চিনলাম চীন-মন রঙ্গিন
প্রথম পর্ব
প্রস্তুতি
আমার চীন দেশ দেখার ইচ্ছা অনেকদিনের। সেই ছোটবেলায় ভূগোল বইতে হোয়াংহো বা ইয়াংসি নদীর কথা, গ্রেট চায়না ওয়ালের বিবরণ পড়া বা পাখা হাতে ট্রাডিশনাল সাজে দাঁড়ানো চীনা নারীর ছবি- এগুলো মনের মধ্যে অগাধ উৎসাহর সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া সত্তরের দশকে কলকাতা – হাওড়াতে যখন বিভিন্ন দেওয়ালে স্লোগান লেখা দেখতাম- “চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান,” ভাবতাম, না, সুযোগ পেলে চীন দেশটাকে দেখতেই হবে, দেখতে হবে যে চীনে আর কি আছে! তবে সে স্বপ্ন মনে গাঁথাই ছিল বহুবছর, বাস্তবায়িত আর হয়ে ওঠে নি।
তারপর বহু বছর কেটেছে, সেদিনের এই বালক আজ বৃদ্ধ। পৃথিবীর অন্যান্য বহু দেশ ঘুরলেও খানিকটা সুযোগের অভাবে আর খানিকটা অন্য দেশ দেখার আকর্ষণে চীন যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। তাই ২০১৯ সালে মনে হল, আর না, এবার উদ্যোগ নেওয়া যাক চীনের। স্থির হল ২০২০ র ইস্টারের ছুটিতে, মানে এপ্রিল মাসে যখন লম্বা ছুটি থাকে, তখন যাওয়া যাবে।
চীন যাওয়ার প্রধান বাধা ভাষা। এখানে ইংরাজি কেউ বোঝে না। বড়ো শহরে এক আধ জন জানলেও ছোট জায়গায় তো অসম্ভব। তাহলে কি চীন কেউ যায় না? যায়, কিন্তু গাইড লাগবে, গাইড ছাড়া অচল। খোঁজ খবর নিতে, অফিসের কলিগ মালবিকা জানালো চায়না হাইলাইটস বলে এক ট্রাভেল এজেন্সির কথা । বলল, এরা খুব অরজানাইজড, ওরা যখন চীন গিয়েছিল ক-বছর আগে,ওদের ভালোই দেখাশুনা করেছে। মালবিকার নাম নিয়ে চায়না হাইলাইটসকে মেল ঠোকা হল, আমরা, মানে আমাদের তিন জনের পরিবার যাবো, প্রাইভেট ট্রিপ হবে। আমাদের পরিবার মানে স্ত্রী দীপা আর কন্যা ডোরা। বেজিংতে প্লেন থেকে নামার পর থেকে সাংহাই তে ফিরতি প্লেনে ওঠা ইস্তক ওদের দায়িত্বে থাকব, মানে গাইড,গাড়ি,ট্রেন,প্লেন, ক্রুজ, হোটেল,এনট্রি ফি যেখানে যা লাগবে, সব ওদের দায়িত্ব। ব্রেকফাস্ট সবই হোটেলে, অধিকাংশ লাঞ্চ ওরা খাওয়াবে – অতএব শুধু ডিনারটাই আমাদের নিজেদের করতে হবে। সেটা একদিক দিয়ে ভালোই কেননা কোথায় কি সাপ ব্যাং খেয়ে ফেলি সে ভয় তো আছেই।
এ প্রসঙ্গে পিয়ালির কথা মনে পড়ে। অফিস ট্রিপে পিয়ালি একমাস বেজিংতে ছিল। রাত্রে একটা রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দিত। ওদের মেনুতে খাবারের ছবি ছিল। তা একটা মেনুর ছবি দেখে ওর মনে হয়েছে চিকেন। কপাল ঠুকে ওটাই ও অর্ডার দিলো। সঙ্গে এরা ভাত দেয়- কাজেই একমাস ধরে ভালোই খেল পিয়ালি, চিকেন টা ভালোই সুস্বাদু লাগত ওর। শেষ দিনে ওর ঐ অফিসের ম্যানেজার ওকে ফেয়ার ওয়েল দেবে বলে নিয়ে এল একটি রেস্টুরেন্টে। সেখানে ঐ মেনুটি দেখে ও ওটাই অর্ডার দিল। তাতে ওর চাইনীজ ম্যানেজার বলল, ও তুমি ব্যাং খাও তাহলে? ব্যাং? পিয়ালির তো হার্টফেল করার অবস্থা- এক মাস ধরে ব্যাং খেয়েছি? ওয়াক, এটা চিকেন নয়? ওর মুখের অবস্থা দেখে ম্যানেজার বলল, না, না, এটা ব্যাং, তবে খেতে খুব টেস্টি, তুহিনা নাকি এরপর থেকে একদম ভেগান হয়ে গিয়েছে।
চায়না হাইলাইটসতে বিভিন্ন মেলবাজির পর স্থির হল- তিনরাত বেজিং, দু রাত সিয়ান (Xian), দু রাত ইয়াংসি নদীর বুকে ক্রুজ চংচিং (Chongqing) থেকে ইয়াংসি (Yangtze), চার রাত জ্যাংজিয়াজি (Zhangjiajie) আর দু রাত সাংহাই -মোট তেরো রাতের খেলা। দূরত্ব কভার করব, বেজিং থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার।
যাওয়ার সব ঠিক, ফ্লাইট টিকিট হয়ে গেছে, চায়না হাইলাইটসকে টাকাও দেওয়া হয়ে গেছে, এমন সময় ২০২০ র জানুয়ারি মাসে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ল করোনা ভাইরাস। প্রথমে আমরা ভাবছিলাম, এ কিছুই না, দু দিনে ঠিক হয়ে যাবে। চায়না হাইলাইটস থেকেও বলল, আগেও এরকম ভাইরাস চীনে হানা দিয়েছে- তার নাম সার্স আর চীন তাকে এক মাসে ঠান্ডা করে দিয়েছে, সুতরাং ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক, এই ভাইরাসও ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেবে চীন।
যাই হোক, বাস্তবে তা হয় নি। উলটে ভাইরাসই সবাইকে ঠান্ডা রেখেছিল বহু দিন। ফলে শেষ পর্যন্ত সে যাত্রা যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পরের দু বছরও হল না, কেননা কোভিডের প্রকোপ তখনও ছিল, ছিল হাজার বিধি নিষেধ। অবশেষে ২০২৩ সালে বোঝা গেল এবারে আবার চেষ্টা করা যেতে পারে – অবস্থা অনেক ভালো। সেই মতো ২০২৪ সালের মার্চের শেষে যাওয়ার দিন স্থির করা গেল। ফ্লাইট টিকিটও সেই মতো হল আর চায়না হাইলাইটসের সাথে সব ব্যাবস্থা আবার পাকা করা গেল।
