মেলবক্সে অনেকগুলো ই-মেল । ব্যাঙ্ক থেকে এসেছে তিনটে, ব্যাঙ্ক ট্রান্সফারের আলার্ট, ইলেক্ট্রিসিটি বিল, ইনকাম ট্যাক্স-মিউচুয়াল ফান্ড । পার্সোনাল মেল বলতে একটা পত্রিকা থেকে মেল । হয়ত লেখা চেয়ে পাঠিয়েছে । পরে দেখলেই হবে । আর সবই আজেবাজে মেল । নানা কোম্পানির অ্যাড । প্রথমেই সেগুলো স্প্যাম মেলবক্সে পাঠানো শুরু করল নন্দিতা । মেলবক্স একটু খালি করে অ-কাজের মেলগুলো দেখা শুরু করল । একনজর দেখা, তারপর ডিলিট ।
একটা ইমেলে চোখ আটকে গেল । গায়ত্রী নামের একজন লিখেছেন । বাংলিশ মেল । মানে হরফটা ইংরেজি, ভাষাটা বাংলা । এই বাংলিশ লেখাটা একদম পছন্দ নয় নন্দিতার । মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপে বাংলিশ লেখা দেখলে পড়ে না, উত্তরও দেয় না । কিন্তু এই ই-মেলের প্রথম লাইনটাতেই চোখ আটকে গেল ।

নমস্কার । আমি গায়ত্রী । কিন্নর পত্রিকা থেকে তোমার মেল-ঠিকানা পেয়েছি । তুমি লিখলাম বলে রাগ করলে না তো? আসলে কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি আমার খুব চেনা, খুব আপন । তোমার ‘উদ্যোগ’ গল্পটা প্রথম পড়েছি । তারপর থেকে তোমার প্রতিটা লেখা খুঁজে খুঁজে পড়ি । এখানে তো বাংলা লেখা চাইলেই পড়া সম্ভব নয় । ইন্টারনেটে পড়ি । আজ এইটুকু থাক । তুমি যদি আমার মেলের উত্তর দাও, আবার লিখব । তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে । ভালোবাসা নিও । -দিদি ।

ফ্যান-মেল? গল্প পড়ে ভালো লাগা, লেখকের ঠিকানা জোগাড় করে সে ভালো-লাগা জানানো… এই পর্যন্ত ঠিক আছে । কিন্তু কি যেন আছে চিঠিতে । আন্তরিকতা? বড্ড আপন কারো লেখার মতো? কে এই গায়ত্রী? নিজের কথা কিছু লেখেন নি, চিঠির শেষে ‘দিদি’ ।
কি ভেবে একটা উত্তর লিখেই ফেলল নন্দিতা । চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার একটা সৌজন্যও বটে ।
পরের দিনই উত্তর এল ।

“আমি জানতাম তুমি ঠিক সাড়া দেবে । তুমি যে পরপর আমার গল্পগুলোই লিখেছ । তোমার প্রতিটা গল্পে আমি নিজেকে খুঁজে পাই । সেই আমি, যাকে আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম একুশ বছর আগে । তুমি জানো, তোমার ‘দ্বিরাগমন’ গল্প আমার জীবনের গল্প? তোমার সঙ্গে যে অনেক কথা আছে বোন । হ্যাঁ গো, তোমার সঙ্গে আমার জন্মান্তরের সম্পর্ক । আগের আগের জন্মে তুই আমার বোন ছিলি, এ জন্মেও ঠিক খুঁজে পেলাম ।“….
বেশ দীর্ঘ চিঠি । অনেক অনেক আবেগের কথা ।

এবার একটু কেমন কেমন লাগছে । একটু অস্বাভাবিক । ইন্টারনেটে নানারকম গল্প শোনা যায় । আলাপ জমানোর চেষ্টা? তারপর অন্যরকম ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা? কত কিছুই তো শোনা যায় । গায়ত্রী নাম নিয়ে কোনো পুরুষও এমন লিখতে পারে । মল্লিকা বলছিল একদিন, ফেসবুকে চ্যাট করত ‘দিদিভাই’ ডেকে, ছোট্ট কলেজে পড়া মেয়ে… সে-ই পরে অশ্লীল নানা কথা বলেছে… মেয়েই নয় সে ।
ই-মেলের উত্তর দিল না নন্দিতা ।

