মুশকিল হইয়াছে অন্য। জগৎ তো আর বসিয়া নাই।সে চলিতেছে।ফলত জন্ম, মৃত্যু, রোগ,ভোগ সবই চলিতেছে।কিন্তু আমি সীমারেখাটা খুঁজিয়া পাইতেছি না।সে আর আমি কবেই বা পাইতাম।সেই কত কাল আগে তাই নিয়া পদ্য লিখিয়া দুই বাংলার বেশ কিছু মানুষের কাছে প্রিয় হইয়াছিলাম। তবে তখন লিখিয়াছিলাম।আর এখন ঢুকিয়াছি।মানে সত্য সত্য টানেলে ঢুকিয়াছি।তাহা হইলে আমরা কি বলিতে পারি লেখা হইলো সত্যে পৌঁছিবার সলিতা পাকাইবার পর্ব?প্রদীপ প্রজ্জ্বলন হইতে পার হইতে হয় সুদীর্ঘ পথ।এই সেই পথ যা সীমাহীন!হ্যাঁ তা যা বলিতেছিলাম,জন্ম মৃত্যু বিষয়ক। ভারতীয় দর্শনের আমি অ আ ক খ ও জানিনা।আমি কীরূপে ব্যাখ্যা করিবো জন্মই বা কী,মৃত্যুই বা কী। আত্মা সম্পর্কে আমার ধারণা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া কিছু বই মাত্র।তাই কেহ ইহার মধ্যে দর্শন বা উচ্চতর কোনো জ্ঞানগম্যি আশাও করিবেন না। তর্কে আমি বহু দূরের বাসিন্দা।আমি আমার মনের স্থিতি ব্যাখ্যা করিতে পারি।বরং পরে তাহা সেলোফিন পেপারের তলায় ফেলিয়া বা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রাখিয়া যে যাহার মতো তত্ত্ব খাড়া করিয়া লইবেন। আপনাদিগের সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণের নিমিত্ত ব্যাপকার্থে আমার মস্তিষ্ক তো প্রদান করাই আছে বলিয়া আমার অনুমান।


মানুষ ঘনঘন মরিতেছে।চিরকাল মরে।রোগে ভুগিয়া মরে,না খাইতে পাইয়া মরে,রেলে কাটা পড়িয়া মরে।স্বাভাবিক ভাবেও মরে।জন্মিলে মরিতে হবে এ আর নতুন কথা কী! নতুন হইলো এই যে যখন বিস্তর লোকে মরে তখন আর তাহা বিশ্বাসযোগ্য থাকে না।এতো দিন ধরিয়া সভ্যতার ধ্বজা উড়াইয়া এখনো যদি আমরা রোগের ওষুধ না বাহির করিতে পারি তবে বিজ্ঞানীদিগের পাততারি গুটাইবার সময় হইয়া আসিয়াছে বলিয়া ধরিতে হইবে। যেইভাবে পৃথিবীর দারিদ্র্য সূচক মুষ্টিমেয় মানুষের ফুঁ এর উপর এখনো নির্ভরশীল ঠিক সেইভাবে মিথ্যার ফুঁ এর উপরও নির্ভরশীল সত্য। এইখানেই গন্ডগোল পাকিয়াছে।আমার আর কোন কিছুই সত্য বলিয়া বোধ হইতেছে না।কার যে পুনর্জীবন লাভ হইবে আর কে যে সত্যই চলিয়া গেলেন বুঝিতে পারিতেছি না।এমন তো হইতে পারে না দেড় দুই বৎসর ধরিয়া পৃথিবীতে কোন মৃত্যুই ঘটে নাই।