত শহরের এই অংশ। ঝাঁ-চকচকে রাস্তা। রোজ জল দিয়ে ধোয় ভিস্তির দল। সাদা মানুষ ঘোরেফেরে।

ছবিঃ আন্তর্জাল

এক পৌষের শীতে এই অঞ্চলেই প্রথম উঠেছিলেন তিনি। জানুয়ারির শেষে। বেশ আরামদায়ক ছিল আবহাওয়া। শহরের এই মধ্যস্থলেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। বন্দর থেকে এখানকার দূরত্ব তা মাইল দুয়েক হবে। বন্দরে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে একটা ছন্দে বাঁধা শব্দ শোনা গেল। আউর জোরে হেঁইও, মারো টান হেঁইও। কালো কালো নেংটি পড়া, মাথায় নীল ফেট্টি বাঁধা অনেক মানুষের সমবেত স্বরের আর্তনাদ যেন। জাহাজের ইঞ্জিনের আওয়াজ চাপা পড়ে গেল। জাহাজ থামল একসময়। বন্দরে প্রচুর ভিড়। অভ্যর্থনার জন্য অনেক মানুষ এসেছে। কেউ রুমাল নাড়িয়ে চলেছে। কেউ কেউ হাতে ফুল নিয়ে ঠেলাঠেলি করে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয় মানুষের দিকে। তামাটে মুখ। অদ্ভুত ভাষা। পুরুষদের পোশাক যেমন, তেমনই আশ্চর্য মেয়েদের পোশাক। হ‌ই-হুল্লোড়, চিৎকার, চেঁচামেচি, ঠেলাঠেলি। তিনি একটি হ্যান্ডব্যাগ আর ছোট্ট চামড়ার সুটকেস নিয়ে জাহাজের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন ধীরে ধীরে। বাঁ হাতে হ্যান্ডব্যাগ সমেত ধরে আছেন লম্বা গাউনের সামনেটা। সাদা সিল্কের ওপর লেসের কাজকরা ফুলস্লিভ গাউন। জুতো-মোজা পরা পায়ের চলনভঙ্গি শান্ত। গলায় সিল্কের স্কার্ফ সমুদ্রের হাওয়ায় উড়ছে। মাথায় ফুলতোলা বড় টুপি লেস দিয়ে থুতনিতে বাঁধা। চোখেমুখে কোনও ক্লান্তির ছাপ নেই। আছে কৌতূহল, বিস্ময়, ভাললাগা না-লাগার অতীত এক অনুভূতি। কাকে যেন খুঁজছেন তিনি!

এই শহরের প্রাণদায়ী বিস্তৃত রাস্তার পর্বে পর্বে আছে চৌরাস্তার মোড়। আর এক-একটা মোড়কে সামনে রেখে ভেতরদিকে বেড়ে উঠেছে পাড়া। সব পাড়াগুলোরই চেহারা প্রায় একই রকম। সামনের দিকে পাকা বড় বাড়ি-বাগান আর অলিগলিতে নোংরা ঘিঞ্জি আরেক কলকাতা। শহরের কেন্দ্র থেকে যত উত্তরদিকে যাওয়া যায় তত মানুষের হতশ্রী চেহারাটা প্রকট হতে থাকে। তারই মাঝে মাঝে প্রতিষ্ঠিত উচ্চবিত্ত জমিদার শ্রেণির বাঙালিদের বাস এই উত্তরেই। আর এই উত্তরেই তার জন্য দোতলা পুরনো বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সদর দরজা পেরোলেই উঠোন। ছাদ খোলা উঠোন ঘিরে ঢাকা বারান্দা। বারান্দা ঘিরে বড়বড় ঘর। সদরের পাশেই বৈঠকখানা। এক কোণে রান্নাঘর। তার সামনেই টিউবওয়েল বা টিউকল। দোতলায় মাত্র দু’টি ঘর। ছোট ছাদ বড় ছাদ মিলিয়ে পাঁচথাকে ছাদ। সে ছাদেরই একদম পূর্ব-পশ্চিম কোণে তিনি ধ্যানে বসেছেন। ছাদের এই জায়গাটা তুলনামূলকভাবে অনেক নিরিবিলি। রোজই এই সময় দীক্ষামন্ত্র জপ করেন। বীজমন্ত্র। দীর্ঘ তিন-চার বছরের অভ্যাস। কিন্তু আজ বারবার ধ্যান ভেঙে যাচ্ছে। বিচলিত তিনি। ক’দিন ধরেই মনটা বিক্ষিপ্ত। তাহলে কি হস্তরেখাই শেষ কথা বলবে!

