ফেসবুকে এক ভদ্রলোকের পোষ্ট আমি খুব মন দিয়ে পড়ি। ভদ্রলোকের নাম সমীরণবাবু। প্রথমের দিকে তিনি আমার বন্ধু তালিকায় ছিলেন না। কিন্তু দু’জনেরই বেশ কিছু কমন ফ্রেন্ড থাকায় এবং সমীরণবাবু তার প্রায় সব পোষ্টেরই প্রাইভেসি স্টেটাস ‘পাবলিক’ করতেন বলে তার পোষ্টগুলি আমারও চোখে পড়ত। সমীরণবাবুর লেখায় এমন ভাষার বাঁধুনি ও জোরালো বক্তব্য যে একবার পড়তে শুরু করলে আপনি শেষ না করে স্ক্রল করে নেমে যেতে পারবেন না। দীর্ঘ মাঝারি ছোট সব রকমের পোষ্ট। বাংলা হরফে লেখা। মাঝেমধ্যে একটা দুটো গালাগালও থাকত। কিন্তু তাতে আমার মহাভারত অশুদ্ধ হত না। বরং তার অ্যাংরি ইমেজের আমি ফিদা হতাম। বেশ কয়েকটা পোষ্ট পড়ার পর আমার খেয়াল হল, আরে এই লোক আমার বন্ধুতালিকায় নেই! অথচ এরকম লোকই তো বন্ধুতালিকায় দরকার। কত কী জানা যায়। ফলে দিলাম একদিন বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠিয়ে। পাঠিয়ে বেশ একটু টেনশনেও ছিলাম বলা যায়। যদি অনুরোধ বাতিল করে দেন। না, আমার সেই আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে তিন দিন পর সমীরণবাবু আমার বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করলেন। দেশ ও রাজ্যের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক অবস্থার নিখুঁত বিশ্লেষণ থাকে তার অধিকাংশ পোষ্টে। শুধু তাই নয় ছবি কাকে বলে, বিমূর্ত আধুনিক ছবি থেকে কীভাবে রস নিতে হয়— সেই বিষয়েও পড়েছি একটা-দুটো পোষ্টে। কখনও আবার প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী কী ভুল সিধান্ত নিলেন, তাঁদের কী করা উচিৎ ছিল— তাও থাকে। সবচেয়ে বড় কথা সমীরণবাবু কাউকেই ছেড়ে কথা বলেন না। লাল, সবুজ, গেরুয়া সব দলের প্রতিই তিনি সমান খড়্গহস্ত। আমাদের অনেকের মতো শত্রু বাড়াবার ভয় তার নেই। আমি পড়ি আর মুগ্ধ হয়ে যাই। ভাবি লোকটার জ্ঞান ও সাহস আছে বটে। আমি লাইক দিই, মন্তব্য বিশেষ করি না। একবার একজনের পোষ্টে মন্তব্য করে বেশ অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল বলে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকি। শুধু জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ব্যতীত আর কোনও মন্তব্য বিগত দু’বছরে করিনি বললেই চলে।


