ঠিক কতটা সময় লাগে মানুষের নিজের স্বরের কাছে পৌঁছতে ? কী বলছে জনগণের স্বতস্ফূর্ত ভাষ ? সেটা বোঝার জন্য তাত্ত্বিকতার আশ্রয় নিতে হয় পণ্ডিতদের। কোর্স করতে হয় কেমনভাবে করা উচিত ক্ষেত্রসমীক্ষা । কিন্তু প্রাণের টান কি বাইরে থেকে শিখিয়ে দেওয়া সম্ভব ? তাকে উজ্জীবিত হতে হয় অন্য প্রাণের উজ্জীবন দেখেই। আর তাইই উইলিয়াম কেরির শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা কিংবা একের পর এক বাংলা গদ্যের প্রকাশ আজও ততটাই গুরূত্বপূর্ণ , যেমন গুরূত্বপূর্ণ ‘ ইতিহাসমালা’ র মত এক আশ্চর্য বইয়ের প্রকাশ। কারণ এই দুশ বছরেও আমরা গদ্য নিয়ে নিরীক্ষা খানিক করলেও বাংলার নিজস্ব লোকসংস্কৃতির শিক্ষাটা এখনো শহুরে শিক্ষিত প্রক্ষেপ কিংবা বিদেশী বই থেকেই আহরণ করি, দেশের মাটি থেকে করিনা।
গ্রীম ভাইয়েরা তাঁদের ফেয়ারি টেলস সংগ্রহ এবং সংকলনের কারণ হিসেবে জানিয়েছিলেন দেশপ্রেম। দেশের শিকড়কে ভালবাসা । আর উইলিয়াম কেরি ইংল্যণ্ড থেকে ইণ্ডিয়া এসেছিলেন মিশনারি হিসেবে, কিন্তু যখন হুগলি জেলার আশেপাশের গ্রাম গঞ্জ থেকে লোককথা সংগ্রহ করছেন বাংলার নিজস্ব সাহিত্য সংগ্রহের আশায় তখন তাঁরও ছিল ভারতবর্ষের জন্য ভালবাসা। বাংলা ভাষার নিজস্ব শিকড়কে চিনতে চাওয়া যা কোনো সংস্কৃতজ্ঞের আরোপণে ভিন্ন রূপ ধারণ করেনি, কোনো বিদেশী ভাষার প্রভাবেও আমাদের গল্পগুলো প্রভাবিত হয়নি। এই প্রেম বা ভালবাসা ভিন্ন লোকসংস্কৃতি চর্চা, মৌখিক সাহিত্য সংগ্রহ প্রায় অসম্ভব।
মূলত বাংলা ভাষা চর্চা , মিশনারীদের বাংলা শিক্ষা ইত্যাদি উদ্দেশ্যেই কেরি বাংলা ভাষা সংরক্ষণে মন দিয়েছিলেন। তাই মিশনারীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যা অর্থাৎ ধর্ম প্রচার তার বাইরেও কেরি বাংলা ভাষার নিজস্ব স্বর এবং সুরকে সংকলিত করতে চেয়েছিলেন যার একটা আদর্শ উদাহরণ ‘ ইতিহাসমালা’ র প্রকাশ। এখানে একাধিক গল্পের অনুবাদ থাকলেও ড। সুকুমার সেন এর মতে ৩২ টি গল্প কেরির নিজস্ব। ( বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস/ ৩য় খণ্ড) অর্থাৎ এই গল্পগুলি কেরি নিজে সংগ্রহ করেছিলেন ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে। কেরিকে হয়ত সহায়তা করেছিলেন তাঁর মুন্সী হিসেবে পরিচিত রামরাম বসু, স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে মিশে যাওয়া কেরির পুত্র ফেলিক্স কেরি এবং হয়তবা জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের মত কোনো পণ্ডিত যিনি তাঁর পাণ্ডিত্যকে সাহিত্যের সৃজনশীলতা বুঝতে ব্যাঘাত হতে দেননি। তাইই ‘ ইতিহাসমালা’ য় অনায়াসে স্থান পেল মানুষের নিজের বলা গল্প, তাদের জীবন থেকে যাপন থেকে উঠে আসা গল্প । যে গল্প পুঁথি সাহিত্যের নৈতিকতার ধার ধারেনা। যে গল্প শ্লীল অশ্লীলের তত্ত্ব জানেনা। জীবনের স্বাদে যে কথা কাহিনি মানুষের জীবনের প্রতি ত্বনিষ্ঠ থাকে মাত্র। সেইই তার একমাত্র দায়।