ছবি- ডা.গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়


ক’দিন পরে আবার মেলবক্সে গায়ত্রী । “অসুস্থ ছিলাম বোন, হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল । আমাদের এখানে যদিও হাসপাতালে বাড়ির মতই সব সুবিধে, আমারই আর ল্যাপটপ নিয়ে বসার ক্ষমতা ছিল না । কিন্তু রোজ সবসময় তোর কথা ভেবেছি । আমার মেল না দেখে তুই নিশ্চয় খুব চিন্তা করছিস । ইভানও ঠিক তোর মত ছিল, জানিস? সবসময় চিন্তা আমাকে নিয়ে । মাঝেমাঝে ভাবি, এখন এতগুলো বছর কি করে একা একা আছে ।“
অসংলগ্ন লেখা । কে ইভান? অসুস্থ ছিলেন, কি অসুখ? একটা কি উত্তর দেওয়া উচিত? কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না নন্দিতার । এগুলো ঠিক চিঠি নয় । অনেকটা ডায়েরি লেখার মতো । যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলা । আসলে এই সব সোশাল মিডিয়া, ভার্চুয়াল জগতের একটা সুবিধেও আছে । মায়াপাতার মায়া । নিজের একটা জানলা । এসকেপ । নিজেকে প্রকাশ করার একটা মাধ্যম ।
হয়ত একাকিত্বে ভুগছেন মহিলা । পুরুষও হতেই পারেন । গায়ত্রী নাম নিয়েছেন মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার জন্য । সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় নি নন্দিতা ।

কিন্তু মনটা একটু অস্থির । অসুস্থতার কথা বলেছেন, একটা রেসপণ্ড করা উচিত নয়? মানবিকতা বলেও তো একটা জিনিস আছে ।
দু’দিন পারে লিখল । কোনো সম্বোধন না করেই লিখল নন্দিতা, ‘কেমন আছেন এখন? হাসপাতালে যেতে হয়েছিল যখন, নিশ্চয় সিরিয়াস কোনো অসুস্থতা । খুব সাবধানে থাকবেন । ডাক্তাররা যেমন বলেছেন, মেনে চলবেন ।‘ তারপর আনমনেই লিখে ফেলল, ‘ইভান কে?’
ই-মেল পাঠানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে উত্তর এল । গায়ত্রী অনলাইন ছিলেন নিশ্চয় ।
“প্রথম দিন থেকেই তো সব কথা তোকে বলার জন্যে বসে আছি বোন । ইভানের কথা, জেরির কথা, আমার গোটা জীবনের কথা । আমার কথা লিখবি তুই, কেমন? একটু অবশ্য লিখেই ফেলেছিস । তোর ‘শাল্মলী’ গল্প পড়েই তো প্রথম চিঠি লিখলাম তোকে । কি করে জানলি এত ডিটেইলস? কারণ এ জন্মেও তুই আমাকে জড়িয়ে আছিস । ইভানও তাই । হাসপাতালে ওকে রোজ অনুভব করেছি, আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকত । কতবার বলতাম, আয় একটু সামনে থেকে দেখি তোকে । একবারের জন্যে এল না । আজ এইটুকু থাক । একনাগাড়ে অনেকটা লিখতে পারি না এখন । তাছাড়া জেরি এখুনি আমার খাবার নিয়ে আসবে । আমি বসে আছি ল্যাপটপে, দেখলেই বকবে । আমাকে বেড-রেস্টে থাকতে বলেছে না? কি যত্নই যে করতে পারে জেরি ।“