কিন্তু আমি যেরূপে সমগ্র পৃথিবীকে আমার রঙ্গমঞ্চ বানাইয়া তুলিয়াছি তাহাতে সকলই অভিনীত বলিয়া বোধ হইতেছে। তা ভালো। মৃত্যু এমন একটা কিছু আহামরি বস্তু নহে যে তাহাকে সত্য ভাবিযা শোক করিতে হইবে।মৃত্যুই একমাত্র সত্য ইহা ভাবিলে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে কিন্তু ফাজিল কালেজ পড়ুয়ারাদিগের নিকট তাহাতে অজ আর অগ্রজের তফাৎ ঘাঁটিয়া যায়।আর সেইসব দুর্বল মুহূর্তে শ্মশ্রু প্রসঙ্গ তুলিয়া গুরুকুলকে তাহারা বারংবার বিরম্বনায় ফেলে।
হয়তো তাৎক্ষণিক শোক হইতে মুক্তি পাইতে চেষ্টা করিতেছি।বা শোক ইত্যাদিতে আমি প্রকৃতই এমনই ভীত যে তাহা লইয়া আর ভাবিতে ইচ্ছা করিতেছে না।এ কী স্বাভাবিক আচরণ?মৃত্যু হইলে আহা বলিতে হইবে।ক্যমু তো আর একা আমি পড়ি নাই।বরং আমি অতি সামান্যই পড়িয়াছি।তাই বলিয়া কাহারও চরিত্রে এমন উদ্ভট লক্ষ্মণ দেখা যায় না। সামাজিকতা বলিয়া একটি বস্তু আছে।যাহাতে আমার শঙ্খদোষ আছে।তথাপি যেটুকু সৌজন্য না দেখাইলেই নয় তাহা দেখাইতে গিয়া নিজের এমন বেমানান লাগিতেছে! প্রক্ষোভ লইয়া কিঞ্চিৎ চিন্তিত আছি। মানুষ যন্ত্রে পরিনত হইতেছে নাকি যন্ত্র মানুষে!স্যাম্পেল ফাইল সর্ব সময়েই অধিক গুণমান সম্পন্ন হইয়া থাকে!
গীতা পড়িয়াছিলাম বাল্যে।তারপর বহুবারই। কিন্তু ওই ধোঁয়া ধোঁয়া। কেউ সেইভাবে বলিয়া বা বুঝাইয়া দেয় নাই।নিজে যা বুঝিয়াছি তাহা কখনো যথেষ্ট ছিল না। আজ মনে হইতেছে না বোঝার ভুলভুলাইয়া বোধহয় বোঝা হইতেও মারাত্নক। নাকি একেই প্রকৃত বোঝা বলে!!
যাহা হউক পথ হারাইলে কপালকুণ্ডলা না আওড়াইয়া আমি গজব কা হ্যয় দিন সোচ যারা, গাহিবার পক্ষপাতি। তুম হো একেলে হাম ভি একেলে থেকে ব্যক্তি প্রশমিত হইলেই তো সে নিরাকার! তবে অত কঠিন করিয়া ভাবিবার প্রয়োজন কি?আগুনের শিখা বা মাটির অন্ধকার কোনোটাই তো ছুঁইয়া দেখিবার জন্য খুব একটা নিরাপদ নহে। অসার না হইবা পর্যন্ত প্রদাহ অবশ্যম্ভাবী।

কান্না কিছু কম পড়িয়াছে না আমি ক্রন্দন অগ্রাহ্য করিয়াছি তাহা বিতর্কের বিষয়।ভাবিয়াছিলাম নিজেকে খুন করিব।(না কেহ আক্ষরিক অর্থে এ কথা ধরিবেন না।শাস্ত্র ঠিকমতো না পড়িয়াও সোজা হিসাবেই বুঝিতে পারি নিজেকে হত্যা করা অপরকে হত্যার সমানই অপরাধ। আমি এর ঘোরতর বিরোধী।) তাহা হইলে এমন সোনার পাথর বাটি মার্কা উচ্চারণ কেন? কেন টেন তাহা বলিতে পারিব না।ইচ্ছা হইলো তাই বলিলাম। অনুভব না করিয়া কে আর কবে প্যাডম্যান হইতে পারিয়াছে।