বুঝিলাম মোক্ষলাভ সম্পন্ন হইয়াছে।কলি যুগের যাহা কিছু বোঝা এতোকাল পিঠে লইয়া ঘুরিয়াছি তাহা ভাষাবৎ উড়াইয়া দিয়াছি মেলা মধ্যে। গুচ্ছের বই কিনিয়াও আমার কোনো রূপ আবেগের উদ্রেক হয় নাই অন্তরে। টুকি দিয়া মঞ্চ পরিক্রমা করিয়া আসিলেও মনে হয় নাই কেন কোনো বন্ধু নাই সেইখানে। ট্রেন কম্পানি কিম্বা টোটো কোম্পানির মতো মেলা চষিয়া ফেলিলেও মনে হয় নাই এ আমার পরিচিত স্থান।অথবা মনে হইয়াছে যে গ্রহের মধ্য দিয়া আমি হাঁটিয়া যাই সেই গ্রহের আমি আর কেহ নই।তোমরা সকলে মিলিয়া যে খেলা খেলিলে তাহাতে তোমাদের মনোরঞ্জন হইলো বটে আমার কিছুই হইলো না একথাও বলা যায় না।আমি যাহা যাহা কিনিব ভাবিয়াছি মন্ত্রবলে তাহা আমার হাতের নাগালে আসিয়া গিয়াছে। তোমরা বলিবে ওই ব্যাগ বোঝাই করিয়া,খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে( যদিও আমি খোঁড়াই নাই।এমনকি আশ্চর্যজনক ভাবে অত বই টানিয়াও আমার তেমন কোনো অসুবিধাও হয় নাই) অযথা ওইরূপ এখন বোকারা করে। তা বটে,আজকাল ঘরে বসিয়া সব মেলে। এমনকি বাঘের দুধও। কিন্তু আমার মাঝে মাঝে বোকা সাজিতে সাধ হয়।অসংখ্য ভিড়ের মধ্যে একমাত্র বোকা মানুষ যার এক কাপ চা খাইবারও সঙ্গী মেলে নাই। তবে আমি তোমাদের সত্যি বলিতেছি,তোমরা আমাকে আঘাত দিয়াছ আমি তোমাদের রেলগাড়ি দিব।তোমরা আমাকে ফাঁকা মঞ্চ, চোখা মঞ্চ,বক্তৃতার ঘনঘটা অনেক দেখাইলে আমি তোমাদের কিচমিচ পাখির ডাক শোনাইবো যা অবিকল মানুষের মতো। পাঠক সমাবেশে আজ আমার ভালোই কাটিল দুদন্ড। বইমেলার সাজসজ্জা খুবই যথাযথ হইয়াছে।আমার ক্লাসরুমের মতো কিম্ভুত হয় নাই।আসলে ওরা যে খুব ছোট। প্রথম প্রথম দিব্যি খেলা খেলা পড়া চালাইয়া লইতে পারিতেছিল, কিন্তু এখন হাঁপাইয়া উঠিয়াছে। যাহা হোউক দৌড় ঝাঁপ না করিলেও উড়িয়া উড়িয়া ঝুলিতে যাহা আসিয়া পড়িল তাহাও মন্দ না। প্রহসন শেষ হইলো। বঙ্কিম বাবু দেখিলেন সেই তমাল তলে আসিয়া ধপ করিয়া থলে দুখানি নামাইয়া আমি বসিয়া পড়িলাম। অদ্যকার মেলা পরিক্রমা সমাপ্ত হইলো। আমরা হকার। আমাদের কাছে চিনে বাদাম থেকে ঝালমুড়ি, প্রতি ঠোঙায় বিপ্লব। আমরা গ্রাম দিয়া শহর দখল করিবার কাজ সম্পন্ন করিয়াছি তোমরা জানিতেও পারো নাই।
অতঃপর বইমেলা ও আমার ব্যাগওয়ালা। বইমেলা হইতে আমি দুটি ব্যাগ কিনিয়াছি চটের। ব্যাগওয়ালা এতো যত্ন করিয়া ব্যাগে আমার বইগুলি ভরিয়া দিলেন যে পর দিন ভোর বেলা ঘুম ভাঙিয়া সেই কথা চিন্তা করিয়া আমার আঁখিপল্লব কিঞ্চিৎ সিক্ত হইলো। এখনো যে আমাকে আর্দ্র করিতে পারে সেই আমার আপনজন। হ্যাঁ ভেজাভেজি লইয়া বিস্তর খিল্লি হইবার পরও।