কৌতূহল হয়েছে সত্যিই । কে এই জেরি? ইভান? রাত জেগে লেখালেখি নন্দিতার অভ্যাস । কিন্তু এত রাতে অসুস্থ মানুষটা জেগেই বা কেন?
উত্তর লিখে ফেলল, ‘হ্যাঁ, আপনি রেস্ট নিন । এত রাতে আপনি জেগে থাকবেন না । আবার পরে কথা হবে ।‘
সঙ্গে সঙ্গে ডানদিকে একটা ছোট উইন্ডো খুলেছে । চ্যাট উইন্ডো ।
‘রাত কোথায়? আমরা তো সাড়ে ন’ ঘণ্টা পিছিয়ে আছি দেশের থেকে । এখানে এখন দুপুর দেড়টা ।‘
আচ্ছা, ইনি বিদেশে থাকেন? সাড়ে ন’ ঘণ্টা টাইম ডিফারেন্স!
‘আমি নিউ জার্সিতে থাকি এখন । অনেক পথ পেরিয়ে, তোর ‘ব্রহ্মপুত্র’ গল্পটায় যেমন লিখেছিস, নদীর মতো এবড়ো খেবড়ো পথ পেরিয়ে মোহনার দিকে এগোনোর ইচ্ছেয় …. তবে মোহনা পর্যন্ত পৌঁছনো বোধহয় হবে না ।’
আমেরিকায় বসে ইনি নন্দিতার সব গল্প পড়েছেন? এও কী সম্ভব? সন্দেহ হচ্ছে ।
‘আপনি আমেরিকায় থাকেন, অথচ আমার সব গল্প পড়েছেন? এ তো আমার প্রাপ্তি । তবে খুব অবাকও হচ্ছি ।‘
‘বললাম যে, তোর সব গল্পে আমি আছি । আমিও খুব অবাক হতাম, কে এই লেখিকা? যে আমার জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে গল্প লেখে? তারপর বুঝেছি, একটা সম্পর্ক আছে কোথাও । এ জন্মে না হলেও আগের কোনো জন্মে । নইলে তুইই বা কেন….’

অনেক সময়ই পাঠক নিজের জীবনের সঙ্গে মিল খুঁজে পান নানা গল্পে । অস্বাভাবিক কিছু নয় । গল্প তো জীবন থেকেই নেওয়া । কিন্তু ইনি… সত্যিই কি কোনো সম্পর্ক… জন্মান্তর বলে কী সত্যিই কিছু হয়? দূর ! তা আবার হয় নাকি! অসুস্থ মানুষ, আমেরিকায় থাকা অনেক বাঙালিই পরবাসের একাকিত্বে ভোগেন, হয়ত এইভাবেই কথা বলার সঙ্গী খুঁজে নিয়েছেন ইনি ।
‘আচ্ছা দিদি, অনেক রাত হল । আমি এবার উঠব । কাল সকালে অফিস আছে । আবার কথা হবে, কেমন?’ চ্যাট উইন্ডো বন্ধ করবে এবার ।
‘এই যে বললি … ‘কেমন?’ এই বলার ধরণটা খুব চেনা লাগল বোন । এমনভাবেই যেন আগেও কখনো… আচ্ছা, আর দেরি করাব না । গুড নাইট বোন । আবার কথা হবে ।‘

ছবি- ডা.গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

-দুই-

“পরনে সবুজ শাড়ি, ইস্ত্রী চলে নি শাড়িটায় .. কতদিন পাটভাঙা শাড়ি পরে নি মেয়েটা, হাতে সোনা-বাঁধানো শাঁখা-পলা, সঙ্গে তিনচারটে লোহা .. একটা বাপের বাড়ির, একটা শ্বশুরবাড়ির, একটা তারাপীঠের, একটা কালিঘাটের .. গলায় চিকচিকে সোনার হার, কানে সোনার দুল, কপালে লাল সিঁদুরের টিপ ..উস্কোখুস্কো চুলে লম্বা একটা বিনুনী ঝুলছে । পরিপাটি সাজানো খাট-বিছানা-ড্রেসিংটেবিল- আলমারি.. সেখানে নয়, জানলার পাশে মাটিতে বসে বই পড়ছে মেয়েটা । বসার ভঙ্গীতে অস্থির ভাব, মাঝে মাঝেই জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে চাইছে । তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে বইটা ।
নইলে বাড়িতে ঢুকেই বকুনি, ‘আবার নাটক নভেল নিয়ে বসে আছ সারাদিন? কতদিন বলেছি, ওই সব আদিখ্যেতার বই পড়ে সময় নষ্ট করবে না ? ইংরেজি বই পড়া তবু ভালো, গ্রামারটা ভালো হবে, ছেলের কাজে আসবে । পড়তেই হয় তো, ইংরেজি বই পড়ো । তা না, কবিতা গপ্পো পড়ে সময় নষ্ট ।“