চীন মুষ্টিমেয় দেশগুলির মধ্যে একটি, যেখানে ব্রিটেন থেকে যেতে ভিসা লাগে। তার জন্য আছে এক বিরাট অন লাইন ফর্ম , যেখানে অনেক অবাঞ্ছিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। বুঝলাম এই যুগে সবাই ডাটা সংগ্রহে আগ্রহী। দীর্ঘ ছ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে দু বছরের মালটি এনট্রি ভিসা পাওয়া গেল। পরে হয়ত বা আবার যাওয়া যাবে, সে রাস্তা খোলা রইল। এ ছাড়া ভি পি এন কানেকশনও নিতে হল, কেননা চীনে গুগল, হোয়াটস আপ সব ব্যান্ড, অচল- তাই চায়না হাইলাইটস বলেছে পারলে ভি পি এন নিতে যার মাধ্যমে গুগল চলবে। দেখলাম ভি পিএন এর মূল্য নামমাত্র- একমাসের জন্য এটা নেওয়া গেল যাতে খান পাঁচেক মোবাইল বা ল্যাপটপ কাজ করবে।
শেষ বাধা চাইনীজ মুদ্রা। চীনে বড়ো শহরে কার্ড চললেও ছোট জায়গায় চলে না। তা ছাড়া লেখা আসবে চাইনীজে, অতএব মেনে নিলাম চায়না হাইলাইটসের পরামর্শ। একদিন চলে গেলাম ফরেন এক্সচেঞ্জ তুলতে- এক আমেরিকান ডলার মানে প্রায় আট ইয়েন বা ওরা বলে আর এম বি বা রেনমিনবি( (Renminbi) বা জনগনের মুদ্রা। পকেটে হাজার আটেক ইয়েন নিয়ে নিদ্দিষ্ট দিনে চললাম লন্ডন হিথরো এয়ারপোর্ট , লন্ডন –বেজিং প্লেন ধরতে।
দ্বিতীয় পর্ব
বেজিং লন্ডন থেকে বেজিং দীর্ঘ পথ, প্রায় আট হাজার কিলোমিটার আর প্লেনে লাগে সাড়ে দশ ঘন্টা। ইংল্যান্ড আর চীনের মাঝে সময়ের ফারাক সাত ঘন্টা। ফলে এখান থেকে দুপুর দুটোয় প্লেন ছাড়লে বেজিং আসবে পরদিন সকাল দশটায়- মানে তখন ইংল্যান্ডের মধ্য রাত। একটা সুবিধা- তিনজনের একসাথে সীট ফলে কখনো বই পড়ে, কখনো বা খাওয়া দাওয়া, সিনেমা দেখা আর বাকি সময় স্রেফ চোখ বুজে আসন্ন চীন যাত্রার কথা ভেবে সময় কাটানো। এই ফ্লাইটে একটা মজার জিনিষ দেখলাম, যেটা কোনোদিন আগে দেখিনি। তা হলো, এই প্লেনে অনেক যে চৈনিক যাত্রী ছিলেন, তাঁরা দেখলাম মাঝে মাঝে উঠে টয়লেটের সামনের খালি জায়গাতে হালকা ব্যায়াম করে নিচ্ছেন। তখন আশ্চর্য লাগলেও পরে দেখেছি চীনারা অনেক বেশী স্বাস্থ্য সচেতন ও দৈনিক ব্যায়াম ওদের মজ্জায়।
সাড়ে দশ ঘন্টা বসে থাকা কষ্টকর হলেও এক সময় তা ফুরালো- পরদিন সকালে চলে এলাম বেজিং- চীনের রাজধানী শহর।
ইমিগ্রেশনে দীর্ঘ লাইন, কিন্তু এরা দেখলাম ম্যান ম্যানেজমেন্টে অতি তৎপর। অতো বড় লাইন, কিন্তু আধ ঘন্টায় খতম ও ভিসায় স্ট্যাম্প পড়ে গেল। আমরা বেরুলাম, কাস্টমস বলতে শুধু লাগেজ এক্স রে, ব্যাস-চলে এলাম বেরুবার গেটে।
বাইরে আসতেই দেখি আমাদের নাম লেখা বোর্ড নিয়ে অপেক্ষা করছেন গাইড – নাম হেলেন। বছর চল্লিশের ফুটফুটে চৈনিক মহিলা, ইংরাজিটা ভালোই বলেন। চীনাদের বয়স ঠিক বোঝা যায় না, মনে হয় এরা চির যৌবনের অধিকারী, সবারই চামড়া জৌলস পূর্ণ ও মাথা ভর্তি চুল। হেলেন হাসিখুশি, সুন্দরী – দেখলেই মনটা ভাল হয়ে যায়। হেলেনকে বললাম, হেলেন, এয়ারপোর্ট থেকে চাইনীজ সিম নেব কেননা আমাদের মোবাইল সিম এখানে অচল। হেলেন বলল, কুচ পরোয়া নেই- এখানে এক আউটলেট আছে চাইনা ইউনিকর্ন কোম্পানীর , এদের কানেকশন খুবই ভালো। দামও আহামরি লাগল না- ১৫০ আর এম বি তে ১৫ দিনের জন্য ৪০ জিবি ডাটা আর ২০০ মিনিট ফোন কল। ভেবেছিলাম চীনে ফোন কানেকশন পাওয়া বিরাট ঝঞ্ঝাট কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল আদৌ তা নয় । শুধু পাসপোর্টটি দাও – ওরাই বিভিন্ন ডাটা এনট্রি করে ফোনে সিম লাগিয়ে একদম চালিয়ে দেখিয়ে দিলো। যাক, অন্তত চীনে একটা যোগাযোগ ব্যাবস্থা রইল, যেটা খুব প্রয়োজন।
বাইরে এলাম হেলেনের সাথে। ঝকঝকে রাস্তা – এক ফোঁটা ধুলো বা নোংরা কোথাও নেই। নেই কোনো টাউটের উপদ্রব। হেলেন বলল, পাঁচ মিনিট দাঁড়াতে হবে- গাড়ি নিয়ে জুলিয়া আসছে।
ক-মিনিটের মধ্যে জুলিয়া এল বিরাট এক ছ সীটার এস ইউ ভি চালিয়ে- এও বছর চল্লিশের মেয়ে- ছোটখাট চেহারা, সুন্দরী আর মুখে সদা লেগে এক অনাবিল হাসি। পিছনে ধরাধরি করে আমাদের মাল তোলা হল। আমার সুটকেশটা নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিল, যতই হোক ছোটখাটো চেহারার মেয়ে, তেইশ কিলোর সুটকেশ তোলা কি অতো সোজা!
