ভোরবেলা সকলে রেডি হয়ে দুটো জিপে ভাগ হয়ে বসে গেলাম। আমার সাথে ব্যাগে ড্রাই ফ্রুটস, জল, টর্চ, ওষুধপত্র, মোবাইল আর কিছু টাকাকড়ি। জিপ এসে দাঁড়ালো আমাদের ট্রেকিং এর starting point এ।

এবার আমাদের গাইড শমীম ভাই আর সঞ্জনা নামের রোগাপাতলা গাড়োয়ালি মেয়েটি। বলা যায় ইন্টার্ন এখন। সবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল স্থানীয় লাঠি ৩০/- করে ভাড়া। আর পাতলা ফিনফিনে প্লাস্টিকের ঢিলে বেঢপ রেনকোট। আমি আলাদা করে রেনকোট নিয়েছিলাম। তাই প্লাস্টিকের প্যাকেট গুলো ভাড়া করলাম না। শমীম ভাই লম্বা বক্তব্য রাখলো। সকলের সাথে পরিচয় করে নিল। আমি আর আর এক দিল্লীর মহিলা, যিনি দুই মেয়ে নিয়ে এসেছেন, আমাদের নিয়ে ওর চিন্তা। পেরে উঠবো কিনা।


আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। অপূর্ব চারপাশ, সবুজ গাছপালা, পাহাড়ের গন্ধ, অনেক বুনো ফুল, প্রথম ২-৩ কিমি অসুবিধে হল না। আমার মেয়ের এবার সমস্যা শুরু হল, ওর একটু হিমোগ্লোবিন কম, হাঁপিয়ে যায়, দাঁড়িয়ে পরে, বসে পরে দেরী হয়। ওর সাথে পাঁচটা একটু গোলগাল মেয়ের ও হাঁটতে অসুবিধে শুরু হল। একজায়গায় এবার ম্যাগি ব্রেক। শমীম ভাই ছুটি (আমার মেয়ে)-র সাথে সঞ্জনাকে ভিড়িয়ে দিল। সঞ্জনা ওকে নিয়ে ধীরে ধীরে আসবে।

শমীম ভাইয়ের আরেক শাগরেদ সেই পাঁচজন কে মনোবল জুগিয়ে এগোবে। আর শমীম ভাই যার যা লাগেজ ভারী লাগছে, যেমন আমাদের ক্যামেরাটা পিঠে গলায় ঝুলিয়ে আগে আগে বাকিদের নিয়ে এগোবে।
কেন এত দায়ভার নিল পরের রাস্তাতেই টের পেলাম। ওপর থেকে ঝরনার জলে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা তার ওপরে কয়েক টুকরো পা রাখার পাথর। সেই পেরিয়ে যেতে হবে। হাত ধরাধরি করে একবারে ৫ জন পার হওয়া। রেনকোট গায়ে ঝরনার জলের ঝিরঝির ধারায় প্রায় ভিজে ভিজে পেরোনো।