জানিস, এটা আমারই গল্প?….
দীর্ঘ ইমেল । কাল রাতেই বোধহয় লিখেছেন । ওহ, রাত না, ওখানে তো তখন দিনের বেলা ছিল ।
‘পাটনায় থাকতাম আমরা । বিহারের পাটনা । ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে । তুই লিখেছিস আমার কথা । তোর ‘আলোপাখি’- তে । কোন জায়গাটা, বলি?
“সবুজ একটা গ্রাম, একটা কাঠের সাঁকো । সেখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাও, সবুজ আর সবুজ । ওপরে তাকাও । কতরকম নীল । ঘন নীল, হালকা নীল, আকাশী নীল, সাদাটে নীল । আর একটু এগিয়ে যাও । একটু দূরে মস্ত দীঘি, এত দূর থেকেও দেখতে পাবে, সাদা-কালো জলে কেমন রূপোলী আলো চিকচিক করছে । ঝর্ণা হয়ে আনন্দ বুকের মধ্যে উথালপাথাল করবেই ।
সন্ধেবেলা আবার অন্যরকম । আকাশটা আবছা আলোয় ছায়া-ছায়া অন্ধকারে মাথার মধ্যে ঢুকে পড়বে । সবুজ ক্ষেতের ওপর বিষন্ন ঘুম-ঘুম নির্জনতা । দূরের দীঘির জলে শান্ত কালো নি:শব্দ ঢেউ । এবার সাঁকো থেকে নেমে আস্তে দীঘির কাছে এসো । চারদিকে বড় বড় গাছ, মনে হবে জঙ্গলের মধ্যে চলে এসেছ বুঝি । পরিষ্কার টলটলে দীঘি । শান্ত গভীর ।“
আমার গ্রাম । হুবহু আমার গ্রামের ছবি ফুটে উঠেছে তোর গল্পে । বিয়ে হয়ে পাটনায় এলাম । অধ্যাপক স্বামী । কিন্তু সে নিজে গান শোনে না .. সাহিত্য পড়ে না, কবিতা পড়ার কথা শুনলেই মাথা ধরে .. প্রেম প্রেম প্যানপ্যানানি ছাড়া ওতে আছেই বা কি । বাংলা বই দেখলেই তার মাথা গরম হয় । গান শুনে, বাজে বই পড়ে সময় নষ্ট করার কথা সে ভাবতেও পারে না । সে অবশ্য ইংরেজি বই পড়ে, সেসব বইয়ে মেয়েদের অপরূপ মুর্তি । সিনেমাও দেখে, রাত জেগে জেগে.. টিভিতে, কম্পিউটারে.. নীল নীল ছবি ।
মনে পড়ছে, নন্দিতা? তুই লিখেছিস গল্পে । আমার জীবনের গল্প । তার মধ্যেই ইভান এলো । বুক ভরে শ্বাস নেবার দিন এলো বুঝি ! ইভানকে ঘিরে সব ভুলে থাকার চেষ্টায় থাকতাম । এবার সব ঠিক হয়ে যাবে, নিজেকে বলতাম জোরে জোরে, ভালো আছি, আমি খুব ভালো আছি ।
লাইনগুলো চিনতে পারছিস, বোন?’