গাড়িতে বসতেই হেলেন প্রত্যেকের হাতে একটা করে জলের বোতল ধরালো, বলল, ঘন্টা খানেক লাগবে আমাদের হোটেলে পৌঁছাতে। হেলেনের থেকে জানলাম, বেজিং বিরাট এক শহর – ১৬৮০০ বর্গ কিলোমিটার এর এরিয়া মানে লন্ডন শহরের প্রায় দশ গুন, কলকাতার প্রায় আশি গুন। বসবাস ২৫ মিলিয়ন লোকের। এই শহরে ছ খানা রিং রোড আছে যার একদম কেন্দ্রস্থলেরটায় আমাদের হোটেল- রাস্তা প্রায় ৬৫ কিলোমিটার।
গাড়ী ছুটে চলেছে মোটরওয়ে দিয়ে একশো কিমি ঘন্টায় গতিতে। জুলিয়ার হাত দারুণ-ঝকঝকে রাস্তা, ফলে মাখনের মত তরতরিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। রাস্তায় কোথাও এতটুকু খানা খন্দ বা নোংরা দেখলাম না। যে কোনো ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান শহরের থেকে ভালো বই মন্দ লাগল না। আর যেটা ভালো লাগল দেখে, তা হল সবাই কিন্তু নিয়ম মেনে চালাচ্ছে। অর্থাৎ লেন ড্রাইভিং ও নিরাপদ দূরত্ব রেখে গাড়ি চালানো এগুলো তো আছেই, আর নেই কোনো হর্ন এর উৎপাত । বিদেশের মত এখানেও কেউ হর্ন বাজায় না, যদি না একান্ত বিপদে কেউ পড়ে। বেজিং এর কেন্দ্রস্থলে যত এগুচ্ছি, গাড়ির সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। বাড়ছে ট্রাফিক সিগন্যালের সংখ্যা কিন্তু সবাই ধৈর্য ধরে নিয়ম মেনে চলেছে। জুলিয়ার মোবাইলে দেখলাম চীনা ভাষায় গুগল ম্যাপের মতো নিজস্ব সফটওয়্যার আর সেই সফটওয়্যারে সিগন্যালগুলোও আসছে , মায় কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে সেই তথ্য সমেত। দেখলাম মাঝে মাঝে কোন এক সুইচ টিপে জুলিয়া সামনের আয়নাটাকে কম্পিউটার স্ক্রীনের মত করে দিচ্ছে। আশেপাশে ও পিছনের রাস্তার লেনগুলির ছবি তাতে ফুটে উঠছে। এমন দেখে আমি অভিভূত – এরকম প্রযুক্তির সাহায্য পেলে গাড়ি চালাতে কত সুবিধা!
গাড়ি চলছে- অবাক বিস্ময়ে দেখছি দুপাশে অজস্র মাল্টি স্টোরেজ বাড়ি, প্রতিটি বাড়ি ৩৬ থেকে ৪০ তলা, একরকম ডিজাইন। হেলেন বলল, বেজিং শহরের কেন্দ্রস্থলে বাড়ি খুব দামি, ও তাই শহরের প্রায় বাইরে থাকে। এখানে এক একটা মালটি স্টোরেজে প্রায় আড়াইশো করে ফ্ল্যাট আর এরকম বাড়ি যে কত সহস্র দেখলাম, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। পঁচিশ মিলিয়ন লোকের বাস যে শহরে সেখানে অজস্র বাড়ি তো থাকবেই। হেলেন জানাল, এখানে থাকার বাসস্থান সবারই আছে আর কাজ সবাইকে করতে হবে। বাড়ি কেনার জন্য টাকা লাগে বটে কিন্তু তা অন্য দেশের তুলনায় কম কেননা সরকার এখানে বাড়ির যৌথ মালিক। তুমি কিন্তু বাড়ি বিক্রি করতে চাইলে যাকে খুশী পারবে না,সরকারকেই বিক্রি করতে হবে। দীপা জিজ্ঞাসা করল , সবই তো ফ্ল্যাট দেখছি, প্রাইভেট বাড়ি নেই? হেলেন বলল, তাও আছে তবে সেগুলি অপেক্ষাকৃত খালি জায়গায় বা অনেক পুরানো জায়গায়, যারা বংশ পরম্পরায় থেকে আছে ,তারাই থাকে। চীনের এরকম রমরমা অবস্থা বলা যায় নয়ের দশক থেকে। তার আগে অধিকাংশ লোকই ছিল গরীব। এখন এখানে নীতি হচ্ছে কাজ কর, থাকো, খাও আর বাকিটা আরাম কর। রিটায়ার করলেও অনেককে কাজ করতে হয়, যেমন রাস্তা যাতে কখনও না জ্যাম হয়ে যায়, তার জন্য থাকে ট্রাফিক পুলিশের মতো এক ঝাঁক ভলেন্টিয়ার যাদের পোষাকি নাম প্রফেশনাল পুশার। বেজিংতে পরে এই প্রফেশনাল পুশারদের তৎপরতা দেখেছি। প্রতিটি লেন যাতে জ্যাম ফ্রি থাকে তার জন্য এরা জান লড়িয়ে দেয়। হাজার হাজার গাড়ি কিন্তু থেমে কেউ নেই।
রাস্তার দু ধারে অজস্র দোকান, বাজার, সুপার মার্কেট –অনেকটা আমাদের দিল্লীর সাথে তুলনীয়। তবে অনেক পরিষ্কার আর আলো ঝলমল চকচকে।
বেলা বারোটা নাগাদা আমরা এসে গেলাম আমাদের হোটেল -নভোটেল পিস বেজিং। হেলেন আমাদের চেক ইন করিয়ে দিল। দেখলাম এরা পাসপোর্টের প্রথম পাতাও স্ক্র্যান করল। পরে দেখেছিলাম চীনে পাসপোর্ট বা আইডেন্টিটি ছাড়া কিছুই চলে না- জীবন তার ছন্দ হারাবে পাসপোর্ট না থাকলে।
