সর্বাঙ্গে ধুলো আর শাড়ির কুঁচিতে চোরকাঁটা লাগিয়ে আলপথে হাঁটার যুগপৎ আনন্দ ও বিরক্তি মাখামাখি হয়ে বড় হয়েছি আমরা। রচনার বইয়ে পড়তাম ‘বইমেলা’ । কিন্তু রথের মেলা, ঝাঁপানের মেলা,শিবরাত্রি ,চড়কের মেলা ছাড়া অন্য কোন মেলা দেখার অভিজ্ঞতা আমার তখনও হয়নি।
ফার্স্ট ইয়ার এ পড়ি । হোস্টেল থেকে দিদির বাড়ি এলাম । তার পুত্র রাজু বায়না ধরল বইমেলা নিয়ে যেতে হবে। ক্লাস ফাইভের ছাত্র, বইয়ের পোকা সে। পাঠ্যপুস্তক এর বাইরে যে বই পায় গোগ্রাসে গিলে ফেলে ।
তখন বইমেলা হত কলকাতা ময়দানে। একদিন সকাল সকাল খাওয়া দাওয়া সেরে শিবপুর থেকে বাসে চেপে আমরা সোজা চলে এলাম কলকাতা ময়দানে। সারিসারি বইয়ের স্টলগুলোকে পেছন থেকে দেখে আমার চকিতে সার্কাসের তাঁবুর কথা মনে পড়ে গেল। তখনও জানি না সার্কাসের থেকে লক্ষ গুন বিস্ময় ,আনন্দ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।

কাউন্টারের সামনে বিরাট লাইন। রাজু দৌড়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালো, মিনিট পনেরো- কুড়ি পরে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম । চারদিকে শুধু বই আর বই আর বই । বাতাস নতুন বইয়ের গন্ধে ম ম করছে! অজস্র লোকের ভিড়! কেমন যেন থতমতো খেয়ে গেলাম। এত বই একসাথে! এত লোক বই দেখতে বই কিনতে নতুন বইয়ের গন্ধ নিতে এসেছে!
কয়েকটা জায়গায় প্যান্ডেল ,অস্থায়ী মঞ্চ । মাইকে ভাসছে গান, কবিতা , বক্তব্য, কোথাও বেজে চলেছে কোন বইয়ের বিজ্ঞাপন।
মাঠে ঘুরছে বেলুনওয়ালা ,হাতে ছবি এঁকে বিক্রি করছে কেউ কেউ ,কারোর হাতে নিজের ছাপানো চটি বই।
মাটিতে খবরের কাগজ বিছিয়ে রুটি তরকারি খাচ্ছে তস্য গ্রাম থেকে আসা কয়েকটি পরিবার। কেতা দুরস্ত ছাত্র-ছাত্রী ,যুবক- যুবতীর ভিড়ে মিশে আছে আমার মতো আধা গ্রাম ,মফস্বল থেকে আসা হতচকিত পাঠকের দল।

ছোট রাজু মুহূর্তে অভিভাবকের ভূমিকা নিয়ে নিল। মাসীমণি ,বড় বড় স্টল গুলোতে এখনো বেশি ভিড় জমেনি। চলো ওইগুলো আগে ঘুরে আসি। শুনেছি ওইসব স্টলে আসেন লেখকেরা। বই কিনে তাদের কাছে থেকে সই নেব কিন্তু। সই নেবার জন্য আলাদা লাইনে দাঁড়াতে হয় । বাবা তখন কিন্তু ব্যস্ত হলে চলবে না।
বিশাল লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে, আগে পিছে ডাইনে বাঁয়ে বই দেখতে দেখতে একসময় ঢুকে গেলাম বড় বড় স্টলগুলোতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তখনো কোনো লেখক এসে পৌঁছান নি। তারপর ছোট,মাঝারি বিভিন্ন স্টল ঘুরে দুহাত ভর্তি করে বই কিনে যখন মাঠের মাঝে এসে থিতু হলাম তখন মাঠে যেন ধুলোর ঝড় উঠেছে ।

