আমি সাদা কাগজের মধ্যে ডেপ্‌থ্‌ খুঁজছি। আজ না। বহুদিন ধরে। সাদায় পেয়েছে আমায়। ভালবাসায়। মগ্নতায়। একটি সাদা বেড়ালের মধ্যে সন্তান খুঁজেছি। সে আমায় প্রতারণা করেনি। আজ সে আমার সন্তানসম। ভালবাসে। তার নিজের মতো করে। আমি খুশি। আমি তাকে অপহরন করিনি। সে স্বেচ্ছায় এসেছে। স্বেচ্ছায় থাকে আমাদের সঙ্গে। ভালবাসা বিতর্কিত। রাজনীতি সম্মানহানিকর। অথচ, তারাও সাদায় বিশ্বাসী। আমি গল্প লিখি। শপথ গ্রহন আমার গ্রাহ্য না।
ছোটবেলায় জামগাছের নিচে একটা লজেন্সওয়ালা আসত। তার গায়ে সাদা জামা ছিল। সে গান গাইত। ভাঙা কাপের টুকরো দিয়ে বাজনা বাজাত। তার তালজ্ঞান ভাল। তার নাম ছিল অনন্ত। অনন্তর একটা মেয়ে ছিল। সেও তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে আসত। সেই মেয়েটি ট্রামে চাপা পড়ে। অনন্ত পাগলের মতো কাঁদছিল। পাড়ার লোকেরা একটা সাদা চাদরে তাকে ঢেকেছিল। তারপর বহুদিন আমার স্বপ্নে একটা সাদা চাদর উড়তো। একটার পর একটা ট্রাম চলে যেত ঘন্টি বাজিয়ে। আমি স্কুলড্রেস পরার ভয়ে বহুদিন স্কুলেই যাইনি। আমি দুর্বল।
আজকাল সন্ধেবেলা শশাঙ্ক আসে। পকেটে করে ভদ্‌কার নিপ নিয়ে। রোজই আসে। তার সাংসারিক সমস্যা। আমি শুনি, মানে শুনতেই হয়। আজও সে এল। বলল, যাবে তো?
-আমি তো রেডি।
আমরা খালের পাশে বসি। একটা সিমেন্টের বেদি মতো আছে। সেখানে। সে একথা ওকথা বলার পরই সাংসারিক সমস্যার অবতারনা করে। তখন আমি চুপ করে যাই। আমি মনে করি, তার সমস্যা তারই মেটানো উচিত। সে আজও বলল, ডিভোর্স হবেই।
-কেন? তুই কি ডিভোর্সে শান্তি পাবি ভেবেছিস?
-হয়তো।
-পাবি না। লিখে দিচ্ছি। ডিভোর্সের ঝামেলা জানিস। আর, একটা কাজও তো নিজে করতে পারিস না। থাকতে পারবি?
-থাকতে হবে। তবে, এভাবে আর বেশিদিন গড়াবে না। শুনে রাখো।
-শোন, আমার শুনে কোনো লাভ নেই। যাদের সঙ্গে সমস্যা, তাদের গিয়েই বল।
-তার মানে তুমি আমার সঙ্গে নেই।
ভদকার নিপ ততক্ষণে শেষ এবং খালের জলে শিশিটা ভাসছে। শশাঙ্ক বলল, তুমিই বল। সারাদিন খাটাখাটি করে এসে কাঁহাতক ভালো লাগে বউ আর মায়ের মড়াকান্না। এখন আবার বাবাটাও জুটেছে।
-তুই একটা ফ্ল্যাট কেন? কত ফ্ল্যাটই তো হচ্ছে। ওই শামিমের ফ্ল্যাটে ফাঁকা আছে। দামও কম। আমি দেখেছি।
শশাঙ্ক আর আসে না। আমার কথা তার পছন্দ হয় নি বোধহয়। আমি নিজের পয়সাই আজকাল ভদ্‌কা খাচ্ছি। প্রায় দু’মাস পরে সে এল। আজ নিপ না। বোতল। মুখে হাসি। বলল, তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি। বাড়িতে গিয়ে বসব।
বললাম, কি ব্যাপার? খুলে বল। তার আগে লম্বা সিগারেট থাকলে দে।

ছবিঃ ডাঃ গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়


সে দিল। সে ফ্ল্যাটই কিনেছে। বাবা-মা কান্নাকাটি করেও মেনে নিয়েছে। সম্পর্ক এখন ভালো হয়েছে। বউয়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে। তার বাড়িতে সে জোর করে নিয়ে গেল। সাদা বিল্ডিং। শামিমের নিচের তলা। শামিম এল। মাল খেয়ে যথারীতি মাতলামি করলো। রাতে রেজালা রুটি খেয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। শশাঙ্কের ফ্ল্যাটের নাম, হোয়াইট হাউস। বেশ না? লোকে বলে, আমায় সাদায় পেয়েছে। আসলে, একটা ভূত আমার স্বপ্নে ঢুকে আছে – বেশ বুঝতে পারি। তার কোনো রঙ নেই। অং বং চং নেই। পঞ্চায়েত ভোট নেই, যে নমিনেশন ফাইল করতে হবে।
এরপরে শশাঙ্কর আর আমাকে প্রয়োজন হয়নি। আর সে আসে না। আমি ও মনে মনে খুশি। যাক। তাহলে সে ভাল আছে। আমিও আমার জগতে ফিরে গেছি। অফিস করছি। বসের ঝাড় খাচ্ছি। বাড়ি ফিরে ভদকা খাচ্ছি। এভাবে চললে কিন্তু গল্প হত না। একদিন অফিস ফেরতা এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সে ইয়ার্কি করেই বলল, কীরে বিয়ে করিস নি কেন? আমার জন্য? বললাম, যাহ। কী যে বলিস। আমার এখন পঞ্চাশ। আর কী বিয়ে করবো। অজন্তার বয়সও কিন্তু পঞ্চাশ। বরং সে আমার থেকে চারমাসের বড়। আমি জানতাম। কলেজে আমাদের নিয়ে লোকে হাসাহাসিও কম করে নি। কিন্তু আমার মনে বরাবরই প্রেম কম। আমি তাকে বললাম, বাড়ি কোথায়? সে বলল, সল্টলেক। তোর? আমি বললাম, শ্যামবাজার। আগেও তো ওখানেই থাকতাম। সে বলল, একদিন আয়। বিয়ে কিন্তু আমিও করিনি। হেসেই বললাম, তাতে আমার কী? সে যেতে যেতে বলল, আয়ই না। একদিন।
তারপর সে ফোন নম্বর আদান প্রদান করে চলে গেল।