ক্যাল সিয়াম বা চুনা জাতীয়
ঘনঘন গরু ডাকিতেছে যান্ত্রিক উপায়ে। আমার শ্বশ্রুমাতার বড় সাধ হইয়াছিল তিনি একখানি বই লিখিবেন। এখন লিখিব বলিলেই তো আর লেখা যায় না। তিনি ভালো রান্না করিতে পারেন। তাই আমার ননদিনী ঠিক করিলেন মাতা ঠাকুরানীর একখানি বই তিনি বানাইয়া দিবেন। বাহা প্রস্তাব। ইনি আমার শাশুমাতার মেজ ভগিনী। বেশ।আমি কাল্য নাচিতে নাচিতে গিয়া তাহার বইটিই নগদ একশত ষাট টংকা দিয়া সংগ্রহ করিলাম। মেলায় কেনা ওইটিই আমার প্রথম বই। প্রীতিকনার প্রীতি লইয়া বড়ই প্রীত হইলাম। এবং রান্নার প্রতি তেমন কোনোরূপ আগ্রহ না থাকা সত্বেও বাড়ি ফিরিয়াও সর্বাগ্রে বইটি খুলিয়া বসিলাম ভালোবাসার তাগিদে। হায় ভালোবাসা।এখানেও ঝুঝি ওই গরু আলিঙ্গনের দিন। রান্নার শুরু আছে শেষ নাই। মূল উপাদানই রান্নায় প্রয়োগ করা হয় নাই। এতো উপকারী এক প্রাণীর এইরূপ হেনস্থা কেন যুগযুগ ধরিয়া জ্ঞানী লোকেরা করিয়াছেন তাহাই আজ উপলব্ধি করিলাম।যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি। এখন ভয় হইতেছে যে বইগুলো এতদিন হইতে পড়িব ভাবিতেছিলাম, হাত এবং কাঁধে যন্ত্রণা বাড়াইয়া তাহা গরু যেপ্রকারে বকলস আলিঙ্গন করে সেইরূপে বাড়ি লইয়া আসিয়াছি তাহাও সকলি ভুল বই কিনা! এ সন্দেহ আমার পূর্বেই হইয়াছিল বটে। পোস্ত রান্নায় পোস্তই যে পড়িল না তা বুঝিতে হাতি ঘোড়া অত কিছু জ্ঞানগম্যি লাগে না। আমার মতো আনাড়ি রাঁধুনিও দিব্য বুঝিতে পারে কিন্তু মুশকিল হইতেছে ওইসব জ্ঞানগর্ভ বই ভুল কি সঠিক তা আমার মতো অজ্ঞানী মানুষ বুঝিবই বা কেমনে। দোলাচালে অন্য বইগুলি এখনো স্পর্শ করিতেই সাহস পাইতেছিনা। অতএব সাধু সাবধান। আপনি কতটা খেলিবেন,কতটা খাইবেন বুঝিয়া করিবেন। কতটা পড়িবেন বা কী পড়িবেনও।

