সাজাহান
অরুনাংশু সময় মেনে চলে। সৃজিতার বুঝি সেসবের বালাই নেই। গরম কড়াইয়ে সৃজিতার চনমনে খুন্তি যখন রান্নার রসে মসগুল, অরুনাংশু তখন রাস্তায়, ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। সাজাহান শুরুর সময় সন্ধ্যে ছ’টা।
অফিস থেকে ইলশেগুড়ি মাথায় নিয়ে সোজা প্রেক্ষাগৃহের সামনে তড়িঘড়ি পৌঁছে অরুনাংশু দেখে সৃজিতা নেই। আর দেরি করলে তো অন্ধকার হলে সরীসৃপের মত ঢোকা ছাড়া গতি থাকবে না!
তবে কী সৃজিতা আসবে না!
বাঙ্গালীর সময় জ্ঞানের পর্যালোচনা করতে করতে অসহায় অরুনাংশু সৃজিতাকে এদিক ওদিক খুঁজবে কিনা ভাবতে থাকে। এমন সময় ঐ দূরে সৃজিতাকে দেখা গেল।
প্রেক্ষাগৃহের এই জগত, অরুনাংশুর প্রানের প্রিয়। রক্তমাংসের মানুষ গুলো মঞ্চে হাসে কাঁদে, তাদের গলার আওয়াজে ঝড় ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, মঞ্চে বাজনদারের মাদল বেজে ওঠে, চড়া আলোর নিচে আসর বসে। জীবন জেগে ওঠে। এ জগত অরুনাংশুর বড় প্রিয়, বড় ভালবাসার জগত।
কিন্তু কই, সাজাহান তো শুরু হল না! সময় যে গড়িয়ে গেল বহুদুর!
আর কত সবুর করব? অরুনাংশুর অস্বস্তি হয়।
দাঁড়াও, দাঁড়াও। সবুরে মেওয়া ফলে। এখন মালপো খাও। সৃজিতা হেসে বলে।
আগে সাজাহান। আমার কত দিনের সাধ জানো, সাজাহান দেখবো!
আরে বাবা, মধ্যযুগে পিছনো কী চাট্টিখানি কথা! সবুর করো, ঠিক দেখবে।
এহেন কথাবার্তা যখন চলছিল, মঞ্চে গুটি গুটি আবির্ভাব হল এক সুন্দরীর। হল ভর্তি দর্শকের গলা ধীরে মিইয়ে যাচ্ছে।
মুমতাজমহল, সৃজিতা ফিসফিস করল, এত রূপ!
অবনতমুখ সুন্দরী আসছে, যেন দীর্ঘ বৈশাখ পেরিয়ে। দর্শক নড়েচড়ে বসছে। অরুনাংশুর মনে হল, একবুক জলভরা মেঘ আগ্রা দুর্গের নহবতখানার রোশনচৌকিতে নেমে এল।
সুন্দরী শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথের গান।
মুঘল সুন্দরীর গলায় রবীন্দ্রগান! অরুনাংশু সচকিত। আধুনিক নাট্যপরিকল্পনা, মোঘলের অন্দরে রবীন্দ্রের উদ্ভাস। অরুনাংশু মোহিত। এ সুরের যেন শেষ নেই , শেষ থাকতে নেই।
অরুনাংশুর ঘোর কাটল দ্বিতীয় গানে।
তারপর তৃতীয় গান যখন শুরু হল অরুনাংশু উসখুশ করে উঠল। ওর চেয়ারে কিচকিচ আওয়াজ হচ্ছে; গানের আবহে বেসুরো চামচিকে উড়ছে। সৃজিতা ফিসফিস করে, অফিস থেকে দৌড়ে এসেছ, ঠান্ডা হও।
উঃ, নাটকটা হবে কখন!
সৃজিতা আবার ফিসফিসায়, এটা মনে হচ্ছে আজকের সন্ধ্যার স্টার্টার ডিশ, রবীন্দ্রনাথের গান, বাঙালির নেমন্তন্ন, প্রথম পাতে ঘি।
কিন্তু কার্ডে তো লেখা ছিল না এসব! অরুনাংশু পকেটে নাটকের কার্ড হাতড়ায়।
এটা ফাউ পেলে, এই মঞ্চে সাজাহান দেখতে এলে রবীন্দ্রনাথ ফ্রী।
আঃ আস্তে, পিছন থেকে কে যেন গলা বাড়িয়ে বলে উঠল।
অগত্যা সাজাহান নাট্য প্রকল্পে ফ্রী- গিফটের মার্কেট স্ট্র্যাটেজির আলোচনায় ইতি পড়ে। ওরা চুপ করে যায়। প্রেক্ষাগৃহ ক্রমে রবীন্দ্র- জলসায় জমাট হয়।
কিন্তু এই নশ্বর পৃথিবীতে সবকিছুই কালের করাল গ্রাসে পড়ে। সহ্যশক্তিও তাই। অরুনাংশু আর চেয়ারে বসতে পারছে না। মাথার ভিতরে দলা পাকাচ্ছে। ঢোক গিলতে লাগছে । অরুনাংশু ছটফট করতে শুরু করে। সাজাহান চাই, সাজাহান। ডি এল রায়ের সাজাহান।
বহুযুগ আগে আগ্রা দুর্গের খাঁচাতেও ছটফট করেছিলেন এক হতভাগ্য। তিনি ছেলেকে ভালবেসেছিলেন। ক্ষমতালোভী সেই ছেলে বাবাকে শেকল পরিয়েছিল। আর ভালবাসা শেকল বড় ভালবাসে।
নাটকের মাথায় জলসার এই আব অরুনাংশু সহ্য করতেই চেষ্টা করে, কারণ অরুনাংশু নাটক ভালবাসে।
সৃজিতা টিফিনবক্স এগিয়ে দেয়, নাও খাও।
এরা তো সময় খাচ্ছে।
চল তবে বেরিয়ে যাই।
অরুনাংশু আসন ছেড়ে উঠব উঠব করেও উঠতে পারে না। সাজাহান কী পেরেছিলেন তাঁর ভালবাসার রেশমগুটি থেকে বেরিয়ে যেতে?