হোটেলটি দারুণ। আমাদের তিনজনের জন্য ন-তলার ওপর এক বিরাট ঘর। এতো বড়ো হোটেল- বিরাট বাড়ি, বিরাট এরিয়া কিন্তু ইংরাজি কেঊ বোঝে না। ফলে একটা অতিরিক্ত খাট ঢোকাতে হবে এটা বোঝাতে গলদঘর্ম অবস্থা। দীপার প্রবল প্রচেষ্টায় এটা অবশেষে বোঝানো গেল ও ঘরে তৃতীয় বিছানাটি সাথে সাথেই পাওয়া গেল।
প্রায় এগারো ঘন্টা প্লেন জার্নিতে হাত পা বেদনায় টনটন। তাই ভালো করে স্নান সেরে বেরুলাম। হেলেন বলেছে দশ মিনিট এগুলে সামনে একটা মল আছে, নাম এ পি এম মল, তার ওপরের দুটো ফ্লোরে ফুড কোর্ট আছে। উদ্দেশ্যে একটাই, দুপুরের খাবার কিছু একটা খাওয়া।
সুন্দর ঝকঝকে মল- লিফটে করে ওপরে উঠলাম। অজস্র দোকান, সামনে মেনু কার্ড লাগানো। কিন্তু সব কিছু চীনা ভাষার বা ম্যান্ডেরিনে লেখা। ফলে সেটার ছবি তুলে মোবাইল ট্রান্সলেটার এ্যাপে ফেলে মেনু দেখা- সে এক ঝকমারি কাজ। প্রায় সব খাবারেই হয় পর্ক বা বীফ আছে – চিকেনওলা মেনু প্রায় নেই। সাপ ব্যাং ওলা খাবার কিন্তু মেনুতে দেখলাম না। খুঁজে পেতে একটা দোকান পাওয়া গেল যেখানে চিকেন হটপট বলে একটা মেনু আছে, আবার টফুও আছে। ওখানেই বসা গেল। অর্ডার দেওয়া গেল মেনুতে আঙ্গুল ঠেকিয়ে ও আঙ্গুল তুলে কটা সেটা বুঝিয়ে। কেননা ইংরাজি কেউ বোঝে না। দেখলাম অর্ডার দেওয়ার পর একটা বিল বানিয়ে টেবিলে রেখে গেল । একটা একটা করে ডিস আসছে, আর ঐ বিলটায় দাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম কোনো মেনু যাতে বাদ না যায়, তাই এই আয়োজন। এতে দু পক্ষরই বুঝতে সুবিধা যে কি অর্ডার আছে আর কি সার্ভ হল।
চীনে সব জায়গাতেই দেখেছি খাবারের দাম অনেক আয়ত্তর মধ্যে। বলা যায় ভারতের মতোই দাম। তবে এখানে দেখার মত জিনিষ হল রোবটের ব্যাবহার। কিচেন থেকে ডিস পৌছে যাচ্ছে টেবিলে রোবটের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে রোবট মানে একটি চাকা লাগানো টেবিল, যাতে আছে তিনটি র্যাক। এক একটি র্যাকে এক একটি টেবিলের খাবার। প্রথমে রোবট আমাদের কাছে এল- ওয়েটার রোবট ট্রে থেকে খাবার আমাদের টেবিলে রাখল, বিলে ঐ আইটেম দাগিয়ে দিলো ও তারপর পরবর্তী টেবিলগুলোতেও একই গল্প। ফলে ফটাফট সবকিছু হয়ে গেল।
এখানে খাবার সাথে চা দেয়। গোটা চীনেই দেখেছি এই ব্যাবস্থা। বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রীন টি- কোথাও দেওয়া হয় হোয়াইট টি, কোথাও হুইট টি অথবা কোথাও অন্য শ্রেণীর গ্রীন টি। চা থাকে পটে- বাটি থাকে চা খাওয়ার জন্য। পটের চা ফুরিয়ে গেলে আবার নতুন চা এসে যাচ্ছে।
খাওয়ার সাথে জল এরা খায় না। আমার আবার জল ছাড়া চলে না। তা জল চাইতে পেলাম গরম জল লেবু দেওয়া। বস্তুত এখানে জল চাইলে গরম জলই পাওয়া যায়। গরম জল বা গ্রিন টি তে খাবার হজম হয় তাড়াতাড়ি। চীনে দেখলাম প্রচন্ড স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়, মানে এটা এদের মজ্জায় মজ্জায়। রান্নায় চিনি নেই বা কেক, মিষ্টিতেও চিনির ভাগ অতি কম। খাবারে তেল মশলা কম কিন্তু বিভিন্ন হার্বে বা ওদের কিছু বিশেষ মশলাতে খাবার স্বাদে ভরপুর। কিন্তু খেয়ে কোনোদিন পেট ভার বা হজমের অসুবিধা হয় নি।
খাবার খাওয়ার জন্য চপ স্টিক আর স্টিকি রাইস খাওয়ার জন্য বড়ো চামচ দিতে সর্বত্র দেখেছি । আমি বা দীপা আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও চপ স্টিক ব্যাবহার করতে শিখিনি বা বলা যায় পারি নি। অগাধ উৎসাহ নিয়ে চপ স্টিক করে হয়ত বা কোনো সবজি তুলেছি, কিন্তু আঙ্গুলের ঐ যে কারসাজি ওটা অনেক কসরত করেও শিখতে পারি নি। ফলে যা এবং যতোটা তুলতে যেতাম, তা অধিকাংশই পড়ে যেত। ডোরা প্রভুত ট্রেনিং দিয়েছিল বটে, কিন্তু আমরা কোনোদিনও সফল হতে পারি নি । ফলে দু দিন পর ঐ চামচই ছিল আমাদের খাবার তোলার একমাত্র অস্ত্র।
