• হাত ধুসোস সন্তা ?
  • হ্যাঁ কত্তা
  • ভালো করে দু হাত ধুসোস ?
  • হ্যাঁ কত্তা , দুহাত ভালো করে কচলে কচলে একদম তাজা রক্ত দিয়া ।উনিশ বছরের তাজা মাইয়ার রক্ত কত্তা । সোকেন একবার, আমার হাতে কেমন লুনা গন্ধ সারসে।
  • আরে চুপ চুপ। একদম চুপ করে বস। কে কোথায় শুনে ফেলবে, সময় হলে সাহেব তুরে ঠিক ডেকে নেবে। আর দাঁড়া সাবান দিয়ে আর একবার হাতদুটো কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নিয়ে এ মুখোশ খান পরে লে।
  • হ্যাঁগো কত্তা, শেষকালে একটা ছাগলার মুখোশ। মানুষের মুখোশ কিছু নাই?
  • যা দিয়েছি মাথায় গলিয়ে ঘরে ঢুকে যা।আর কিছু আমার হাতে নেই।আর হ্যাঁ, কারুর সঙ্গে কথাটি বলবিনে।

সন্তা মানে সনাতন একটা বড় ঘরের মেঝেতে বসে পরে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরো দশ -বারোজন লোক। সবার মুখে মুখোশ। গরু, ছাগল, কুকুর, শেয়াল, হাঁস, মুরগি, ভেড়া, বিড়াল এইসব, মানুষের মুখোশ কিছু নেই। ঘরের ভেতর থেকে কর্কশ গলায় ক্যা ক্যা ডাক শোনা যাচ্ছে ভেতর থেকে একটা দাঁড়কাক বেড়িয়ে এলো। দাঁড়কাকের হাতে একটা খাম। এবার শেয়ালের পালা, সে খ্যাক খ্যাক করতে করতে ভেতরে ঢুকে গেলো। সন্তা পাশের গরুটাকে ফিসফিস করে বললো, ‘তুমি কে আছোস ভাই ?
অবাক কান্ড, সন্তার মুখ দিয়ে ব্যা ব্যা ছাড়া আর কিছু বলতে পারলো না।’

পাশের লোকটা মানে গরুটা একটু আস্তে হাম্বা হাম্বা করে কি যে বললো কিছু বোঝা গেলো না।
বাইরে থেকে ছুটে এলো কেল্টা , ‘তোদের বলেছিনা কেউ কোনো কথা বলবিনে। কত্তাসাহেব শুনতে পেলে তোদের শুধু নয় আমারও মুন্ডু কেটে হাতে ধরিয়ে দেবে। আর শোন্ তোদের যদি ভুখ লাগে সব রাখা আছে – খড়-বিচালি, রুটি মাংস, কাঁঠাল পাতা, ছোলা – গুড়, দুধ, মাছ। যা ইচ্ছা খেয়ে লিস। বাড়ি ফিরতে কিন্তু দেরি হয়ে যাবে।’
কেল্টার একটা ভালো নাম ছিল কিন্তু কত্তাসাহেবের কাছে চাকরিটা হবার পর আসল নামটা ভুলে গেছে । কত্তাসাহেব এমনিতে খুব দিলদরিয়া মানুষ। মাঝেমাঝেই বাড়তি কিছু বকশিস গুঁজে দেন। মাসমাইনে না থাকলেও কোন অভাব নেই | বাড়ি নেই, কেউ নেই, মানে ছিল একসময়, কিন্তু কত্তাসাহেবের হুকুমে সেসব ভুলতে হয়েছে। বাড়িটাড়ি ভুলে যা কেল্টা, যেদিন বাড়ি যাবার চেষ্টা করবি সেদিন তোর মায়ের কাছে তোর কাটা মুন্ডুটা যাবে বলেদিলুম। আমার কাছে থাকলে তোর কোনও চিন্তা নেই। দশ বছর ধরে আর বাড়ি ফেরেনি সে। বাড়িতে সবাই জানে মরে গেছে, লাশ পাওয়া যায়নি । কত্তাসাহেবের কাছে কাছে থাকে। বোমা বাঁধতে গিয়ে ডান হাতের কনুই থেকে বাদ গেছে। গোটা মুখটা আগুনে ঝলসে এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে। ডান চোখটাও গেছে। কত্তাসাহেব খুব দয়ালু মানুষ, অনেক খরচ করে একটা পাথরের চোখ বসিয়ে দিয়েছেন। এখন আর কোনও অ্যাকশন করতে হয়না ওকে, শুধু এইসব ছোটোখাটো ভিড় সামলাতে হয়। এতদিন জানতো কত্তাসাহেব সবার ওপরে, কিন্তু না, একদিন দুঃখ করছিলেন সাহেব,’বাবারও বাবা আছে রে কেল্টা।’