সারাদিন ধরিয়া মনে হইলো নিজের টুঁটি টিপিয়া ধরি। ভাগ্যি মানুষের মনে যাহা হয় তাহাই বাস্তবে সে করে না।নচেৎ কোনো আপিসেই বসের চেয়ারে কেউ আর থাকিত না।হয় অপঘাতে মৃত্যু হইত অথবা হইতে পারে এই আশঙ্কায় বোঁ বোঁ করিয়া চেয়ার ঘুরিয়া যাইত, বসিবার লোক পাওয়া যাইত না।ইচ্ছা হইলো নিজেকে দুমড়াইয়া মুচড়াইয়া দলা পাকাইয়া বোতলের মধ্যে পুড়িয়া ছিপি আঁটিয়া দিই। কিন্তু দেখিলাম হইতেছে না। দুলিয়া দুলিয়া সে চারার অঙ্কুরোদগম হইতেছে।বোতল ফুঁড়িয়া সে মাথা তুলিতেছে।এখন এ যদি শুধু সাহিত্যের নিমিত্ত সাহিত্য হইত তাহাতে সমস্যা ছিল না।অমন ঐন্দ্রজালিক ভাষা আমরা অনেক পড়িয়াছি।কিন্তু মুশকিল হইলো আমি তো প্রতিটি ভাবনা ভাবিয়াই ভাবি অসি চালনা করিলাম।ফলত অকারণে ক্লান্ত হইয়া পড়ি। ডন কিহোতে পড়িয়াছি অনেক পরে।যদিও বইটি এই মুহূর্তে তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়াও পাইলাম না।এইটিও বহু পান্ডুলিপির মতো কোথাও উধাও হইয়া গিয়াছে কিনা কে জানে।বই হারাইলে বই পাওয়া যায় কিন্তু পান্ডুলিপি হারাইলে পান্ডুলিপি পাওয়া যায় না।যা পাওয়া যায় তাহা হইলো ওই অসি চালনার অভ্যাস। আর অদৃশ্য অর্থহীন এই লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত স্বঘোষিত ডনের অবস্থা মিলাইয়া লইবার জন্য আমার বর্তমান অবস্থা খুবই জুতসই। কিন্তু এই মিলানো ব্যাপারটাই আমার অসহ্য লাগিতেছে। মিলাইতে মিলাইতে আমি গল্পের গরু কে গাছ হইতে অন্তরীক্ষে পাঠাইয়াছি। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু! বাস্তবিক। না জানি আর কতকিছু মিলিবে।দিব্যি মতো পান খাইয়া ঢেকুর তুলিয়া সাহিত্য মঞ্চ কাঁপাইয়া,ধ্বজা উড়াইয়া প্যান্ডেমনিয়াম ব্যাপার করিয়া দিতেছে সব্বাই। আমি কিছু দেখাইলাম বটে! তাও কোথায় লিখি? না হাওয়ায়।এয়ারে।অমল ধবল পালে।অঙ্গে জড়াইলে যাহা নামাবলী।


তা জ্যান্ত মরা আবার হইবে কীভাবে? তন্ত্র সাধনায় ওইসব অনেক রকম কিছু হয় শুনিয়াছি।কিন্তু ওসবে আমি কখনো আগ্রহ প্রকাশ করিনি।সত্যি বলিতে কী কেউ যদি আমায় জিজ্ঞাসা করেন তুমি কি এসব বিশ্বাস কর? আমি বলিব আমি ভয় পাই।আর যা বা যাহাকে মানুষ ভয় পায় তা সর্ব সময়ই এড়াইয়া চলে। আমার মন সেমি বিজ্ঞানমনস্ক। যদি আমাকে কেহ বলেন ঈশ্বর বিশ্বাস করি কিনা,আমি বলিব একশ ভাগ।কিন্তু যদি বলেন যুক্তি দেখান।