গায়ত্রী দ্রুতপায়ে দিদির ঘরে ঢুকেই হাতের ‘নাগপুর নিউজ’ পেপারটা বিশাখার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, দিদি, দ্যাখ দ্যাখ, আজকেও একটা চিঠি লিখেছে সেই লোকটা !
বিশাখা টেবিলে বসে একটা ফাইলে কিছু লিখছিলো। মুখটা তুলে ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে বললো, কে, কোন লোকটা রে ? কী লিখেছে ?

  • ওই যে সেই প্রমুখ সুনাওয়ালা রে ! পশুপ্রেমী ! তোর ‘সম্পাদক সমীপেষু’-তে চিঠি বেরোনর পর একটা বিশাল রিজয়েনডার দিয়েছিলো না !
    বিশাখা পেপারটা তুলে নিয়ে দেখলো ‘সম্পাদক সমীপেষু’র পাতাটায় গায়ত্রী একটা চিঠির পুরোটা লাল কালিতে গোল করে মার্ক করে দিয়েছে ।
    এক নজরে চিঠিটা পড়ে নিয়ে বিশাখা কাগজটা পাশে সরিয়ে রেখে বললো, এবার লিখেছে পথশুয়োর নিয়ে ! ইডিয়েট ! আরে তাদের বংশবৃদ্ধির জ্বালায়ও তো বাঁচবার জো নেই । নেহাত রাতের বেলায় তারা রাস্তায় থাকে না, তাই বাঁচোয়া !
  • তুই সুনাওয়ালার এই লেখাটার জবাবে আবার একটা জোরালো চিঠি লিখে দে না ! গতবার তোর চিঠির জবাবে তোকে তো খুব আইপিসি দেখিয়েছিল ! একেবারে জমে যাবে ! গায়ত্রীর উৎসাহিত স্বর।
  • হ্যাঁ: ! রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরদের নির্বীজকরণের কাজটা কিভাবে চারশো আঠাশ আর চারশো উনত্রিশ সেকশন অ্যাট্র্যাক্ট করে তা তো বুঝি না। আমি তো মনে করি রাস্তার কুকুরবাহিনীর মেনাসের হাত থেকে বাঁচার জন্য স্টেরিলাইজেশন একটা প্র্যাকটিক্যাল সলিউশন। আমি শুধু সেটাই লিখেছিলাম। যত্তো সব অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী ! এইসব লেম্যানদের চিঠির জবাবে কিচ্ছু লিখবো না। আর ভবিষ্যতে যদি কাগজে চিঠি লিখিও তাহলে আমার নামের নীচে অ্যাডভোকেট শব্দটা লিখে দেব ভাবছি।
    বিশাখা ফাইলে নোট লিখতে লিখতে বিরক্তির সুরে বললো।
    দিদিকে সুনাওয়ালার চিঠির পালটা চিঠি লেখায় উজ্জীবিত করতে না পেরে গায়ত্রী বোধহয় একটু হতাশ হলো।
  • শোন দিদি, তুই অ্যাডভোকেট লিখলেও কাগজ কিন্তু সেটা এডিট করে বাদ দিয়ে দেবে। পাঠকের চিঠি পাবলিশ করার সময় তাদের প্রফেশনের উল্লেখ করাটা মিডিয়া পলিসিতে নেই ।
    কাগজটা তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে গায়ত্রী বললো।

বিশাখা শিরকে একজন উঠতি লইয়ার।
নাগপুরের ডিসট্রিক্ট অ্যানড সেশন কোর্টে বছর খানেক হলো যেতে শুরু করেছে একজন সিনিয়র অ্যাডভোকেট, নীতিন দেশমুখের চেম্বারে।
স্মার্ট সুন্দরী তরুণী, কথাবার্তায় চৌখস, এককথায় আজকের নারী !