দু’জনেই দাঁড়িয়ে রইল। মুহূর্তরা থেমে থাকে চুপচাপ। ‘কাম,’ বলে মার্গট দরজার একপাশে সরে দাঁড়াল। তরুণ আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল। মার্গট আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখল তাঁর বাংলা শেখার মাস্টারমশাইকে। তরুণ বয়স। উজ্জ্বল চোখ। তবে স্বামীজির মতো ভাবাবিষ্ট, বাঙ্ময়, অত বুদ্ধিদীপ্ত নয়। মাথার চুল থেকে দাঁড়ি-গোঁফ সবই কামানো। শুধু মাথার পেছন দিকের মাঝ বরাবর একগুচ্ছ চুল লম্বা করে রাখা। সাদা দু’ফালি কাপড় তার পোশাক। পা থেকে সারা গায়ে অদ্ভুত কায়দায় জড়ানো। জড়সড় হয়ে বসে আছে সোফায়। পার্কস্ট্রিটের এই বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশনের অতিথিদের রাখা হত। গতকাল মার্গট, মার্গারেট নোবেল, এসে উঠেছেন সকালে এই বাড়িটাতে। বিকেলে ডায়রিতে লিখলেন— ‘২৮শে জানুয়ারি, ১৮৯৮। আমি বিজয়িনী, শেষপর্যন্ত ভারতে এসেছি।’

জাহাজের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একটি চোখ খুঁজছেন শুধু। আগুনভরা সে-চোখে দেখেছিলেন একটা ডাক, সন্ন্যাসের ডাক, ত্যাগের ডাক, মানুষের সেবা করার ডাক। ইংল্যান্ডে মিস বুলের বাড়িতে শেষবিকেলের নরম লালচে আলোয় অপার্থিব পরিবেশ হয়েছিল। আর তাঁর মন্দ্র কণ্ঠস্বর। আজও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। ওই তো এগিয়ে আসছেন তিনি। গেরুয়া আলখাল্লা। গেরুয়া পাগড়ি। একটু কি রোগা হয়েছেন! লম্বা দেখাচ্ছে আগের থেকে বেশি! তবে চারপাশের আর সব মানুষের থেকে বলিষ্ঠ তাঁর গড়ন। সটান এগিয়ে আসছেন বড় বড় পা ফেলে। তিনি বেশ গম্ভীর। মার্গট উচ্ছ্বাসে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসছিলেন। সংযত হলেন। স্বামীজির মতোই পোশাকে আরেকজন সঙ্গে আছেন। সে এগিয়ে এসে মার্গটের গলায় মালা পরিয়ে দিলেন। মার্গট একবার মালার দিকে, একবার স্বামীজির দিকে, একবার তরুণ সন্ন্যাসীর দিকে হতবাক হয়ে তাকায়। মালাতে হাত বোলায়। সুন্দর গন্ধ। জড়ো করে নাকের কাছে আনে। গোলাপ, জুঁই, আর মাঝে মাঝে জরি। মালা গলায় নিয়েই ওদের সঙ্গে হাঁটতে থাকে। স্বামীজি একবার শুধু জিজ্ঞাসা করলেন – ‘পথে অসুবিধা হয়নি তো?’ মার্গট শব্দহীন, শুধু ঘাড় নেড়ে জানালেন – না। তিনি তো সমস্ত কষ্টের অন্তিমে এসেছেন। অথবা মহান কষ্টের সামনে দাঁড়ালেন। এ দুইয়ের মাঝে বিস্তৃত বোধহীন ভেসে যাওয়ার সময়, দুঃখ-কষ্ট-মান-অপমান-রাগ-আনন্দ ইত্যাদির অতীত এক অতীন্দ্রিয় চলা। পরিণাম সম্পর্কে প্রশ্নহীন সমর্পণের পথে চলা।

