যে দুনিয়া আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ,যা আমাদের বিনোদনের তাকে নিয়ে আমাদের কৌতুহল চিরকালীন। সেই সব জীবনের আনাচে কানাচে আলো ফেলেছেন লেখক। আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেই মায়াবী দুনিয়া।
প্রথম গল্প ‘ ইন্ড্রস্ট্রি’ তে আমরা কেরিয়ারের ওঠা নামার এক পরিষ্কার ছবি দেখতে পাই। এই গল্পের নায়িকা মনোরমা, তার উত্তরণের কাহিনী যেমন আছে তেমনি আছে উত্তরণের পেছনের নিজেকে বিকিয়ে দেবার গল্প। শরীরের অলিগলিতে লুকিয়ে রাখা রহস্য কে মূলধন করে ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে নিয়েছে মনোরমা। কিন্তু নায়িকা প্রধান গল্প হলেও তাকে ছাপিয়ে যায় নায়ক নীলাদ্রির অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা। ‘টি আর পি,”ওয়ান লাইনার’ সিরিয়ালে অপরিহার্য এই শব্দগুলোর সাথে আমাদের পরিচয় হয় এই গল্পটিতে । ‘হিরোইনের সঙ্গে মাপা খুনসুটি ‘এই বাক্যবন্ধে যে টুকু বলা হয়েছে তার গভীরে না বলা কথা আছে ঢের।এই গল্পে যেন টিভির মেগা সিরিয়াল কে অতিক্রম করে জীবনের মেগা সিরিয়ালের দুঃখ সুখ ভোগ প্রাচুর্য যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে চমৎকার। চৈতালীর যন্ত্রণা কাতর মুখ দেখে আমাদের আবার মনে পড়ে যায় সেই আপ্ত বাক্যটি ,প্রদীপের নিচেই থাকে সবচেয়ে বেশি অন্ধকার।
খুব সুচারু বুননে গাঁথা এই গল্প পড়েই অন্য গল্পে পৌঁছানো যায় না। বই বন্ধ করে চুপচাপ ভাবতে ইচ্ছে করে। নীরবতা দাবি করে পাঠকের কাছে এই গল্প।

দ্বিতীয় গল্প, ‘রিমঝিম রয়’ শুরু হয়েছে চিঠি দিয়ে। না না ঠিক চিঠি নয়, চিঠির আধুনিক সংস্করণ ই মেল দিয়ে। দুটো মনের মধ্যে সেতু বাঁধতে চিঠি অতুলনীয়। নব প্রজন্মের কাছে সাবলীল ভাবে এই কাজটাই করে চ্যাট বা ইমেল।
এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইন্দ্র সদ্য যুবক হবার পরে প্রকাশ্যে অকারণে অপমানিত হয় এক যুবতীর হাতে।তার মনজগতে ঘটে যায় তুমুল আলোড়ন। সে শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে মহিলাদের প্রতি। তার প্রতিফলন পড়ে তার স্বভাবে চরিত্রে। পাড়ার সাইবার ক্যাফে ‘দি ডিজিটাল’এর মালিক কিশোরের সাথে সে অন্যায় নোংরা কাজে জড়িয়ে পড়ে।
সেই সময়েই তার সাথে অন লাইনে বন্ধুত্ব হয় রিমঝিম নামের একটি মেয়ের। একদা যার তুমুল ক্ষতি করেছিল ইন্দ্র নেহাতই মজার ছলে,অজান্তে সেই তার ভালোবাসার মানুষ জানতে পেরে সে স্তম্ভিত।দুষ্কর্মের মূল্য চোকাতে গিয়ে সে হারিয়ে ফেলে রিমঝিম কে। প্রেম কতভাবে প্রবঞ্চনা করতে পারে ,আধুনিক প্রযুক্তি কী ভাবে সর্বনাশের অতলে ফেলে দিতে পারে সরলমতি যুবতীকে তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই গল্প। পড়তে পড়তে গা শিউরে ওঠে।
এখানে পুরুষের রাগ ,প্রতিশোধ স্পৃহা লেখক যে ভাবে বলিষ্ঠ কলমে ফুটিয়ে তুলেছেন ঠিক সেই ভাবেই নারীর মনের কোমলতার পিছনে দৃঢ়চেতা মনের প্রকাশও দেখিয়েছেন।
এক অঝোর বর্ষার দিনে লেখক প্রেমিক ইন্দ্রকে ফেলে দিলেন এক মারাত্বক দোলাচলের মধ্যে আর আমাদের কে নাছোড় পিছুটানের মধ্যে। এরপর থেকে ঝরঝর বাদলের দিনে কোনো জলপরির মত মেয়ে দেখলেই পাঠকের মনে হবে আচ্ছা রিমঝিম রয় নয় তো? গল্প কে এভাবেই বাস্তবের সাথে মিশিয়ে দিতে পেরেছেন লেখক।