নতুন জুনিয়র প্র্যাকটিস, তাই পড়াশোনাও করতে হয় বেশি।
সব কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে রাত হয় ।
স্কুটি চালিয়ে যখন ফেরে তখন বিশেষ কয়েকটা রাস্তায় কুকুরের দল প্রায়ই ওর স্কুটির পেছনে ধাওয়া করে।
দিন পনেরো আগে এক রাতে একটা কুকুর ওর স্কুটির পেছনে ছুটতে ছুটতে ওর সালওয়ারের কাপড়টা কামড়ে ধরে টান মেরে ছিল।
বিশাখার ভাগ্য ভালো ছিল, হালকা স্কুটি ব্যালান্স হারিয়ে উল্টে যায়নি।
পড়ে গেলে হাড়গোড় ভেঙ্গে একটা বড়ো রকমের অ্যাকসিডেন্ট হতে পারতো।
সেযাত্রা পড়ে না গেলেও অফ-হোয়াইট দামি সালওয়ারটা বিশ্রীভাবে ছিঁড়ে যাওয়ায় বিশাখা ধৈর্য হারিয়ে পরের দিনই নাগপুর নিউজে একটা লম্বা চিঠি লিখে দেয় রাস্তার ক্রমবর্ধমান কুকুরের উপদ্রব নিয়ে।
শুধু সমস্যার কথা নয়, সমাধানের পথ বাতলে দেওয়ার অভিপ্রায়ে বিশাখা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনকে পরামর্শও দেয় পথকুকুরদের ধরে ধরে নির্বীজকরণের একটা স্কিম আশু চালু করার জন্য ।
সে চিঠি প্রকাশিত হওয়ার সাতদিনের মাথায় এই প্রমুখ সুনাওয়ালার একটা কাউন্টার চিঠি প্রকাশিত হয়েছিলো !
তাতে কতো কি যুক্তি, মায় ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ধারা চারশো আঠাশ আর চারশো উনত্রিশ উল্লেখ করে কেন নির্বীজকরণকে ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস বলে গণ্য করা উচিৎ, ইত্যাদি ইত্যাদি । স্বাভাবিক ভাবেই বিশাখা সে চিঠি অবজ্ঞা করার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল…নামি অ্যাডভোকেটের জুনিয়ারের অনেক কাজ থাকে !
বিশাখার পিঠোপিঠি ছোটবোন গায়ত্রী।
বছর খানেক আগে মাস কম্যুনিকেশন পাশ করে এখন টাইমস অফ ইন্ডিয়া নাগপুরের শাখাতে ইন্টার্ন সাংবাদিক…সর্বদাই তাই খবরের খোঁজে থাকে !
নিজের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই অভিনব একটা খবরের অঙ্কুরের সন্ধান পেয়ে উৎসাহিত হয়ে চেয়েছিল দিদি ওই সুনাওয়ালার চিঠি কাউন্টার করে একটা কড়া চিঠি লিখুক ওই কাগজে ।
কিন্তু বিশাখা পত্রযুদ্ধে সামিল হতে একেবারেই উৎসাহ দেখায়নি।
হাতে ওর দুটো ইম্পরট্যান্ট কেসের ব্রিফ তৈরির কাজ ছিল, এখন অন্য দিকে মন দিলে চলবে না ।
আর তাছাড়া ইতিমধ্যে ও ‘সংসার ফ্যাশন মল’ থেকে আগেরটার থেকেও সুন্দর একটা অফ হোয়াইট সালওয়ার কিনে ফেলেছে !
বিশাখাকে উত্তেজিত করতে না পেরে বিফলমনোরথ গায়ত্রী তাই দিদির কাছে মিডিয়া পলিসির ব্যাপারে তার জ্ঞান জাহির করে চলে গেলো ।

বার কাউন্সিলের বাইরের হলটাতে একেবারে থিকথিক করছে ভিড়।
এই অ্যানুয়াল জেনারাল বডি মিটিংটা অ্যাডভোকেটরা প্রায় কেউই মিস করতে চায় না।
মিটিংয়ের অ্যাজেন্ডা আর ফাইনাল সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সদস্যদের যতো না আগ্রহ সম্ভবত লাঞ্চের মেনুর প্রতি তাদের নিষ্ঠা সমধিক।
পাশের অডিটোরিয়ামে মিটিং এখনও শুরু হয়নি।
এই হলে চা-কফি আর স্ন্যাক্সের পর্বের সঙ্গে সকলেই বিশ্রম্ভালাপে ব্যস্ত ।
বিশাখা হলের এক কোণে তারই মতো কিছু জুনিয়র অ্যাডভোকেটের সঙ্গে গল্প করছিলো।
