কাকলি দেবনাথ

কামধেনু মেঘ

এক

“ভালো আছেন মাষ্টার মশাই?”
পঁয়ষট্টি বছরের লম্বা,ঋজু , গৌর বর্ণ, সৌম্য দর্শন অবিনাশ, হাঁটার গতি শ্লথ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। তারপর মৃদু হেসে শান্ত স্বরে বললেন, “ভাল আছি। তুমি কেমন আছো দীপক?“
দীপক চওড়া হাসি মুখে ঝুলিয়ে জবাব দিল, “এই চলে যাচ্ছে।“
দীপক মৃদু হাসতে জানে না। যখনই হাসে এমন প্রাণ খুলে হাসে।
অবিনাশ আবার হাঁটতে শুরু করেছেন। এখন সোজা গিয়ে বসবেন পার্কে। পার্কে আরও বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতরা আসে। বৃদ্ধ বয়সের এই সঙ্গটা বড্ড উপভোগ করেন। রাজনীতি থেকে খেলা। শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্নীতি থেকে চন্দ্রযান-৩ এর সাফল্য সবই থাকে তাঁদের আলোচনায়।
“হাঁটতে বেরিয়েছেন মাষ্টারমশাই?”
এবার আর অবিনাশ হাঁটার গতি শ্লথ করলেন না। ঠোঁটের কোণে মৃদু হেসে হাত তুললেন।
প্রতিদিন বিকেলে ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে হাঁটতে বের হন অবিনাশ। রাস্তায় চেনা-অচেনা সকলের এই কুশল বিনিময় উপভোগ করেন। চেনা কেউ তার পাশ দিয়ে কথা না বলে চলে গেলে ,মনে মনে ক্ষুণ্ণ হন।
যুবক বয়সে মাষ্টারির চাকরি নিয়ে এই মফঃস্বলে এসেছিলেন। সে অনেককাল আগের কথা। সে সময় অন্ধকার রাতে, আকাশের তারারা মিটিমিটি আলো জ্বালিয়ে জোনাকির বেশে হাতের নাগালে চলে আসত। গভীর রাতে গাছের কোটর থেকে পেঁচার ডাক… মগডাল থেকে হাড় হিম করা শকুনের ডাক… সন্ধ্যা হতেই হুক্কাহুয়া রবে শেয়ালের ডাক… ভোর না হতেই কুক্কুটধ্বণি শোনা যেত। বড় রাস্তায় টিম টিম করে কাঁচা হলুদ রংয়ের আলো জ্বলত। শীতের কুয়াশাভরা রাতে আধো-অন্ধকারে পুরো অঞ্চলটাই তখন শ্মশানভূমি। রাত আটটার মধ্যেই গৃহস্থ মানুষের পালে ঘরে ফেরার গান। রাস্তা ঘাট তখন মদমাতাল আর নিশাচরদের উন্মুক্ত ভূমি।

এখন হাওয়া উল্টোমুখী। এল ই ডি আলোর চমক ঢমকে ভয়ংকর শ্মশানভূমিও ‘শান্তির উদ্যান’। অবিনাশের চোখের সামনেই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর এখন চিকনা চামেলি শহর। ঝকঝকে রাস্তা, চকচকে দোকান পাট, রঙচঙে মানুষ। ড্রাগের নেশার থেকেও ভয়ংকর নেশায় বুদ হয়ে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ে চলেছেন অবিনাশ।