এইসব চিন্তা করতে করতে বেশ সময় কেটে যাচ্ছিলো কেল্টার। কোনোদিন সাহেবের আসল মুখ দেখেনি কেল্টা, সাহেবের মুখে সবসময় একটা ভালোমানুষের মুখোশ সাঁটা থাকে। গত একমাস ধরে যা যা অ্যাকশন হয়েছে আজ তার হিসাব বুঝে নেবেন কত্তাসাহেব। তাই আজ খুব লম্বা সময় লাগবে।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো গরু, কুকুর, হাঁস, মুরগি সবাই ঘর ছেড়ে চলে গেছে। একমাত্র ছাগল বসে আছে। ঘরের ভেতর ঢুকে আছে কেল্টা। ওর মুখে কোনো মুখোশ থাকে না, বোমার আগুনে পুড়ে ওর মুখটাই কেমন মুখোশ হয়ে গেছে। সন্তা ওরফে ছাগল এই প্রথম কত্তাসাহেবের কাজের বরাত পেয়েছে। আজ তার হিসাব দেবার পালা।
‘যা ঘরে যা, এবার তোর পালা’ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে কেল্টা। ঘরে ঢোকার আগে একটা যন্ত্র থেকে বাষ্প মতন বেরিয়ে সন্তার সারা শরীর ভিজিয়ে দেয়। চোখদুটো জ্বালাজ্বালা করে, হাত-পা কেমন চিড়বিড় করে।

  • ইটা কি দিলে গো কত্তা , বিষ গায়ে দিলে কেনে?
  • অরে বিষ নারে , ওই কিসব সানিটার না কি ওটা কম পরে গেছে , কত্তাসাহেব বললেন, ওই খেতির ফসলের পোকামারার ফলিডল মিশিয়ে নিতে তাই।। যা রোগ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে । বিষে বিষে বিষক্ষয় হয়ে যাবে।
    ছাগল ঘরে ঢোকে। একটা বিশাল টেবিলের ওপারে একজন ভালোমানুষ বসে আছে , তোর ভালো নাম কি ?
  • আজ্ঞে, সনাতন কত্তাসাহেব, লুকে আমারে সন্তা ডাকে কয়।
  • আজ থেকে তোর ও নাম আর থাকবে না, তোর নাম হবে ছাগলা।
  • বলেন কি কত্তাসাহেব মোর ঠাকুরডার দিয়্যা নাম …
  • চোপ শালে, মুখে মুখে কথা। যা কাজ দেওয়া ছিল করেছিস ?
  • হ্যা সাহেব, ওই সাতক্ষীরা গাঁয়ের মোড়ল নকুলের উনিশ বছরের মাইয়াটা…
  • থামলি কেন বলে যা, নকুলটা খুব বাড়া বেড়েছিল, লোক তাতাচ্ছে, আমার বিরুদ্ধে ভোট নামবে। তারপর ?
  • কাল রেতের বেলা আটটা থিক্যা নকুলদের বাড়ির কলঘরের পিছনের ঝোপে ঘাপটি মেরে বসেছিলাম। তখন রাত একটা -দেড়টা হবে, আসমানে তখন তেরোদোশীর চাঁদ, সামনেই পুন্নিমে, তাই বেশ আলো ছিল।
    একটু শ্বাস নিলো সন্তা।
  • কি রে, তারপর কি হলো?
  • চাঁদনী ঘর থেকে বেইরে কলঘরের দিকে আসছে ঠিক এমন সময় আমি পিছন থিক্যা গিয়া ওর মুখে আমার গামছাটা বেন্ধে দিলাম।
    আবার থামলো সনাতন।
  • কি রে ব্যাটা, তারপর ?
