সময়টা একেবারে তখন ভালো যাচ্ছে না। আত্মীয়বন্ধু দের করুণা কুড়োতে আর যেন পারছি না। ছেলে মেয়েরা ও কোথাও বেরোতে চায় না, লোকের ওই এক কথা,”আহা! বাপ মরা ছেলেমেয়ে দুটো! এহেন বিরক্তিকর দিনে ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া এক মহিলাদের ট্রেকিং অভিযানে নাম লিখিয়ে ফেলি। মায়েদের সাথে বাচ্চারাও যেতে পারবে। দিল্লী বেসড দলটা।কসোল ক্ষীরগঙ্গা ট্রেক… কয়েকঘন্টার মধ্যে এদিক, ওদিক বন্ধুদের সাথে কথা বলে কনফার্ম হয়ে হ্যাঁ বলে দিলাম। যাবো রাজধানী তে, ফেরা ফ্লাইটে। প্রথমে দিল্লী যাবো, ওখানে সবাই জড়ো হয়ে রওনা হব হিমাচলের উদ্দেশ্যে।

হিমাচলের পার্বতী ভ্যালি পেরিয়ে যাবো অনেক উঁচুতে ক্ষীরগঙ্গা নামে এক উষ্ণপ্রস্রবণ এ। কথিত আছে আমাদের কাত্তিক ঠাকুর নাকি কঠিন তপস্যা করছিলেন। মা পার্বতী তাই ক্ষীরের প্রস্রবণ করে দেন যাতে ছেলের খাবার কষ্ট না হয়। সেই থেকে ক্ষীরগঙ্গা নাম। ট্রেকিং-এর হাতেখড়ি-র জন্য বিখ্যাত।

এবার শুরুতে আসি, রুকস্যাক, জুতো, লাঠি, টর্চ জোগাড় হল। অভিজ্ঞ ট্রেকার বন্ধুদের উপদেশ, বক্তিমে মাথায় নিয়ে প্রথম রাজধানী চড়া আমাদের তিনজনের, আমি, মেয়ে ১৬, ছেলে ১৪ বছর তখন।

দিল্লী পৌছলাম রাজধানী গতিতে। সেদিনটা দিল্লীতে রাত্রিবাস,পরদিন পুরো দলবলের সাথে মিট হবে। কমলানগরের একটা হোটেলে ছিলাম। তীব্র গরম, তখন মে মাস। বিকেল,সন্ধে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম দিল্লি, আর সাথে উমদা পরাঠা আর মালাই পনির।

পরদিন হোটেল থেকে ঢিলছোড়া দূরে বাসস্ট্যান্ডে যে যার রুকস্যাক কাঁধে হাজির হলাম। গ্রুপ লিডার প্রেক্ষা, একদম অল্পবয়সী সুন্দরী আর অসম্ভব স্মার্ট। জনা ২০ মেয়ে, তার মধ্যে আমরা ছাড়া আরেকজন আছেন উনিও দুই মেয়েকে নিয়ে এসেছেন, আমাদের দলের সিনিয়র সবচেয়ে। আর আশ্চর্য কথা এই যে একজনও বাঙালি নেই দলে আমরা বাদে। সুতরাং হিন্দি আর ইংলিশ।

ঢাঊস একটা ভলভো-তে ওঠা হল সিট নং, আর জলের বোতল আর ব্রেকফাস্ট হাতে ধরিয়ে দিল। আমরা প্রথমে যাবো Bhuntar.সেখান থেকে জিপে Kasol. Kasol থেকে হাঁটা শুরু হবে।

হাইওয়ে ধরে বাস ছুটলো। আমাদের কাছে সব নতুন। রাস্তাঘাট, মানুষজন, ধাবা, আর সঙ্গী মেয়েরা সব দারুণ স্মার্ট আর কি সুন্দরী সব! আস্তে আস্তে আলাপ হল, কেউ একা, কেউ চারবন্ধু মিলে, কেউ মা আর মেয়ে। এরমধ্যে একটি মুসলিম মেয়ের সাথে আলাপ হল। বাড়িতে তুমুল ঝগড়া করে বেরিয়েছে একাই, পরনে সালোয়ার, বললো জিন্স একটা লুকিয়ে এনেছি। ভারী বন্ধুত্ব্ব হয়ে গেল গাইড প্রেক্ষার সাথেও। চটপটে, দারুণ অর্গানাইজড। মাঝে এক ধাবাতে থামল বাস। হইহই ভিড়, রঙিন ক্যান্ডিতে ভরতি, ঝলমলে। আবার বাস ছুটলো বিকেলের আগে Bhuntar পৌঁছলাম। হিমাচলে প্রবেশ হল।পাশে কুলকুল করে বয়ে চলেছে অপরূপা বিয়াস নদী। গাছপালা, প্রকৃতির পরিবর্তন টের পাচ্ছি। গায়ে গরম জ্যাকেট উঠেছে সবার। ছুটি আর শুভ আমার ছেলেমেয়ে দুজনে বেশ মিশে গেছে সবার সাথে। ছুটি ওর ক্যামেরায় অনেকের ছবি তুলছে। কথামতো আর একঘণ্টা জিপজার্নি করে Kasol er trekkers hut এ রাত কাটানো।