হেলেন বলে দিয়েছিল পরের দিন সকাল সাড়ে আটটায় বেরুব- প্রথমে যাব চায়না ওয়াল দেখতে। সেই মতো পরদিন হোটেলে জলখাবার খেয়ে লবিতে এলাম। হেলেন ও জুলিয়া একগাল হেসে আমাদের নিয়ে এল হোটেল পারকিংতে রাখা গাড়িতে। হেলেন জানালো, এখান থেকে চায়না ওয়ালের যে জায়গায় আমরা যাব,তা ৬৫ কিলোমিটার রাস্তা। দেড় ঘন্টা লাগবে। তাই এই ফাঁকে গ্রেট ওয়াল সম্বন্ধে একটু জানিয়ে রাখি।
চীন আগে ছিল টুকরো টুকরো রাজ্য আর সেই প্রাচীন কাল থেকে চীনের বেশ কিছু রাজ্যের সীমানায় পাঁচিল ছিল বা দিয়েছিল নিজেদের রাজ্য রক্ষার জন্য। সে চীন আজকের এই চীন নয়- ছোট ছোট রাজ্যর সমষ্টি মাত্র। ২২০ বি সি নাগাদ সম্রাট কিন সি হুয়ান (Qin Shi Huang) চীনকে একত্রিত করেন- বলা যায় উনি হলেন প্রথম সম্রাট। উনিই প্রথম বিভিন্ন টুকরো টুকরো পাঁচিলকে জোড়া লাগান- প্রধানত কাঠ ও মাটি দিয়ে তৈরি এই প্রাচীর –উদ্দেশ্যে বিদেশি শক্তির থেকে দেশকে বাঁচানো । পরে হান সাম্রাজ্য আমলের (২০৬ বি সি থেকে ২২০এ ডি) অন্যান্য সম্রাটরা একে আরো বাড়ান সিল্ক রোড ট্রেডের জন্য।
পরে জু ইয়ানহাং (Zhu Yuanzhang), যিনি চীনে মিং রাজ্যর (Ming dynasty) সম্রাট, উনি এই পাঁচিলের প্রভুত উন্নতি সাধন করেন। উনি প্রাচীরের উঁচু জায়গাগুলোয় ওয়াচ টাওয়ার ও প্ল্যাটফর্ম লাগান। ১৩৬৯ থেকে ১৬৪৪ সালের মধ্যে এই প্রাচীরকে অনেক লম্বা ও মজবুত করা হয়, যার প্রধান উদ্দেশ্যে ছিল মোঙ্গোলিয়ান আক্রমন আটকানো। ফলে প্রাচীরের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ২১০০০ কিলোমিটার- পূর্বে সানহাইহুয়ান থেকে পশ্চিমে জিয়ায়ুগুয়ান পর্যন্ত এই প্রাচীর বিস্তৃত। আর এখন এই গ্রেট ওয়ালের যতটা টিকে আছে তার অধিকাংশই মিং এর আমলে বানানো।
কতোটা টিকে আছে হেলেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
-এক তৃতীয়াংশ বলা যায় নেই, কিন্তু বাকিটা আজও আছে। মজার ব্যাপার কি জানো? এই প্রাচীরের বেশ কিছু অংশে গ্লুটেনে ভর্তি চালের ময়দা ব্যাবহার করা হয়েছে ইঁট গাঁথার জন্য। আবার কিছু জায়গায় আর্সেনিক ব্যাবহার হয়েছে পোকা মাকড় থেকে প্রাচীরের কাঠ বাঁচানোর জন্য। ফলে তারা আজও টিকে আছে।
মসৃণ রাস্তা দিয়ে গাড়ি মাখনের মতো এগিয়ে চলেছে। জুলিয়ার ড্রাইভিং অসাধারণ – বস্তুত এতো ভালো ড্রাইভার জীবনে খুব কম দেখেছি। জেট ল্যাগের জন্য ভালো ঘুম কালকেও হয়নি- কখন যে গাড়ির ছন্দে তিনজনেরই চোখ বুজে এসেছিল জানি না। টনক নড়ল, যখন সাড়ে দশটা নাগাদ হেলেন বলল, আমরা এসে গেছি। এবার নামতে হবে।
নামলাম- হাজার হাজার লোক। প্রথমেই বিরাট লাইন। লাইন বিরাট কিন্তু এদের ব্যাবস্থাপনা সত্যিই ভালো। মিনিট কুড়িতে চলে এলাম ঢোকার গেটে। গাইডের জন্য আলাদা ঢোকার রাস্তা। গেটে দেখি হেলেন দাঁড়িয়ে- বলল, পাসপোর্ট আছে? পাসপোর্ট? এরকম তো ভাবিনি যে চায়না ওয়াল দেখতে পাসপোর্ট লাগবে, সেটাতো হোটেলের লকারে সযত্নে রেখে এসেছি। হেলেন বলল, কুচ পরোয়া নেই, আসলে আমারই বলে দেওয়া উচিত ছিল। যাক গে, আজকের দিনটা ম্যানেজ করে দিতে পারব, কিন্তু কাল থেকে রোজ পাসপোর্ট নিয়ে বেরিও। পরে দেখেছিলাম সমগ্র চীনে পাসপোর্টই তোমার এন্ট্রি পাস। সে যে কোনো টুরিস্ট প্লেসই হোক বা ট্রেন জার্নি হোক বা প্লেন- পাসপোর্ট হচ্ছে তোমার টিকিট। আসলে যখন প্রবেশ মূল্য দেওয়া হয় টিকিট কাটার জন্য, তখন পাসপোর্ট নাম্বার দিতে হয়। ব্যাস- ওটাই সব- কোনোই টিকিট বা পেপার টিকিটের ঝামেলা নেই। যখন ঢোকার হবে, পাসপোর্ট স্ক্র্যান করো, গেট খুলে যাবে। অর্থাৎ আলাদা করে টিকিটের প্রয়োজন নেই। আমাদের সব টিকিট চায়না হাইলাইটস করে রেখেছে – কাজেই এই তথ্য জানতাম না।
হেলেন গেটকীপারের থেকে ওনার মোবাইল ফিডারটা নিয়ে আমাদের তিনজনের পাসপোর্ট নাম্বার ঢোকাল, তবে গেট খুলল। হেলেনকে তিনবার বিভিন্ন গেটে এটা করতে হল, কি ঝামেলা!
