থানার ডিউটি অফিসার কাজের ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ্য রাখছিল মানুষটাকে। পরিতোষের ব্যাক্তিত্ব যে একবারে সাধারণের মতো নয় সেটা পুলিশবাবুটি দেখেই বুঝে গেছেন। বেল টিপে অফিসার একজনকে ডাকলেন। পরিতোষকে দেখিয়ে বললেন, ওনার কী সমস্যা জেনে আমাকে বল। ছেলেটি সাধারণ বেশে কোনো সিভিক ভলেন্টিয়ার হবে। অফিসার যে ভাবে কথাটা বলল তাতে সে পরিতোষকে সম্ভ্রমের সঙ্গে জিগ্যেস করল, “আপনার কী সমস্যা”?
পরিতোষ ছেলেটির প্রশ্নে চুপ করে থাকে।
-“আপনাকে বলছি। স্যার জানতে চাইছেন আপনি কী কারণে এসেছেন”?
পরিতোষ এবার কথা বলে, “ফাঁকা হোক আমি ওনার সঙ্গে কথা বলব”।
-“ঠিক আছে বলবেন। কিন্তু…”। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল ছেলেটি। অফিসার বললেন, “ঠিক আছে চলে আয়। চাপাচাপি করার দরকার নেই। তাড়া যখন নেই উনি বসুন”। শেষ কথাটা বলল পরিতোষের দিকে তাকিয়ে।
অফিসার এবার ছেলেটিকে বলল, “চা আনা। ওনাকেও দিবি”।
উনি বুঝে গেছেন এই বয়স্ক মানুষটা বেশ কিছুটা সময় নেবে।

সামনে বসা লোকেদের কাজ মেটাতে অফিসারের প্রায় দশ পনেরো মিনিট সময় কেটে গেল। পরিতোষের খারাপ লাগছে না। থানায় সম্ভবত সে আগে কখনও আসেনি। নতুন বিষয়। দেওয়ালে ঝোলান এক গোছা হ্যান্ডকাফের দিকে ওনার বারবার চোখ চলে যাচ্ছে। পরিতোষ গরম চা তাড়াতাড়ি খেতে পারে না। আসলে সে বেশ ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। অফিসার ডাকলেন, “আসুন আপনি”। পরিতোষের চা শেষ হয়নি। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা কী করবে। অফিসার বললেন, “চা খেয়ে নিন। তাড়া নেই”। পরিতোষ কিন্তু পুরো চা টা না খেয়ে বসে পড়ে অফিসারের সামনের চেয়ারে।
চা শেষ করে প্লাস্টিকের কাপটা ফেলে দিয়ে ডিউটি অফিসার গভীর ভাবে দিকে তাকালেন সামনে বসা মানুষটার দিকে। নরমসরম পরিতোষ চোখ নামায় টেবিলে। কাচের নীচে তারা মায়ের ছবি। অফিসারের আঙুলে সোনায় বাঁধানো বেশ ক’খানা রঙিন পাথর।

“বলুন”। শুরু করে অফিসার।

কোথা থেকে কথা শুরু করবে সেটা পরিতোষ খুঁজছিল। অফিসার অপেক্ষা না করে প্রশ্ন করল।

“আপনার নাম”?

মুখ ও চোখের ভাঁজগুলো জড়ো করে দুষ্প্রাপ্য একটা হাসি হেসে পরিতোষ বলল, “আমাকে আপনি ডোডো পাখি বলতে পারেন”। অফিসার চমকালেও সেটা সে প্রকাশ করল না।
শুধু বলল, “কেন”?
“ওই সেই একই গল্প”। পরিতোষের উচ্চারণে হতাশার নিঃশ্বাস মিশে যাচ্ছিল।
ইনি একেবারেই সাধারনের মত নন। নিজের এই ভাবনা মিলে যাচ্ছে দেখে অফিসার ভেতরে ভেতরে নিজেকে তারিফ করে।
এবার অফিসারের গল্প শোনার প্রস্তুতি। আঙুলের ফাঁকে থাকা কলমটাকে টেবিলে রাখে অফিসার। তারপর প্রশ্ন, “কী সেই গল্প”?
পরিতোষ সারাসরি ঢুকে পড়ল নিজের কথায়। “আমরা ছয় ভাইবোন। আমি সবার বড়ো। বাবা হুকুমচাঁদ জুটমিলে কেরাণির কাজ করতেন। খুব টানাটানির সংসার। ডালভাতের পরে আর একটা পদ প্রায়ই জুটতো না। তারপর যা হয় আর কি”!
অফিসার পরিতোষের দিকে একটু ঝুঁকে বললেন, “আপনার বাবা হঠাৎ মারা গেলেন । তাই তো”?
এই সঠিক আন্দাজে পরিতোষ একটু হলেও থমকাল। তবে ওনার মুখের ভাঁজেই থাকল উত্তর লেখা।
অফিসার আর এক ধাপ এগোয়। “তখন আপনি কলেজে পড়েন। ধরলেন সংসারের হাল। সম্বল কয়েকটা টিউশানি। আপনি সম্ভবত ম্যাথ আর ফিজিক্স পড়াতেন”। পরিতোষ ভাবছিল কী বলবে। সব মিলে যাচ্ছে।
পরিতোষের আবাক হওয়া দেখে অফিসার বললেন, “আমরা মানুষ দেখে দেখে এত অভ্যস্ত তাই আন্দাজগুলো বেশ মিলে যায়”।
“ঠিক, আমি ওই দুটোই পড়াতাম”। বেশি গভীরে যাওয়ার ইচ্ছা পরিতোষের ছিল না। তবে অফিসারের আগ্রহে সে প্রশ্রয় পাচ্ছে। “জানেন, ভাই বোন গুলোর মাথা খুব পরিষ্কার ছিল। সবকটা মাস্টার ডিগ্রি। মেজটা পি এইচ ডি করল। চাকরিও পেয়ে যায় সবকটা একে একে”।

