নতুন করে
একটা নীল ঘুড়ি উড়ছিল অনেক উঁচুতে। ওর সুতো ছিল আমার হাতে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া বন্ধুদেরকে জিজ্ঞাসা করলে তাদের মধ্যে অনেকেই বলত, ‘বড় হয়ে পাইলট হব’। এসব বলে তারা প্রশংসাও পেত খুব। আমি বাংলা মিডিয়াম। আমি বড় হয়ে কী হব সে উত্তর তখন আমার জানা ছিল না, তবে এটা জানা ছিল যে ওরা ঘুড়ি ওড়াতে পারে না বলেই বিকল্প হিসেবে প্লেন ওড়ানোর কথা ভাবছে!
কখনও কখনও পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। এই ব্যস্ত সময়ে পিছন দিকে তাকানোর সুযোগ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তবুও পিছন ফিরে তাকাতে হয় আর তখন মনে হয় আমরা কী করে যেন হটাৎ বড় হয়ে গেলাম আর পাল্টে গেল সব কিছু। পাল্টে গেল মাঠের সবুজ, পাল্টে গেল রাস্তার কালো, পাল্টে গেল আকাশের নীল। আর মনের সাদা? সেও কী এখন আস্তে আস্তে ধূসরের দিকে এগিয়ে চলেছে!
তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। স্কুল ছুটি হত তাড়াতাড়ি। ঠিক পাড়ার মধ্যে স্কুল না হলেও আমাদের স্কুল খুব একটা দূরে ছিল না। তাই বিকেলের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসতাম তারপর মাঠে যেতাম খেলতে। ক্রিকেট খেলতাম, ফুটবলও।
আমরা শহরে শীতকালে ঘুড়ি ওড়াতাম না। ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হত বিশ্বকর্মা পুজোর আগ দিয়ে আর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ির উৎসব। এসব ভালবাসা আমার বাবার কাছে শেখা। ঘুড়ি ওড়ানোর মরশুমে আমি ঘুড়ি ছাড়া আর অন্য কিছুর দিকে মন দিতাম না। আজকাল তো বিশ্বকর্মা পুজোর দিনেও আগের মতো ঘুড়ি উড়তে দেখি না কিন্তু আমার মনের আকাশ এখনও রঙিন ঘুড়িতে ঢাকা পড়ে আছে।
‘ফিরতে রাত হবে। সন্ধ্যার আগেই ছাদ থেকে নেমে এসো।’ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বাবা বলে গেছিলেন। কিন্তু সেদিন দুপুর শেষে বৃষ্টি হল আর আমার মন খারাপ। ভাবলাম আজ আর ঘুড়ি ওড়ানো হবে না। কিন্তু বিকেলের দিকে মেঘ কেটে গিয়ে রোদ উঠল। উজ্জ্বল রোদ। নীল আকাশের নীচে গাছের সবুজ পাতায় কী এক আশ্চর্য সৌন্দর্য খেলা করতে শুরু করে দিল আর আমার মনের ভিতর অদ্ভুত একটা আনন্দ। আগে লাটাই থেকে ছাদে কিছুটা সুতো ফেলে নিতাম তারপর ডান হাতের তর্জনী আর বুড় আঙুল দিয়ে সুতো টানতাম। একটু বেশি বাতাসে মাঞ্জা দেওয়া সুতোর টানে আঙুল কেটে যেত।
ছাদ শুকোতে শুকোতে প্রায় সন্ধ্যা। সুন্দর একটা হাওয়া বইছিল। আমার চাঁদিয়াল ঘুড়ি অবশেষে আকাশে জায়গা পেল। একমনে ঘুড়ি ওড়াচ্ছি, এদিকে কখন যেন সন্ধ্যা নামল শহরে। সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাশের বাড়ির নারকেল গাছের মাথার উপর দিয়ে উঠে এল বিশাল আকারের গোল চাঁদ। জ্যোৎস্নার নেশা আমার ক্লাস সিক্স থেকে আর সিগারেট ক্লাস নাইন। সিক্স আর নাইন সংখ্যা দু’টোকে পাশাপাশি বসানোরও একটা আলাদা নেশা আছে। তবে ওসব কথা থাক এখন। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত আমি ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম, কারণ বাড়িতে মা বাবা কেউই ছিলেন না। বিকেলের উজ্জ্বল রোদের আনন্দটা জ্যোৎস্নায় একটা চাপা উত্তেজনায় পরিণত হয়েছিল। আমি চিন দেশের গল্পে রাত্রে ওড়ানোর লণ্ঠন ঘুড়ির কথা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু সে-রাতে দু’টাকা দামের জ্যোৎস্না ঘুড়ি ওড়ানোর কথা আমি কোনওদিনও ভুলতে পারব না। আমার চাঁদিয়াল তখন চাঁদের আলোয় লাট খাচ্ছে। আমার মনে হল এখন আর ঘুড়ি নয়, আমি পূর্ণিমার বিশাল চাঁদটাকেই যেন ওড়াচ্ছি ঘুড়ির মতো করে। আর এটা মনে হতেই আমার অবচেতন মনে কয়েকটি কথার জন্ম হল— বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানো হয়নি বলে সন্ধ্যার পর চাঁদ ওড়াচ্ছি নারকেল দড়ি দিয়ে। কেন এমন উপলব্ধি হয়েছিল জানি না। তখন আমার সঙ্গে কবিতার সে অর্থে কোনও সম্পর্কও ছিল না।
তারপর প্রায় বারো তেরো বছর কেটে গেছে। জীবনের রাস্তায় আমি হোঁচট খাচ্ছি রোজ। জ্যোৎস্নার নেশা কাটেনি কিন্তু ওরকম নরম আলোকেও মাঝে মধ্যে জৈষ্ঠ্যের চড়া রোদ মনে হয়। আমি রুমালে ঘাম মুছি, দীর্ঘশ্বাস ফেলি। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কবিতা লেখা শুরু হয়ে গেছে বেশ কিছুকাল যাবৎ। একদিন হঠাৎ সেই ফেলে আসা জ্যোৎস্না রাতের কথা মনে পড়ে গেল। শুধু তাই নয়, আশ্চর্যজনকভাবে নারকেল দড়ি দিয়ে চাঁদ ওড়ানোর প্রসঙ্গটাও মনে পড়ে গেল হুবহু। মন ভীষণ রহস্যময়, মনের গভীর থেকে উঠে আসা কবিতাও কম রহস্যময় নয়। এতদিন পরও ওই কথাগুলো কীকরে আমার মনের মধ্যে থেকে গেছিল, তা আমার কাছে সত্যিই অজানা। আমি ওই কথাগুলো দু’টি পঙ্ক্তিতে লিখে ফেললাম খাতার পাতায়। এরপর একটার পর একটা দৃশ্যকল্প ফুটে উঠতে থাকল আমার চোখে। এভাবেই আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে লিখে ফেললাম পনেরো লাইনের একটি কবিতা। কীভাবে চাঁদ হারালাম জানি না, জানি না কীভাবে স্টেশনের কথা উঠে এল কবিতায়। কেন এসব লিখলাম জানি না, কিন্তু লিখলাম।
বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানো হয়নি বলে
সন্ধ্যার পর চাঁদ ওড়াচ্ছি নারকেল দড়ি দিয়ে
ঝোড়ো হাওয়ায় দড়ি ছিঁড়ে হঠাৎ ওই চাঁদ ভেসে চলল দ্রুত
কুড়িয়ে আনব ভেবে আমিও দৌড়তে শুরু করলাম পিছন পিছন
আমার একটা চোখ নেই
অন্য চোখটিকে সহজেই ফাঁকি দিয়ে হতভাগ্য চাঁদটা
কোথায় যে গিয়ে পড়ল— কিছুতেই দেখতে পেলাম না অন্ধকারে
এদিকে রাত তখন অনেক
এক আলোকবর্ষের থেকেও অনেক কম দূরত্বে থাকা
আমার চোখের তারাটিকে সবুজ-সংকেত মনে করে
সশব্দে ছেড়ে দিল সে রাতের লাস্ট ট্রেন
স্টেশনের কাছেই শ্মশান
বালকের চোখের জলে নিভল না পিতার উদ্বায়ী চিতার আগুন
তারপর ধীরে ধীরে ফিরে চলে গেল
শরীরী আত্মার কতগুলি অশরীরী ছায়া…
কবিতাটির নাম রাখলাম ‘অশরীরী ছায়া’। পরবর্তীকালে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হল। কবিতাটি শুধু কবিতা হিসেবেই নয়, আমার কাছে একটা রহস্য হয়ে থেকে গেছে। যার উত্তর আমি পাব না কোনওদিন!
পড়ে মন ভালো হয়ে গেল।কি সুন্দর স্বচ্ছন্দ লেখা। লেখকের মুন্সিয়ানা এবং লেখার হাত আছে। সম্পাদকের কাছে আমার অনুরোধ তথাগত দত্তকে দিয়ে আরো লেখান,যদি সম্ভব হয় তাহলে বড়োগল্প বা উপন্যাস। লেখক বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল আবিষ্কার।
বাঃ অপূর্ব কবিতা! আমিও ঘুড়ি ওড়াতাম, পৌষ সংক্রান্তি তে। রাত্রে জোৎস্নার চাঁদের আলোয়
চাঁদিয়াল ঘুড়ি উড়ানোর কল্পনায় আমিও বিভোর হলাম!
মন ভালো করা লেখা ।