ছবিঃ আন্তর্জাল

মার্গট অবাক চোখে চারপাশ দেখছে। ভিড়, ঠেলাঠেলি, ঘেঁষাঘেঁষি। ধীরে এগোচ্ছে তারা কাস্টমসের গেটের দিকে। অদ্ভুত লাগছে মানুষদের পোশাক। এত রকম পোশাক! মেয়েদের ঘোমটা টানা পোশাক। মজাও লাগছে। ঠেলাগাড়ি, গরুর গাড়ি, জুড়িগাড়ি সব চলছে। তার মাঝে মাল বোঝাই কুলির হাঁকডাক। জুড়িগাড়ির কাঠের চাকার আওয়াজ, কোচোয়ানের গলার আওয়াজ আর চাবুকের আওয়াজ মিলে এক আশ্চর্য শব্দমাহাত্ম্যে ভিড়ের মধ্যদিয়েই তিনজনকে নিয়ে জুড়িগাড়ি এগিয়ে চলল।

মার্গট অবাক দেখছিল কলকাতা। হালকা শীতের আমেজ জড়িয়েছে গায়ে। দু’পাশে ঝোপঝাড় গাছপালা। পাকা বাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আছে টুকরো কাঠের ছাদওয়ালা মাটির বাড়ি। সবুজ দু’পাশ। নানা ফুল। ফুলের হাসি নিয়ে খালিপায়ে হাড়গিলে শিশুরা দৌড়চ্ছে। দাওয়ায় বৃদ্ধ বসে আছে উদাস। মাথায় কাপড়-ঢাকা মেয়েরা এদিক ওদিক ত্রস্ত চলে যাচ্ছে। ছাগল গরু দৌড়ে সরে যাচ্ছে। সবারই বস্ত্র মলিন। সম্ভ্রান্তরা আছে। কম। বেশ কিছুটা আসার পর চারপাশটা গেল পাল্টে। একটু সাজানো গোছানো বড় বড় বাড়ি। পাথরের রাস্তায় সাদা দাগ দেওয়া। মানুষের চেহারা-ছবিও পাল্টে গেল দ্রুত। পুরুষদের পোশাকে অদ্ভুত বৈচিত্র্য। কার‌ও মাথায় পাগড়ি, কার‌ও নেই, কার‌ও গায়ে কোট, কেউ চাদর জড়ানো। তাদের জুড়িগাড়ি যে চালাচ্ছে, তারও পোশাক অদ্ভুত। একটু মজা পেল মার্গট। আড়চোখে দেখল স্বামীজিকে।
স্বামীজি তাকালেন – ‘লন্ডনের বন্ধুরা কেমন আছে মার্গট? মা?’
কোচোয়ানের ঘাড়ে, পাগড়ির শেষে, ঝাঁপিয়ে পড়া বাহারি চুলের থেকে চোখ সরাল মার্গট – ‘ভাল।’