হ্যাঁ, নন্দিতারই গল্পের লাইন । গায়ত্রীর জীবনের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে গেছে ।
আগ্রহ বেড়েছে নন্দিতারও । কবে থেকে যেন ‘দিদি’ বলে ডাকা শুরু হয়েছে । সব পেয়েছির দেশে থেকেও মানুষটা এমন দু:খী কেন? ইভান অন্য কোথাও চলে গেছে? ও দেশে নাকি আঠারো হলেই ছেলেমেয়ে আলাদা থাকতে শুরু করে ।
আস্তে আস্তে শুনেছে গায়ত্রীদিদির জীবনের গল্প ।
পাটনায় ভালো থাকা হয় নি ।
নিজের হাতে সাজানো সংসারটা পর করে দিয়েছিল । সংসারটা ছায়া ছায়া দেখালো প্রথম, তারপর ধু ধু মরুভুমিতে মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেল একদিন । শিশু সন্তানসহ স্ত্রীকে বাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছিলেন সে ‘ভদ্র’লোক । এক বছরের মধ্যেই মানানসই একজন মনোরমা মনোমত জীবনসঙ্গিনী খুঁজে নিয়েছে গায়ত্রীদির অধ্যাপক স্বামী । ইভানের খোঁজও নেয় নি । প্রথম প্রথম চেষ্টা করেছে সবাই, দু’তিন মাসে একবার যেন বাবার দেখা পায় অবোধ শিশু । সে লোক আগ্রহ দেখায় নি । বাবার বাড়িতে ফিরেছিলেন গায়ত্রী, ইভানকে নিয়ে ।
এতটা লিখে আবার নন্দিতার গল্প থেকে খানিক তুলে দিয়েছেন গায়ত্রীদিদি ।

“স্বামী-পরিত্যক্তা সব মেয়েদের মতো লাবণিও বাবার বাড়িতেই ফিরেছিল । বাবা তো ছিলেনই, ভাই এখন বাবার চেয়েও বেশি সোচ্চার । মালিক হয়েছে বাড়ির । প্রথমে তো ঢুকতেই দেবে না, তারপর অসুস্থ ছেলে নিয়ে গোয়ালঘরে জায়গা হল লাবণির । সেও সমাজের ভয়ে । ‘লোকে কি বলবে !’
মা আসতেন লুকিয়ে । কলঙ্কিনী মেয়েকে সোহাগ দেখানোর সাহস ছিল না তাঁর ।
সব সইছিল লাবণি । কিন্তু বুকের মধ্যে থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে বুবাইকে কোথায় মানসিক-পঙ্গুদের হোমে পাঠিয়ে দিল ভাই, সেদিন আর পারল না । বোধহয় পাগল হয়েই গিয়েছিল । নইলে সে সময়ের কতগুলো মনে পড়ে না কেন ! ঝাপসা ঝাপসা ছবির মতো মনে পড়ে, সাঁকো দুলিয়ে নেমে আসা ঝড়ের কথা ।
‘পালিয়ে যা, তুই পালা’, মা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ।
‘তোমাকে উঠে দাঁড়াতে হবে’, স্যার বলেছিলেন ।
তারপর কত দিনরাতের নিরলস যাত্রা । বন্ধুরাও খুব করেছিল সে সময় । পেছন ফিরে দেখলে আজ সেসব অন্য কোনো মেয়ের গল্প মনে হয় ।“

আমার পুরোনো দিনগুলো ঠিক এইরকম ছিল বোন । আমার ইভানকে বাবা কোন এক হোমে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিল । আমি ইভানকে কোলে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম ।
আজ বড় ক্লান্ত লাগছে । আর লিখতে পারছি না । আবার পরে লিখছি । তোকে তো সব বলে যেতেই হবে ।‘
কোনো ইতি না টেনেই হঠাত্‍ চিঠি শেষ ।