উইলিয়াম কেরি


দুশ বছর পরেও বাংলা ভাষার লোককথা সংগ্রহে নারীর নাম খুব কম সংগ্রাহক হিসেবে। অথচ বেশিরভাগ লোককথাই নারী জীবনের। সহজেই অনুমান করা যায় নারীর মুখ নিঃসৃত বলেও। তাই পুরুষ সংগ্রাহকদের বাড়তি দায়িত্ব থাকে বৈকি । কেরি নিজেও ছিলেন এব্যাপারে অতি সচেতন। পরবর্তীকালের লোককাহিনি গুলিতে নারীকে হয় দেবী নয় রাক্ষসী পরিণতি দেওয়ার স্পষ্টত পুরুষতন্ত্রের যড়যন্ত্রের তুলনায় ‘ ইতিহাসমালা’ র কাহিনি গুলি মুক্ত। নারীকে নারী হিসেবেই তার প্রতিষ্ঠা। নারীর চাওয়া পাওয়ার স্বাভাবিকতা থেকে যাচ্ছে অনায়াসে এই গল্পগুলিতে।
উল্লেখ করা যাক দুটি গল্পের। ১২৫ সংখ্যক গল্পটিতে পাওয়া যায় ধনপতি নামের এক বণিক দূরদেশ থেকে বাড়িতে না গিয়ে ছদ্মবেশে অন্যত্র থেকে স্ত্রীর সতীত্ব পরীক্ষা করার জন্য এক কুট্টিনীকে দিয়ে স্ত্রী রত্নপ্রভাকে দু লক্ষ টাকার বিনিময়ে আহ্বান করেন। স্ত্রী পরপুরুষ জেনেও টাকার জন্য রাজি হয়ে চলে আসেন। আর ধনপতি অর্থের মহিমা অনুধাবন করেন। আর ১১২ সংখ্যক গল্পটিতে বর্ণিত হয়েছে ধনপতি সওদাগরের দুই স্ত্রী লহনা-খুল্লনার কলহ। সংসার নিয়ে, স্বামী নিয়ে দুই নারীর সমান মাপের ঝগড়ায় গল্পটি উপভোগ্য। অথচ লিখিত সাহিত্য ‘ ধর্মমঙ্গল’ এ ভালো মেয়ে আর খারাপ মেয়ের পুরুষতান্ত্রিক ছকে গাঁথা হয়েছে লহনা- খুল্লনাকে যেখানে একজন অত্যাচারী আর অন্যজন অত্যাচারিত।
তাই লোককথার এই প্রথম সংকলনটি আমাদের সাহিত্য ভাবনার একটা আধুনিকতম অধ্যায়, যাকে আমরা এখনো পুরোপুরি আয়ত্ত্ব করতে পারিনি। আমরা আমাদের নিজেদের গল্পকে স্পর্শ করার জন্য কেবলই নির্ভর করেছি লিখিত সাহিত্যের ওপর, যার ভিত্তি অনেকটাই পাশ্চাত্য প্রভাবে পুষ্ট। আমাদের দেশকে ভালবাসা এবং দেশের ঘ্রাণকে গ্রহণ করার জন্য আমাদের যতটা প্রস্তুত হবার কথা, ততটা কি হতে পেরেছি ? এইকারনেই দুশ দশ বছর পরেও প্রায় একটা হারিয়ে যাওয়া গ্রন্থের প্রকাশকে আমরা সঠিক তাৎপর্যে উদযাপন করতে পারছিনা।
এবার আর একটা ছোট্ট তথ্য দেওয়া যাক। ‘ ইতিহাসমালা’ র প্রথম প্রকাশের পরই আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছিল তার স্টক। ( সূত্র: ফাদার দ্যতিয়েন/ ভূমিকা / ইতিহাসমালা)। তিনটি কপি ছাড়া হারিয়ে গেছিল তার সব বই। ১৮১২ র মার্চ মাসে ঘটে এই আগুন লাগার ঘটনাটি। ধরে নেওয়া যায় তবে জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যেই বইটির প্রকাশ। আর ওই ১৮১২ এর ডিসেম্বররে গ্রীম ভাইদের বইটি প্রকাশ পায়। পৃথিবীর প্রথম লোককথা হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে আগুন লাগার ঘটনাটি না ঘটলে কি এই সম্মান উইলিয়াম কেরির ‘ ইতিহাসমালা’ র প্রাপ্য হত না ?

[শিক্ষক। বাংলা বিভাগ। শ্রীরামপুর কলেজ]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, মে ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
indira mukhopadhyay
5 months ago

খুব ভালো লেখা।