সংগ্রহ করতে ছবিতে ক্লিক করুন


পরের গল্প’ রুপোয় মোড়া আকাশ’এর নামেই এই গল্পের বইয়ের নামকরণ হয়েছে। এটি একটি ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। লোভ,রিরংসা ,প্রেমপ্রেম খেলা এই গল্পে গায়ে গা লিগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এটি একটি বার সিলভার স্কাই এবং বার সিঙ্গারদের গল্প। এক একটা সন্ধে সুর কে কেন্দ্র করে সূরা এবং রমণীতে কিভাবে রমনীয় হয়ে উঠতে পারে, তারই প্রকাশ এই গল্পে ।সাধারণ মধ্যবিত্তের ধ্যানধারণা এবং ধরা ছোঁয়ার বাইরে এই এক বিলাসী জগত। যার নাগাল পেতে গেলে পকেটের জোর থাকতে হয়।

লেখকের হাত ধরে আমরা যখন এই বারে এসে দেখি
প্রথমে গান তারপর প্রেমের অভিনয় করে সায়নকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে বার সিঙ্গার পামেলা ।।অন্যদিকে পুরনো বার সিঙ্গার স্বপ্নার সাথে সায়নের মেলামেশা কাস্টমার এবং সিঙ্গারের গণ্ডি ছাড়িয়ে গভীরতায় পৌঁছে গিয়েছিল। নতুনত্বের লোভে সে পামেলাকে ভালবাসতেই একটা ত্রিকোণ প্রেমের সূচনা হয়ে গেল । আর কে না জানে ত্রিকোণ প্রেম মানেই প্রতিহিংসা অনিবার্য। গল্পের শেষে এসে খুন হয়ে গেছে স্বপ্না। এবং পামেলা স্বীকার করেছে যে সে ভালোবাসার অভিনয় করে গেছে সায়নের কাছে। স্তম্ভিত সায়ন ভালোবাসার সংজ্ঞা বদলাতে চেয়ে ক্রীড়নক হয়ে যায়। হতাশায় সে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে ।

সত্যিই এক রুপোয় মোড়া আকাশ আমরা দেখি গল্পের পরতে পরতে। যে আকাশের নাগাল সাধারণ মধ্যবিত্তরা কখনোই পায় না, হয়তো বা পেতেও চায়না।
ভিন্ন স্বাদের এ গল্প পড়ে মনটা বিষন্নতায় মাখামাখি হয়ে যায়।

চতুর্থ হেল্প ‘লিপস্টিকে লক্ষ্যভেদ’ যেন এক কমার্শিয়াল ব্রেক। আগের তিনটি গল্প শেষ করে ভারাক্রান্ত মনে চুপটি করে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই গল্পটি শেষ করে মনে হচ্ছে,এক কাপ চা হলে ভালো হতো। এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত। মনটা কে এতটাই ফুরফুরে করে দিতে পেরেছে এই গল্প।
এই গল্প আমাদের কলেজে জীবনের কোলাজ।আমরা যেন ফুটে উঠতে দেখলাম আমাদেরকেই।
একদল টগবগে ফার্স্ট ইয়ারের বন্ধুরা লিপস্টিকের ভূমিকা নিয়ে বাক্য জাল বিস্তার করেছে। লিপস্টিক থাকলে ঠোঁট থাকবে। আর ঠোঁট আর চুমু একে অপরের পরিপূরক। কাজেই গল্পে চুমুও এসেছে। এবং মধুরেন সমাপয়েৎ হয়েছে আড্ডাটি কলেজ করিডোর থেকে কলেজ ক্যান্টিনের দিকে যাত্রা করে….
লিপস্টিক নিয়ে এত সুন্দর গল্প লেখা যায় ভাবা যায় না!