ছবি- ডা.গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়


-তিন-
এমনও হয়! এত মিল হয় কারো জীবনের গল্পের সঙ্গে । গায়ত্রী অনেকগুলো আলাদা আলাদা গল্পের কথা বলেছেন, যা বিভিন্ন সময়ে লিখেছে নন্দিতা । সবটাই বানানো, কল্পনা । অথচ অদ্ভুতভাবে মিলে গেছে আরেকজন মানুষের জীবনের সঙ্গে । সে মানুষটির সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগও ছিল না । নেহাত ইন্টারনেট ছিল বলে যোগাযোগ হল ।
কাল লিখেছেন গায়ত্রী, “জানি না, এ জন্মে তোর সঙ্গে দেখা হবে কিনা । তোর ছবি তো এই মেল অ্যাকাউন্টে দেখেছি, তুইও আমার ছবি দেখেছিস । হয়ত এ জন্মে এমনভাবেই দেখা হবার কথা । আমি আর দেশে যাই না । বত্রিশ বছর হয়ে গেল । দেশ আমায় টানেও না । সেখানে আমার কেউ নেই । তুই যদি কখনো এ দেশে আসিস, দেখা হবে । জেরিকে তোর কথা বলেছি । ও, জেরির কথা তো বলাই হয় নি তোকে । ইভান যখন চলে গেল, জেরিই আমায় আগলে রেখেছিল । ইভান, আমার একুশ বছরের ছেলে, কার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল । তখনকার কথা কিছু মনে পড়ে না আর । আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছিলাম । অনেকদিন হাসপাতালে ছিলাম । কতদিন, কত মাস, আমার মনে নেই । আজকাল এত হিসেব করতে পারি না । জেরি আমায় জোর করে ওর বাড়ি নিয়ে এসেছিল । বিয়ে করল । ভালোবাসি, বলেছিল অনেক বছর আগে । আমি রাজি হই নি । ইভানের জন্যে । ইভানের মা-বাবা দুই হয়ে ওকে বড় করেছিলাম । ওর ছোটবেলার স্মৃতি সব ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম । কী ভালো, কি মায়াবী ছেলে হয়ে উঠেছিল ইভান ! হারিয়ে গেল । চলে গেল আমায় ছেড়ে ।“

আহা! অনেক কষ্ট পেয়েছেন গায়ত্রীদি । একুশ বছরের তরতাজা ছেলে । মায়ায় পড়েছে নন্দিতাও ।
রোজই গল্প হয় ই-মেল, চ্যাটে । নন্দিতার সংসারের গল্প শুনে প্রাণভরে ভালোবাসা জানিয়েছেন, সপরিবারে নিউ জার্সি আসার কথা বলেছেন । মনেই হয় না আলাপ শুধুই ইন্টারনেটে । আজকাল নন্দিতারও মনে হয়, কোথাও একটা ওয়েভলেংথ মিলেছে । নিজের সব গোপন কষ্টের ভার দিয়ে মুক্ত হতে চাইছেন যে মানুষটা, তাঁর প্রতি কিসের যেন এক দায়বদ্ধতা আছে ।
একদিন বললেন, “কাল আবার হাসপাতালে যাচ্ছি বোন । হয়ত একটা সার্জারি হবে । কবে আবার তোকে লিখতে পারব জানি না । জেরিকে বলেছি, আমার যদি কিছু হয় তোকে জানিয়ে দিতে ।‘
খুব মন খারাপ হয়েছে নন্দিতার । ‘কেন এমন বলছেন দিদি? আপনি ভালো হয়ে যাবেন । ওদেশে চিকিত্‍সার কত সুবিধে । প্লিজ এমন বলবেন না ।‘
‘যা-ই হোক, যেখানেই যাই, তোর সঙ্গে আবার দেখা হবে বোন । আমার কিছু হলে মন খারাপ করবি না । আমি তো ইভানের কাছে পৌঁছে যাব । সেটা ভালো হবে না? হ্যাঁ, জেরি একলা হয়ে যাবে । সেটা একটা চিন্তা । জেরি তো আমার মতো সবার সঙ্গে মিশতেও পারে না ।‘

অনেকদিন চিঠি নেই তারপর। কে জানে কেমন আছেন দিদি । ই-মেল ছাড়া যোগাযোগের উপায় নেই । কোনো কমন বন্ধু নেই, বুদ্ধি করে জেরির ই-মেল ঠিকানা যদি নিয়ে রাখত! রোজই এক লাইন দু’লাইনে ইমেল পাঠায় নন্দিতা । চিঠি লেখার মতো সুস্থ হলেই উত্তর দেবেন গায়ত্রীদি ।
মাসখানেক পর বহু প্রতীক্ষিত মেল এল। গায়ত্রীদির মেল ইনবক্সে দেখেই আনন্দে লাফিয়ে উঠেছে
নন্দিতা । তারপর চোখে জল এসেছে । চিঠি লিখেছেন গায়ত্রীদির স্বামী । জেরি গামার্শ । ‘মাই বিলাভেড ওয়াইফ ইজ নো মোর ।….’
চিঠির বাকিটুকু আর পড়তে পারে নি নন্দিতা । স্বজন হারানোর বেদনায় ভার হয়েছে মন । ই-মেল খুলতেই ইচ্ছে করত না আর । ইন্টারনেট জিনিসটার ওপরই বিতৃষ্ণা এসেছে । অ-দেখা দিদির শোকে চোখ ভরে জল এসেছে ।