দুই
পার্কের কাছাকাছি আসতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল, তাড়াতাড়ি গিয়ে পাশে চায়ের দোকানটায় দাঁড়ালেন। অবিনাশকে দেখে দোকানে বসা দু একজন উঠে দাঁড়াল। দোকানির সহাস্য আহ্বান – “আসুন মাষ্টার মশাই।“ বলেই কাজের ছেলেটাকে নির্দেশ, “এই ছটু বেঞ্চটা মুছে দে। দাঁড়ান মাষ্টরমশাই আগে বেঞ্চটা মুছে দিই। আপনার সাদা ধুতিতে দাগ লেগে গেলে।” বলে দোকানি নিজেই বেঞ্চ মুছতে শুরু করল । অবিনাশের কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। সাধারণত রাস্তার চায়ের দোকানে তিনি বসেন না। এইসব জায়গায় যারা বসে আড্ডা দেয় তাদের সঙ্গে অবিনাশের পদমর্যাদার পার্থক্য একটা লক্ষ্মণরেখা টেনে দেয়। অবিনাশ এই দোকানে এসে দাঁড়ানোয় দোকানে উপস্থিত খরিদ্দাররা একটু যেন আড়ষ্ট। অবিনাশও কুণ্ঠিত। দোকানের ছাউনি থেকে মুখ বার করে আকাশের দিকে তাকালেন। বর্ষার মেঘ। যেখানে মেঘ সেখানেই একপশলা বৃষ্টি। অনেকটা কামধেনুর মত। বাছুরের হাঁক-ডাকের দরকার হয় না। সময় হলেই ঝরঝর করে ঝরে যায়। বৃষ্টিটা এখন একটু কমেছে। ঝিরঝির করে পড়ছে। কাঁধে ঝোলানো শান্তিনিকেতনি ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে রাস্তায় নামলেন। একবার পার্কের দিকে তাকালেন, মনে মনে ভাবলেন, আজ আর কেউ আসবে না। বাড়ি ফিরে যাওয়াই ভাল। হালকা বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনের ভেতর এক অদ্ভুত ভালোলাগা। বুড়ো বয়সে নিজের যুবক বয়সের পুরস্কারগুলো দেখলে যেমন অনুভূতি হয়, এ যেন ঠিক তেমন অনুভূতি। গ্রামের ছেলে অবিনাশ। সেইসময় বর্ষাকাল মানেই মাঠ ঘাট পুকুর সব জল থইথই। এমন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা। কাদায় চটি পরে হাঁটা যেত না। ফটাস করে ফিতে ছিঁড়ে যেত। তখন পায়ের চটি মাথায় উঠত। অনেক সময় ছাতার শিকের ভেতর চটি ঢুকিয়ে বন্ধ ছাতা সিনেমায় সলমন খানের সানগ্লাস ঝোলানোর কায়দায় জামার পিছনে ঝুলিয়ে, খালি পায়ে হাঁটা। সেই সময়ের ছাতাও ছিল অন্য রকম। মোটা শিক দেওয়া কালো কাপড়ের ‘দাদুর ছাতা’। এই ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে অবিনাশের খুব ইচ্ছে করছে খালি পায়ে একটু ভিজতে। ছোটবেলার মত ছুটে ছুটে লাল কাঁকড়া ধরতে। গ্রামের নালা দিয়ে বয়ে চলা টলটলে জলের ভেতর থেকে খপ করে ল্যাঠা মাছ ,চ্যাং মাছ ধরতে…
“মাষ্টারমশাই? ফিরে চললেন?”
দীপকের ডাকে অবিনাশের কিশোরমন বার্ধক্যের ধুসর জমিতে অবতরণ করল।
“বৃষ্টিতে কেউ আসেনি আজ।তাই…“ অবিনাশের স্বরে হতাশার সুর ।
হাত কচলাতে কচলাতে দীপক বলল, “আপনার সঙ্গে একটু পরামর্শ করার ছিল।“
অবিনাশ মুহূর্তের জন্য কী যেন ভাবলেন। তারপর এক পা দু পা করে সিঁড়ি বেয়ে ব্যাংকের চাতালটায় উঠলেন।

