হানা মার্শম্যান – ভারতের প্রথম নারী মিশনারী ( ১৭৬৭-১৮৪৭)
প্রায় অনুল্লেখিত তাঁর অধ্যায়। ইতিহাসে তিনি উপেক্ষিতা। অথচ উনিশ শতকের নারী শিক্ষা আন্দোলনে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হওয়া উচিত ছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলা জুড়ে যে নারীশিক্ষার প্রচলন শুরু হয়েছিল এবং ১৮৪৯ এ বেথুন কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই শ্রীরামপুরে ডেনিস কলোনিতে স্থানীয় মেয়েদের জন্যে স্কুল খুলেছিলেন হানা মার্শম্যান। অথচ অদ্ভুতভাবে প্রায় সকলেই তাঁকে ভুলে গেছেন। শ্রীরামপুর মিশন কলেজে তাঁর সামান্য কিছু ব্যবহৃত জিনিসপত্র, শ্রীরামপুর শহরে তাঁর বাড়ির ভগ্নস্তুপ ছাড়া হানা হারিয়ে গেছেন শ্রীরামপুরে আগত মিশনারীদের অর্থাৎ উইলিয়াম কেরী, ওয়ার্ড, জশুয়া মার্শম্যানদের বিপুল কার্যভারের আড়ালে অথবা ভারতীয় নারী শিক্ষা আন্দোলনের অন্যান্য মনীষীদের কাজের আড়ালে। হানা মার্শম্যান কেবলই পরিচিত হয়ে থেকেছেন মিসেস মার্শম্যান হিসেবে।
উইলিয়াম কেরী নিজে ভারতবর্ষে ধর্মপ্রচারে এলে জশুয়া মার্শম্যানকে ডাক পাঠালে হানা প্রথমে বিচলিত হন। কীভাবে সেইসময়কার ভারতবর্ষে গিয়ে ছেলেমেয়ে মানুষ করবেন বুঝতে পারেন না। প্রসঙ্গত বলা যায় একই আপত্তি ছিল কেরীর স্ত্রী ডরোথি কেরিরও। অত্যন্ত অনিচ্ছুক ভাবে ডরোথি কেরী ভারতে এসেছিলেন। পরবর্তীকালেও ডরোথি ভারতবর্ষকে ভালোবাসতে পারেননি , বিশেষত এখানকার জল হাওয়া সহ্য না করতে পেরে উইলিয়াম কেরী এবং ডরোথি কেরীর ছোট ছেলে মারা যাওয়ার পর। এই প্রসঙ্গ এইজন্যই উল্লেখ্য যে বিদেশিনী মায়েদের পক্ষে তখনকার ভারতবর্ষে সন্তান মানুষ করার কাজটা অত সহজ ছিলনা। স্বামীদের কাজের সহযোগিনী হতে গিয়ে তাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। হানা কিন্তু তাঁর প্রাথমিক অনিচ্ছাকে কাটিয়ে কেরীর এই আহ্বান কে ঈশ্বরের আহ্বান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ১৭৯৯ তে তিনি ভারতের শ্রীরামপুরে আসেন দুই সন্তান এবং স্বামী সহ। নিজের পরিবারের পাশাপাশি উইলিয়াম কেরী প্রতিষ্ঠিত ‘ শ্রীরামপুর মিশন’ এর একাধিক গুরূত্বপূর্ণ কাজ সামলাতেন হানা । জর্জ স্মিথ তাই তাঁকেই ‘ ভারতবর্ষের প্রথম নারী মিশনারী’ বলে উল্লেখ করেছেন।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কেরী আসার পর মিশনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে যখন আয় বাড়ানোর নানা পন্থা ভাবা হতে লাগল তখন মার্শম্যান দম্পতি একটা বোর্ডিং স্কুল খুললেন । স্থানীয় ছেলেদের জন্যেও পড়াশোনার ব্যবস্থা করা গেল যদিও তাতেও ছিল নানা বাধা। ভারতীয়দের মধ্যে এরকম গুজব ছিল যে মিশনারীরা ছেলেদের পড়াশোনা শিখিয়ে