অফিসার পরিতোষের কথা ধরে নিয়ে বললেন, “আপনি গ্র্যাজুয়েটে থেমে গেলেন। কিন্তু টিউশন চালিয়ে গেলেন। তারপর ভাই বোনেদের বিয়ে থা দিলেন। আপনার আর বিয়ে করা হয়না”।
পরিতোষ ঘাড় নেড়ে বলল, “ঠিক। একদম ঠিক বলেছেন। আসলে এসব গল্প তো সবার জানা। এক সময়ে পাড়ায় পাড়ায় এমন দেখা যেত।
গল্প মিলছে দেখে অফিসার মনেমনে বেশ মজা পাচ্ছিল। তিনি আর এক পা এগিয়ে বললেন, “আপনার সব ভাইয়েরা বাড়ি করে অথবা ফ্ল্যাট কিনে আপনাকে ছেড়ে একসময়ে চলে গেল। পুরোনো বাড়িতে আপনি মাকে নিয়ে রয়ে গেলেন”।
পরিতোষ নিজের ব্যাক্তিত্ব ঠিক মত ধরে রাখতে পারছে না। পুলিশেরা লোক চড়ায় জানে। পুলিশেরা চৌখস হয় জানে । সব ঠিক আছে। কিন্তু এত নিখুঁত মেলানোটা পরিতোষের ঠিক বোধগম্যের মধ্যে আসছে না। এবার অফিসারকে বলার আর সুযোগ না দিয়ে পরিতোষ বলল, “জানেন একসময়ে ওরা সবাই মিলে আমাদের পৈতৃক বাড়িটার ভাগ চাইল। আমি বারণ করে ছিলাম। বলেছিলাম , “এখন বাড়ি ভাগ করিসনা। মা বেঁচে রয়েছে”। তবুও ওরা বলল, “না বাড়িটা বিক্রি করে দাও। বাবার সম্পত্তির ভাগ আমরা সবাই নেব। তারপর যা হয়। বাড়িটা বিক্রি দিলাম এক প্রোমোটারকে। যা পেলাম আমরা সবাই সমান ভাগ করে নিলাম। সেই থেকে মাকে নিয়ে থাকতাম ভাড়া বাড়িতে।
মুখোমুখি দুজনের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি হয়েছে। অফিসার হাত দেখিয়ে পরিতোষকে আর কিছু বলতে বারণ করলেন। “তারপর সম্ভবত আপনার মায়ের কোনো ভারি অসুখ হয়”। পরিতোষ এক আবেগের সরণিতে ভাসছে। আর সে অবাক হচ্ছে না অফিসারের কথা শুনে।
“মায়ের লিভার ক্যান্সার হয়েছিল। প্রথম প্রথম সবকটা ভাই বোন আসত আমার কাছে। মাকে দেখে যেত। দু পাঁচ হাজার করে দিত মায়ের চিকিৎসার জন্যে।
এবার চেয়ারে হেলান দিতে দিতে অফিসার যা বললেন সেটা পরিতোষেরই গল্প। “আসলে সবার ছেলে মেয়ে হয় কনভেন্টে পড়ে অথবা কেউ ডাক্তারি কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং করছে। কেউ বা ম্যানেজমেন্ট পড়ছে। কত খরচ বলুনতো? তারপর বাড়ি গাড়ির ইএমআই আছে। বছরে অন্তত একটা বড় ট্যুর। কী করে আপনাকে হেল্প করবে? সম্ভব”?
পরিতোষের গলা খাতে নেমে এসেছে। বলল, “না একেবারেই সম্ভব নয়”। একটু থেমে সে অফিসারকে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা আপনি কী লেখালেখি করেন। আমি অবাক হচ্ছি আপনার কল্পনা শক্তি দেখে”।
-অফিসার খানিকটা লজ্জা পেল। তার মোবাইলে কল আসছে। সেটা কেটে দিয়ে বলল, “পুলিশের চাকরি করে ওসব আবার হয় নাকি? যাইহোক তারপর আপনার মা মারা গেলেন। মায়ের চিকিৎসায় আপনার জমানো টাকা পয়সা সব শেষ। তার ওপর ধার হয়ে গেছিল। এতটা গতে বাঁধা লাগছিল। তারপর? বাকিটা অজানা লাগছে। এরপর আপনি বলবেন”।