‘রাজকুমারী রঞ্ঝাবতী’ গল্পে অনেক দূরের অতীত ফিরে এসেছে। নির্জন অরণ্যের শোভা, সেখানে নৃত্যরতা রাজকুমারী,তাঁর নৃত্য শিক্ষিকা এবং রাজপুরীর আলোর কারিগর বিজয় সেন এর মানসিক ঘাত প্রতিঘাতে এই গল্পটি রচিত। গল্পটি পড়তে পড়তে আমার ‘শব্দ ‘ সিনেমাটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। কি অপূর্ব ভাবে যে আলোর সৃষ্টি করার করা যেতে পারে প্রাকৃতিক কৌশলে এবং নিত্য ব্যবহার্য জিনিস দিয়ে তার দারুন পরিচয় এই গল্প। তার সাথে মানুষের আদিম প্রবৃত্তি প্রেম ভালবাসা লোভ হিংসা মানের দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে এই গল্পে।
‘মন খারাপের রং’ গল্পে রাম্প শো এবং ডিজাইনারদের এত টেকনিক্যাল টার্মিনালজি আমরা জানতে পারতাম না এই গল্পটি না পড়লে। ক্ষুদ্র ঈর্ষা,বিষময়ী ভুজঙ্গিনী, কথাটা মনে পড়ে গেল এই গল্প পড়তে পড়তে।প্রফেশনাল হাজার্ড, একটা থেকে আর একটা সম্পর্কে সুইচ ওভার , নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে জেলাশীর এর বশে ক্রমান্বয়ে সুচারু ভাবে অনিষ্ট সাধন এই গল্পের প্রতিপাদ্য। গ্ল্যামার জগতের এত অনুপুঙ্খ বর্ণনা লেখকের প্রতি এক অনাবিল মুগ্ধতা এনে দেয়।

‘হানিমুনের এক্সপেরিয়েন্স’ একটা আদ্যন্ত মজার গল্প।নব দম্পতিতে থেকে প্রৌঢ় দম্পতি সবার জীবনে এট্টু এডজাস্ট থাকলে জীবন মধুময়।অনেক্ষন মানসিক চাপ নেবার পর এ গল্প এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস যেন।খুবই সুখকর এই গল্প।

শেষ গল্প ,’ভাঙা গড়ার খেলা’ সত্যিই জীবনের ভাঙা গড়ার জলছবি। লিপিকার কিছু শারীরিক ত্রুটি বিচ্যুতি ভাস্বরের স্বপ্ন ভঙ্গ করে। সে নব বিবাহিতা বধূকে ডিভোর্স দেয় । যার সাথে চুম্বন ছাড়া অন্য কোনো শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন হয় নি তার জন্যই কোথায় যেন একটা মায়া তৈরি হয় ভাস্বরের পরবর্তীতে।
অন্যদিকে প্রাক্তন ও বর্তমান স্বামীর সামনেই সদ্যজাত সন্তানকে স্তনদান ক’রে লিপি বোধহয় নীরবে প্রমান করতে চেয়েছে ছোট ত্রুটি মহৎ সৃষ্টিতে বাধা দেয়না।

‘রূপোয় মোড়া আকাশ’পড়তে পড়তে একটা কথা বারবার মনে হয়েছে। কবিরা যখন গল্প লেখেন তখন তার মধ্যে এক অপরূপ মায়াময়তা কাব্যিক ব্যঞ্জনা থাকে। এই বইয়ের প্রতিটি গল্পে সেই কাব্য সুষমা মনকে মধুর রসে সিক্ত করেছে। আমার খুব প্রিয় এই কবির গল্পের বইটি মনে আরো গভীর ভাবে জায়গা করে নিলো।
পরিশেষে বলতে হয় বইটির নির্মাণ কার্য সম্পর্কে।অপূর্ব প্রচ্ছদ, সুন্দর পৃষ্ঠা এবং বাঁধাই প্রশংসার দাবি রাখে। সব মিলিয়ে বইটিকে অসাধারণ ,চমৎকার বললেও সবটা বলা হয় না,যতটা বলতে চাই।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জুলাই ২৪, সূচিপত্র]