-চার-

একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা তারপর । সকালবেলা অচেনা একটা নম্বর থেকে ফোন । ‘নন্দিতা চট্টোপাধ্যায় বলছেন?’
‘বলছি ।‘
‘আমি পি চ্যাটার্জী, নর্থ আমেরিকা বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলছি । এ বছর সাহিত্য বিভাগে আমাদের পুরস্কারের জন্যে আপনি নমিনেট হয়েছেন ।‘
‘আমি? আমি কিভাবে?’ এত অবাক হয়েছে নন্দিতা, কথা বলতেই পারছে না ।
‘আমাদের কমিটি আছে, তাঁরা সারা বছরের লেখালেখি লক্ষ্য রাখেন । বাংলা, ইংরেজি এবং আরো নানা ভাষার লেখালেখি । এ বছর বাংলা সাহিত্য বিভাগে আপনার নাম সর্বসম্মতি ক্রমে ঠিক হয়েছে । আপনি মত দিলে আমরা পুরস্কার পাঠিয়ে দেব ।‘
লেখালেখির জন্যে জীবনে প্রথম পুরস্কার। আর সে পুরস্কার আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এ যে কতখানি প্রাপ্তি ।
সারাদিন ঘোরের মধ্যে কেটেছে । রাতে ঘুম আসছে না উত্তেজনায় । মাথায় আলগা একটা স্পর্শ । মেয়ে এমন করে । মেয়েরা মাঝেমাঝে মা হয়ে যায় । চোখ না খুলেই ভালো লাগা উপভোগ করছে নন্দিতা । আরামে চোখে ঘুম নেমে আসছে ।
‘কি রে বোন? কি বলেছিলাম? সারা জীবন তোর সঙ্গে থাকব । দেখলি তো?’
চমকে উঠে বসেছে নন্দিতা । কে বলল কথাটা? মৃদু সুগন্ধ ঘর জুড়ে । জুাঁই ফুলের গন্ধ । শরীর জুড়ে ঠান্ডা বাতাস । ‘দিদি’, অস্ফুটে ডেকে উঠল নন্দিতা ।

দিন পনেরোর মধ্যেই পুরস্কার এসেছে । ডলারে চেক, আর একটি অপরূপ সুন্দর বাঁধানো প্লাক । গায়ত্রী গামার্শ মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড ফর লিটারেচার । নন্দিতার নাম লেখা । বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্যে পুরস্কার । হ্যাঁ, সারা জীবন নন্দিতার সঙ্গেই থাকবে এই পুরস্কার । গায়ত্রী গামার্শ নামটিও ।

ছবি- ডা.গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

[পরম্পরা ওয়েবজিন, এপ্রিল ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
7 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Angsuman Ghosh
Angsuman Ghosh
6 months ago

খুব সুন্দর গল্প।

S Chattopadhyay
S Chattopadhyay
6 months ago

বেশ লাগল । টানটান লেখা।

Ritu Koiry
Ritu Koiry
5 months ago

খুব ভালো গল্প । এমন হয় । কিছুই হারায় না ।

আশিস সাহা
আশিস সাহা
5 months ago

চমৎকার

Goutam Goswami
Goutam Goswami
5 months ago

সুন্দর গল্প l শুভেচ্ছা l

উমাদাস ভট্টাচার্য
উমাদাস ভট্টাচার্য
5 months ago

বাঃ —

Sisir Dasgupta
Sisir Dasgupta
5 months ago

চমৎকার লাগলো