ইংল্যন্ডে চালান করে দেবে। তাই ১৮০০ তেই হানা মেয়দের শিক্ষা চালু করার চিন্তা করতে শুরু করলেও বাস্তবে তা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু বিদেশিনী হানা তাতেও না দমে বারংবার স্থানীয় নারীদের সঙ্গে মেলামেশা বাড়িয়েছিলেন শিক্ষাপ্রচারের জন্যই। মাত্র বারো বছর বয়সেই বাবা মা উভয়কেই হারিয়েছিলেন হানা। ব্রিস্টলেই আত্মীয়ের বাড়ি মানুষ হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পড়াশোনাকে ভালোবাসতেন ছোট থেকেই। তার সঙ্গে ছিল সেবাপরায়ণ মন। এই দুইই ছিল তৎকালীন বাংলার মেয়েদের অবস্থানকে বুঝে নেবার জন্যে এবং তা সংশোধনের জন্যে যথেষ্ট।
১৮৪৯ এ বেথুন সাহেব মেয়েদের স্কুলকে প্রথম বলে প্রচারিত হলেও তার আগেও যে বাংলায় নারীশিক্ষার প্রচলন নিয়ে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা শিবনাথ শাত্রী তাঁর ‘ রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ বইতে উল্লেখ করেছেন। সেই তালিকায় শ্রীরামপুরের আশাপাশে মেয়দের স্কুলের প্রসঙ্গ থাকলেও হানার নাম আলাদা করে নেই। বাংলায় নারী শিক্ষার আন্দোলনেও তাঁর নাম স্বতন্ত্রভাবে নেই। অথচ বালিকা শিক্ষা নিয়ে শ্রীরামপুরে তখন একমাত্র হানা মার্শম্যানই সচেষ্ট। ১৮০০ থেকে চেষ্টা করার পর ১৮২১ এ হানা একটি মেয়েদের স্কুল খুলতে পেরেছিলেন যা আবারও স্থানীয়দের দ্বারা প্রচণ্ডভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তবে এতেও না দমে হানা একাধিক বালিকা বিদ্যালয় খোলেন যার কোনোটারই অস্তিত্ব আজ আর নেই। পরবর্তীকালে পুরুষ মিশনারীরা কিংবা বিদেশীরা তাঁদের কাজের স্বীকৃতি পেলেও হানা কেন চিরতরে অস্বীকৃত রয়ে গেলেন?
“ Respecting our family , I shall only say I live for all, and make it a part of my prayer that I may continue to live in love and peace with all . I wish to ever see my own faults before those of others ; and this is one of the blessed things which I have learnt in my affliction. Thanks to be the giver.” ১৮০১ এ হানা তাঁর এক বান্ধবীকে লিখেছিলেন এই চিঠির অংশ যার ভেতরের মহত্ত্বটুকু সহজেই বোঝা যায়। যে ভালোবাসা আর মহত্ত্ব হানা বিস্তার করতে চেয়েছিলেন সেদিনের বাংলায়, তা বোঝার মত সামাজিক এবং বৌদ্ধিক পরিসর সেদিন আমাদের ছিলনা। কিন্তু আজও কি তা নেই? হানা মার্শম্যানের অধ্যায়টির প্রতি এই উপেক্ষা ভারতীয় নারীদের জীবন ইতিহাসে অনুসন্ধানের জন্যেও লজ্জাজনক নয় কি?
[লেখকের অন্য লেখা]
[শিক্ষক। বাংলা বিভাগ। শ্রীরামপুর কলেজ]
চমৎকার বিষয় ।
হানা মার্শম্যান এর ইতিহাস তুলে ধরার জন্য
ধন্যবাদ।
অজানাকে জানার আনন্দ পেলাম । ভালো লাগলো।
সম্পূর্ণ অজানা বিষয়। চমৎকার লেখা।