ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
সিঁদুরখেলা কী ও কেন?
যে কোনো ঘটনা কে কেন্দ্র করে এক আড়ম্বরময় উৎসব তা সে এক সফল ফুটবল ম্যাচই হোক বা ভোটের ফলাফল, রাখীবন্ধন বা দোলযাত্রা। সুচারুভাবে সেই অনুষ্ঠানের সমাপ্তির অন্যতম অনুষঙ্গ যেমন মিষ্টি মুখ তেমনি সেই উৎসবের বিষন্নতা যাতে জনজীবনকে গ্রাস করতে না পারে তাই “মোহে রঙ দে, রঙ দে…” বলে যেন সামগ্রিক চীতকার। আর তাই বুঝি পাঁচদিন ব্যাপী এলাহি দুর্গাপুজোর আয়োজনের সর্বশেষ রীতি হল দোলের বানভাসি রঙ খেলার মতই সিঁদুর খেলা। মা দুর্গা সহ তাঁর পরিবার এমনকি দেবদেবীর প্রত্যেকের বাহনের কপালে সিঁদুর ঠেকিয়ে আশেপাশে যে আছে সবার কপালে, গালে লাল সিঁদুর মাখিয়ে মিষ্টিমুখ হিন্দুদের অন্যতম এক সামাজিক প্রথা। মা চলে যাচ্ছেন একবছরের মত। কিন্তু তাই বলে মনখারাপের সুর যেন আছড়ে না পড়ে আমাদের মধ্যে তাই যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো মা আরেকটিবার। দুর্গাপুজোর বিজয়াদশমীর মনখারাপ রঙমিলান্তি করে তোলার নেপথ্যে বিজয়াদশমীতে এই ঐতিহ্যবাহী সিঁদুর খেলার উৎসের সঠিক তারিখ এবং স্থান জানা না গেলেও এক তত্ত্ব অনুযায়ী, গৃহবধূদের মধ্যে এক খুশির বাতাবরণ বয়ে আনতে প্রায় ২০০ বছর আগে বাংলার বর্ধিষ্ণু জমিদারবাড়ির দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বাংলায় উদ্ভব এই প্রথার। কেউ আবার বলে সিঁদুর খেলার সাবেকী ঐতিহ্য প্রায় ৪০০ বছরের পুরানো। বিসর্জনের পরে দর্পণে মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখা, দধিকর্মা বা পান্তাভাত আর কচুশাক খাইয়ে দেবীকে বিদায় দেওয়ার মতই বিজয়াদশমীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রীতি রূপে সিঁদুরখেলা কিন্তু আজো সমাদৃত এক স্ত্রী আচার। তবে যদি কেউ প্রশ্ন করেন যে মেয়েরাই কেন সামিল এই সিঁদুরখেলায়? ছেলেরা কেন নয়?
তাহলে আবারো মনের কোণায় উঁকি দেয় সেই প্রশ্ন। তেত্রিশকোটি দেবতাদের মধ্যে পুরুষেরা মহিষাসুরবধে ফিল্ডে নামিয়েছিলেন ছিলেন রণরঙ্গিণী শক্তিময়ী মা দুর্গা কে। তাই সেই শক্তিরূপিণী, শান্তিময়ী বরদাত্রী দেবীর প্রতিভূ রূপে সব মায়েরা বা মেয়েরাই যে সামিল হবেন সেই সিঁদুরখেলায় সেটাই তো স্বাভাবিক। সম্বচ্ছরের মত সেই বার্তাই তো জিইয়ে রাখবে নারীদের জয়। এর মধ্যে পুরুষতান্ত্রিকতার কোনো গল্প অন্ততঃ আমি খুঁজিনা। আর অশুভ আসুরিক শক্তির বিনাশে দুর্গার জয়লাভ তো সব মেয়েরই জয়। সেখানে লাল জয়টীকার তো ভূমিকা থাকবেই। আর মায়ের বিদায়বেলায় এই সিঁদুরখেলা নিছক কোনও প্রথা নয়, সেখানে রয়েছে মাহাত্ম্যও!