চৌকো কাঠের বাক্সে বসে আছেন তিনজন। খড়িখড়ি দেওয়া কাঠের জানালা দিয়ে মার্গট দেখছিল কলকাতা। হঠাৎ সামনের ও পেছনের কোচোয়ানদের বিকট গলায় চিৎকার এবং কাঠের মচমচ শব্দের সঙ্গে গাড়ির বেসামাল দুলে ওঠায় সম্বিত এল মার্গটের। গাড়ি থামল একটি দোতলা বাড়ির সামনে।
‘মার্গট, আজকের দিনটা বিশ্রাম নাও, কাল থেকেই কাজে নেমে পড়ো। কাল থেকেই তুমি বাংলা শিখবে। এখানে কয়েকদিন থাকো। এই পাড়াটা সাহেবদের পাড়া। পার্কস্ট্রিট। এখানে আমাদের বিদেশি অতিথিরা থাকেন। তোমারও মানিয়ে নিতে সুবিধা হবে।’
স্বামীজিকে অনেক নিয়ন্ত্রিত মনে হচ্ছে। ঘরটা গোছানোই ছিল। খাট-আলমারি সমেত সাধারণ আসবাবপত্র। বেশ পরিপাটি। আড়ম্বরহীন কিন্তু প্রয়োজনীয় সবকিছুই যথাযথ। বড় জানালা। জানালা দিয়ে দেখা যায় রাস্তা। রাস্তার ওপাশে রকমারি দোকান। অন্যদিকের জানালার পাশে সবুজ সমারোহ। লতানে গাছে থোকা থোকা ফুটে আছে নাম-না-জানা ফুল। ক্লান্তি জড়িয়ে ধরছে শরীর। তবু মার্গটের ভাল লাগছে। সে মানুষের জন্য কাজের ডাকে আসতে পেরেছে। এইটুকুনি রাস্তা পেরিয়ে আসতে আসতেই তার চোখ এড়ায়নি দারিদ্র্য। কিন্তু স্বামীজি? স্বামীজি এ-বাড়ির কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে, কিছু নির্দেশ দিয়ে চলে গেলেন কখন জানতেই পারেননি মার্গট। নিজের দেশ, পরিবার, বাড়ি, যাপনযোগ্য এক সুস্থির জীবন ছেড়ে দিয়ে চলে এলেন এক অজানা দেশে। না ভাষা, না রীতি-নীতি, না পোশাক কিছুই জানেন না। কিছুই চেনেন না। একমাত্র চেনেন স্বামী বিবেকানন্দকে। তিনিই শেখাবেন এই নতুন দেশে চলার চলন। কিন্তু সেই তিনি! চোখ ছাপিয়ে জল গাল বেয়ে গড়াচ্ছে মার্গটের। শীতের সন্ধ্যা আচমকা নেবে পড়েছে বাইরে। মার্গট নিজের অজান্তেই শরীর এলিয়ে দিয়েছিলেন বিছানায়। সেজবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে ঘরে কেউ। টেবিলে ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে খাবার। একা লাগছে। ভীষণ একা। বাইরে রাস্তায় সার সার মৃদু আলো জ্বলছে। লোহার পোস্টের মাথায় নক্সা করা কেরোসিনের ল্যাম্প। ম্লান আলোয় ভুতুড়ে লাগছে এ শহর। দূরে কোথাও সমস্বরে শিয়াল ডেকে উঠল। সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এ কোন অন্ধকার দেশ! জাহাজের সহযাত্রীদের কথা বারবার মনে ঘা মারছে—ভারতবর্ষ ভয়ংকর জায়গা, সবসময় সতর্ক থাকতে হবে, প্রতিপদে বিপদ ঘাপটি মেরে আছে। ঘুমহীন জলভরা চোখে মার্গটের প্রথম রাত কাটল ভারতবর্ষে, এক ঘোর আতঙ্কময় স্বপ্নে।

ভোর হল। পাখি ডাকছে। হিমেল হাওয়া আসছে। চোখে-মুখে ঠান্ডা স্পর্শ। মার্গট বিছানা থেকে উঠলেন। একটা ছোট্ট পাখি মিষ্টি সুরে জানালার ধারেই ডাকছে। কতগুলি চড়ুই কিচিরমিচির জুড়েছে। জানালার ধারে এসে দাঁড়ালেন। নাম না জানা ফুল ফুটেছে নানা গাছে। এই তো মাস ছ’-সাত আগেই তিনি লিখেছিলেন, সব চিঠি বারবার পড়ে পড়ে মুখস্থ হয়ে গেছে— ‘ভারতবর্ষ আজও মহীয়সী নারী সৃষ্টি করতে পারেনি। অন্য দেশের কাছ থেকে এ জিনিস তাকে ধার করে আনতে হবে। তোমার শিক্ষা, আন্তরিকতা, পবিত্রতা, বিপুল মানব-প্রেম, সংকল্পের দৃঢ়তা – সবচেয়ে বড় কথা তোমার কেল্টিক রক্তের তেজ – এইসব আছে বলে এদেশের জন্য যেমন মেয়ে চাই, তুমি ঠিক তেমনই।’ ১