এটা একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এ টি এম কাউন্টার। অবিনাশ এখানে মাঝে মাঝেই টাকা তুলতে আসেন। দীপক এই ব্যাঙ্কের দারোয়ান। সারাক্ষণ ইউনিফর্ম পরে সামনের টুলটায় বসে থাকে। কীভাবে যেন ও জানতে পেরেছে অবিনাশ এখানকার উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তারপর থেকে অবিনাশকে দেখলেই উঠে দাঁড়ায়। ছেলেটার মধ্যে এক অদ্ভুত নরম সরলতা আছে। কিন্তু সে যে খুব একটা নরম নয়, সেটা একদিন টের পেয়েছিলেন অবিনাশ।
সেদিন ব্যাঙ্কের পাশের এ টি এম থেকে টাকা তোলার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কয়েকটা অল্পবয়সি ছেলে এ টি এমের পাশে দাঁড়িয়ে গুলতানি মারছিল। রোজই ওরা এখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়। সেদিন ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল ,”এমন হতচ্ছাড়া দেশ পৃথিবীতে আর একটাও নেই। চারিদিকে শুধু অভাব, বেকারত্ব আর দুর্নীতি। শালা এমন দেশের মুখে আগুন। “
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দীপক ছেলেটার কলার ধরে বলে উঠল, ” ‘হতচ্ছাড়া’ কাকে বলছিস তুই? এই দেশের খেয়ে-পরে বড় হয়েছিস। আর এই দেশকেই হতচ্ছাড়া বলছিস? তুই নিজে কী করেছিস দেশের জন্য? কতটুকু স্বার্থ ত্যাগ করেছিস?”
ঘটনার আকস্মিকতায় ছেলেগুলো হতচকিত হয়ে যায়।
ছেলেটাও প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় দীপকের চুলের মুঠি ধরে মারতে উদ্যত হয়। ছেলেটার বন্ধুদের ততক্ষণে সম্বিত ফিরে এসেছে। ওরা চট করে ছেলেটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে , “অন ডিউটি সরকারি কর্মচারীর গায়ে হাত দিস না। ফেঁসে যাবি। আমরা পরে শালাকে দেখে নেব।“
যেতে যেতে চোখ রাঙিয়ে গালাগালি দিয়ে বলে যায়, “খুব তেল হয়েছে না? দেশ মারাচ্ছ?” কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে বলে, এই দেশের জন্য একটা চোখ তো গেছে , এবার তোর আর একটা চোখ দিয়ে আমরা পিং পং খেলব, দেখে নিস।“
পুরো ঘটনাটাই অবিনাশের চোখের সামনে ঘটেছিল। শান্ত ছেলেটার অশান্ত রূপ দেখে সেদিন বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন। সেদিনই প্রথম জেনেছিলেন দীপকের একটা চোখ পাথরের। চোখের জল মুছতে মুছতে দীপক অবিনাশকে বলেছিল, “দেখেছেন মাষ্টরমশাই , এই দেশের খাচ্ছে , এই দেশের পরছে আবার দেশমাতাকেই গালাগাল দিচ্ছে?”
