কুখ্যাত লালু মস্তান। ওয়ান শটার হোক বা ছ ঘরা, দুই হাতের নির্ভুল টিপ। প্রতিপক্ষের ছোঁড়া হাত বোমার স্প্লিন্টারে হাঁটু জখম হয়ে একটু খুঁড়িয়ে চলে বলে নাম হয়ে গেল ল্যাংড়া লালু। ভোটের আগে পরে নেতাদের নয়নের মণি। রেল সাইডিং, চার নম্বর বস্তি, খালপাড়, ভাঙা মসজিদ রিক্সা স্ট্যান্ড, লালুর কথায় এলাকা ওঠে বসে। থানাতেও দহরম মহরম। এলাকার কালো সাদা সব ধরনের কারবারের নজরানা লালুর মাধ্যমে যথাস্থানে পৌঁছে যায়। তোলাবাজি, ডাকাতি, রাহাজানি খুন জখম নিয়ে ডজন খানেক কেস ঝুলছে মাথার ওপর।
প্রশাসনের “শাসন” প্রমাণ করতে মাঝে মাঝে লালুকে “মামার বাড়ি” ঘুরে আসতে হয়। সেই রকমই কয়েক মাস হাজতবাসের পরে জামিন পেয়ে আজ ফিরে বিকেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখতে গেল সব আগের মত আছে কিনা। নিজের উপস্থিতিটাও জানান দিতে হবে। চেলা চামুণ্ডগুলোকেও এখনও দেখা যাচ্ছে না। এতদিন উপস্থিত না থাকায় অন্য কেউ এলাকার দখল নিচ্ছে কিনা সেটা জানাও একান্ত জরুরী।
দূর থেকে দেখতে পেল একটা আলুকাবলিওয়ালা ফুটের ধারে দাঁড়িয়ে পলকা কাঠের টুলের ওপর দোকান সাজাচ্ছে। লোকটা নতুন, লালু হাজতে যাবার আগে একে দেখেনি। লালুর মনে প্রশ্ন জাগে লোকটাকে কে বসালো ওখানে? ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে গেল।

মহাজনকে হাতে পায়ে ধরে আরও কিছুদিন সময় চেয়ে রাজি করিয়েছিল লোটন। আসলের থেকে সুদ অনেক বেড়ে গেছে। এবছর বর্ষা ভালো করে হয়নি, সারা বছর কীভাবে চলবে জানা নেই। বংগালের এই শহরে এসে আলু কাবলি বিক্রি করে যে কটা টাকা রোজগার হয় তার অনেকটুকুই খরচ হয় নিজের খাওয়া আর দেশোয়ালি ভাইদের সঙ্গে ঝুপড়ি ঘরে মাথা গুঁজে রাত কাটিয়ে। বাকি যৎসামান্য কিছু দেশে পাঠাতে পারে। আজ কিছুক্ষণ আগে ফোনে শশুরাল থেকে বড় শালা খারাপ খবরটা দিল। গতকাল রাতে ঠাকুরের পহেলবান এসে ওদের খেতি থেকে যতটুকু আনাজ হয়েছিল কেটে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ঐ এলাকার ওদের মত পিছড়ে বর্গের সবকটা ঘর আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ফুলি ওর বৌ, বাচ্চাগুলোকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে দশ মাইল ছুটে বাপের বাড়িতে এসে উঠেছে। এলাকা ঠাকুরের দখলে চলে গিয়েছে। মাথায় আগুন জ্বলছে লোটনের। এখানে থেকে কীই বা করতে পারে? দেশে থাকলেও যে কিছু করতে পারত তা নয়, হয়তো ঠাকুরের লোকের হাতে প্রাণ দিতে হত।
একটা লম্বা চওড়া লোক ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে এল। নিজেকে যথা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে ছুরি দিয়ে কাঁচালঙ্কা কাটতে কাটতে তার দিকে তাকিয়ে বলল- বোলুন বাবু, আলু কাবলি, মটর, চানা কী দেব? দস টাকা, ইয়া কুড়ি টাকা?
লোকটা কোন উত্তর না দিয়ে একমুঠো ভিজে ছোলা মুখে তুলে চিবোতে লাগলো। লোটন বিস্ময়ে তাকিয়ে বলল- ইয়ে কেয়া বাবু, ওখান থেকে কিঁউ লিচ্চেন?
লোকটা এবার আর একমুঠো ছোলা তুলে রাস্তায় ছড়িয়ে দিল।

  • বাবু এ্যায়সা কিঁউ কর রহা হ্যায়? হমলোগ গরীব আদমি হ্যায়। প্যায়সা দেকে লিজিয়ে
  • এক থাপ্পড় মারব শুয়োরের বাচ্চা। এখানে কাকে বলে দোকান লাগিয়েছিস?
  • গালি মত দেও বাবু নহি তো… লোটনের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে
    এবার লালু আলু কাবলির ঝাঁকাটায় একটা লাথি মারে। সস্তা কাঠের নড়বড়ে টুল থেকে ঝাঁকাটা রাস্তার ওপর ছিটকে পড়ে। ভিজে ছোলা, মটর আলু সেদ্ধ, লবণ, তেঁতুল জল মশলার কৌটো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।
    লোটন নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। হাতে ধরে থাকা লঙ্কা কাটা ছুরিটা নিয়ে লালুর পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।

মজা দেখতে দু চারজন করে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। অকস্মাৎ লোটন চানাওয়ালা লালুর পেটে ছুরি মারতেই ঊর্ধশ্বাসে যে যেদিকে পারল ছুটে পালালো। আশেপাশের দোকানের ঝাঁপ ঝপাঝপ বন্ধ হতে শুরু করল। নিমেষে এলাকা ফাঁকা হয়ে গেল।

কয়েক মাস হাসপাতালে যমে মানুষে টানাটানির পর লালু এলাকায় ফিরে এসেছে। সেদিনের সেই ঘটনার পরে লোটনকে আর কেউ দেখেনি। বিহারে ওর বাড়িতেও নাকি ওকে পাওয়া যায়নি। কেউ বলে মুম্বাই কেউ বলে দিল্লী বা সুরাটে চলে গেছে।
তবে যাবার আগে এক আপাত নিরীহ, দেহাতি, সব হারানো চানাওয়ালা সেদিন নির্মম, নির্দয়, দোর্দণ্ডপ্রতাপ দুষ্কৃতী, ল্যাংড়া লালুর মেরুদণ্ডটা সর্বসমক্ষে ভেঙে দিয়ে গেছে।

অসমর্থ রুগ্ন লালুর মাথার ওপরে আর কেউ ছাতা ধরে নেই। লালু এখন রাস্তার ধারে বসে আলুকাবলি বিক্রি করে।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, আগস্ট ২৪, সূচিপত্র]

5 2 ভোট
Article Rating
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Ivy Chattopadhyay
Ivy Chattopadhyay
2 months ago

খুব ভালো গল্প ।

Syamali Bhadra
Syamali Bhadra
2 months ago

এমন কেন সত্যি হয় না আহা!!

পল্লববরন পাল
পল্লববরন পাল
1 month ago

কবে আমাদের প্রশাসক আলুকাবলি বেচবেন?
সেই ইচ্ছেটা উশকে দিলেন। নিজেকে মাঝেমাঝে লোটন চরিত্রের সাথে একাত্ম হতে সাধ হয়।
দারুণ গল্প। দারুণ।