তাহলে মানিয়ে নিতে হবে। তার আগে দেখতে হবে। বুঝতে হবে। এ দেশের আবহাওয়া, রীতিনীতি, আচার-বিচার, পোশাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া সব সবকিছু নিজের করতে হবে। তার জন্য দরকার খোলা চোখ আর গ্রহণ করার মতো মন। এক শূন্য আধার। সব ত্যাগ করে শূন্য আধার নিয়েই এখানে আসা পূর্ণ হবার জন্য। মাথার উপর তিনি – ‘আমি আমরণ তোমার পাশে আছি — তা তুমি ভারতের জন্য কাজ কর বা না কর, বেদান্ত রাখ বা না রাখ। ‘মরদকী বাত হাতীকা দাঁত’ — একবার বেরুলে আর ভিতরে যায় না। পুরুষের কথার নড়চড় হয় না।’ ২

ঝাপসা হয়ে আসে চোখ নিবেদিতার।

‘কাম’ বলার পর তরুণ সন্ন্যাসী ঘরের ভেতর ঢুকে দাঁড়িয়ে রইল। মার্গট বুঝতে পারছে না সে ইংরেজি বুঝতে পারছে কি না। ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে হাসিমুখে তাকালেন তরুণের দিকে। তরুণ টেবিলের উপর দুটো ছোট বই রাখল। চেয়ারে বসল। তরুণ খুব সহজ ইংরেজিতে কথা শুরু করল।
‘এটা ঠাকুরের বই।’
‘কোন ঠাকুর? যিশু? কৃষ্ণ?’
‘না, ঠাকুর রামকৃষ্ণ।’
মার্গট একটু লজ্জা পেল। ভাল করে দেখছিল তরুণ শিক্ষককে। স্বরূপানন্দ। নিবেদিতার প্রথম বাংলা শিক্ষক। সুন্দর ইংরেজি বলেন। লাজুক একটু, কিন্তু বেশ ব্যক্তিত্ব আছে। সৌম্য শান্ত।

ঠক, ঠক, ঠক। এত ভোরে কে এল! চমকে উঠলেন নিবেদিতা। এমনিতেই আজ কেন যে ধ্যানে মনঃসংযোগ রাখতে বিঘ্ন হচ্ছে। বীজমন্ত্র উচ্চারণে পড়ছে ছেদ। বিক্ষিপ্ত হচ্ছে মন। বারবার ফিরে ফিরে আসছে স্মৃতি। কেন কেন উতলা হচ্ছে মন! আবেগকে সংযত করার কৃচ্ছ্রসাধন অনেক করেছেন। তবুও আজ! এই ভোরে…!

ঠক, ঠক, ঠক। ঠিক শুনেছেন তিনি। এই বাড়িরই সদরের দরজায় কড়া নাড়াল কেউ। ধ্যান অসমাপ্ত রেখেই উঠে পড়লেন তিনি। ঝি আসেনি! ঝি এলে শেকল নাড়িয়ে আওয়াজ করত, সঙ্গে অদ্ভুত সুরে ডাক –ওওও যোগীনের মাআআআ! অন্য কেউ এল! মনটা ডুকরে উঠল। তাড়াতাড়ি উঠে ছাদের পাঁচিলে ঝুঁকলেন। নীচে উঠোন। উঠোন ঘিরে চারদিকে ঢাকা বারান্দা। বারান্দার থামের উপরে উপরে পায়রাদের বকবকম চলছেই। উত্তরে সদর দরজা। যোগীনের মা গিয়ে দরজা খুলল। মঠের এক তরুণ সন্ন্যাসী এসেছে। কেঁপে উঠলেন তিনি। দ্রুত ছাদ থেকে নামলেন। ধীরে উঠোন পেরিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে আবেগ সংযত করলেন। গুছিয়ে নিলেন নিজেকে একটু। ভেতরে হিমশৈল ভেঙে পড়ার আওয়াজ। তরুণ তাঁর হাতে একটা ভাঁজ করা কাগজ দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রাত জাগার কালো ক্লান্তি তার চোখেমুখে ।
‘তুমি একটু বসো’, বলেই দ্রুতপায়ে উঠে এলেন নিবেদিতা নিজের দোতলার ঘরে। ভেতরে হিমশৈল ভেঙে পড়ার আওয়াজ। দীক্ষামন্ত্র জপ করে নিজের শক্তি সঞ্চয় করছেন। ধীরে ধীরে চিঠিটা খুললেন।