যাই হোক, প্রথন গেটের পর এলাম শাটল বাস লাইনে। শাটল বাসে মিনিট দশেকের পথ – নিয়ে যাবে কেবিল কার স্টেশন। শাটল বাস ফ্রী, মানে টিকিটের দামেই ধরা আছে। হাজার হাজার লোক কিন্তু শাটল বাস-ও কম নেই। প্রতি মিনিটে একটি করে বাস আসছে – লাইন করে লোকে উঠছে, বাস চলে যাচ্ছে, আবার পরের বাস আসছে। এতো লোক, এতো বাস, কিন্তু সব কিছুই যেন মেশিনের মত তরতরিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
আমরা চারজন বাসে উঠলাম। বাস ছুটে চলল পাহাড় জঙ্গল ভরা রাস্তা দিয়ে। দশ মিনিটে এলাম কেবিল কার বেস স্টেশন। এখানে আবার লাইন। দীর্ঘ সিঁড়ি উঠে গেছে প্রায় শ-খানেক ধাপ। সিঁড়ি ওঠা মানেই প্রবল কষ্ট, তবে যেহেতু লাইন এগুচ্ছে ধীর কদমে – শেষ দিকটা এক পা এক পা করে এগুনো।
অবশেষে পুরোটা উঠে আবার গেট আর আবার হেলেনের ম্যানুয়ালি পাসপোর্ট নাম্বার ঢোকানো। এই গেটটা কেবিল কারের। এখান থেকে চীনের প্রাচীরের ওপরতলা প্রায় সাত আটশো ফুট উঁচু। অনেকে হেঁটেও যায় একটু একটু করে পাহাড় চড়ে। আমাদের সে ক্ষমতা নেই। আমরা এই ওঠাটা কেবিল কারেই উঠব। হেলেন বলল, আমরা উঠব একেবারে ১৪ নম্বর টাওয়ারের কাছে। ১৪ থেকে ২৩ নম্বর টাওয়ার প্রায় দু কিলোমিটার রাস্তা আর এতে সময় লাগে দু ঘন্টা। তবে প্রচুর ওঠা নামা আছে। শুনে আমি বললাম, দেখা যাক কতোটা পারি, না হলে আমি মাঝপথে থেকে যাব, তোমরা যতোটা পার, ঘুরে নিও।
কেবিল কারে মিনিট দশেক লাগল প্রাচীরের মাথায় উঠতে। কেবিল কার থেকে নেমে আবার এক প্রস্থ সিঁড়ি। ধীরকদমে উঠে গেলাম প্রাচীরের মাথায়। বিরাট চওড়া প্রাচীর- কোথাও বা কুড়ি ফুট চওড়া, কোথাও ত্রিশ ফুট। আমরা প্রথমে গেলাম ১৪ নম্বর টাওয়ার। টাওয়ার বলতে অবজারভেশন টাওয়ার, যেগুলি মিং এর আমলে বানানো। এখান থেকে চীনা সৈন্যরা নজর রাখত শত্রু আসছে কিনা। শত্রু আসছে দূর থেকে দেখতে পেলে টাওয়ারের মাথায় আগুন জ্বালাত, যাতে অন্য টাওয়ার থেকে দেখতে পায় শত্রু আসার বিপদ সংকেত। দেখলাম টাওয়ারের দেওয়ালে ছোট ছোট গর্ত করা – বন্দুক বা কামান দাগার জন্য। হেলেন দেখাল বৃষ্টির জল ড্রেন করার যে নলগুলি আছে সেগুলি সব চীন সীমান্তর দিকে মুখ, যাতে ঐ নলে দড়ি বেঁধে মোঙ্গোলিয়ার দিক থেকে শত্রু না উঠতে পারে। হেলেন জানালো এখানকার কিছু অংশ বহু প্রাচীন – সেই কিন আমলের, মানে প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরানো।
১৪ নাম্বার টাওয়ার দেখে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললাম ১৫ নাম্বার টাওয়ারের দিকে। চওড়া প্রাচীর, কিন্তু লোক অনেক- তার ওপর চীনে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তোলাটা খুব চালু ফ্যাশন। প্রায় সব জায়গাতেই দেখেছি – যেখানে আমরা একটা কি বড়ো জোর দু তিনটে ছবি তুলি, সেখানে ওরা খান কুড়ি পঁচিশ ছবি তোলে- বিভিন্ন ভঙ্গিমায়- কখন ও আঙ্গুল তুলে, কখনো নাচের ভঙ্গিমায়, কখনও বা হাত আকাশে। অনেক মেয়েই দেখছি, তাদের ট্রাডিশনাল কস্টুম পরে এসেছে- মাথায় মুকুট, মুখে চন্দনের মত বা গ্লিটার দিয়ে নকশা কাটা, খোঁপায় ফুল, হাতে চিত্র বিচিত্র পাখা। ঠিক যেমনটি ছোটবেলায় ভূগোল বইতে দেখেছি। অধিকাংশ দর্শক চাইনীজ- প্রায় ৯৫ শতাংশ। আসলে চীনের লোকসংখ্যা বেশি, তাই দর্শনার্থীও বেশি। বিদেশী মুষ্টিমেয় বলা যায়। তবে বিদেশী বলে কোনো বিদ্বেষ বা বিরূপ ভাব বা বৈষম্য কোথাও দেখিনি।
১৫ নাম্বার টাওয়ার খুব বেশী দূর নয়- ৫০০ মিটারও হবে না, কিন্তু তার মধ্যে এত ওঠানামা – পা বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। আসলে পাহাড়ের মাথায় মাথায় চলেছে এই প্রাচীর, ফলে পাহাড় যেমন উঁচুনীচু- প্রাচীরও সেভাবে বানাতে হয়েছে। এখানে সিঁড়ির ধাপগুলো খুব ছোট ছোট। হেলেন বলল ঘোড়া যাতে অবলীলায় যেতে পারে, সেই মতো ধাপ গুলি করা। ধীর কদমে এগুচ্ছি- সামনে দেখছি বিস্তীর্ণ প্রাচীর চলেছে – এঁকে বেঁকে , উঁচু নীচু – দু পাশে পাহাড় আর পাহাড়। সাধারণত গরমকালে সবুজে সবুজ হয়ে থাকে, কিন্তু আমরা গিয়েছি শীতের পর বসন্তে। সেরকম সবুজ ভাব পাহাড়ে তখনও আসে নি । তবে অজস্র চেরী গাছে ভর্তি পাহাড় তাদের ব্লসমে চারদিক রঙ্গীন।