পরিতোষ কিছু বলছেনা। অফিসারও চুপ। দুজনেই ভাবছিল সামনের জন কিছু বলবে।
নিস্তব্ধতাটা ভাঙলেন অফিসার। “আপনি থানায় কেন এলেন? সেটা এবার বলুন”।
পরিতোষের চোখ আবার টেবিলে। তারামায়ের ছবিটা এখন ঝাপসা। বলল, “একটা হাউসিং এ সিকিউরিটির চাকরি নিলাম। আর কিছু করার ছিল না”।
অফিসারের কপালে কয়েকটা ভাঁজ। “আপনার টিউশানের কি হল?
পরিতোষ বেশ বাজারি ভাযায় উত্তর দিল,”টিউশনের বাজার সবসময়ে এক থাকে না। পালটায়। এসব টানা পোড়েনের সময়ে কী জানি কেন নতুন ছাত্রছাত্রী আসা কমে যেতে থাকল। তারপর এক সময় আর কেউই আসতো না। সেইথেকে এই ভাবেই চলছিল”।
পুলিশ অফিসার বাকরুদ্ধ। একভাবে তাকিয়ে থাকে সামনে।
পরিতোষের গলায় তাচ্ছিল্য। “আপনাদের মতো আমিও নিরাপত্তা কর্মী হয়ে গেছিলাম। আবাসনে কেউ আসলে রেজিস্টারে তার নিজের নাম এবং কার ফ্ল্যাটে যাবে সব লিখতে হত।
অফিসার বলল, “তারমানে আপনি নিরাপত্তা কর্মী ছিলেন। এখন আর নন”।
“ঠিক তাই। আমি এখন সিন্ধ্রিতে থাকি। এই হাউসিং এ আমার এক পুরোন ছাত্রর ফ্ল্যাট কেনা ছিল। ওরা এখানে থাকত না। জগদ্ধাত্রী পুজোয় সে এখানে এসে আমায় চিনতে পারল। একরকম জোর করে আমায় সে নিয়ে গেল সিন্ধ্রিতে। ওখানে সে ভালো চাকরি করে। এখন আমি ওদের পরিবারের একজন বলতে পারেন। এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা কাউকে আমি জানাইনি। ছাত্রটিকেও বলেছিলাম আমার যাওয়ার কথা কাউকে ঘুণাক্ষরে না জানাতে। মানে একরকম অন্তর্ধান। নিরুদ্দেশ!
এবার আপনার থানায় আসার কারণটা আন্দাজ করছি।
পরিতোষের গলা ভারি হয়ে এলো। “ওই আর কী। কিউরিসিটি”।
অফিসার কিছু বললনা।
পরিতোষের অনুনয়। ” শুধু জানার ছিল আমার অন্তর্ধানের পরে কেউ মিসিং ডাইরি করেছিল কিনা। এটাই আমার এখানে আসার কারণ। আর কিছু না”।
অফিসার কথা বলছে না। মনে হচ্ছিল তার শব্দ হারিয়ে গেছে।
পরিতোষ বলল,”না না আপনাকে কোন বিড়ম্বনায় ফেলব না। কাজটা আমি একটু সহজ করে দিতে পারি! মিসিং ডায়েরির ফাইল বা রেজিস্টারটা বার করে দিলে আমি একবার চোখ বুলিয়ে নিতাম। নিজে হাতে করে সবকটাকে ছোট বয়স থেকে পড়িয়েছিতো, ওদের হাতের লেখা এক ঝলক দেখলেই চিনতে পারব। বেশি খুঁজতে হবেনা”।
অফিসার পরিতোষের দুটো হাত চেপে ধরল। বুঝল মানুষটা ভেতর থেকে তিরতির করে কাঁপছে। আবেগতারিত পুলিশ অফিসারটি বলল, “স্যার আমি আপনার ছাত্র ছিলাম। মনে করতে পারছেন”?

[পরম্পরা ওয়েবজিন, ফেব্রুয়ারি ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
8 months ago

আবেগ তাড়িত পুলিশ অফিসার এর সঙ্গে একাত্ম হলাম! ভালো লাগলো।
অভিনন্দন।