এমনতরো দ্বন্দ্বে যারা দীর্ণ হন তাঁদের সমাপতন আসে দ্রুত। অরুনাংশু হঠাৎ করে চেঁচিয়ে ওঠে, মানসিক রোগীর মত। ওর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।
চিৎকারে জলসা থেমে যায়। চারদিক থেকে চোখেরা ঘুরে ঘুরে খুঁজতে থাকে, কে ভাঙল পবিত্র মুর্তি!
কে ছুঁড়েছে কাদা, রবীন্দ্রনাথের গায়ে? সৃজিতা গায়িকার পিছনের কালো পর্দার আড়ালটা সরে গেল। বেড়িয়ে এলেন এক মঞ্চ অভিনেতা। এ তো আওরংজেব! একমুখ দাড়িতে মেকআপ তখনো চলছে।
কে ছুড়েছে কাদা?
প্রেক্ষাগৃহের চোখ অরুনাংশুকে খুঁজে নিল।
গানটা আপনিই গান। উঠে আসুন।
দর্শকাসন শুনতে পাচ্ছে আওরংজেব অরুনাংশুকে মঞ্চে আহ্বান করছে।
চারিদিকে টানটান নৈঃশব্দ। অরুনাংশুর মনে হল ওর পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিতে প্রেক্ষাগৃহ নীরব সম্মতি দিচ্ছে। ও এদিক ওদিক দেখে। আশেপাশের লোকগুলো আসলে পাশে নেই। তারা বুঝি সমাপতনের নীরব অপেক্ষায় প্রেক্ষাগৃহের ছাদে ঝুলে আছে।
আওরংজেব নিরুদ্বিগ্ন গলায় মাইক্রোফোনে বলে উঠল, আপনাদের চোখের সামনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মঞ্চচ্যুত হলেন। সুস্থ শিল্প কক্ষ্যচ্যুত হল… আপনারা কী এটাই চেয়েছিলেন?
অরুনাংশু ভাবতে বসল, ও কী এটাই চেয়েছিল?
ওপাশ থেকে এক টি শার্ট উঠে বলল, আমরা শিল্পীর অপমানে মর্মাহত। গায়িকার কাছে সুস্থ সংস্কৃতির পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইছি।
অরুনাংশুর মনে হল, একটা কালো ওকে টানছে। ও শুনতে পেল, মাইক্রোফোন বলছে, লুম্পেন সংস্কৃতির কাদা লাগল রবীন্দ্রনাথের গায়ে, আসুন ধুয়ে নিই।
কিন্তু কী ভাবে? কে যেন বলে উঠল।
মঞ্চে দুটো কালো চোখ চকচক করে উঠল।
সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ চুপ, সমাপতনের অপেক্ষায়। সৃজিতার শ্বাস জোরে পড়ছে। অরুনাংশুকে কী ওরা অপমান করবে? বেরিয়ে যেতে বলবে? অরুনাংশুর দিকে সৃজিতা চোখ তুলে তাকাতে পারল না।
সামনের আসন থেকে একটা গলা শোনা গেল, শিল্পীকে আবার গাইতে ডাকা হোক।
দর্শকাসন করতালি দিয়ে উঠল; প্রস্তাবকে সমর্থন করল জনতা। সৃজিতা শুনতে পেল, অরুনাংশু আটকে রাখা শ্বাস ধীরে ধীরে বের করে দিচ্ছে।
সৃজিতা ওর হাত ধরে টান দিল, চল, বেরিয়ে যাই। এখানে আর নয়। কিন্তু অরুনাংশু উঠতে পারল না।
অতঃপর শুরু হল জলসার দ্বিতীয় অধ্যায়।
দলা পাকিয়ে অরুনাংশু নিস্পন্দ বসে রইল সাজাহান দেখবে বলে।