আমি পারিব না।শুধু বলিব আমার কাছে প্রতিটি শব্দ ঈশ্বর, সুর ঈশ্বর,অনুভূতি ঈশ্বর। অক্ষর কখনো তা প্রকাশ করতে পারে,কখনো পারে না।আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি শুধু এই কারনেই যে অধিকাংশ সময়ে আমি তা অক্ষরের মধ্যে দিয়ে ধরতে পারি।স্পর্শ করতে পারি। তাই আমার স্বভাবসুলভ মস্তানিতে আমি ভাবিয়াছিলাম মরা মাছ ও যেইরূপে কড়াইয়ে উপর লাফাইয়া ওঠে শেষবার জীবনের প্রমাণ দিতে আমিও তেমনই অবিশ্রান্ত লম্ফন কম্পন দেখাইয়াই যাইবো যে ধরিবে,যে কাটিবে যে রাঁধিবে সবাইকে।
চলিল পারস্পরিক লম্ফঝম্পের খেলা। আমার চারপাশের মানুষজন আমার নিমিত্ত ভেক ধরিল।কেহ হলিউড কেহ টলিউড কেহ স্যন্ডেলউড।আমার ছোট্ট শহর উডল্যান্ড হইয়া উঠিল। হাতের মুঠিতে সবই রূপোলী। চেনা মুখে বসানো অচেনা কথা। আমি যে কথা শুনিতে ব্যকুল তাহাই বলিতেছে যেন কেহ।কে বলিল তাহা তো বড় কথা নয়,তাহা উচ্চারিত হইলো এই যথেষ্ট। আর এইসব সমবেত উচ্চারণ আমাকে আরও একধাপ আগাইয়া দিল। কোথায়? জানিনা তো!!
পথে চলে যেতে যেতে…আমার প্রতিবাদের ভাষা..লেখক হইতে চাহিয়াছিলাম,ক্রমশ নেতা হইয়া উঠিতেছি।( সর্বক্ষেত্রে লিঙ্গ নির্ধারণ আবশ্যক নহে,যদিও অপরাধও নহে,এক্ষেত্রেও আমি নিরপেক্ষ পাতসীমান্ত)।নেহাত হাওয়ায়, হাওয়ায়…তাই রক্ষে।
মরা আর হইলো না।ভাবিয়াছিলাম কাঁদনও বন্ধ করিবো। কিন্তু পরে ভাবিয়া দেখিলাম ও একটু থাক।জলসিঞ্চন কিছুটা আবশ্যক ও বটে।না হইলে যে পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার হইতো না। আর ওইটুকু না থাকিলে ধ্বজা উড়িবে কীরূপে!ওই কানেকশন টানেকশনের ব্যাপার আর কী!!


আজকাল খুব কষ্ট হয়।মনে হয় বিস্ফারিত এ চক্ষু কি অক্ষিগোলক হইতে বাহির হইয়া আসিবে? এতো দেখিবার কী আছে যে আমি দেখিতেছি?সেই সবুজ ধানক্ষেত, নীল আকাশ,শুকনো পাতা ঝুলে থাকা কলাবাগান,ফসল উপড়াইয়া ফেলা বিবর্ণ মেঠো জমি। অসংখ্য মানুষের বাক্স প্যাঁটরা, কেহ আধুনিকা,কেহ সনাতনী। এখনো গিজগিজ করিতেছে মানুষ। এত্তো এত্তো বৎসরের মানব সভ্যতা অথচ এখনো মানুষের নখ ছত্রাক মুক্ত হইলো না।ত্বক পেলব হইল না।পোশাক পরিপাটি হইলো না।এখনো রেল স্টেশনে মরিচা পড়া টিনের দোকান,এখনো নোনা ধরা ঘরের দেওয়াল।কবে ছুটিবে মানুষ ইয়া বড় বড় ঝাড়ু আর নিড়ানি হাতে,ব্রাস আর বালতি হাতে।কেন প্রকৃতই বিজ্ঞাপনের মতো হইবে না দুনিয়া।কেন সুন্দর আসিবে না মানুষের কাছে।সহজেই কেন দুনিয়া হইয়া উঠিবে না রূপকথা। এই সব ভাবিতে ভাবিতে আমার চক্ষু স্ফিত হইয়া ওঠে।আর জায়গার অতিরিক্ত ফাঁপিয়া উঠিলে যা কিছুর বিস্ফোরণ অবশ্যম্ভাবী। তাই শংকা হয়, সেই চিরাচরিত শংকা।