একজন সীমন্তিনী গৃহলক্ষ্মী রূপের আড়ালে তো প্রতিটি নারী দশভুজা, তেজস্বিনী নারীশক্তির আধার। সায়ুধায়ৈ (সশস্ত্র) দেবী দুর্গা এই রূপেরই প্রতিভূ। তা তার স্নেহময়ী মাতৃরূপই হোক বা শক্তিরূপিণী কন্যারূপ। নারী কিন্তু ক্ষমতায়ন ও মাতৃত্বের ধারক ও বাহক। তার সিঁথিজুড়ে সেই শক্তির তেজ যুগে যুগে দুর্গারূপিণী নারীর সিগনেচার বহন করছে। বিজয়া দশমীতে সেই শক্তিরই তো নতুন করে বিচ্ছুরণ ঘটায় তারা।
আর এ যুগে দাঁড়িয়ে শাস্ত্রের সনাতনী আপ্তবাক্য অর্থাৎ সিঁদুর খেলা সধবাদেরি একবগগা বিশেষ আচার… এসব নিয়ে কপচাবো না আমরা। সধবা, বিধবা, কুমারী, কিশোরী, নির্বান্ধব, জাতপাতের ঊর্ধ্বে ওঠা সব নারীই দুর্গারূপী। তাঁদের যেন নবরূপে অন্তরাত্মার শক্তির প্রকাশ হয় সেদিন। শক্তিরূপিনী মা দুর্গাকে সাক্ষী রেখে মেয়েরা যেন সদর্পে মেতে ওঠে এক আন্তরিক মিলনমেলায়। একে অপরকে রাঙিয়ে দেয় টকটকে লাল সিঁদুরে। সিঁদুরই যেন তার ক্ষমতায়নের অন্যতম হাতিয়ার। সিঁদুরই যেন পারবে সব মেয়েদের একসূত্রে গেঁথে রাখতে।
সে যুগে বাঙালীদের এক রীতি ছিল। মেয়ে যখনই বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি চলে যেত তার সঙ্গে দেওয়া হত মিষ্টি আর মাথায় ছোঁয়ানো হত সিঁদুর আর আলতা। এক্ষেত্রে মা দুর্গাও তো পাড়ি দেবেন স্বামীর ঘরে তাই বুঝি এই সিঁদুরদান। আবার তৎকালীন লড়াকু বাঙালীর জাহাজযাত্রা বা যুদ্ধ যাত্রাতেও ঘরের পুরুষ মানুষটিকে বরণ করে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হত। সে হল ক্ষত্রিয়রীতি। স্ত্রী তার সিঁদুরের শক্তি দিয়ে স্বামীকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে পারেন। এমনি ছিল বিশ্বাস।
ভবিষ্যপুরাণ মতে সিঁদুর হল ব্রহ্মের প্রতীক। আবার আমাদের কপাল বা সিঁথি হল ব্রহ্মের স্থান। এয়োস্ত্রীরা সেই ব্রহ্মস্বরূপ সিঁদুর সিঁথিতে ধারণ করে স্বামী ও পরিবারের মঙ্গলকামনা করে। স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা ছাড়াও দশমীর দিন একে অপরকে সিঁদুর পরানো সৌভাগ্যেরই প্রতীক। শ্রীমদ্ভাগবতের একটি ব্যাখ্যা অনুযায়ী কাত্যায়নী ব্রত উপলক্ষে ব্রজের গোপীনিরা নাকি সিঁদুর খেলায় মেতে উঠে একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে আসলে তারা শ্রীকৃষ্ণেরই মঙ্গল কামনা করতেন। শক্তিরূপিনী মায়ের সেই বিজয়ের দিনটিই তো পুরাণে বিজয়াদশমী বলে উল্লিখিত। বিজয়া মানে অশুভের বিনাশে শুভ শক্তির জয়। দেবী দুর্গা আসলে নারীর অন্তরের নিহিত শক্তি, যিনি অসুররূপী অশুভ, অন্যায়, অত্যাচারকে নাশ করে শুভশক্তি ও শুভবোধের জাগরণ ঘটান। সে জন্যই বিজয়া দশমীর