My dear Nivedita
The end has come.
Swamiji has slept last night at nine, never to rise again.

Yours affy

S.S

S.S – স্বামী সারদানন্দ এর স্বাক্ষরিত এই চিঠি। আজকের তারিখ লেখা চিঠির ডানদিকের কোণে উপরে – 5/7/1902 । চিঠিটি আবার পড়লেন। সামনে সাদা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

শূন্য। কৃষ্ণগহ্বর যেন গ্রাস করল নিবেদিতাকে। রুমালে মুছে নিলেন চোখ। একটু বসলেন চৌকির উপর পাতা বিছানায়। জানা ছিল না যে, তা নয়। শরীরটা খারাপই ছিল ক’দিন ধ’রে। গত বুধবার গিয়েছিলেন নিবেদিতা বেলুড়মঠে। গত কাল, শুক্রবার তিনি খবর পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি সুস্থ আছেন। আর রাত্রি ন’টায়…।
ধীর পায়ে নেবে এলেন সিঁড়ি দিয়ে। নিচের ঘরে চৌকির উপর ব’সে ছিল তরুণ সন্ন্যাসী। মাটিতে ব’সে কাঁদছে যোগীনের মা।

সন্ন্যাসী নিবেদিতাকে অনুসরণ করল। পেছন পেছন যোগীনের মা। কেউ কোনো কথা বলছে না।

সকাল হচ্ছে বাগবাজারে। বাগবাজারের গঙ্গার ঘাটে লোক সমাগম হচ্ছে। নিবেদিতাকে এই এলাকার মানুষজন সহজ ক’রে নিয়েছে অনেক এখন। কিন্তু আজ যেন পাথরপ্রতিমা। ভোরের নরম আলো মেঘের আড়াল ভেঙে কমলারঙের গাউনে ঢাকা নিবেদিতাকে আরো উজ্জ্বল ক’রে তুলেছে। ফরসা গাল টকটকে লাল। থুতনিতে জমা হচ্ছে স্বেদবিন্দু। স্থীর চোখ গেরুয়া গঙ্গার জলে। ঘাটে বাঁধা নৌকায় বসলেন। নৌকা ঘাটে বাঁধা রশি খুলে ভেসে পড়ল। মরা আলোর স্রোতে গঙ্গা। স্রোত বৈঠার আঘাতে বারংবার ভাঙ্গছে, গড়ছে, ভাঙ্গছে।

চাঁদ ভাসছিল সেদিন গঙ্গায়। মৃদু হাওয়া বইছে। দক্ষিনেশ্বর আর বেলুড়ে নিলাম্বর বাবুর পুরোন বাড়ির মাঝে গঙ্গা। নৌকা স্থির। চাঁদের আলোয় নিবেদিতার সাদা গাউন আরো সাদা লাগছে। আজ নিবেদিতার মনও অনেক বেশি উজ্জ্বল। জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হল। সামনে ব’সে আছেন বিবেকানন্দ। তাঁর মাথার পেছনে অন্ধকারে জেগে উঠেছে দক্ষিনেশ্বরের মৃদু আলো। গেরুয়া পোষাকে বিবেকানন্দ। মাথার চুল ছোট ক’রে ছাঁটা। আজ সকাল থেকে অনেক ধকল গেছে। কিন্তু ক্লান্ত লাগছে না তাঁকে। বরং প্রাণবন্ত লাগছে। নিবেদিতার মনে অজস্র কথা স্রোতের মত বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু কোনটা আগে, কোনটা পরে, কোনটা সময়োচিত হবে এইসব ভাবতে ভাবতে সময় চলে যাচ্ছে। তবে এই আদিগন্ত খোলা আকাশের নিচে, জোৎস্নায় ভেসে যাওয়া গঙ্গার উপর নৌকায় চুপ ব’সে থাকাও ভালো লাগছে। মুখোমুখি যখন স্বামীজি স্বয়ং। নীরবতা মাঝে মাঝে অপার্থিব হ’য়ে ওঠে। বাঙময় হয়ে ওঠে।