মানুষ গলন্ত,ফুটন্ত ভূগোলকে বসিয়া যদি ইতিহাস, বিজ্ঞান সব ভুলিয়া নিশ্চিন্তে ঘুমাইতে পারে এ আর এমন কী। মানুষ আঁকশি দিয়া বিদ্যুৎকে আসমান হইতে হাতের মুঠিতে আনিল।গ্রহ নক্ষত্র বশ করিল।সেখানে বসতি গড়িবার পরিপাটি বন্দবস্ত হইতেছে। অথচ.. না আর লিখিব না।কি হয় লিখিয়া? ইচ্ছা করিলে দুচারিটি গদ্য, কবিতা অমনিই লিখিতে পারে লোকে।দুপাত্তর সুরা পেটে পড়িলে যেভাবে গাইয়ে হইয়া ওঠে মানুষ।স্নানঘরে হয় সঙ্গীতজ্ঞ! আর আপনার পকেটে ডলার আসিলে আপনি আবার এইসবসুদ্ধও করিতে পারেন পকেটস্থ। মূল্যের বিপনিতে দুর্মূল্য আর কিছুই নহে।অতএব চোখ বুঁজিয়া থাকা অভ্যাস করুন বৎসে,তাহাতে আপনারও মঙ্গল, জগতেরও। ডুবিয়া মরিলেও টের পাইবেন না।উত্তাপ বাড়িলে পিঠ ফিরিয়া শুইয়া অপেক্ষা করিবেন মহা প্লাবনের।পৃথিবী রসাতলে হইলে আপনার কী,আপনি তো তখন রূপকথার দেশে প্রাসাদ বানাইতেছেন,হাওয়ায়..হাওয়ায়।
আত্ম প্রবঞ্জনা করিব না।আমিও আসলে দেখিনা কিছুই,আমি আসলে খুঁজি,খুঁজি মানুষের অনন্ত লোভের পরিসমাপ্তি কোথায়…!

এখন হইতে চুরি হইবার জন্য লিখিব।চুরি করিলে তো ননী চুরি গোপালই করিবে। মানে ওই আমার ছানাপোনা,খোকা খুকুর দল।তা করুক।উহাদিগের প্রতি আমার প্রশ্রয় অব্যাহত। আগলাইয়া রাখিয়া এযাবৎ লাভ বিশেষ কিছু ঘটে নাই। প্রকাশকরা হিসাব পত্র দেবার কালে হাত উল্টাইয়া দেন।এ অভ্যাস তাহাদিগের আজিকার নহে।তাহা লেখক মাত্রেই বিলক্ষণ জানেন।লেখক দেখিবামাত্র অধিকাংশ প্রকাশকের কুম্ভীরাশ্রু বর্ষিত হয়।বই বিক্রিতে ভাঁটা পড়িয়াছে বলিয়া। লেখকের যক্ষা হইবে ইহাই দস্তুর। ইহার অন্যথা নাই।না হইলে প্রকাশক মোটরগাড়ি হাঁকাইবেন কীরূপে! এক্ষেত্রেও সর্বহারা নেতা মন্ত্রীদিগের কথা স্মরণে আসিতে পারে।কেহ কেহ আদর্শ রক্ষা করিয়া চলেন।প্রকাশ্যে কাঁদুনির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখিয়া।কাহারো বা সেই সৌজন্যটুকুও নাই। অতএব লিখিয়া অর্থ উপার্জন ওই সান্তনা মাত্র। তাহা চাকুরির বিকল্প হইতে পারে না।তাহা হইলে লেখকের হাতে পেনসিল বই আর কী রহিল?


