কেন ‘ বীরাঙ্গনা’ র সব বীর নারীরাই তাদের স্বামী কিংবা প্রেমিককে বলে—‘ ইচ্ছা করে দাসী হয়ে সেবি পা দুখানি’। ২০০৭ সাল। একটি আধা মফস্বল শহরে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বাংলা অনার্স পড়তে আসা অধিকাংশ ছাত্রী আর গুটিকয়েক ছাত্রের ক্লাসে প্রশ্ন করেছিলাম মধুসূদন দত্তের ‘ বীরাঙ্গনা’ পড়ানোর সময়। কিন্তু সেদিন সেই প্রশ্নের উত্তর পাইনি । যতটুকু পেয়েছিলাম তা ছিল নোট বইয়ের মুখস্থ উত্তর । সেই উত্তরে প্রাণ ছিলনা, ছিলনা জীবনের প্রতি অনুসন্ধান।
১৮৬১ তে লেখা ‘ বীরাঙ্গনা’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন মধুসুদন দত্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। মধুসূদন দত্তের এই উৎসর্গ আর বইয়ের নাম স্পষ্ট করেছিল নারী উত্থান নারী জাগরণে কবির মনোভাব।
গত ১৫ বছর ধরে ক্লাসরুমে সাধারণ পরিবারে মফস্বল অথবা গ্রামে বড় হয়ে ওঠা মেয়েদের কে ‘ বীরাঙ্গনা’ র পাঠ দিতে গিয়ে এই প্রশ্ন আমাকেও তাড়িত করেছে তবে কি সম্পর্কে ওই দাস্যভাব মাইকেলেরও কাঙ্খিত ছিল ? দাসী হয়ে সেবার মধ্য দিয়েই তবে নারীর যাবতীয় বীরত্বের সূচনা ? সদ্য লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা বা নীল সাদা সবুজ সাদা শাড়ি পরা ইস্কুল ছেড়ে আসা বালিকাদের চোখ দিয়ে মধুসূদনকে বুঝতে চাওয়া ছিল একটা অভিযান।
দুষ্ম্যন্তের মত বিশ্বাসঘাতকের পাশাপাশি নারীমুক্তির পটভূমি এবং মধুসুদনের জনা কিংবা কেকয়ীর মত চরিত্ররাও ছিল ওদের পাঠ্য। যে জনা প্রবল বিদ্রূপে বিদ্ধ করেছে স্বামীকে কারণ স্বামী পুরধ্বজ নিজের পুত্রের হত্যাকারী অজুর্নকে রাজসভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তাই জনা বলেছে—
‘ সাজিছ কি, নররাজ, যুঝিতে সদলে—
প্রবীর পাত্রের মৃত্যু প্রতিবিধিৎসিতে ,-
নিবাইতে এ শোকাগ্নি ফাল্গুনির লোহে ?
এই তো সাজে তোমারে , ক্ষত্রমণি তুমি
মহাবাহূ—’
কিংবা কেকয়ী বলেছে দশরথকে—নিজ পুত্র ভরতকে কথা দিয়েও রাজ্য না দেবার অভিশাপ—
‘ পরম অধর্ম্মচারী রঘু-কুল-পতি !
থাকে যদি ধর্ম্ম, তুমি অবশ্য ভুঞ্জিবে
এ কর্ম্মের প্রতিফল ! ’