১৫ নাম্বার টাওয়ারের কাছে এসে দেখি বিরাট বিরাট খাড়াই সিঁড়ি- এক একটা স্টেপ দু গুন সাইজের, কিন্তু উপায় তো নেই, ঐ খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে চললাম
১৬ নাম্বার টাওয়ারের দিকে।
যাবো কি- খালি ওঠা আর নামা। হাঁফ ধরে যাচ্ছে, পা দুটি ব্যাথায় টনটন- হেলেনকে বললাম দীপাদের নিয়ে এগুতে- আমি আস্তে আস্তে যতোটা পারি যাচ্ছি।
ওরা এগিয়ে গেল- আমি ধীর কদমে খানিক যাচ্ছি, খানিক পাঁচিলে ঠেস দিয়ে পা গুলোকে পালা করে বিশ্রাম দিচ্ছি, প্রায় দেড় ঘন্টা এভাবে এগুলাম। দেড় কিলোমিটার হেঁটেছি বড়ো জোর, দেখি দীপারা ফিরছে। ওরা আরো খান তিনেক টাওয়ার গিয়েছিল। বলল, চীনের টাওয়ারে হাঁটার যে আনন্দ, যে অভিজ্ঞতা, যে সৌন্দর্য রস আহরণ তা হয়ে গেছে, আর নতুন করে কিছু পাওয়ার নেই- কেননা এর শেষ নেই। অতএব এবার ফেরা যাক- শরীরকে বেশী কষ্ট দিয়ে লাভ নেই কেননা টুর সবে শুরু। চলো তাহলে ফেরা যাক- আমরা একমত। ফেরার আগে হেলেন দেখাল দূরে
২৪ নাম্বার টাওয়ারের কাছে পাহাড়ে বিরাট চীনা হরফে মাও সে তুং এর নাম লেখা। বলল, এখানে মাও-কে লোকে দেবতা জ্ঞানে দেখে।
প্রায় দুটোয় এলাম চায়না ওয়ালের নির্গম দ্বারে। এখান থেকে বেরিয়ে হেলেন নিয়ে এল জেড রেস্টুরেন্ট বলে এক রেস্তোরায়। খুব ভাল বুফে লাঞ্চ খাওয়া হোল এখানে। চিকেন, ভেজ নুডলস,বান, মোমো, বিভিন্ন ডেজার্ট। এর পর এক দোকানে খানিক জেড পাথরের জিনিষ দেখা হল। তবে দাম অনেক বেশি। এখানে জানলাম যে সব জায়গায় দর কষাকষি করতে হয়। যা দাম বলে তার অর্ধেক দিয়ে শুরু করে মাঝামাঝি কোথাও থামে। কেউ কারুর ভাষা বোঝে না – বিক্রেতার হাতে বড়ো ক্যালকুলেটার থাকে, সে সেখানে দাম লেখে। তুমি দেখে তোমার দাম টাইপ কর। এভাবে চলতে চলতে যখন দুজনের দাম মিলে যায় তখন আঙ্গুল ওপরে তোলে মানে দরাদরি শেষ। এখান থেকে কিছু ঘর সাজাবার জিনিষ কিনল দীপা ও ডোরা।
আবার আমাদের পথ চলা শুরু। জুলিয়া এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে আর এক হাতে মাঝে মাঝে ওর ফ্লাক্স থেকে চা খাচ্ছে। হেলেন জানালো এবার আমরা যাব হুটোং (Hutong), এখানে চীনের বহু প্রাচীন এক কমিউনিটি থাকে । তারা এখনও একসাথে থাকে- বাবা, মা, ছেলে, পুলে, নাতি, নাতনি। থাকার জায়গা খুব সীমিত, অনেকেরই টয়লেট নেই তাই এরা পাবলিক টয়লেট ব্যাবহার করে। আমরা এমন একটা পরিবারের কাছে যাব আর ওদের থেকে শিখব চাইনীজ পেপার কাটিং।
বেলা সাড়ে চারটেয় এলাম হুটোং। এখানে এক পরিবার আমাদের নাড়ু টাইপ কিছু তিলের মিষ্টি ও চা পরিবেশন করলো। তারপর ভদ্র মহিলা শেখালেন চাইনীজ পেপার কাটিং- কিভাবে হ্যাপি ফ্যামিলি সাইন বানাতে হয়।
হুটোং তে ঘন্টা খানেক কাটিয়ে ঐ পরিবারের থেকে বিদায় নিয়ে বেরুচ্ছি, হঠাৎ মাথায় এল চীনা ঘুড়ি তো কই দেখলাম না। হেলেনকে বলতে হেলেন বলল, সামনে একটা পার্ক আছে অনেক সময় ওখানে ঘুড়ি ওড়ে- চলো, দেখা যাক।
এগুলাম। মিনিট দশেক হেঁটে দেখি এক পার্ক – তার দু ধারে দুটি বিশাল টাওয়ার। একটি হচ্ছে বেল টাওয়ার, এখানে রোজ সকালে ঘন্টা বাজানো হত, তবে নগরেরে দ্বার খুলত। অপর টাওয়ারটি হচ্ছে ড্রাম টাওয়ার – এখানে সন্ধ্যা হলে ড্রাম বাজিয়ে জানান দেওয়া হত যে সন্ধ্যা হচ্ছে এবার গেট বন্ধ হবে। এ সবই প্রাচীন যুগ মানে ১৩০০ থেকে ১৭০০ সালের কথা। পরে চীনের বেশ কিছু অন্য শহরে এই রকম বেল টাওয়ার ও ড্রাম টাওয়ার দেখেছি।