আবার চড়াই, ফিরতি যাত্রী যে কজন দ্যাখা হয় জিজ্ঞেস করি আর কতদূর? তারা হাতে ব্লুটুথস্পিকারে গান শুনতে, শুনতে হাত নেড়ে বলে, চলতে বনো। আরো একবার এক ঝরনার কাছে ব্ব্রেক। দুই পাহাড়ের ফাটলের মাঝে উপছে পরছে। হাতপা শুকোই চুল শুকোই, ছুটির মুখ ক্রমশ লাল। আর কত কি মি? সঞ্জনা ওকে শান্ত করে, ভারী শান্ত ধীর স্থির,অথচ জিন ও প্রাকৃতিক কারণেই বোধহয় খুব ফিট। আমার ছেলে শুভ হালকা পাতলা হয়ে তড়বড় করে এগিয়ে যায়, ওর কাছাকাছি বয়সী দুজন ছেলের সাথে পথেই আলাপ করে এগোতে থাকে। আমরা কুটকুট করে মাঝে মধ্যে ড্রাই ফ্রুটস মুখে নি। আরো দুবার ওরকম নড়বড়ে পিচ্ছিল রাস্তা পেরোতে হল ধরে, ধরে। শেষ দু কি মি প্রাণ যায় যায়।ঘোষণা হল, সামনে দুটো প্রচন্ড খাড়া স্টেপ আছে, তৈরি হও। সে এক প্রাণান্তকর চড়াই। কিভাবে ডিঙিয়েছিলাম জানি না। শুধু মনে আছে আমরা দুই আম্মা যখন ঠ্যাং তুলে ওপরে উঠলাম লাঠি, আর গাছের ডাল ধরে সকলে হাততালি দিয়ে উঠেছিল। গাড়োয়ালি মেয়েটি কেমন সুন্দর এগিয়ে যায়, কি অভ্যস্ত যেন! আমরা বাকিরা শাপশাপান্ত করতে করতে উঠি, কেন এলাম এ যাত্রায়, আবার ফিরতেও ত হবে।
অবশেষে ক্ষীরগঙ্গা বুগিয়াল, বেশ খানিকটা সমতল জায়গায় ছড়ানো রঙিন তাঁবু। আমাদের একটা তাঁবু বরাদ্দ হল। ব্যাগ রেখে এবার চললাম সেই ক্ষীরগঙ্গা নামক উষ্ণ প্রস্রবণে চান করতে, টেন্ট থেকে ৫০০ মিটার মত ওপরে। তখন বেলা চারটে, অন্ধকার হল বলে পাতলা, পাতলা মেঘ এসে ভয় দেখিয়ে চলে যাচ্ছে। মেয়েদের স্নানের জায়গা আলাদা।অবিরাম গরমজলের ধারা বয়ে চলছে।হই হই করে আমরা মেয়েরা ওপরের ধড়াচূড়ো বাইরে রেখে চান করে নিলাম।আহ! হটবাথ এর আরামে সারাদিনের ক্লান্তি সব উধাও। অনেকগুলো টেন্টের মাঝে একটা কমনরুম মত।তাতে মাঝে ফায়ার প্লেস। চারপাশে ঘিরে সকলে গা গরম করে নেওয়া। এরমাঝে ছেলে শুভকে খুঁজতে রাস্তা হারিয়ে অন্য দলের তাঁবুতে উকি মেরে জিভ কেটে বেরিয়ে এসেছি। তারপর ফায়ারপ্লেসের টেন্টে এসে দেখি সে দিব্যি আগুন পোহাচ্ছে। হাতে, হাতে চা নিয়ে নিজেদের মোজাগুলো শুকোতে লাগলাম আগুনের কাছে।মনে হচ্ছিল আদিম পৃথিবীর আমরা যূথবদ্ধ মানুষ আগশুদ্ধি করে নিচ্ছি নিজেদের।
খোলা আকাশের নিচে বুফে ডিনার।প্রত্যেকটা আইটেম গরম।আর শেষপাতে পায়েস। একটু চিনিকম হলেও সেসময় অমৃত লেগেছিল। খাওয়ার পর আগুন ঘিরে জটলা পাকাই, আগুনের জ্বলন্ত ছাই ঠাণ্ডা হুহু বাতাসে উড়ে উড়ে চলে যায়।

তাঁবুর আশপাশ আলো জ্বলে উঠে এক অদ্ভুত মোহময় পরিবেশ। দূর কোনো টেন্ট থেকে শিবের মন্ত্র ভেসে আসছে। তাঁবুর ভেতরে আলো নেই।মোটা লেপ কম্বল জুটেছে।আমার সোলার টর্চটা ভেতরে ঝুলিয়ে দিলাম। ছুটি এবার জেহাদ ঘোষণা করলো, “ওই রাস্তা দিয়ে আর আমি নামতে পারবো না।তুমি হেলিকপ্টার জোগাড় কর।,, ওই ঠান্ডায় আমার কপালে ঘাম।এইরে এবার বিগড়ে গিয়ে যদি কাল জেদ ধরে বসে থাকে?আমি কাল দ্যাখা যাবে, বলে শুয়ে পরলাম।তারপর সে এক রোমাঞ্চ, তাঁবুর বাইরে একপাল শেয়াল যেন ধূলো উড়িয়ে চলে গেল। স্বচ্ছ দেওয়ালের ওপারে তাদের ছায়া। আসলে ওরা বুনো পাহাড়ি কুকুর ছিল।