ছবি ইন্টারনেট


এই তীব্রতা , শুধু স্বামী নয় দেশের রাজাকে চ্যালেঞ্জ করার এই দুঃসাহসী একান্তই মধুসূদনীয় নারী চরিত্রেরা কি কোথাও বাংলা পড়তে আসা ভীরু মেয়েগুলিকে প্রভাবিত করেনি ?করেনা ? শুধু প্রতিবাদ নয় প্রেমে ? ‘ সোমের প্রতি তারা’ পত্রে তারা নিজের মুখে যখন নিজের স্বামী বৃহস্পতির শিষ্য সোমদেবকে কামনা করে উচ্চারণ করে নিজের যৌন আকাঙ্ক্ষা –
‘ কিন্তু যদি থাকে দয়া এস শীঘ্র করি !
এ নব যৌবন, বিধু , অর্পিব গোপনে
তোমায়…’। ইত্যাদি ইত্যাদি তখন এই নীতি পুলিশী সমাজ ব্যবস্থায় মুখ বুজে সম্প্রদান হয়ে যাওয়া শাড়ি গহনা সর্বস্ব বিয়ের কনে দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা এই ছাত্রীরা ছাত্ররা কি প্রথা ভেঙে নিজের মত হয়ে ওঠার আহ্বান পায়নি ? কোথাও কি বিদ্রোহ, বিপ্লবের বীজ রাখতে পারছেন মাইকেল সেই অর্থে বাংলা ভাষায় লেখা এই প্রথম ফেমিনিস্ট গ্রন্থটিতে ? শূর্পনখা যেমন লক্ষ্মণকে বিয়ের প্রস্তাব দিতেই পারে তেমনই দুষ্ম্যন্তর বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে কেন সরব হবেন না শকুন্তলা এই তর্ক আমাদের কৈশোর সদ্য পেরনো মেয়েদের ঠিক কী দিতে পারছে ?
২০২২ সালে কিন্তু পট বদল হয়েছে অনেক । চোখের সামনে মেয়েদের পোশাক বদল হতে দেখলাম। দেখলাম সাধারণ, অতি সাধারণ মেয়েদের কারোর কারোর জেদ বেড়ে যাচ্ছে। প্রায় না খেতে পাওয়া বাড়ির মেয়েটিও সুপাত্রকে প্রত্যাখ্যান করে বলছে— আমি আপনাদের মত পড়াতে চাই, নিজে আরও পড়তে চাই। খুব স্পষ্ট করে মেয়েরা আজকাল ঘোষণাও করছে—আমি আরেকটা মেয়ের সঙ্গেই জীবন কাটাতে চাই। ছাত্রেরাও নিজেদের নারীসাজের ছবি লুকিয়ে রাখছেনা মোটেই।
লোকাল ট্রেনে অনায়াসে দেখতে শুরু করলাম জিন্স পরা সুন্দরী কলেজ ছাত্রী পেয়ারা বিক্রি করছে , ক্লাসেও দেখলাম বাবার ফলের দোকানে গিয়ে বসে মেয়েটি কলেজ ছুটির পর। আর এক ছাত্রী টোটো চালিয়ে পরিবার রক্ষা করছে নিয়মিত ক্লাস করে গিয়েও।
আর হ্যাঁ, এখন প্রশ্ন তোলে ওরা। কেন মধুসূদন মেয়েদের দিয়েই দাসী হয়ে পদদেবা করার কথা বলেন ? এত নিবেদন কেন ? কেন একা মেয়েরাই এত নিবেদিত হবে ? তাহলে আর ‘ বীরাঙ্গনা ’ বলব কেন ?
মধুসূদনের জন্মের ২০০ বছর ( ২০২৩ এ ২০০ ) হবার মুহূর্তে টের পাই আলো জ্বলছে। যে তর্ক উসকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মাইকেল তাকে নেহাত পাঠ্যপুস্তকে আবদ্ধ করে রাখা যাচ্ছেনা। জীবন দিয়ে মেয়েরা উত্তর খুঁজছে । কোথাও একটা আগল খুলে দিয়েছে কেকয়ী, জনা , তারা, শূর্পনখারা। মধুসূদনের কল্পনায় সেদিন পৌরাণিক নারীরা যেভাবে ধরা দিয়েছিল তাইই যেন সত্যি হয়ে যাচ্ছে আজ সাধারণ পরিবারের মেয়েদের মধ্যে। তাইই ‘ বীরাঙ্গনা’র স্রষ্টাকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এই প্রশ্নটাই এই চ্যালেঞ্জটাই ‘ বীরাঙ্গনা’র প্রধান সার্থকতা নয় কি ?

[পরম্পরা ওয়েবজিন, ফেব্রুয়ারি ২৪, সূচিপত্র]