  • তারপর মাইয়াটারে দুচোখ মেলে দেখলুম, একটা জোনাক পোকা ওর কপালে বসে আলোয় ভরিয়ে দিছিলো ওর সারা মুখ, আহা কি তার রূপ,তারপর ওই চাঁদনী রাতে অমন ডাগর ডাগর চাঁদনীকে দেখে আমার কেমন সাধ চেপে গেলো। জাপ্টে ধরলাম। মুখের থেইকা গামছাটা খুলে টকাস টকাস করে কখান চুম খেলাম। মাইয়াটা কিছুটি বল্ল না। সত্যি বলছি সাহেব আমার বেশ নেশা ধরে গেলো।
  • এত ফ্যানাস না , আসল কথাটা বল।
  • বলছি তো সাহেব, চাঁদনী কোনো বাধা দিলো না, তারপর একটা একটা করে ওর শাড়ি, জামা গুলান.. জামাখান খুলে চন্দ্রমল্লিকা ফুলের মতন দুইখান, কি যে নরম , আর বলতে পারছিনা সাহেব আমার খুব লাজ হচ্ছে।
  • মটকা চটকে দিসনা ছাগল, যা করেছিস ঠিককরে বল।
  • তারপরনা, বিশ্বাস করেন সাহেব, আপনার দিব্বি, এই পোত্থমবার জেবনে মাইয়াছেলের আস্বাদ, আবার উনিশ বছরের মাইয়া। একটু সময় দ্যান সাহেব, ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতি হবেতো।
  • বড্ডো জ্বালাচ্ছিস ছাগল, শেষে যা করতে বলেছি করেছিস?
  • হ্যা সাহেব খুব কষ্ট হচ্ছিলো, খুব মায়ায় ভরা মুখখান। আমি বললাম তোকে কিন্তু আমার হাতে মরতে হবে। ওর মুখে গামছা গোঁজা, কাঁপছিলো শিরীষ গাছের পাতার মতো শিরশির করে। তারপর আমার হাতের ভোজালিটা সরাসরি চালিয়ে দিলাম ওর, না কোথায় বলতে পারবুনি , মাইয়া মানুষের একটা ইজ্জত আছে। কোপাতে কোপাতে একসময় নিস্তেজ হয়ে গেলো চাঁদনী। পলকা শরীল তো, এ ধকল নিতে পারলো নি । একদম নিস্তেজ হয়ে গেলে কাঁধে চাপিয়ে পুঁতে দিয়ে এলাম মরা নদীর সোঁতায়। কেউ জানতি পারলো না, তখন চাঁদ ডুবে আসছে, অন্ধকার মাখা আকাশ জুড়ে কেউ কাঁদছে। চাঁদনীর গলা মনে হলো। জীবনে পোত্থমবার আমি খুন করলাম, তারপর আবার মাইয়া মানুষ।
    ডুকরে কেঁদে উঠলো সনাতন।
    ভালোমানুষ আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন, ‘মেয়েছেলের মতন কাঁদিসনা সনাতন। প্রথম কাজ একদম ঠিকঠাক করেছিস তুই, তোকে আজ একটু বেশি উপরি দিতেই হবে। তবে একটু বাড়াবাড়ি করেছিস সনাতন, রেপ করেছিস বেশ করেছিস, কিন্তু শেষে অতো কষ্ট দিলি কেন বাচ্ছা মেয়েটাকে। চাকু দিয়ে মেয়েটার গলার নলিটা কেটে দিতে পারতিস। হাজারহোক, মেয়েদের ইজ্জত করতে শেখ ছাগল। আমার কাজ করতে নেমেছিস, সবসময় মনে রাখবি মেয়েদের আমি ইজ্জত করি। পরে কোনোদিন বেচাল করতে দেখলে তোর মুন্ডুটা কেটে হাতে ধরিয়ে দেব।’
    ভালোমানুষ একটা মোটা ফাইল নাড়াচাড়া করতে থাকেন। ফাইলের ভেতর রাখা ছিল ওটা। একবার হাতে পেলে আর চিন্তার কিছু নেই। অনেকদিন পরে বেশ হালকা লাগে। একটা গাঁইয়া ভুত নকুল কিনা পাঙ্গা লড়তে এসেছিলো। এবার দ্যাখ কেমন লাগে, সারাজীবন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবিনা।
  • আমার পাওনাটা দ্যান সাহেব।