প্রায় এক বছর কেটে গেছে। আমার ট্রান্সফার হয়েছে। আগে চশমা ছিল না। এখন একটা চশমা উঠেছে নাকের ওপর। আবার তার সঙ্গে দেখা, খুব এলি তো? বললাম, যাব যাব। সময় পাচ্ছি না একদম। জানিস তো আমাদের কাজ। আজ এখানে কাল ওখানে। চা খাবি? সে বলল, চল। এয়ারপোর্টের কাছে একটা ভালো চায়ের দোকান ছিল। আমরা দাঁড়িয়ে চা খেলাম। সে হেসেই বলল, কিপ্‌টেই রয়ে গেলি। ভাবলাম, কোনো টি-বুটিকে নিয়ে যাবি। আমতা আমতা করে বললাম, একদিন গেলেই হয়। সে হাসতে হাসতে চলে গেল।
এরও প্রায় বছর চারেক পরের ঘটনা। একদিন একটা ফোন পেলাম। তখন আমি পুরুলিয়া। অজন্তা। খুব সংক্ষিপ্ত একটা ফোন। বললাম, কেমন আছিস? একটু ভাঙা ভাঙা গলায় উত্তর পেলাম, কোলকাতায় আছিস? বললাম, নাহ্‌ পুরুলিয়া। সে ধীরে ধীরে বলল, ফিরছিস কবে? বললাম, পরশু হবে। কেন রে? সে বলল, কোলকাতায় এসে একবার ফোন করিস। অবশ্যই। দরকার আছে।
না। এবার ফোন করেছিলাম। কলকাতায় ফিরেই। সে তোলেনি। তার কোনো রিলেটিভ তুললো, কে বলছেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম, অজন্তা? তিনি বললেন, আপনি? বললাম, ওকে বলুন ওর বন্ধু। সেই কলেজের সময় থেকে। তিনি একটু ভারী গলায় বললেন, সৈকত? আমি বললাম, হ্যাঁ। ওকে দিন না ফোনটা। ও বলেছিল ফোন করতে। তিনি বললেন, পারলে একবার আমাদের সল্টলেকের বাড়িতে এসো। ও তো এখন নেই। আচ্ছা তুমি চিনতে পারবে তো। আমি বললাম, আমরির পাশে তো। আমি চিনি। দু তিন দিন পরে সল্টলেকে একটা কাজ ছিল। ভাবলাম, অজন্তার বাড়িটা হয়ে নেব। গেলামও।
অজন্তার মা দরজা খুললেন। বললেন , সৈকত? এসো ভেতরে এসো।
বসার ঘরে একটা বিশাল ছবি। অজন্তার। ছবিতে মালা। ধূপ জ্বলছে। আমি সোফার ওপর ধপ্‌ করে বসে পড়ি। সে কী? তার মা বলল, ব্লাড ক্যান্সার। বহুদিন ধরেই বলছিল। তুমি আসবে। শেষ সময়েও তোমাকে দেখতে চেয়েছিল। মেয়েটাকে রাখতে পারলাম না। আমরা দুজন এখন কী নিয়ে থাকি বলো তো। আমি জানিনা এক্ষেত্রে কী বলতে হয়। আমি অনেক কষ্টে তার মা কে বললাম, আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি যাই। তিনি বললেন, দাঁড়াও। তোমাকে একটা চিঠি দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেছে সে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে ভেতর ঘর থেকে একটা বন্ধ খাম এনে আমাকে দিলেন। সেটা পকেটে চালান করে দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বললাম, আবার আসব। কিন্তু আমি এখানে আর কোনো দিনও আসব না, এটা আমি জানি।
অনেকদিন হয়ে গেছে। সাহস করে অজন্তার চিঠিটা খুলতেও পারিনি। পড়া তো দূর কি বাত। আমি তাকে প্রতারণা করি নি ঠিকই। কিন্তু, শেষদিন পর্যন্ত সে জানতো আমি অবিবাহিত। কেউ তাকে সেটা বলে থাকবে। আমি বলিনি যদিও। আমি যে বিবাহিত – সেটা হয়তো তাকে জানানো উচিত ছিল। আমি কোনো দিনও তার চিঠিটা পড়তে পারব না। যদিও সেটা খুব সাবধানে রেখে দেওয়ার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। অজন্তা মারা গিয়েও রহস্যময় হয়ে গেল। আর আমি বেঁচে থেকেও অপরাধী।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জানুয়ারি ২৪, সূচিপত্র]