ভোর থাকতে উঠে চান-টান ক’রে সকাল সকাল চলে এসেছেন নিবেদিতা বেলুড়মঠে। মঠ বলতে বেলুড়ে গঙ্গার ধারে বাগানময় নীলাম্বর বাবুর পুরনো বাড়ি। এটাই কিনে সাড়ানো হ’য়েছে। বিবেকানন্দ ক’য়েকজন শিষ্যকে নিয়ে এখানেই থাকছেন। এই দোতলা বাড়িটিই এখন মঠ। বাড়ির সামনে সবুজ ঘাস বিছানো প্রশস্ত অবিন্যস্ত বাগান। বড় বড় আম-জাম-বাবলা গাছ। ফুলের গাছ ইতস্তত। অযত্নের আগাছা চারপাশে। চোরকাঁটাতে বাঁকা সবুজ মাঠ। তবে সবুজে ঢাকা গঙ্গা লাগোয়া এই জায়গা দেখে উচ্ছসিত হ’য়েছিলেন নিবেদিতা। ক’দিন আগে মিসেস হ্যামন্ডকে লিখেই ফেললেন – ‘গতকাল তাঁর (স্বামীজি) অতিথি হিসাবে পিকনিক করলাম সুন্দর এক নদীর তীরে (গঙ্গাতীর), যে জায়গাটি মিস মূলার মঠ তৈরীর জন্য স্বামীজিকে কিনে দিচ্ছেন। জায়গাটি ঠিক উম্বলডন কমনের কোন একটি অংশের মতই- গাছপালাগুলোকে খুব খুটিয়ে নজর না করলে তফাৎ ধরা পরেনা। এখানেই মঠের কাজ চলছে।’

ভোরে নিবেদিতা স্নান করে পৌঁছলেন বেলুড় ঘাটে। দিনটা ছিল ২৫ মার্চ ১৮৯৮। স্বামীজি একতলায় পুজোর ঘরে নিয়ে গেলেন নিবেদিতাকে। তখনও পুজোর ফুল আসেনি। নিবেদিতা বসলেন। দু’টি আসন পাতা। স্বামীজি পাশে। বিবেকানন্দ গল্পের ছলে বলছিলেন বুদ্ধের কথা। তথাগত হয়ে উঠার কাহিনি। নিবেদিতা তন্ময়। ধূপ জ্বলছে। ধুনো। প্রদীপ । সব মিলেমিশে একটা গন্ধ। এক ঝুড়ি টাটকা ফুল দিয়ে গেল এক সন্ন্যাসী। পাপড়িতে পাপড়িতে জলবিন্দু। ফুল দিয়ে শিবমুর্তিকে সাজালেন বিবেকানন্দ। পাশে বুদ্ধের মুর্তি, সাজালেন। নিবেদিতা অপলক। কত যত্নে, মমতায় বিবেকানন্দ আলতোভাবে ফুলগুলি দিয়ে সাজিয়ে তুলছিলেন তাঁর দেবতাকে। আসনে শিরদাঁড়া সোজা করে বসলেন তিনি। উদাত্ত কণ্ঠে শিবমন্ত্র উচ্চারণ করলেন। স্বরের ওঠানামা সংগীতের আবহ তৈরি করল। নিবেদিতার দু’হাতের তালুর মাঝখানে ধরা আছে ফুল। ঘেমে উঠছে হাতের তালু। ভিজে যাচ্ছে ফুল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে নামছে গাল বেয়ে। স্বামীজি যখন যেমন বলছেন তখন তেমনভাবে শিবলিঙ্গের কাছে রাখছেন ফুল। বুঝছেন, এটা worship of Lord Shiva। পাশে বুদ্ধমূর্তি।
মার্গট নোবেল হলেন নিবেদিতা।

