পায়ের তলায় সর্ষে (পর্ব ২)
পরদিন ঘুম ভেঙে জানলায় চোখ পরতেই সবুজ,সাদা পাহাড় আর ঝকঝকে রোদ। Kasol… হিমাচলের এই অংশটায় বিদেশীদের যাতায়াত খুব বেশি। ইজরায়েল, তুরস্ক, ইয়েমেন, ফরাসী, ইতালি সব দেশ এসে হাজির। সকালে জলখাবার দেওয়ার আগে একচক্কর আশেপাশে ঘুরে এলাম। হিপি কালচারে দীক্ষিত বিদেশি টুরিস্ট যেন বেশি। ঢিলে হারেম প্যান্ট, মাথায় স্কার্ফ বা বিনুনি ওলা টুপি,গলায়, হাতে পুঁতির মালা,ঘাড়ে গলায় ট্যাটু আর পিঠে Hemp ব্যাগ।
দিব্যি আলুরপরোটা,সিঙাড়ায় কামড় বসাচ্ছে।জলখাবারের টেবিলেই মতের অমিল,একদল হাঁটতে নারাজ অতি ভক্তিসহকারে মণিকরণ এ মাথা ঠেকাতে চায়, আর গাইডের মতে হেঁ টে আগে নিজেকে একটু তৈরী করা ভালো।
দলের গাইড প্রেক্ষার সাথে hosteller এর গাইড নতুন একটি মেয়ে সুহানা ছালাল ট্রেকে নিয়ে যাবে।বেশ রুক্ষ,কঠিন প্রসাধনহীন চেহারা,রংচটা ঢিলে জামাকাপড়, আড়ালে গিয়ে সিগারেটে টান মেরে এসে চরম বিরক্তি প্রকাশ করে আনাড়ি আলুভাতে মহিলাদের একহাত নিল।
যথারীতি আমরা জনা ১২ ওর পেছনে আর দেরী না করে রওনা হলাম ছালাল ট্রেকে।একপাশে সুন্দরী বিয়াস নদী আর আরেক পাশে পাহাড়, সবুজ,খাপড়ার চালের ছোটো,ছোটো ঘর।মাঝে,মাঝে চ্যাটালো পাথরের ওপরে অনেক সাধুসন্ত গোছের লোকজনকে বসে থাকতে দেখলাম,রাস্তা সোজা,চড়াই নেই, কিন্তু ৩কিমি হাঁটা। পাশে পাশে খচ্চরের পিঠে কাঠ নিয়ে চলে যাচ্ছে গ্রামের লোকজন আর আমাদের খুঁড়িয়ে হাঁটা দেখে হাসির শেষ নেই।পৌঁছলাম ফ্রি ডম ক্যাফে.. চারপাশ থেকে পাহাড় ঘেরা একটা দু তিনতলা রেস্তরাঁ।
গমগমে কিছু মিউজিক বাজছে।Bob Marley আর শিব ঠাকুরের ছবি তে চারপাশ ভরতি।মাথায় ঝুটিবাধা একটি ছেলে আর এক অসংখ্য বিনুনি বাঁধা মহিলা খাবারের অর্ডার নিয়ে গেল।বিরাট একটা ঘরের চারপাশ দিয়ে ছোটো, ছোটো টেবিল দেওয়া, চেয়ার নেই ফ্লোরে কার্পেট পাতা।নানারকমের বোর্ড গেম,জলের বোতল।
পাশে আলাদা একজায়গায় একটু পরদার আড়ালে গাঁজার ঠেক।এই অঞ্চল অতি উত্তম cannabis,চরস এর জন্য বিশ্ববিখ্যাত। বিদেশিদের ভিড় ওইকারণেই বেশি।Bob Marley বাজছে,মাঝে মাঝে শিব তান্ডবস্তোত্র,কাঠের দোতলা ক্যাফেতে আমরা গোল হয়ে বসে চিকেন প্ল্যাটার,মিল্ক শেক আর স্মুদি তে মন দিচ্ছি পা ছড়িয়ে।পাশের ঘর থেকে ধোঁয়ার মৌতাত আর গিটার, ব্যাঞ্জোর টুংটাং। আর অপার প্রকৃতি উজাড় করে দিয়েছে সৌন্দর্য।
ভালো হাঁটতে গেলে সবচেয়ে দরকার আরামদায়ক জুতো এটা টের পেলাম হাড়েহাড়ে।এযাত্রায় আমাদের তিনজনের জুতো আমাদের বাঁচিয়ে দিল।ফিরতি পথে মণিকরণ গেলাম বটে কিন্তু অত ভিড় দেখে আর ঢুকতে ইচ্ছে হল না।পবিত্র উষ্ণ প্রস্রবণ আর গুরুদ্বোয়ারা। দূর থেকে ফটো তুলে রেহাই দিলাম।দুপুর বিকেল কাসোলের আশেপাশে ঘুরে, মার্কেট ঘুরে, অতি উত্তম চিজ কেক,স্ট্রবেড়ি কেক খেয়ে কাটিয়ে সন্ধের আগেই আস্তানায় ঢুকে গেলাম।আজ আর দেরি নয়।৮টায় ডিনার খেয়ে নিতে হবে।কাল অনেক ভোরে বেরোনো ক্ষীরগঙ্গার পথে।এর মধ্যে শুনলাম মুসলিম মেয়েটির শরীর খারাপ,জ্বর।তাকে একটু ওষুধপত্র দিয়ে খাবারঘরে দেখলাম সকলে জড়ো হয়ে গানের লড়াই চলছে।সকালের মনোমালিন্য মতের অমিল পাশে রেখে দিব্যি হইহই চলছে।
আমার ছেলে আর মেয়ে দেখি হোটেলের বুক কর্ণারে বইয়ে ডুবে গেছে।খুব ভালো সংগ্রহ এদের আর বইগুলো রাখাও সুন্দর করে। রাতের খাওয়া শেষে প্রেক্ষা একটু ছোটো করে আগামীকালের সারাদিনের প্ল্যানিং, কি কি নিতে হবে সব জানিয়ে দিল।আমরাও গুড নাইট বলে যে যার কম্বলের তলায়।
পরের দিনটা যে কি কঠিন হতে চলেছে কোনো ধারণাই নেই।একদম হালকা ব্যাগপ্যাক রেডি করে শুতে গেলাম।
[লেখকের অন্য লেখা]
ছবিঃ ডা. স্ববর্ণা চক্রবর্তী
খুব ভালো লাগলো ,এমন আরও ভ্রমনের অভিজ্ঞতা তোমার কলমে পড়তে চাই।
পাহাড়ি ঝরনার মত ঝরঝরে লেখা। পড়লে মনে হয় সঙ্গে আমিও যাচ্ছি!