সেদিন দীপকের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছিলেন অবিনাশ। গ্রামের গরীব বাড়ির ছেলে সে। তিন ভাই এক বোন। ছোট বেলায় পড়াশোনা করতে ভাল লাগত না। দুবার পরীক্ষা দেওয়ার পর মাধ্যমিক পাশ করেছে। তবে স্বাস্থ্য বরাবরই ভাল। খুব জোরে ছুটতে পারত। ভাল ফুটবল খেলত। সেই কারণেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়ে যায়।
দীপক দুঃখ করে বলেছিল, কাশ্মীরে পোস্টিং ছিল সে তখন। সেখানে বোমা বিস্ফোরণে তার একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। তবুও সে ফিরে আসতে চায়নি। সেনাবাহিনীতেই কাজ করতে চেয়েছিল। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে চেয়েছিল। হতাশ গলায় দীপক বলেছিল , “পড়াশুনা তো বেশি শিখিনি, নিজের প্রাণ ছাড়া দেশকে দেওয়ার মত আমার আর কী আছে বলুন?“
অফিসাররা দীপককে খুব ভালবাসতেন। ওঁরা বুঝিয়েছিলেন, দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া মহৎ কাজ। কিন্তু দেশের সম্পদ রক্ষা করাও কম গর্বের নয়। ওঁরাই ওকে এই ব্যাংকে দারোয়ানের কাজটা দেন।
দীপকের কথায়, সেদিন অবিনাশের মনের ভেতর কেমন যেন এক অহংকার মেশানো আনন্দ হয়েছিল। দেশের সব চেয়ে বড় সম্পদ দেশের যুবক সম্প্রদায়। তাদের তৈরি করছেন তিনি। এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে?
দীপক আরও বলেছিল , “জানেন মাষ্টারমশাই, খুব শরীর খারাপ না হলে আমি ছুটি নিই না।“
“দেশের বাড়িতে তোমার ফ্যামিলির কাছে যাও না?”
“যতদিন মা বেঁচে ছিল যেতাম, খুব ইচ্ছে ছিল জানেন, ভাইবোনগুলো পড়াশুনা করে মানুষ হোক। পড়াশুনা তো দূর অস্ত ওরা কিছুই করতে চায় না। সারাদিন শুধু মোবাইল দেখবে আর ভাল ভাল পোশাক পরবে, রেস্টুরেন্টে খাবে…“
“কিছু করে না তো টাকা পায় কোথায়?”
দীপক একমুখ বিরক্তি নিয়ে বলেছিল , “পার্টির দাদাদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। সেই নেতারাই তো কচিকচি ছেলেগুলোর হাতে টাকা তুলে দিচ্ছে উচ্ছন্নে যাওয়ার জন্য।”
অবিনাশকে চেয়ারে বসতে দিয়ে দীপক টুলের উপর বসল। আজকের বৃষ্টি অবিনাশকে বেশ ফুরফুরে করে দিয়েছে। রাস্তার পাশে চপের দোকান থেকে তেলেভাজার গন্ধ আসছে। আহা! কতদিন এমন চপ, বেগুনি দিয়ে মুড়িমাখা খাওয়া হয় না। ডাক্তারের পরামর্শে বাইরের সবরকম ভাজাভুজি এখন বন্ধ। কী মনে করে , পকেট থেকে একটা নোট বের করে দীপকের হাতে দিয়ে বললেন, “যাও তো দীপক, দোকান থেকে চপ, বেগুনি আর চা নিয়ে এস। কতদিন খাইনি। বাড়িতে তোমার কাকিমা খেতে দেয় না। আজ খুব খেতে ইচ্ছে করছে।“
দীপক টাকাটা হাতে নিয়ে অবিনাশের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
আরে, “অমন হাঁ করে দেখছ কী? যাও নিয়ে এস।“

আজ বেশ গল্পের মুডে আছে অবিনাশ। চা খেতে খেতে নিজের ছোটবেলার অনেক গল্প করলেন দীপকের সঙ্গে। “একবার বৃষ্টির দিনে পাশের পুকুর থেকে এক ঝাঁক কই মাছ কান ঘসে ঘসে পাড়ে উঠে এসেছিল। বাবা সেগুলো ধরে নিয়ে এলে, মা তেল কই রান্না করেছিল… বৃষ্টির মধ্যে তাল কুড়োতে গিয়ে একবার গোসাপের তাড়া খেয়েছিলেন… ছোটবেলায় এমন বৃষ্টির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে খালি পায়ে ফুটবল খেলতে দারুণ লাগত… এখন তো বাচ্চাদের তেমন খেলাধুলা করতে দেখাই যায় না। আমাদের সময় বাবা-মা পড়াশুনার জন্য অত চাপ দিত না। বাবা বছরে দু একবার স্কুলের হেড স্যারের সঙ্গে দেখা করে শুধু বলে আসত, “আপনার কাছে দিয়েছি মাষ্টারমশাই , ছেলেটাকে মানুষ করে দেবেন।”
গল্প করতে করতে হঠাৎ অবিনাশের খেয়াল হল, দীপক যেন তাকে কী একটা বলতে চেয়েছিল। মনে পড়তেই বলল, “তুমি কী কথা ছিল বলছিলে?”
দীপক একটু ইতস্তত হয়ে বলল, “আজ থাক। অন্য একদিন বলব।“
“আরে থাকবে কেন? আজই বলো। আজ আমার হাতে অনেক সময়। মনটাও বেশ অক্সিজেনে ভরপুর আছে।“
দীপক একটু আমতা আমতা করে বলল, “আপনাকে তো আগেই বলেছি , আমার ভাইগুলো একেবারে অপদার্থ হয়েছে। আমার কোনও কথাই শোনে না। বোনটাকে পাড়াতেই বিয়ে দিয়েছিলাম। জামাইয়ের মুদিখানার দোকান। দোকানটা করার সময় বেশ কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলাম। গতকাল বোনের শ্বশুরমশাই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।“
“কেন ? আরও টাকা চায় বুঝি ।“
দীপক মাথাটা নিচু করে বলল , ”ওরা টাকা চাইলে আমার এত খারাপ লাগত না। কিন্তু… বলে দীপক একটু থামল।“
অবিনাশ দীপকের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, দীপকের মনের ভেতর একটা দ্বিধা চলছে।
পরিচিত -স্বল্প পরিচিত সকলেই সুবিধা-অসুবিধায় অবিনাশের সঙ্গে পরামর্শ করে। এই অঞ্চলে যেকোনো জনসভায় বিশিষ্ট সমাজসেবী হিসেবে তাঁর নাম উল্লেখ হয়। অন্যের চোখে এই সম্মান অবিনাশ খুব উপভোগ করেন। মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ”কী হয়েছে দীপক? তোমার বোন ভালো আছে তো?”
দীপক মাথা নিচু করে বলল , “আমার টাকায় দোকান হয়েছে বলে বোন ওর শ্বশুর–শাশুড়ির উপর অকথ্য অত্যাচার করে। ওদের দিয়ে সব কাজ করায় অথচ তিনবেলা পেটপুরে খেতে অবধি দেয় না। ভাবতে পারেন! ওই বৃদ্ধ মানুষটার কান্না দেখে কাল থেকে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আর নয়, বোনকে এবার শাস্তি পেতেই হবে। মাষ্টারমশাই, আপনিই আমায় বলে দিন, কী শাস্তি আমি ওকে দেব?“
দীপককে উতলা হতে দেখে অবিনাশ বললেন, “শান্ত হও দীপক। আমাকে একটু ভাবতে সময় দাও। আজ আমি আসি।“
রাস্তায় নেমে অবিনাশ একবার পিছন ফিরে তাকালেন। দীপক তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। হাঁটতে হাঁটতে অবিনাশ ভাবছেন, প্রকৃত শিক্ষা না থাকলে এমনই হয়! হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে হাঁটার গতি বাড়ালেন। এতক্ষণে মধুছন্দা নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে এসেছে। ও প্রতিদিন বিকেলে একটি সংগঠনে যায়। সেখানে গীতা, উপনিষদ, ভাগবত পাঠ হয়। অবিনাশ মনে মনে হাসেন। ওই সংগঠনের নাম দিয়েছেন- ‘কাজ নেই তো খই ভাজের দল।‘
নিঃসন্তান অবিনাশ স্কুলে পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতেও টিউশনি পড়াতেন। তার দেওয়া সিলেবাস ছিল অব্যর্থ। এখন তো এই শহরে তাঁর তিনটি কোচিং সেন্টার। যত টাকাই ফিজ চান অভিভাবকরা দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। তাঁর কোচিং সেন্টারের ট্যাগলাইন হল- “রকেট গতিতে সাফল্যের চাবিকাঠি।“
ডাক্তার স্ট্রেস নিতে বারণ করায় এখন শুধু সিলেবাস তৈরি করেন অবিনাশ। পড়ানোর জন্য কয়েকজন শিক্ষক রেখেছেন।

তিন

বুকের ভেতরের জমাট বাঁধা কষ্টটাকে ঘিরে রয়েছে লজ্জা , আর ভয়। মনে মনে নিজেকে লুকোনোর মত একটুকরো অন্ধকার গলি খুঁজে চলেছেন অবিনাশ। খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য গভীর রাতে পা টিপে টিপে ছাদে উঠে এলেন। শ্রাবন মাসের রাত্রি। আকাশ জুড়ে পোয়াতি মায়ের মত ধুসর জলভরা মেঘ। সকালে বৃষ্টি দেখে ভিজতে ইচ্ছে করছিল। এখন একটা হিম শীতল স্রোত তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসছে। অনেকক্ষণ একভাবে বসে আছেন। আকাশের দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে কালো মেঘের আড়াল থেকে প্রতিটি গ্রহ নক্ষত্র তাঁর দিকে তাকিয়েই ব্যঙ্গ করছে। বলছে , “এবার কী করবে অবিনাশ ? কোথায় মুখ লুকোবে?“
দূরে কে যেন হেসে উঠল। আরে, ওই তো, ওই সাদা বাড়িটার ছাদে কেউ দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে। তাহলে কি সবাই এতক্ষণে জেনে গেছে? এখন তিনি কী করবেন? সকাল হওয়ার আগেই এই অঞ্চল ছেড়ে বেরিয়ে পড়বেন?
“এই , এত রাতে এখানে কী করছ তুমি?”
স্ত্রীর ডাকে চমকে তাকালেন অবিনাশ। সিঁড়ি বেয়ে এতটা ওঠার ধকলে মধুছন্দা তখন হাঁপাচ্ছে।
“সন্ধে থেকেই দেখছি কেমন গুম মেরে আছো। রাতে কিছু খেলেও না! কি হয়েছে?” পাশে বসতে বসতে মধুছন্দা জিজ্ঞেস করল।
স্ত্রীর প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন অবিনাশ বুঝতে পারছেন না।
সন্ধেবেলা হেঁটে আসার পর খুশি খুশি মনেই টিভি খুলে খবর শুনতে বসেছিলেন। তারপর থেকেই ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। র‍্যাগিং এর শিকার গ্রাম থেকে বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে আসা এক তরুণ। সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ… অসহায় বাবার আকুতি… দেখে একটু খারাপ লেগেছিল ঠিকই, মনে মনে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “কি যে হচ্ছে চারিদিকে! কিছুদিন আগেই মণিপুরের দুই মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানো নিয়ে দেশ তোলপাড় হল। এখন আবার এই খবর। দেশের যুব-সম্প্রদায়ের উচ্ছৃঙ্খলতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।“
চ্যানেল পাল্টানোর জন্য রিমোটটা হাতে নিয়েছেন, ঠিক তখনই দেখলেন ছেলেটাকে। এ তো দীপারুণ। তাঁর কোচিং সেন্টারে পড়ত। এই ছেলেটার কথাই তো গর্ব করে সবাইকে বলতেন। সেই ছেলে কি না একটা নিষ্পাপ সরল ছাত্রের মৃত্যুর জন্য দায়ী!
কয়েকদিন ধরে চন্দ্রযান-৩ র সাফল্য নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো তোলপাড় ছিল। ওই প্রজেক্টে যুক্ত বিজ্ঞানীদের স্কুল, কলেজের শিক্ষকদের হাসিমুখের ছবি পাতায় পাতায়। আশায় ছিলেন দীপারুণের শিক্ষক হিসেবে তাঁর নামটাও একদিন খবরের কাগজে দেখতে পাবেন। অথচ এখন সেই ছেলের জন্যই ভয়ে কুঁকড়ে আছেন অবিনাশ।
ওই যে দুটো বাড়ির পরে থাকেন সংস্কৃতের শিক্ষক নৃপেনবাবু। সারাক্ষণ গীতা, উপনিষদের বুলি আওড়ান। বলেন, “বৃদ্ধ বয়সে নয় কৈশোরেই ছাত্রদের এসব পড়া উচিত।”
তা নিয়ে কতদিন ওর মুখের উপরেই হাসিঠাট্টা করেছেন অবিনাশ। বলেছেন, “গীতা ,উপনিষদ ,সাহিত্য পড়ে ফালতু সময় নষ্ট করার মত সময় তাঁর ছাত্রদের নেই।”
একদিন প্রচণ্ড অপমানিত হয়ে নৃপেনবাবু বলেছিলেন, “আপনি যেভাবে ছাত্রদের নোটস দিয়ে পড়ান, এতে তো শুধু জ্ঞানদান হয়। মনের সুক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর বিকাশ হয় কি? ছাত্রদের চরিত্র গঠন করাও তো শিক্ষকের ধর্ম, তাই না?
অবিনাশ বাঁকা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “জ্ঞানী হলে চরিত্র গঠন এমনিই হয়ে যাবে। তার জন্য আলাদা করে সময় দেওয়ার দরকার হয় না।“ আজ সেকথা মনে পড়ে লজ্জায় নুয়ে পড়েছেন অবিনাশ।

চার

ছাদ থেকে নেমে, নিজের অফিসঘরে এসে বসলেন অবিনাশ। মনের ভেতর হাজার প্রশ্নের ঝড়। এই খবরটা জানাজানি হয়ে গেলে কি তার কোচিং সেন্টারে ছাত্র সংখ্যা কমে যাবে? অবশ্য তাতে তাঁর কিছু যায় আসবে না। এতদিন যা জমিয়েছেন তা দু জনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সম্মান! বাইরে বের হলেই তো রিকশাওয়ালা, চায়ের দোকানি, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত সকলে আঙুল তুলে বলবে, “মাষ্টারমশাই, আপনার গর্বের ছাত্রের কীর্তি শুনেছেন?“
একটা পাপবোধ অবিনাশকে কালনাগিনীর মত আষ্টেপৃষ্টে গিলে খেতে চাইছে। বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন বলে মনের ভেতর সবসময় একটা অহংবোধ ছিল। সেই অহংবোধই কি চাড়িয়ে গেছে তার ছাত্রদের মধ্যে! দীপকের মুখটাও মুহূর্তের জন্য অবিনাশের মনের কোণে ঝিলিক মারল। বুকের ভেতর ডিং ডং শব্দ –‘ প্রকৃত শিক্ষা কাকে বলে?’
অবিনাশের মনে পড়ছে , বিজয়া দশমী, শিক্ষক দিবস, আরও কত সময় ছাত্ররা এসে তাঁকে প্রণাম করে। সবাইকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন। বলেন- “সাফল্য তোমার চলার পথ সুগম করুক।“
আজ অবিনাশের কেন যেন মনে হচ্ছে, এটা বড্ড বস্তা পচা আশীর্বাদ। কোথায় যেন একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে… আজকের যুব সম্প্রদায় এমন কিছু একটা চাইছে, যা শিক্ষকরা দিতে পারছে না।
অবিনাশ একের পর এক সিলেবাস তৈরি করছেন আর ছিঁড়ছেন… কোনোটাই মনঃপূত হচ্ছে না।

অনেক ভেবে- চিন্তে ট্যাগলাইনে লিখলেন– “কেবলমাত্র উচ্চমেধা নয়, উচ্চমানসিকতা গড়ে তোলা আমাদের লক্ষ্য।”

[পরম্পরা ওয়েবজিন, ডিসেম্বর ২৩, সূচিপত্র]