নৌকা এগিয়ে চলেছে ছলাৎ ছলাৎ। নিবেদিতা তাকিয়ে আছেন গঙ্গার স্রোতের দিকে। বয়ে চলেছে কত সহস্র অনুচ্চারিত শব্দমালা নিয়ে। নৌকা এগিয়ে চলেছে বেলুড়ের দিকে। বড্ড শব্দহীন। চারপাশে শুধু দাঁড়ের শব্দ। শুধু যোগীনের মায়ের ফোঁপানির শব্দ। নিবেদিতা ভেসে চললেন।

——————————
১. বিবেকানন্দের চিঠি নিবেদিতাকে ২৯ জুলাই, ১৯৯৭, অনুবাদ শঙ্করীপ্রসাদ বসু।
২. বিবেকানন্দের ২৯ জুলাই ১৯৯৭-এর ওই চিঠির শেষ অংশে বলছেন তিনি নিবেদিতাকে।

[ক্রমশঃ]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, মে ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
7 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
প্রতিভা
5 months ago

গদ্যের চলনটাই খুব আশ্চর্য করে দেয়। লিনিয়ার তো নয়ই, কেমন উদাসীন, যা বলা হচ্ছে তার সঙ্গে ন্যারেটরের যেন কোনও সংপৃক্তিই নেই। অনেক দূর থেকে তিনি দেখছেন এবং নির্মোহ ভাবে বলে যাচ্ছেন। কোনও চরিত্রের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নেই। খুব আগ্রহ রইল।

প্রচুর টাইপো নজরে পড়ল। এত চমৎকার ম্যাগাজিন, আমি এবার প্রথম পড়ছি, এই টাইপোগুলো মন খারাপ করে দেয়।

সম্পাদকীয় দপ্তর

আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। লেখাটি পরিমার্জন করা হল। আশাকরি ভুলগুলি দূর হয়েছে।
সঙ্গে থাকবেন।

Rajat Chakraborti
Rajat Chakraborti
4 months ago

খুব ভালো লাগলো। আসলে এনাদের দেখছি তো দূর থেকেই। কাছে তো যাওয়ার পথ নেই। আর যে পথ নির্মিত আছে তা বড্ড একপেশে গদগদ। কী আর করা! যেতে হবেই।

অরিন্দম গোস্বামী
অরিন্দম গোস্বামী
5 months ago

কাহিনির চলন খুব আকর্ষণীয়। কখনো সামনে, কখনো আবার পেছনে নিজের খেয়ালে চলেছে। এক মুহুর্ত শৈথিল্য প্রদর্শনের উপায় নেই। প্রারম্ভিক পর্যায়ে যথেষ্ট আগ্রহ সঞ্চালনায় লেখক সফল। পরবর্তী পর্যায়ের অপেক্ষায় রইলাম।

Rajat Chakraborti
Rajat Chakraborti
4 months ago

ভালো লাগলো। সঙ্গে থাকুন। একসাথে চলি কিছুটা।

কাকলি দেবনাথ
কাকলি দেবনাথ
4 months ago

খুব সুন্দর বর্ণনা। শব্দ দিয়ে দেন ছবি আঁকা হয়েছে । পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

Rathin Chakraborty
Rathin Chakraborty
4 months ago

বাঃ! রাস্তার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকা জীবনের এত ডিটেলস বর্ণনা কখন যে মোচড় নিয়ে অন্য প্রেক্ষিতে এনে ফেলল বুঝতেই পারলাম না। আর তারপর? স্বামীজি তো চলে গেলেন, নিবেদিতার ভিতরে ঝড়, কিন্তু বাইরে পাষাণ মূর্তি হয়ে বসে আছেন। অনুভব করছি সেই সব। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকব।