বিবর্তনের ধারপাত
পর্ব ৬ – স্কুলের কিছু মজার ঘটনা এবং স্কুল ড্রেস পরিবর্তনের গল্প
আমাদের স্কুলে annual function ছাড়াও আরও কিছু ছোট ছোট অনুষ্ঠান হত৷ আমাদের জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষিকা স্বর্গত শুভ্রাদি এইরকম অনুষ্ঠানে ছোট ছোট নাটক করাতেন। আমি দু’বার ওঁর সঙ্গেই দুটি ছোট নাটক করেছিলাম এবং বেশ মজাদার সব ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একদিন গনেশ ঠাকুর দুধ খেলেন। সেই নিয়ে শুভ্রাদি পরের বছর আমাদের একটা নাটক করিয়েছিলেন। যতদূর মনে পড়ছে নিজেই লিখেছিলেন বোধহয়৷ স্কুলজীবনে আমার ছোট চুল থাকত বলে আমি সেবার কার্তিকের রোল পেয়েছিলাম। গনেশের রোল করেছিল আমার সহপাঠী পারমিতা। পারমিতা বাইন। ও এখন মস্ত দন্তবিশেষজ্ঞ। শুঁড়ের props দুলিয়ে দারুণ অভিনয় করেছিল।
আর একটু বড়তে শুভ্রাদি ১৫ই আগস্টের আগে মাস্টারদা সূর্য সেন ও প্রীতিলতার একসঙ্গে শেষ অভিযান নিজে স্ক্রিপ্ট লিখে মঞ্চস্থ করেছিলেন। এখানে আমি প্রীতিলতা হয়েছিলাম। এটি আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি নাটক ছিল। আরও ভালো লেগেছিল দিদি প্রধান এবং আমার খুব প্রিয় চরিত্রটি আমাকে দিয়েছিলেন। সূর্য সেন হয়েছিল আমার সহপাঠী ভ্রামরী। খুব লম্বা ছিল বলে ও ঐ চরিত্রের জন্য appropriate ছিল। এখানে শেষ দৃশ্য ছিল, প্রীতিলতা ব্রিটিশ পুলিশের কাছে ধরা দেবে না। সে আংটি থেকে বিষ খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে। স্টেজ রিহার্সাল বা অন্য জায়গায় যেখানেই রিহার্সাল হোক না কেন, শুভ্রাদি এই দৃশ্যে আমাকে কখনও মাটিতে পড়তে দিতেন না। শুধু বলতেন,”লেগে যাবে।” কিন্তু মূল অনুষ্ঠানের দিন তো আমাদের বিশাল শান বাঁধানো স্টেজে খুব জোরে পড়েছি, দৃশ্যে যাতে অভিনয় করছি মনে না হয় তাই আরও সহজাত করার চেষ্টা করেছি৷ ব্যস, কপাল তো ফুলে আলু। শুভ্রাদি তো স্টেজ থেকে নামার পর জড়িয়ে ধরলেন। ‘খুব সুন্দর করেছিস রে। তোর তো কপাল ফুলে গেছে, আয় বরফ দিয়ে দিই।’ কোথা থেকে ঠিক মনে নেই বরফ এনে লাগিয়ে দিলেন। প্রীতিলতার চরিত্রে শাড়ি পরে করা এই অভিনয়টি আমার জীবনের সম্পদ। এরপর পাড়ায় এবং আরও টুকটাক অভিনয় করেছি, কিন্তু এই চরিত্রটির মতো আর কোনওটা মনে তেমন দাগ কাটে নি।
এই করতে করতে ক্লাস নাইন হল। রেজাল্ট বেরোনোর পর চরম উত্তেজনা। এবার ড্রেস চেঞ্জ হবে। দাগিয়ে দেওয়া হবে আমরা সিনিয়র – অর্থে নবম -দশম। আমাদের সময়ে স্কুল থেকে বই-ড্রেস ইত্যাদি দিত না। নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে কিনতে হত। প্রথম যেদিন নতুন বানানো সাদা-সালোয়ার-কামিজ আর লাল ওড়না পরে স্কুলে গেলাম সেদিন আর আনন্দ পায় কে! আমাদের লাল ওড়না চওড়া করে ইংরেজি ভি-আকৃতিতে দিয়ে যেতাম, দুই কাঁধে সেফটি পিন। কিন্তু অচিরেই আনন্দ দূর হল। পিরিয়ডের সময়ে তটস্থ হয়ে থাকতাম, সাদা জামায় না দাগ লেগে যায়৷ আগে লাল স্কার্টে এই সমস্যা ছিল না। ঐ এক বা দেড় সপ্তাহ প্রতিমাসে আমার কাছে বেশ চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াত। যাই হোক! পোষাক পরিবর্তন আমাদের ‘বড় হয়ে’ ওঠায় আর এক ধাপ ছিল। ‘পা দেখা যাওয়া’ স্কার্ট থেকে ‘সারা শরীর ঢাকা’ সালোয়ার কামিজে উত্তরণ। এখন ভাবলে হাসি পায় খানিকটা, কিন্তু তখন বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার ছিল। আমার দুটি সেট ছিল৷ অল্টারনেট করে পরতাম, যেমন হয় আর কি! এই নাইনে ওঠার আরও একটা সুফল ছিল। আমি ক্লাস এইট থেকেই পাড়ার একটা দিদির সঙ্গে পাবলিক বাসে স্কুল যাতায়াত করতাম৷ ক্লাস নাইনে উঠে আর দিদিদের লাগে নি, আমিই তো তখন ‘দিদি’, তাই নিজেই বাসে ফেরা। খুচরো পয়সা রাখা, বাসে যাতায়াতেই মেন্টাল ম্যাথ শেখা৷ তখন তো abacus আবিষ্কৃত হয় নি,ঐ বাবার সঙ্গে বাজারে যেতে যেতে আর ২১৯ বাসে বাঙুর থেকে ক্লাইভ হাউস যাতায়াতেই আমার যতটুকু মৌখিক অংক প্র্যাক্টিস করা। আসলে মূল কথা হল তখন এর বেশি দরকার লাগে নি। এখন দরকার লাগে… তাই abacus শেখা এখন extra-curricular এর মধ্যেই পড়ে প্রায়৷
বাবার কাছে অঙ্ক করতাম। কি যে উত্তাল বকা খেতাম! কাটা দিত বড় করে আর ছোট্ট করে রাইট৷ বাবার কাছে অংক করেই মাধ্যমিকে ৯৫ পেয়েছিলাম। এই সদ্য, কয়েকদিন আগে বাবাকে টিনটিনের জন্য ক’টা মেন্টাল ম্যাথস-এর প্রশ্নপত্র বানাতে দিয়েছিলাম। আমার ছোটবেলার মতোই যত্ন করে বানিয়ে দিয়েছে। এই প্রশ্নগুলো দেখলে বাবার সঙ্গে বাজারে যাওয়া আর ২১৯ বাসের দিনগুলো মনে পড়ে যায়…যা স্মৃতিতে এখনও অমলিন।
(পরের পর্বে বোর্ড পরীক্ষা, টিউশন এবং স্কটিশ কলেজের গল্প)।
[পর্ব ৫ – বয়:সন্ধির আরও কিছু ঘটনা ও স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশন]
ছাত্রী জীবনের স্মৃতি পড়তে ভালো লাগছে! সরল স্বাভাবিক লেখা মন কেড়ে নেয়।
Nostalgic. Golden period of life. Khub bhalo laagche porte. Next episoder jonno wait kore thaklam.
Khub valo laglo. Keep it up.