  • এত তাড়া কিসের? এবার মুখোশটা খুলে ফেল, তোর বদনটা দেখি।
    সন্তা চুপচাপ মুখোশটা মুখ থেকে গলায় নামিয়ে রাখে|
    সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ভালোমানুষ পিছন ফিরে আলমারিটা খোলেন।আসল জিনিষটা খুঁজে পেতেই হবে।
    তন্নতন্ন করে আলমারি খুঁজতে থাকেন ভালোমানুষ। সনাতনের মুখের আদলটা খুব চেনা চেনা লাগছে, কি যেন নাম ছিল? ভালোমানুষ একটু আনমনা হয়ে পড়েন।
    সেই সুযোগে সনাতন একছুটে গিয়ে পিছন থেকে কাঁধের গামছাটা ভালোমানুষের মুখেচোখে বেঁধে ফেলে। পকেট থেকে দড়ি নিয়ে হাত দুটো পিছন করে বেঁধে দেয়। এতো ক্ষিপ্রতায় কাজ সারে সনাতন যে সাহেব আর নড়তে পারেনা ।
    শালা, শুয়োরের বাচ্ছা, নেতা হয়েছো। প্যান্টের পকেট থেকে ধারালো চাকুটা বার করে সনাতন। পিছন থেকে জাপ্টে ধরে চাকু দিয়ে ভালো মানুষের গলার নলিটা কেটে দেয়। কোনো কথা ফোটেনা ভালোমানুষের মুখ থেকে, মুন্ডুটা সামনের দিকে ঝুকে পড়ে। মুখোশটা টেনে ছিঁড়তে গিয়ে ভালোমানুষের মুখের ছালচামড়া হাতে উঠে আসে সনাতনের। মায়ের মুখটা মনে পড়ে সনাতনের, এমনি এক রাতে অকুল পাথাল শরীরে মায়ের শেষ কথাগুলো কানে ভাসে – ওই ভালোমানুষটার কোনো ক্ষতি করিসনা সোনা আমার, হাজার হোক ওই ভালোমানুষটা তোর…
    কে মা কে, তুমি কার কথা বলছো? একবার বল না আমায়…
    দশ বছরের বেশি আগের দুঃসহ সেই রাতের স্মৃতি সনাতনের দুচোখ ঝাপসা করে দেয় – তোমার কথা রাখতে পারলাম না মা। চোখদুটো মুছে নিয়ে সনাতন মনে মনে গজরায়, শালা হারামি, ওয়াগন ভেঙে, কয়লা পাচার করে, খাদান থেকে বালি তুলে অনেক টাকা লুটেছো এতো বছর ধরে। এখন নেতা হবার সাধ হয়েছে। কত মেয়েমানুষকে বেধবা করেছো আবার তাদের ইজ্জত লুটেছো। মুখে বড় বড় কথা – মেয়েদের ইজ্জত দিতে শেখ ছাগল। দ্যাখ শালা, বাবার ও বাবা আছে। হটাৎ চেয়ে দেখে কেল্টা আসছে ঘরের দিকে, চকিতে নিজের মুখোশ খুলে কেল্টার মুখ চেপে ধরে, কেল্টা ছটফট করতে থাকে দমবন্ধ অবস্থায়। একটুও সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে পেটের ভেতর চাকুটা চালিয়ে দেয় সনাতন। তারপর ধীরেসুস্থে বাইরে বেরিয়ে আসে। হিসাব যা বুঝে নেবার ছিল সব হয়ে গেছে। আর সময় নেই, অনেকটা পথ যেতে হবে। কাল পূর্ণিমা। পকেটে রাখা রজনীগন্ধার মালাটা প্রায় শুকিয়ে এসেছে, যাহোক করে ওটা দিয়েই কাজ হবে। চাঁদনী অপেক্ষা করছে সদ্যফোটা শিউলিফুলের মালা নিয়ে, ওকে নিয়ে ভোর হবার আগেই পালিয়ে যাবে এ গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে। নতুন ভোরের সূর্যকে সাক্ষী রেখে মালাবদল হবে।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জুলাই ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
3 months ago

শিউরে ওঠার মত ছোট গল্প! লেখকের কলমের তারিফ করতেই হয়! শেষ টাও দুর্দান্ত!