চাকরিসূত্রে আমাকে বাড়ি ছেড়ে দামোদর নদীর কাছে পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রান্তে ভাড়াবাসায় থাকতে হয়। আগে বাইরের খাবার খেতাম, কিন্তু এখন আর খাই না। তবু দু’বেলা রান্না ও অফিস করা ছাড়া কাজ বিশেষ নেই, হাতে অনেকটা সময়। নেটফ্লিক্সে ওয়েব সিরিজ দেখি আর মন দিয়ে ফেসবুক করি। বিশেষ করে ওই সমীরণবাবুর কোনও পোষ্ট মিস করি না। খুব ইচ্ছে করে ইনবক্সে একদিন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করি। কিন্তু সাহসে কুলোয় না।
কিন্তু সেদিন সমীরণবাবুর একটা পোষ্ট পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি যা লিখেছেন তার সারমর্ম এই—যখন হাতে কোনও কাজ থাকে না তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। হয় ছবি আঁকেন, গলা ছেড়ে গান করেন বা কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। জুন মাসে বাধ্য হয়ে ছাত্রদের ফোন করেছিলেন। তাতে পুরনো ছাত্রদের কেউ কেউ অনলাইনে পড়তে রাজি হয়েছে। এপ্রিল মাস থেকেই তার কাজ নেই। তিনি টিউশনি পড়ান না। স্পোকেন ইংলিশ শেখান। কিন্তু এই করোনার বাজারে অন্যান্য বিষয় পড়তে রাজি থাকলেও স্পোকেন ইংলিশ কারা শিখতে চাইবে তা নিয়ে তার নিজেরই গভীর সন্দেহ। ব্যাঙ্কে যা ছিল তাতে কোনওমতে জুলাইটা হয়তো টানা যাবে। কিন্তু তারপর? তিনি বিয়ে করেননি, মা’কে নিয়ে তার সংসার কীভাবে চলবে তিনি আর ভাবতে পারছেন না…ইত্যাদি। পড়ার পর মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভদ্রলোককে আমার বেশ একজন সফল সার্থক মানুষ বলে মনে হত।
করোনা এখনও পর্যন্ত আমার কোনও আর্থিক ক্ষতি করেনি। আমি রাজ্য-সরকারি কর্মী। সরকার এখনও আমদের মাইনে কমায়নি। তবে মূখ্যমন্ত্রীর ত্রাণতহবিলে ও দু’একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে অর্থ সাহায্য করেছি লকডাউন পিরিয়ডে। সেটা তো কোনও ক্ষতি নয়। বরং আমার মানসিক শান্তি।তবে অর্থক্ষতি না হলেও মানসিক ক্ষতি হয়েছে। বাড়িতে স্ত্রী-পুত্র, বয়স্ক মা-কে ছেড়ে দূরে থেকে চাকরি করি। আগে শুক্রবার করে বাড়ি ফিরতাম, আবার সোমবার ভোরে বেরিয়ে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে সকাল দশটা-সাড়ে দশটার মধ্যে চলে আসতাম অফিসে। কিন্তু এই করোনার কারণে সাপ্তাহিক বাড়ি যাওয়ার কপালে এখন ছাই। ট্রেন চলছে না বা চললেও গুটিকতক দূরপাল্লার ট্রেন। এদিকে স্টেশন লিভের ক্ষেত্রেও বেশ কড়া নিয়ম জারি হয়েছে। উপরওয়ালার নির্দেশ-ব্যতীত স্টেশন লিভ করলে চূড়ান্ত হেনস্থা হওয়ার আশঙ্কা। এছাড়াও ঘন ঘন বাসে যাতায়াতে সংক্রামিত হওয়ার ভয় তো আছেই। ফলে এখন মাসে একবার ছুটি নিয়ে কয়েক দিনের জন্য বাড়ি যেতেও বেশ সাধ্য-সাধনা করতে হয়।
ফলে রোজ রাতে আমি একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করি। আমার ছেলের ফোন। সাত বছরের আকাশ ফোন করে বলে, তোমার কি মোবাইল ডাটা অন?
যদি বলি হ্যাঁ, বলে, তাহলে আমরা ভিডিওকল করছি। আমরা মানে পাশে ওর মা-ও থাকে। তো যাইহোক, এছাড়া আর যে খুব কষ্টে আছি বলা যাবে না। কিন্তু ভদ্রলোকের ফেসবুক পোষ্টটি আমাকে পূর্ব-জীবনের কথা স্মরণ করাল। চাকরি পাওয়ার আগে আমিও টিউশনি করতাম। আমার একটা সাইকেল ছিল। সাইকেল নিয়ে বাড়ি বাড়ি ছুটতাম। একই বিষয়ের অনেক ছাত্রছাত্রী আমার কখনও জোটেনি।ফলে কোচিং করার বদলে আমাকে বাড়ি বাড়ি ছুটতে হত। আমার এক বন্ধু বলত, গৃহশিক্ষক মানে গৃহভৃত্যের জাস্ট পরের স্তর। আমার খুব অপমান বোধ হত যখন কোনও বাড়িতে গিয়ে শুনতাম ছাত্র বাড়িতে নেই, অন্য কোথাও গেছে।অথচ আমাকে খবর দেওয়া হয়নি। বরং আমাকেই ছাত্রের মা অনুরোধ করতেন, আপনি কালকে এসে পড়িয়ে দিতে পারবেন? কী অপমানিত বোধ হত যে, মনে হত ধরণী দ্বিধা হও। একেবারে যে সেসব অনুরোধ রক্ষা করিনি, তা নয়। টিউশনি যখন কম ছিল, তখন একটা পাঁচশো ছ’শো টাকার টিউশনি হাতছাড়া হয়ে গেলে আয় অনেকটা কমে যাবে বলে আবার একদিন গিয়ে পড়িয়ে দিতাম। কিন্তু যখন টিউশনি বাড়ল, পায়ের তলার মাটি একটু শক্ত, তখন এইসব অনুরোধ পাশ কাটাতাম, না, আসলে আমার তো সময় হবে না, অন্য জায়গায় পড়ানো আছে।
ভাগ্যিস চাকরি পেয়েছি। শুধুমাত্র টিউশনিকেই ধ্যানজ্ঞান করে জীবন কাটাইনি সেসময়। রাত্রে যৎসামান্য সময় বাঁচিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য পড়তাম।
একবার অনির্বাণ নামে আমার এক বন্ধু আমাকে একটা টিউশনির সন্ধান দিল। ক্লাস এইট। সায়েন্স গ্রুপ পড়াতে হবে। ইংলিশ মিডিয়াম। আমি বাংলা মাধ্যমে পড়েছি। ইংরেজির সঙ্গে পরিচয় ক্লাস সিক্সে। কিন্তু যেহেতু সায়েন্স নিয়েই পড়েছি উঁচু ক্লাসে, তাই রাজি হয়ে গেলাম। সায়েন্সই তো, ভাষাটা না-হয় আলাদা। ওমা! কথা বলতে গিয়ে ছাত্রের মায়ের মুখে শুনি ইংরেজিটাও আমাকে পড়াতে হবে। ইংরেজি আবার কার কাছে পড়বে?
ঠিকই তো, ইংরেজির জন্য আবার টিচার মানে আবার কতগুলো টাকার ধাক্কা। অতএব সায়েন্স গ্রুপের সঙ্গে ইংরেজি। সেশনের শুরুতে টিউশনির বাজারে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। বাৎসরিক পরীক্ষার পরে রেজাল্ট, নতুন বই কেনা প্রায় এক মাসের বিরতিতে এমনিতেই টিউশনি মাস্টারের শিরে সংক্রান্তি, বেতনে চ্যূতি ঘটে। দুই-একটি সহৃদয় পরিবার হয়তো এই চ্যূতি ঘটান না, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটে। তার ওপর কারা থাকবে আর কারা নতুন শিক্ষকের কাছে বায়না করবে তা নিয়েও তীব্র অনিশ্চয়তার মেঘ। ফলে এই লগ্নে ইংরেজি পড়াতে হবে বলে টিউশনি হাতছাড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই রাজি হয়ে গেলাম। আইসিএসই না সিবিএসই কী বোর্ড ছিল আজ আর মনে নেই। কিন্তু দিব্যি মনে আছে প্রথম দিন পড়াতে গিয়ে ছাত্রের ইংরেজি বইয়ের মলাট আলগা করে বইয়ের নাম দাম প্রকাশক মুখস্থ করে নিয়ে ছাত্রকে জিজ্ঞেস করি, বইটা কোথায় পাওয়া যায়?
পরদিন সাইকেল নিয়ে ছুটেছিলাম নির্দিষ্ট বইয়ের দোকানে।