দিনটি হল অশুভ ও অন্ধকারের অবসানের দিন, জয়ের দিন, আনন্দের দিন। প্রীতি ও সম্প্রীতির দিন। তাই এই দিনে বনেদী বাড়ির ঠাকুরদালানেই হোক বা পাড়ার মণ্ডপে মহিষাসুরদলনী যে দেবীমূর্তি পূজিতা হচ্ছেন, তিনিই বাঙালির মনে হৈমবতী, হিমালয় কন্যা আদরিনী উমা, স্নেহময়ী জননী আবার অসুরদলনী শক্তি। পুরাণে তিনিই নারীশক্তি এবং অদ্বৈততত্ত্বের প্রতীক। ঋগ্বেদের ‘দেবীসূক্ত’এ দুর্গাই ব্রহ্মস্বরূপিনী, তিনিই প্রকৃতি, তিনিই জগতের একমাত্র অধিশ্বরী। তাঁর সাকার রূপ সীমন্তিনী, তিনি নীলকণ্ঠ মহাদেবের সোহাগিনী স্ত্রী। সিঁদুর তাঁরই শক্তির প্রতীক। নবরাত্রি উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে সিঁদুরখেলা বিজয়ের প্রতীকও। দেবী দুর্গার সামনে সিঁদুর রাঙিয়ে যে প্রথা চলে আসছে এত বছর ধরে তা নিছকই সাধারণ আচার নয়। পুরুষতান্ত্রিক গতে বাঁধা নয়। নির্যাতন, শোষণের দলনে এ হল মেয়েদের একমেবাদ্বিতীয় বিজয়োল্লাস। অস্ত্র-সজ্জায় সজ্জিত মা দুর্গার মূর্তি একদিকে শ্রীবৃদ্ধিকারী মহালক্ষ্মী আর অন্যদিকে সৃজনশীলতা আর জ্ঞানবৃদ্ধির প্রতীক মহাসরস্বতী। এই তিন নারীশক্তির সুদৃঢ় উপস্থিতিতেই তো নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব। আর তাই তো এই দাপুটে সিঁদুরখেলা। আর সেই সিঁদুরখেলার মত্ত-প্রাঙ্গণে পুরুষ ব্রাত্য। মাননীয়া গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের ‘স্ট্রাটেজিক এসএনসিয়ালিজম’-এর তত্ত্ব ধরে আমরা জোর গলায় বলতে পারি যে সিঁদুর আজ হয়ে উঠেছে নারীর স্ব-ক্ষমতায়নের এক অনবদ্য হাতিয়ার।
আর যদি বলি এই মিলনোৎসবের মাধ্যমে পাড়াপ্রতিবেশী বা পারিবারিক ঝগড়াঝাটি এই আচারের মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়া? সেই মেয়েটির সঙ্গে খুচরো মনোমালিন্য সামান্য বন্ধুতার স্পর্শে তার সঙ্গে আগের সম্পর্কটা আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া? সেটিরও জব্বর দাওয়াই কিন্তু এই সিঁদুরখেলা।
আর মায়ের কপালে সিঁদুর ছুঁইয়ে কানে কানে মেয়েরা সেদিন বলেই ফেলে হয়ত “আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে, একটি বিন্দু এঁকো, তোমার ললাটচন্দনে… ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো…” এটুকুনিই কামনা বোধহয় সারাবছরের মত মা দুর্গার কাছে।
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের লেখা , সিঁদুর খেলা কি ও কেন, খুব সুন্দর রচনা। এই খেলা নারীশক্তির জয়গান, তাতে মাতৃ রূপে, জায়া রূপে, কন্যা রূপে পুরুষ দের কাছে ও সমান আনন্দের ও উৎসাহের!
লেখিকা কে অভিনন্দন।
ধন্যবাদ!
খুব ভাল লিখেছ