পুনরায় ট্রেন ভ্রমণ
মেয়েদের গল্পগুলি বড় বেশি চেনা হইয়া গিয়েছে।এইবার ভাবিতেছি ভেক ধরিয়া ছেলেদের ঠেকগুলিতে গিয়া বসিব। না ঠেক মানে ওই শক্তি সুনীলরা যে ঠেকের গল্প লিখিয়া গিয়াছেন, বাংলা ইত্যাদির ওই ঠেক নহে। কারণ তাহা তাহাদের দৌলতে বহুশ্রুত। বরং বিশুদ্ধ চায়ের ঠেক। সেখানে গল্প কিছু ভিন্ন মিলিতে পারে। মেয়েদের গল্প প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক, প্রাকৃতিক যাহা রক্তের সঙ্গে সম্পর্কিত আর দুই অর্থনৈতিক, যাহা রক্তের সঙ্গে সম্পর্কিত। এক্ষণে আপনারা ভাবিতে পারেন এ আবার কেমন হইলো, দুটি কারণই তো দেখি এক! তাহাদের উদ্যেশ্যে বলি আগে পড়ুন পরে মন্তব্য করিবেন।
প্রথমত প্রাকৃতিক কারণ গুলি ব্যাখ্যা করা যাউক। কাহার বস্ত্রে কতটুকু রক্ত লাগিল, রক্তপাত কতদিন হইলো চলিতেছে, রক্তের রঙ গাঢ় লাল নাকি ফিকে। রক্তপাত বন্ধ হইয়া গিয়াছে না হইবো হইবো করিতেছে। জরায়ু থাকিবে না যাইবে।
এরপর আসি দ্বিতীয় তথা অর্থনৈতিক কারনে। দিন ক্ষণ গুনিয়া সে আসিয়াছিল না এক্সিডেন্টাল? কমাস চলিতেছে।কত খরচ হইবে? সিজার না নরমাল? কথা বলিতে শিখিলো,ভাত খাইতেছে,পটি হইলো। ভর্তি হইলো? ঠিকঠাক পড়িতেছে? জ্বর নামিলো? রক্তক্ষরণ অব্যাহত। শুধু নিম্নাঙ্গে নয়, উর্ধাঙ্গেও। একদম বুকের মাঝখানে। মস্তিষ্কের কেন্দ্রে। চোখের কোলে।কন্ঠনালির ওঠানামায়। স্যালাইন চলিতেছে। সূচ,রক্ত।হাসিতেছে? চারচক্ষুর মিলন হইলো বুঝি! রক্ত আসিয়া জমিল কপালে,কপোলে। শুধু র আর ড় এর তফাৎ যে! প্রবাহমান..
কিঞ্চিৎ অন্য গল্প পাইলে নড়ে চড়ে বসি। আজ শুনিলাম নাগা সন্ন্যাসীর গল্প।উত্তেজিত হইয়া দুই সখী গল্প করিতেছে কী করিয়া বিবস্ত্র হইয়া অমন পদচারণ চলিতে পারে। আমরা তো সভ্য হইয়াছি। যথার্থ কথা। একথা কখনো আমারও যে মনে উদ্রেক হয় নাই এমন নহে। কিন্তু সম্প্রতি ভাবিয়া দেখিয়াছি মার্গ ব্যাপারটা কী বা বুঝি। না বুঝিয়া কেনইবা মন্তব্য করিব। তবে ওই দুই সখীর পুলকে আমিও কিঞ্চিৎ পুলকিত হইলাম। যাক তবু ডাল ভাত সবজির থেকে কিছু আলাদা। কিন্তু অচিরেই তাহারা যে রূপে পাপ পুণ্যে আটকাইয়া গেলো তাহাতে বুঝিতে আমার কাল বিলম্ব হইলো না এ তৈরি করা গল্প। যাহা কৃত্রিম তাহাতে কোনো কালেই আমার আগ্রহ নাই। শুধাইলাম কি করা হয়? শুনিলাম তাহারা ব্লক উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক! ভাবিলাম আপনাদের চারিপার্শ্বে বৃহৎ মৎস্য কুল লাঙ্গুল
নাড়াইয়া জল ঝাপটাইতেছে আর আপনারা পাপ খুঁজিতে নাগাল্যান্ড! উষ্মা চাপিতে গিয়াও দু এক কথার বুড়বুড়ি উঠিয়া গেল জলে। ব্যাগ উঠাইয়া দ্রুত পাশ কাটাইলাম।এরপর কোন দিন মার খাইবো।বলি লোকে কি আমার জন্য গল্পও করিবে না চোখে আঙুল গ্রানি! ঠাঁসিয়া ধরিলেও তুমি ফ্রান্স দেশ কপচাইবে তাও আবার কিছু না জানিয়াই!