বই সংগ্রহ করতে ওপরের ছবিতে ক্লিক করুন


সপ্তাহে তিনদিন পড়াতে হত এই ছাত্রটিকে। পড়াতে বেরনোর আগে ইংরেজির যে চ্যাপ্টার পড়াতে হবে মোটামুটি আন্দাজ করে পড়ে রীতিমতো রপ্ত করতাম ডিকশনারি নিয়ে।(তখন তো আর স্মার্টফোন, গুগলের যুগ ছিল না।) টিউশনি কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেওয়া যাবে না।

আজ রবিবার। বহুদিন পরে আজ মাছ খাওয়ার ইচ্ছা হল। এমনিতে এখানে আমার একার সংসার। ডিম ডালসেদ্ধ দিয়েই বেশির ভাগ দিন কাজ চালাই। কিন্তু কলকাতার বাড়িতে মাছ রান্না হলে আমার মায়ের মন ছটফট করে। আমাকে ফোন করে বলে, আজ একটু মাছ এনে রান্না করিস। তো, আজও একটা তেমন দিন। সকালে মা ফোন করেছিল। ফলে পায়ে হাওয়াই চটি গলিয়ে মাস্ক পরে টাকা ও বাজারের ব্যাগ নিয়ে সবে বেরোব, দেখি বাড়ির সামনের রাস্তায় একটা ভ্যানে মাছ নিয়ে যাচ্ছে একটা বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের রোগা ছেলে। মনে হল আর বাজারে কেন যাব, এখান থেকেই মাছ নিয়ে নিই। খাটনি ও সময় বাঁচবে।