শনশন বাতাসের আওয়াজ, সাথে বাইরে শ্বাপদের ছায়া, ভেতরে তিনজনে লেপ কম্বলে সিঁটিয়ে। এখন ভাবলে কেমন লাগে। পরদিন সকালে বাইরে বেরিয়ে দারুণ আকাশ, দিগন্ত জুড়ে বরফ পাহাড়, সবুজ পাইন, দেবদারুর সারি।রঙিন টেন্টগুলো আর আমরা অসাধারণ দৃশ্য। বাথরুম, বেসিন কমন দু তিনটে, কিন্তু অসম্ভব পরিষ্কার,ঝকঝকে।বেশ অনেক ছবি তোলা হল।আমি ভয়ে ভয়ে শামীম ভাইকে বলি, মেয়ে ত বেঁকে বসেছে। সঞ্জনা আর শামীম ছুটিকে প্রায় ২০মিনিট ধরে কিযে ফুসমন্তর দিল,মেয়ে জুতো, লাঠি সামলে রেডি।
আমরা নামতে থাকি সেই ১২ কিমি।উঠতে ১৩ কিমি।সেই অনন্ত যাত্রা।তবে নামার রাস্তায় আর অত ঝরনা পেরোতে হয়নি।গ্রামের মাঝ দিয়ে,দিয়ে থামতে থামতে নামা। পুরো টিমটা একটা পরিবারের মত হয়ে গেছি যেন। কত নতুন বন্ধু,ছবি দেওয়া নেওয়া,হ্যা,হ্যা হি,হি।নামতে সময় একটু কম লাগলো। শামীম গাইড বিদায় নিল। যাওয়ার আগে দুই বুড়ির পিঠ চাপড়ে বলে গেল,”আপ দোনো কামাল কর দিয়ে আন্টি।”


কাসোলে ফিরে আর থাকা নয়, ঘর থেকে বাকি রুকস্যাক পিঠে নিয়ে এবার ফিরতি গাড়িতে ওঠা।আজই ভুন্তর হয়ে দিল্লী। ঝাঁকাতে,ঝাঁকাতে, ধুলোয় ভরিয়ে গাড়ি চলে, পাশে অনন্ত সুন্দরী পার্বতী ভ্যালি, বিয়াস নদী।
ভুন্তরে খাওয়া, আড্ডা,চোখের জল সব সামলে যখন দিল্লী ঢুকলাম তখন রাত।বাসস্ট্যান্ডেই দল ভেঙে যে যার বাড়ির পথে। আমরা এক হোটেলে মাথা গুঁজলাম। পরদিন ফ্লাইট।ভাইবোন স্বীকার করে নিল যে এতটা যে ওরা ট্রেকিং পারবে ভাবতেও পারেনি।আর এত সৌন্দর্য প্রকৃতির!
এই যে কূপমণ্ডূকতা ছেড়ে প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে এই দূর্গম পথ হেঁটে যেন এক বৃহত্তর জগতে পৌছে গিয়েছিলাম। সমস্ত সংকীর্ণতা রেখে শোকসন্তাপ সব ভুলে সামনের আরো লড়াইয়ের জন্য মনের জোর এনে দিয়েছিল এই পুরো জার্ণি।এখোনো স্বপ্ন মনে হয়, সত্যিই কি গিয়েছিলাম? সত্যি কি পেরেছিলাম? জীবনের এই প্রাণান্তকর লড়াইয়ে বিপদে পরলে চোখবুজে সেই খাড়াই বাঁক টা মনে করি,আর স্বস্তি পাই।

[লেখকের অন্য রচনা]

ছবিঃ ডা. স্ববর্ণা চক্রবর্তী

[পরম্পরা ওয়েবজিন, আগস্ট ২৪, সূচিপত্র]