উৎসব শেষে ঘরবাড়ি এলোমেলো ক্লান্তিতে দুদন্ড জিরিয়ে নিচ্ছে, তখন ছেলেমেয়েরা ফিরে গেছে। দেওয়ালে হেমন্তকাল। এমন এক ঝিম ধরা দিনে ডাক এলো। যেতে হবে নামখানা, “পথের পথিক” সংস্থার ডাকে। একটা মেডিকেল ক্যাম্প হবে। তার আগের দিন হাসপাতালে ছিলো রাতের ডিউটি। পরদিন প্রায় ঘুমচোখে ওদের গাড়িতে উঠলাম পাইকপাড়া থেকে।

এক,দুই করে আরো তিনজনকে নিয়ে গাড়ি ছুটল। এদিকটা আসা হয়নি, আস্তে আস্তে হাইরাইজ ছাড়িয়ে দুধারে শুরু হল ঝুঁকে পড়া গাছ, আর মাঝে মাঝে বাজার, হেয়ারকাটিং সেলুন, লেভেল ক্রসিং, সব পেরিয়ে এলাম হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদীর ওপর। আগে ভেসেলে পার হতে হতো, এখন ঘাড়উঁচু করা ব্রিজ পেরোলাম। নদীতে ট্রলারের সারি যতদূর চোখ যায়। গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলে আবার ছুট। পথে এক মহিলার চায়ের দোকানে থামা। একটা সাইনবোর্ড বেশ মনে ধরেছিলো,”হাড়ে মাংস ১৮০/- আর খালি মাংস ২২০/-” মাংসের দোকানের সাইনবোর্ড। সুন্দর অনুবাদ।

দেখতে দেখতে সুন্দর এক ছায়াঘেরা গ্রামে ঢুকে পরলাম। গ্রামের নাম চন্দনপিঁড়ি। আমরা যাবো ওখানকার এক আশ্রমে, আবাসিক ছেলেদের আর গ্রামের বাচ্চাদের জন্য একটা মেডিকেল ক্যাম্প এর আয়োজন। এত সুন্দর পরিপাটি গ্রাম আমি দেখিনি। দুধারে ধানের ক্ষেতে পাকা ফসল। আল দিয়ে দিয়ে সবজি লাগানো। অনেক বাড়িই পাকা।

আর কাঁচা বাড়িগুলো যেন ছবি আঁকা। আকাশমণি, অপরাজিতা, জবাফুলে ঘেরা। খানিকটা জমি তে শীতের সবজি, বাঁধাকপি, কড়াইশুঁটি, বেগুন। ঘরে ঘরে তুলসীমঞ্চ। ভ্যান,টোটো কয়েকটা চলে। আমাদের আশ্রমে ঢুকতে একটু দেরিই হয়ে গেছিল। আমি বেশকিছু ওষুধপাতি নিয়ে গেছিলাম। একেবারে দুপুরের খাবার খেয়ে বসে পরলাম কাজে।

আগেই আশ্রমের মাথা স্বপনবাবু ছেলেদের,বাচ্চাদের, মায়েদের জড়ো করে রেখেছিলেন। ওজন,উচ্চতা মাপা চলতে লাগলো, আর তার সঙ্গে আমার রুগী দ্যাখা। ছেলেগুলোর বিশেষ কোনো রোগ নেই,কিছু চর্মরোগ,পরিচ্ছন্নতার অভাব আর কৃমির জন্য রক্তাল্পতা। কিন্তু ওরা খুব গম্ভীর, মুখগুলো যেন বিষণ্ণতায় ঢাকা।

যা খবর পেলাম, এদের বেশিরভাগ-এর বাপ কে বাঘে নিয়েছে। মা হয়ত অন্যত্র সংসার পেতেছে। ছেলেকে আশ্রমে রেখে গেছে। একটা বাচ্চা ছিলো, তাকে যে কে রেখে গেছে আজ অব্দি জানা যায়নি। প্রথমে একদম গম্ভীর থাকলেও একটু একটু করে আমার সাথে গল্প করতে শুরু করলো। আর বাকি গ্রামের বাচ্চাদেরও দেখলাম।

এই আশ্রমেই সকালে চলে প্রাথমিক স্কুল। তাদেরকেও কিছু দেখলাম। পুরো রামকৃষ্ণ মিশনের ভাবধারা অনুযায়ী আশ্রমের পরিবেশ। প্রার্থনাঘর, ছেলেদের ডরমিটরি, অতিথিশালা, লম্বা খাওয়ার ঘর, গোশালা, নিজস্ব পুকুর আর পুকুরে মাছে, সব্জি বাগান, ধানি জমি একফালি, খেলার মাঠ আর ছেলেদের পড়ার ঘর।

অতিথিদের জন্য সুন্দর থাকার ব্যবস্থা লাগোয়া বাথরুমসহ। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। নিচের অফিস ঘরে গ্রামের মেয়েদের হাতে করা শাড়ি, আচার, ঘি ইত্যাদি-র একটা আউটলেট। স্থানীয় মেয়েদের প্রশিক্ষণও চলে এই সব কর্মকান্ডের পাশাপাশি।
এবার আমরা গ্রামে হাঁটতে বেরোলাম। ধানক্ষেতে নেমে পড়ি একবার, একবার তুলসীমঞ্চের বাধানো সিঁড়িতে বসি, বিকেলের সূর্য অস্ত যায় ওই ধানিজমির ওই পাড়ে। তখন ও আকাশে আলো, খবর পেলাম কাছেই এক ছোট্ট নদীর ঘাট আছে, তাতে খেয়াপারাপার হয়। চললাম আমরা দেখতে। পথে আরেক চমক।