পাহাড় ঘুরে ঘুরে রাস্তা, বেশ ঝাঁকাতে, ঝাঁকাতে পৌঁছলাম Hosteller Trekkers Hut। পুরো রাস্তায় পাশ ছিল পার্বতী নদী। প্রকৃতির এত চোখ ঝলসানো সৌন্দর্য আগে কখোনো দেখিনি। আর দূরের ঘন সবুজ পাহাড়ের কোলে হলুদ কালোয় ভীষণ আধুনিক Hosteller। কিন্তু এখানেও খানিকটা নড়বড়ে পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হল। আমাদের জুটল ফ্যামিলি রুম, জানলা দিয়ে শুধুই পাহাড়, গাছ, সবুজ। ঝুপ করে সন্ধে। আটটায় ডিনার রুটি, চিকেন, ভাত, সবজি, গোলাপজামুন। আহ! কম্বলে সেঁধিয়ে গেলাম যে যার রুমে। রাত তখন সাড়ে দশ,বেশ ঠান্ডা। দরজায় নক নক।

Stargazing adventure মানে তারাভরা আকাশ দেখতে গাইডের সাথে যেতে চায় কারা, কারা?কেউ রাজি হল না। একমাত্র আমি, আমার ছেলে, একটি গাড়োয়ালি মেয়ে আর এক সদ্য বিবাহিত তরুণ দম্পতি।

গাইড ছেলেটি আর তার চেলা। প্রত্যেকের হাতে লাঠি আর টর্চ। বাপরে! কঠিন, এবড়োখেবড়ো রাস্তা! হ্যাচোড় প্যাচোড় করে আমি এগোই। এই ৫ জনের মধ্যে আমি ই সিনিয়র। কিন্তু উদ্যমের ঘাটতি নেই। হঠাৎ একটা সমতল জায়গায় এনে ফেলল। সকলে টর্চ নিভিয়ে ফেললাম। ওপরে তারায় ভরা ঝিকমিক চাদর। কি অপূর্ব সুন্দর! আশপাশ নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। গাইড তারা চেনাতে লাগলো আর আমরাও ছেলেমানুষের মত উচ্ছাস দ্যাখাতে লাগলাম। মিনিট খানেক পরেই এবার উতরাই নামা আবার সেই এবড়োখেবড়ো পাথুরে রাস্তা দিয়ে নামা। এবার প্রবল জলতেষ্টায় ছটফট করছি। একজন গাইডের কাছে দেখছি জলের বোতল, জল চাইলেও কিছুতেই দিচ্ছেনা। আরো মিনিট দশ চলার পর দেখি নদীর জলের শব্দ পাচ্ছি। টর্চ ফেলতেই দেখি আমরা বিয়াসের ধারে।

সঙ্গে গ্লাস, বোতল কিচ্ছু নেই। অনুমতি নিয়ে দু হাত দিয়ে আঁজলা করে জল খেলাম সেই রাতের অন্ধকারের পাহাড়ি নদী থেকে। সে যে কি অপূর্ব স্বাদ! গাইড দুজন দেখলাম আগুন জ্বেলে ফেলল। গাইডের জলের বোতল আসলে কেরোসিন এর বোতল। ফ্লাস্ক এ করে কখন চা নিয়ে এসেছে জানিই না। সাথে ওদের নিজস্ব বেকারির বিস্কুট। বিয়াসের কুলুকুলু শব্দ পায়ের কাছে, হাতে ধোঁয়াওঠা চা, আর ওপরে অনন্ত তারামণ্ডল। নিজেকে এক অন্যগ্রহের মানুষ মনে হচ্ছিল। যারা সেদিন কম্বলের তলা থেকে বেরোয় নি, তাদের জন্য মায়া হচ্ছিল।

ভীষণ ঘোরের মধ্যে ফিরে শুয়ে পড়লাম। পরদিন নাকি একটা ছোটো ট্রেক হবে acclimatisation আর training এর উদ্দ্যেশে। ছালাল ট্রেক… ২-৩ কিমি হেঁটে যেতে হবে ফ্রিডম ক্যাফে তে। সাথে মণিকরণ দর্শন আর Kasol নামের সুন্দর এলাকাটা ঘুরে দ্যাখা।

জীবনের প্রথম ট্রেকিং চল্লিশ পার করে, সাথে ছানা পোনা নিয়ে। একটু ত দম নিতেই হয় নাকি? তাই আজ এই পর্যন্তই। পরের পর্বে সেই কালান্তক ট্রেকিং এর গপ্পো নিয়ে হাজির হব। অলমিতি।


[লেখকের অন্য লেখা]

ছবিঃ ডা. স্ববর্ণা চক্রবর্তী

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জুন ২৪, সূচিপত্র]

5 1 ভোট
Article Rating
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
4 months ago

বাঃ মনে হচ্ছে ওই ট্রেকিং এ আমিও ছিলাম!
এমনই লেখার গুন!

Parna Datta
Parna Datta
4 months ago

Chokher samne drishyo guli fute uthlo. Khub bhalo laglo..

Syamali Bhadra
Syamali Bhadra
4 months ago

লেখা নয় যেন ছবি আঁকছেন। খুব সুন্দর

পার্থ সারথি বণিক
পার্থ সারথি বণিক
3 months ago

আমাদেরও মানস ভ্রমণ হল। ভাল লাগল। আরও ভাল লাগছে ভেবে যে ওই তারায় ভরা ঝিকমিক চাদরের কথা আমার গল্পটাতে আছে!