অনলাইনে সংগ্রহ করতে, ওপরের ছবিতে ক্লিক করুন


একটু দূরে খাবার স্টলে ভিড় উপচে পড়ছে।
ক্লান্ত রাজু বললো,চলো বাইরে গিয়ে খাবো। একপ্যাকেট চীনা বাদাম কিনে খেতে খেতে বাইরে আসছি, হঠাৎ রাজু হেঁট হয়ে মাটিতে কী যেন খুঁজতে বসে পড়লো।
জিজ্ঞেস করি, কি হয়েছে কি খুঁজছিস ? ততক্ষণে জামাইবাবু বুঝতে পেরে গেছেন ব্যাপারটা কি হয়েছে। দস্যি ছেলেটার সামনের একটা দাঁত খেলতে গিয়ে ভেঙেছিল কোন ছোট্টবেলায়। সেই খুচরো দাঁতটি বাদাম খেতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেছে। জামাইবাবু ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দিলেন । রাজুর সাথে আমরাও বসে পড়লাম সেই ঘাস আর ধুলোর মাঝখানে সাদা এক পাটি দাঁত খুঁজতে। উৎসুক মানুষের ভিড় সর্বত্রই লেগে যায় । আমাদের খুঁজতে দেখে যথারীতি কি হলো দাদা কি খুঁজছেন? ও ভাই তুমি কি খুঁজছো?
আমাদেরকে ঘিরে বেশ কয়েকজন উৎসাহী মানুষ দাঁড়িয়ে পড়লো। তারাও আমাদের সাথে কিছু না জেনেই খুঁজতে লাগলো । হঠাৎ এক সময় পেয়েছি বলে উঠে রাজু সোজা হাঁটা লাগলো প্রস্থান গেটের দিকে। একজন খপ করে তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো,কি খুঁজে পেলে খোকা?
আমার আংটি, বলেই দৌড় লাগালো হাত ছাড়িয়ে।
পরে জিজ্ঞেস করেছি,মিথ্যে বললি কেন এই সামান্য ব্যাপারে?
ইসসস, বইমেলায় এসে দাঁত খুঁজছি বলা যায় নাকি?

এর অনেকবছর পরে আবার গেলাম করুণাময়ী সেন্ট্রাল পার্কের বইমেলায়। আশ্চর্য! বইমেলার গায়ে ধুলোর সোঁদা গন্ধ নেই একটুও। কী স্মার্ট ,কী পরিণত ঝাঁ চকচকে বইমেলা এখানে। জায়গায় জায়গায় রোড ম্যাপ, প্রতি গেটে পুলিশ। সাজানো শহরে নাম্বারিং করা বাড়ির মত একেকটা বুকষ্টল। মেলায় পৌঁছে এক গভীর আত্মিক অনুভূতিতে আক্রান্ত হলাম।

আমার মত এক সামান্য কলমচির কবিতার বই ,গল্পের বইও আছে একটি স্টলে। সোজা চলে গেলাম পরম্পরা স্টলে। উপচে পড়া ভিড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলাম। ঐতো সাজানো আছে ‘ভালোবাসার হোমস্টে’, আরে ওই যে একজন হাতে নিয়ে দেখছেন সদ্য প্রকাশিত গল্পের বই,’প্ল্যাটফর্ম নম্বর ওয়ান’। আমার হঠাৎ ভীষণ ভয় করতে লাগলো ,ঠিক যেন পরীক্ষা শেষের ঘন্টা বাজবে এক্ষুনি অথচ অনেক উত্তর লেখা বাকি। ভেতরে ভেতর কী সাংঘাতিক উৎকণ্ঠিত আমি।পাঠকের কাছে আমার বই গ্রহণীয় হবে তো?
হঠাৎ অনুভব করলাম আমার মুখে ফুটে উঠলো এক আনন্দের বিভা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম বিক্রি হয়ে গেল আমার দুটি গল্পের বই এবং একটি কবিতার বই ।
বইমেলাকে আমি আর এক নতুন ভাবে দেখলাম চিনলাম। ভালবাসলাম।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, মার্চ ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Ivy Chattopadhyay
Ivy Chattopadhyay
7 months ago

খুব ভালো লাগলো ।