ছেলেটার মাছ কাটা ও ওজন করা দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না যে এই লাইনে নতুন। বললাম, ভাই একটা কথা জিজ্ঞেস করব কিছু যদি মনে না করো?
কী কথা? বলুন না?
তোমাকে তো আগে কখনও এদিকে দেখিনি। তুমি কি এই কাজে নতুন?
আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি ফিল্মের অ্যাসিট্যান্ট ডিরেক্টর ছিলাম। কলকাতায় কাজ করতাম। তিন মাস বসে থাকার পর এই কাজে নামি। কী করব বলুন? জমানো টাকায় কতদিন চলে?
ছেলেটার কথা শুনে মনটা খারাপ হলেও মনে হল ছেলেটা ঠিক কাজই করেছে। লকডাউনে মুদি দোকান বা সবজি বিক্রেতাদের ঝাপ বন্ধ করতে হয়নি।
আমার হঠাৎ সমীরণবাবুর কথা মনে পড়ে গেল। ভদ্রলোক স্পোকেন ইংলিশ পড়াতেন। আচ্ছা এই করোনার বাজারে স্পোকেন ইংলিশে ছাত্র যদি না পান, অন্য কিছু পড়াবেন। ভাবতেই একটা বুদ্ধি এল মাথায়।
মাছটা ঘরে রেখে মোবাইলে ফেসবুক খুললাম। সমীরণবাবুকে ইনবক্সে লিখলাম—
ফেসবুকে গত বুধবার আপনার পোষ্টটি পড়ে আমার খুব খারাপ লাগল। আমি একটা সরকারি চাকরি করি। আপনাকে কিছু আর্থিক সাহায্য করতেই পারি। কিন্তু আপনি নেবেন না। আপনার সম্মানে লাগবে।আর এই দানেও আপনার সমস্যার সমাধান হবে না। তবে আপনার জায়গায় আমি থাকলে চুপচাপ বসে থাকতাম না। কাজ খুঁজতাম। যেকোনও কাজ। প্রয়োজনে নিজেকে পাল্টাতাম।স্পোকেন ইংলিশের ছাত্র নেই ঠিক আছে, অঙ্ক পড়াব, নাহলে বাংলা। যে বিষয়ে ছাত্র পাওয়া যায় তা-ই পড়াব। প্রয়োজনে নিজে পড়াশোনা করব, ইউ টিউবে প্রায় সমস্ত বিষয়েরই ভিডিও আছে। তা-ও যদি না পারি, ছাত্র যদি না-ই জোটে, তাহলে সবজি বেচব। মা-কে নিয়ে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে পারব না। না, সম্মানে লাগবে না। কাজকে আমি ছোট মনে করি না। আর সম্মান ধুয়ে জলও খাওয়া যায় না।
মেসেজটা সেন্ট করে দিলাম।
সপ্তাহখানেক কেটে গিয়েছে। সমীরণবাবুর কথা প্রায় ভুলতে বসে ছিলাম। হঠাৎ একদিন মনে হল আরে সমীরণবাবুর কোনও পোষ্ট তো আমার টাইমলাইনে দেখছি না। তাহলে কী…
ফেসবুকে আমার বন্ধুতালিকা সার্চ করে সমীরণবাবুর নাম আর খুঁজে পেলাম না। বুঝলাম আমাকে তিনি ব্লক করে দিয়েছেন।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, মার্চ ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
আইভি চট্টোপাধ্যায়
আইভি চট্টোপাধ্যায়
7 months ago

খুব ভালো লাগলো ।

বিশ্বনাথ পাল
বিশ্বনাথ পাল
7 months ago

অনেক ধন্যবাদ।

ডাক্তার দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়।
ডাক্তার দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়।
7 months ago

ভালো লাগলো। এই প্রসঙ্গে আমার কয়েক টা জীবনের চলার পথে উপপাদ্য আছে।
প্রথম টা হোলো “”যেচে কারুর উপকার করতে যাবেন না।”

বিশ্বনাথ পাল
বিশ্বনাথ পাল
7 months ago

ধন্যবাদ।