যাহা রইলো তাহাই আমার মিলিয়া যায় ওই খোকাখুকুর দৌলতে।লোকের মুখে মুখে ফেরে আমার লেখা।আর কী বা চাই।এক্ষণে প্রশ্ন জাগিতে পারে তাহা হইলে শোক কীসের? আসলে অনুমান তাহা জুম করিয়া দেখা বৃহৎ অক্ষরের ন্যায় স্পষ্ট হইলেও প্রমাণিত নহে।আর যতক্ষণ প্রমাণিত নহে ততক্ষণ এই লোভের দুনিয়ায় ইতিহাস মনে না করিয়া উপায় কী?
বর্তমানে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর। এখন লেখক হইতে গেলে আগে উদ্যোগপতি হইতে হইবে।উদ্যোগপতি হওয়া খারাপ কিছু নহে।বরং জগৎ সংসারে তাহাদিগের অবদান লেখক সাহিত্যিক অপেক্ষা বেশি বই কম না।কিন্তু মুশকিল হইতেছে লেখক হইবার সঙ্গে এই শর্ত জুড়িয়া গিয়াছে।
কেহ লেখক হইতে পারেন।কোনো উদ্যোগপতিও লেখক হইতে পারেন।কিন্তু কেবলমাত্র উদ্যোগপতিরাই লেখক হইবেন এ ভয়ংকর। কিন্তু তাহাই হইতেছে।যাহার যত ক্ষমতা তিনি তত বড় লেখক। ক্ষমতা এক্ষেত্রে দুই প্রকারের।এক অর্থনৈতিক দুই সাংগঠনিক।যাহার প্রথমটি রহিয়াছে তাহার আর কিছুরই প্রয়োজন নাই।তবে তাহা সামান্য অর্থে নহে। পরিপার্শ্ব হইতে অনেকাংশে অধিক হইবার প্রয়োজন। আর দ্বিতীয়টির জন্য প্রয়োজন অফুরন্ত উৎসাহ আর শারীরিক সক্ষমতা। দৌড়ঝাঁপ, অনুষ্ঠান,ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ইত্যাদি। যোগাযোগ ও তৈলমর্দন বলিয়া তাহাকে ছোট করিতে চাহি না।বাস্তবিকই নহে। সেসবও আছে তবে তাহা সত্যিই স্বল্প পরিমাণ। কারণ এইসবের নিমিত্ত প্রচুর শ্রমদান করিতে হয়।শ্রমের বিনিময়ে যা কিছু অর্জন তাহা আর যাহাই হোক হেলাফেলার নহে। শুধু ঘরে বসিয়া পাতা ভরাইয়া কিছু পাইবার নাই।আর এইখানেই ঘটিয়া যায় বিপত্তি।এই বোধ অধিকাংশের এতো শীঘ্র আসিয়া পড়ে যে আসলের ঘরে পড়িয়া থাকে ফাঁকি। কেহ বলিতে পারেন অমুকে খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান, ও কী স্বীকৃতি পায় নাই,তমুকের কত দূরবর্তী গ্রামে বসবাস। আজ্ঞে হ্যাঁ অমন দুই চারিজন না জুটাইলে এইসব অভিযোগ খন্ডন হইবে কেমন করিয়া।আর তার বদলে মিলিবে অনুগত জনে কেন কর এতো প্রবঞ্চনা…
অতএব দিন শেষে ইহাই জানা গেল,লেখক হইতে গেলে আগে বোকা হইতে হইবে। শেষ জীবনে উচ্চিড়িংগের ন্যায় লাফাইতে হইবে না হইলে ফ্যালফ্যাল করিয়া আকাশের দিকে তাকাইয়া কাটাইতে হইবে।নাহইলে এটা হইতে হইবে,নাহইলে ওটা হইতে হইবে।এতসব জানিবার পর কেহ কি আর লেখক হইতে চাহিবে!