কিটস, রক্তবমি ও কুমির ছানার গল্প।

শেয়ালের গর্ত হইতে মাঝে মাঝেই কুমিরছানা বাহির হইতেছে। সখী ভালোবাসা কারে কয়। টিবি হইলে এখন আর কেহ মরে না। জন্মমাত্র চামড়ার ঠিক নিচে অতি নিপুণতায় তাহা বিন্দুবৎ প্রবেশ মাত্র শুরু হইয়া যায় প্রস্তুতি দখলদারিত্বের। বুদ্ধি বনাম নিয়তি। এবং অবধারিত ভাবে লিখিত হয় জীবনের জয়গান। আরে গাইতে দেয় না বলে বলিলেই চলিবে? তুমি কি পুত্তলিকা যে চক্ষু আছে তবু দেখিতে পাও না। তোমার আছে হারমোনিয়াম। আছে বেলো। হাওয়া বাহির হইলেই ভ্যাঁ। আর বুঁচকি তো কবেই বলিয়া গিয়াছে ভ্যাঁ মানেই হ্যাঁ। বেলোয়ারি রিঅ্যাকশন।
সকালে আপিস মানে আমার কাছে এক বিরম্বনা। সে আজ হইতে নহে।পুরা কালে যখন ইস্কুলের ঘন্টা বাজিলে ফাটকে তালা ঝুলিত সেই কাল হইতে ওই হাঁপাইতেছি।তথাপি রোগ সারিল না। প্রাত্যহিক ক্রিয়া কর্মে যে সময় বরাদ্দ থাকিত তাহাতে কদলি চিপসের প্যাকেটে হাওয়া ঢুকিবার মতো বিরতি ঢুকিয়া যাইত বেশি। ভুলিয়াই যাইতাম ওইদিকে সিটি বাজিয়া গেলো। আজও সেই একই প্রকার। স্লাইড শো চলিতেছে তো চলিতেছেই।তবু কী প্রকারে এত্তোদিন এই বস্তুগত পৃথিবীতে টিকিয়া গেলাম তাহা এক রহস্য বটে। ওয়াটসনের আতসকাচ না হোমসের পরিচালন স্রোত কোন শক্তিবলে কে জানে।


পাতার পর পাতা লিখিতাম, প্রাণপণ আমার বন্দি অবস্থা অস্বীকার করিবার জন্য। ঢং ঢং করিয়া ঘন্টা বাজিত। নীল পার সাদা শাড়ি থালা হাতে লাইনে গিয়া দাঁড়াইতাম উন্মাদ আর অপরাধীর সহাবস্থানে। যে সঠিক ভাবে জানেই না এটা হাসপাতাল না কারাগার। তার কী সংশোধিত হইতেছে শরীর না মন না তার কলম। নাকি এটা তার সর্বাপেক্ষা নিরাপদ আশ্রয়, গৃহকোণ। কীভাবে যেন টের পাইয়াছিলাম আমার লেখা মানুষ পড়িতেছেন। ব্যাস। ওই ছিল আমার শক্তি,আমার সম্বল।
এক্ষেত্রে লিখিতে ইচ্ছা করিয়াছিল ওই আমার শক্তি, ওই আমার সুনীল। (যদিও সুযোগ থাকিলেও গোষ্ঠীবদ্ধ হইবার কোন উদ্যোগই আমি কখনো দেখাই নাই। তাই বুঝি আমার এই রূপ হাঁড়ির হাল। শুধু লেখকের লেখাগুলিকে আঁকড়াইয়া রাখিয়াছি। যাঁরা স্বর্গ গত তাঁরা কী জানেন স্তাবক বৃত্তের বাইরে খুব নির্জনে কোথাও গড়ে ওঠে তাঁদের কলমসন্তান!) কিন্তু লিখিলাম না। কারণ শব্দ নিয়ে খেলার একটা মারাত্নক নেশা।তাহাতে সঠিক জায়গায় লাগাম টানিতে না পারিলে গদ্যের গুরুভার কিছু ম্লান হয়। ননসেন্স এও কিছু সেন্স তো আবশ্যক। আজ আর সম্পাদকের ভয় নাই। তাই একথা নির্ভয়ে বলিতে পারি যে মহাজ্ঞানী মহাজনেরও দু এক সময় অতি পিচ্ছিল পথে এক্কাদোক্কা করিতে গিয়া পা হড়কাই যায়। জামায় আমি এসেন্স দিছি বলিয়া এড়াইয়া গেলে তো আর চলিবে না।
কী খাইতাম টের পাইতাম না।ঘুমাইয়া উঠিলাম কিনা তাহাও বুঝিতাম না।ঘুম পাইতেছে বুঝিতাম।পরবর্তী অধ্যায়টুকু ভাসমান বেলুনের মতো। বায়বীয়। ইমার্জেন্সি, আন্ডারগ্রাউন্ড এইসব শব্দবন্ধ ইতিহাস বইয়ে পড়িয়াছি।সাহিত্যে পড়িয়াছি।লিখিয়াছিও।
আজ উপলব্ধি করিতেছি। পুলক লাগিতেছে এই ভাবিয়া যে জীবন আমাকে কতকিছু শেখাইলো! নিজের পোট্রের্ট করবার জন্য আয়নার সামনে গিয়া দাঁড়ানোই তো একজন শিল্পীর কাজ। আমার ব্যথা যখন…

[পরম্পরা ওয়েবজিন, সেপ্টেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

5 1 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
আইভি চট্টোপাধ্যায়
আইভি চট্টোপাধ্যায়
1 month ago

দুর্দান্ত।