বড় করে বাঁধানো তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ। এইগ্রাম থেকেই হয়ত উত্থান। আবেগে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আর খানিক যেতেই ঘাট অতিসাদামাটা। নদীর পাড় জুড়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের শ্বাসমূল,কাদা লেপা মাটিতে মাডস্কিপার মাছেরা ইলিবিলি দাগ কাটছে। একপাশে ট্রলার মেরামতি চলছে। ঘাটে ভটভটি নৌকাতে দেখলাম লোকজনের ওঠানামা। ঘাটের ল্যাম্পপোস্ট এ সোলার আলো। এখন গ্রামে এই ব্যাপারটা খুব পছন্দের।

সোলার এনার্জি র ব্যবহার সবজায়গায়। খুব অন্ধকার হওয়ার আগেই ফিরে এসেই শুনতে পেলাম সন্ধ্যারতি শুরু হচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে ওপরে গিয়ে দেখি সুন্দর ধুতি চাদরে ছেলেরা পালটে গেছে। আরতি,নামগান,কাঁসরবাজানো সব ওরাই করে।সুন্দর কচি গলায় সেই প্রার্থনা সংগীত সন্ধেটা অদ্ভুত সুন্দর করে দিল।

শেষ হতেই ওরা চলে গেল পড়ার ঘরে। এই শৃঙ্খলা জীবনে কী যে দরকার! বিকেলে গ্রামে ঘুরতে যাওয়ার সময় দেখেছিলাম ওরা মাঠে খেলছে, আমাদের সাথী এক দিদি ওদের জন্য দুটো ফুটবল এনে দিয়েছেন এবার। একটু বিশ্রাম নিতে নিতে চললো আমাদের মেয়েলি আড্ডা,হা,হা,হি,হি আর এই বাচ্চাদের জন্য বাস্তব কিছু পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা। রাতের খাওয়া হলো ছেলেদের সাথে নিয়ে।আমি কিছু আতসবাজি নিয়ে গেছিলাম ওদের জন্য।ওইসময় দেখলাম মুখগুলো খুশিতে চকচক করছে,মুখে একগাল হাসি। রাত বাড়লো আর বাড়লো অসংখ্য ঝিঁ,ঝিঁ পোকার সাইরেন।

পরদিন ভোর টাকে হাতের মুঠোয় ধরব বলে বাইরে পা ফেলতেই নজরে এল আশ্রমিক সোমনাথ গায়ে দলুই গায়ে বাগানে ফুল তুলছে। ঘাস ভিজে আছে হেমন্তের শিশিরে।আর প্রার্থনা ঘর থেকে ভেসে আসছে সমবেত গান। সে এক অপূর্ব অনুভূতি। আবার একবার ভোরের সাক্ষী হয়ে গ্রামের আলে ডালে ঘুরে ফিরলাম। বক,সারস,মাছরাঙা, শাপলায় পরা জলবিন্দু দেখতে দেখতে ফেরার সময় হয়ে এল।

আপিস ঘরের দাদা ততক্ষণে নিয়ে এসেছেন দেশী ভেটকি,গুলে মাছে,জ্যান্ত ট্যাংরা,চিংড়ি,টাটাকা ফুলকপি, বিনস,শালগম,আশ্রমের ক্ষেতের চাল। গ্রামে ধানচাষের সাথে সাথে পেছনদিকেই মাছের বেড়ি।সেখান থেকে সদ্য আনা মাছ আর ক্ষেতের সবজি। শহরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক দাম নিলেন। প্রথমে ত নিতেই চাননি।আমরা জোর করে দিয়ে এসেছি।


এইবার হল চাপ,এত বাজার, বরফ দিয়ে সুরক্ষিত মাছ টাছ নিয়ে গাড়িতে আমাদের ল্যাজেগোবরে অবস্থা।ড্রাইভার দাদা অত্যন্ত ভদ্রভাবে গাড়ির মেঝের মাছের জল মুছলেন আর গাড়ি ভরতি মেছোগন্ধ সহ্য করলেন।
লম্বা রাস্তা পেরিয়ে দুপুর দুপুর বাড়ি।


এখানে বলে রাখা যায় চন্দনপিঁড়ি আশ্রমের অতিথিশালায় যে কেউ থাকতে পারেন গিয়ে। ভাড়া কিছু নেই শুধু ডোনেশন বাবদ আপিসে কিছু দিলেই হল।


অনেক টাকাই ত হোমস্টে, হোটেলে, ক্যাফেতে চলে যায়।একবার নামখানার এই চন্দনপিঁড়ি আশ্রমে ছেলেদের সাথে একবেলা কাটিয়ে যাবেন না কি? দেখবেন এক গভীর আত্মপ্রশান্তি হবে।

[ছবি- লেখক]

[লেখকের অন্য রচনা]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, ডিসেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

0 0 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
1 month ago

লেখাটা পড়ে নির্মল আনন্দ পেলাম।
আশ্রমিক দের জীবন, গ্রামের প্রকৃতি খুব সুন্দর বর্ণনা করেছেন!