লিখিয়া হইবেই বা কী,না লিখিলেই বা কী হয় এই প্রশ্ন মনে উত্থাপিত হয় নাই এমন লেখকও পাওয়া ভার। কবির আধিক্য দেখিয়া একসময় কবিতা লেখা ছাড়িয়া দিয়াছিলাম।এখন প্রশ্ন উঠিতে পারে আমি কবিতা ছাড়িয়া ছিলাম না কবিতা আমাকে ছাড়িয়া গিয়াছিল।কারণ আমি আজও মনে করি জোর করিয়া কবিতা লেখা যায় না।অন্তত যাহা লেখা যায় তাহা কবিতা পদবাচ্য নহে।ইচ্ছা করিলেই কবিতা লিখিয়া ফেলা যায় না।সম্পাদক চাহিলে গোটা দুই গল্প নামাইয়া দেওয়া যায়,চাহিলে উপন্যাসও।কিন্তু তাই বলিয়া কবিতা নহে। কবিতা ব্যক্তি নিজে লেখেন না।তার সূত্র অন্যকোথাও অন্যকোনখানে।এখন এখানেও আবার প্রশ্ন।চাহিদার সঙ্গে খানিক সংগতি রাখিয়াই কি জোগান সম্পন্ন হয়? কবিতার জোগান আমার সবসময়ই চাহিদার অনুপাতে বেশি।যখন চাহিদা অধিক ছিল তখনও,যখন কম ছিল তখনও। তবে কী করিয়া মেঘের আড়ালে লুক্কায়িত হইয়াছিল আমার কবিসত্তা জানিনা।দীর্ঘকাল আমি খুব কম কবিতা লিখিয়াছি।আসলে সে বড় অভিমানী। আমারই মতো হয়তো। আবার যখন সে ফিরিয়া আসিল তুমুলভাবে আসিল।যেন সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে। এখন তাহা থামাইয়া রাখি কী প্রকারে? কোনো দিন কেহ কি পারিয়াছে?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য চুরি লইয়া এই পড়ন্ত বেলায় ( ধুর কয়েক ঘন্টা বাদেই পুনরায় যা উঠিয়া পড়িবে তাহা আবার পড়ন্ত হয় কীপ্রকারে! এই সব বহু ব্যবহৃত শব্দ প্রয়োগে আমি আদৌ রাজি নই)বরং বলা ভালো নতুন করিয়া ভাবিতে বসিয়াই বা আর কী করিব। কোন শৈশব হইতে আমার কী কী চুরি হইয়াছে,আর সেসবে আজ কী প্রকার অত্যাশ্চর্য বোধ হইতেছে সে গল্প আর একদিন করিব।সাসপেন্স বজায় থাকুক। যদিও জানি আমার কাছে যাহা সাসপেন্স সে রহস্যের সমাধান হয়তো হইয়াই গিয়াছে।কিছু আমি নিজেই লিখিয়াছি, কিছু লিখিয়াছে আমার পরিপার্শ্ব। তথাপি আমার ঘোর আমি কীরূপে বর্ণনা করিব সে ব্যাপারে উৎসাহ থাকা স্বাভাবিক। আমার নিজেরই আছে আর অন্যের তো তা থাকিবেই। আর এই উৎসাহে পাখি খাঁচায় বন্দি থাকিবে আরও কিছু দিন আর বলিবে দাও আরও আরও দাও প্রাণ।

[ক্রমশঃ]

[পূর্ববর্তী পর্ব]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, অক্টোবর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

0 0 ভোট
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
4 days ago

রম্য রচনা টি পড়িয়া নিজেকে ওই খাঁচার পাখির মত মনে হইল! আরও দাও আরো দাও বলিয়া লেখিকার পরের পর্বের জন্য ছটপট করিতে লাগিলাম!