পার্কে দেখলাম এলাহি শরীর চর্চার উপকরণ। সবগুলিই ব্যালান্স ঠিক রাখার বা হালকা ব্যায়াম বা ম্যাসাজ করার। হেলেন জানাল, এগুলির নাম হেলথ পার্ক। চীন দেশে এরকম হেলথ পার্ক বিভিন্ন জায়গাতে আছে। প্রধানত বয়স্ক পুরুষ মহিলারা দিনের শুরুতে বা শেষে এখানে আসেন ও শরীর সচল রাখেন। এ ছাড়া গানের সাথে সম্মিলিত নাচও শরীর চর্চার এক প্রধান উপকরণ। পরে চীনের বিভিন্ন জায়গাতেও এই জিনিষ দেখেছি। আসলে কেউ অলসভাবে বসে থাকে না। কিছু না কিছু করে শরীর চালু রাখে।
বেল ও ড্রাম টাওয়ার দেখা হল। ঘুড়ি কিন্তু দেখতে পেলাম না। হেলেন বলল এখনও ঠান্ডা বলে ঘুড়ি ওড়ানোর চল এখনও আসে নি।
সব ঘুরে হোটেল এলাম সন্ধ্যা ছ টা। হেলেন ও জুলিয়া বাই করে চলে গেল। বলল, কাল সকাল সাড়ে আটটায় বেরুব, তৈরি থেক। তবে কাল অনেক হাঁটাহাঁটি আছে কিন্তু।
চলবে
[আগামী সংখ্যায় বাকি বেজিং আর এক অবিস্মরণীয় ট্রেন জার্নি করে সিয়ান।]
বাঃ, দারুন লেখা আপনার! ভ্রমণ কাহিনী, ঠিক এই রকম ই আমার পছন্দ! পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
অনেক ধন্যবাদ।
সুন্দর লেখা। পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম। শুধু পিয়ালী ব্যাং খেয়েছেন বলে তুহিনার ভেগান হবার রহস্যটা ঠিক করতে হবে
পিয়ালী কে ভুল করে তুহিনা লেখা হয়েছে। ক্রুটি মার্জনা করবেন। তবে এটা নিয়ে একটা গল্প লেখা যাবে, পিয়ালীর ভুলে তুহিনা ভেগান কিভাবে হল। দারুন আইডিয়া ।
দীপ্ত তোর চীন ভ্রমণ কাহিনী পড়ে খুব ভালো লাগলো I
আমরা তিরিশ আগস্ট তিন সপ্তাহের জন্য চীন আর জাপান যাচ্ছি I তোর দেওয়া ইনফরমেশন গুলো খুব কাজে লাগবে I
পরের পর্ব গুলোর জন্য অপেক্ষায় থাকবো !
অনেক ধন্যবাদ বরুণ।
Osadharon lekhoni . Vrry few writers connect a reader to the plave of visit as you do. Learnt a lot of things sbout china through your writing .
Thanks Anindya
চীনের কার্রেন্সি টা ইয়েন এর জায়গায় ইউয়ান হবে 😊
ইংরেজি উচ্চারণে ইউয়ান কিন্তু লোকাল লোকরা ইয়েন বলে। আসলে খুব তাড়াতাড়ি উচ্চারণের ফল
দারুন লেখা, চিনের রাস্তার মত মসৃন গতিতে এগিয়ে চলছে। আগামী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
চিনচিনে এক আনন্দে হৃদয় ভরল পাঠকের তৃপ্তি তে
Excellent narration… Waiting for next
Thanks Subrata. Next one is coming on next month , terracotta warriors and many more
সুন্দর লিখেছিস। আমি বছর ছয়েক আগে ঘুরে এসেছি বেজিং সাংহাই, তাই একদম কানেক্ট করতে পারছি স্মৃতির সাথে।
পাঠক খুশি, লেখক তৃপ্ত
দুর্দান্ত ভ্রমণ কাহিনী। দীপ্তর চোখ দিয়ে আজকের প্রতিবেশী চীন কে ঢিনছি। পরের episode এর অপেক্ষায় রইলাম।
সময় করে পড়েছিস, ভালো লেগেছে, এটাই আমার বিরাট পাওয়া
সুন্দর ভ্রমণ বিবরণ। পরিচ্ছন্ন উপস্হাপনা। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
Went to China ten years back for about ten days
Mainly visit to some steel plants for a week and then Beijing tour few days
Toured many countries around the world but what I saw and observed in China was simply unbelievable
Refreshed my memory once again reading your travelogue
One thing Dipto I could not find any mention about the dry fruit vendors at the gate of Great Wall
There were so many of them with lot of varieties of mainly Chinese berries which I really liked and purchased some .Are they not selling them any more?
Could not find any dry fruit vendor, not on great wall, not any other places of China. Probably the trend has changed
বেশ লাগছে। সমৃদ্ধ লেখনী।
আমার অনেক অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দিলি।
খুব আনন্দ পেলাম প্রবীর
Asadharan paribeshona. ” CHIN(A)” niye ei lekha te chini achhe, masla o achhe.
Waiting for next episode.