প্রফেশন লাইফের শুরুতে এটা তার প্রথম এজিএম মিটিং।
এই দিনটা বেশ পছন্দ হয়েছে তার। রোজকার কালো কোট আর সাদা কলার ব্যান্ডের বালাই নেই।
তাই এই স্পেশাল দিনে বিশাখা একটু সাজগোজ করে একটা পছন্দসই ভালো শাড়ি পরে এসেছে।
বিশাখা খুব যে একটা টানটান রূপসী তা নয়।
কিন্তু ভিড়ের মধ্যেও আলাদা করে চোখে পড়ার মতো একটা বিশেষ সৌন্দর্য আছে তার।
কথা বলতে বলতেই বিশাখার মনে হলো তার নাম ধরে পুরুষকণ্ঠে কেউ যেন ডাকছে।
পিছনে তাকাতেই দেখলো তার সিনিয়র দেশমুখ স্যার তাকে ইশারা করে ডাকছেন।
বিশাখা তাড়াতাড়ি কাছে যেতেই দেশমুখ পাশে দাঁড়ানো এক সুদর্শন যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই হচ্ছে বিশাখা, বিশাখা শিরকে, আমার জুনিয়র। এই এক বছর হলো কোর্টে বেরোচ্ছে । আর বিশাখা, এ হচ্ছে, প্রমুখ সুনাওয়ালা, নাগপুরেই বাস ওদের, তোমার থেকে কিছুটা সিনিয়র। নাসিকে নিজের প্র্যাকটিস করতো, পারিবারিক কারণে নাগপুরে ফিরে আসতে হয়েছে। গত সপ্তাহে বারে এনরোল করেছে, এখন থেকে আমাদের টীমে কাজ করবে ।
দেশমুখ স্যারের কথা শুনে আর প্রমুখ সুনাওয়ালাকে দেখে বিশাখা এক মুহূর্তের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে গেলো…কাগজের পাতার প্রমুখ সুনাওয়ালা রক্তমাংসের একজন রূপবান মানুষ হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে…সে-ও লইয়ার…আবার সে এখন আমার কলিগ হয়ে যাবে !
বিশাখার ভাবান্তরটা নিশ্চয়ই তার মুখেচোখে বিশেষ ফোটেনি, তাই সামনে দাঁড়ানো দুজনের কেউই খেয়াল করলো না ।
প্রমুখ তার মুখে হাসির ভাব ফুটিয়ে বললো, হ্যালো বিশাখা ।
বিশাখা সামলে নিয়ে বললো, হ্যালো ! তারপর একটু হেসে বললো, আমি তো ভেবেছিলাম, আপনি বেশ বয়স্ক মানুষ হবেন !
দেশমুখ অবাক হয়ে বললেন, তোমরা দুজনে পরস্পরকে চেনো না কি ?
বিশাখা বললো, ওঁর নামে চিনি স্যার। উনি একজন পশুপ্রেমী ! ঘোরতর অ্যাকটিভ। নিউজ পেপারে রাস্তার পশুদের নিয়ে প্রায়ই লিখে থাকেন, কনসামেট অ্যানিম্যাল অ্যাকটিভিস্ট !
নীতিন হেসে বললেন, তাই নাকি, প্রমুখ !
বিশাখার কথা শুনে সুনাওয়ালার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, ওহ ! আপনিই সেই বিশাখা শিরকে ! রাইট ? তাই স্যারের মুখে নামটা শুনে মনে হচ্ছিলো এই নামটা যেন আমার চেনা, কোথাও পড়েছি বা শুনেছি !
তারপর হাসতে হাসতে বললো, আরে আমি যদি কনসামেট অ্যানিম্যাল অ্যাকটিভিস্ট হই তাহলে আপনি তো একজন অ্যানিম্যাল স্টেরিলাইজেশন এক্সপার্ট ! হা হা হা !
বিশাখার বেশ রাগ হলো…’লোকটা কি রকম মুখ-আলগা রে বাবা ! স্থান কাল পাত্রের ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান নেই’…রাগের সঙ্গেই লক্ষ্য করলো হাসলে লোকটাকে আরও সুন্দর দেখায় !
ও জবাবে কিছু বলতে যাবে এমন সময় দেশমুখ বললেন, সেটা আবার কি !
বিশাখা তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, ও কিছু নয় স্যার !
সুনাওয়ালা হাসতে হাসতেই বললো, আমি বলছি স্যার । মিস বিশাখার সঙ্গে আমার কিছুদিন আগে নাগপুর নিউজ কাগজে একটা হালকা পত্রযুদ্ধ হয়েছিলো, রাস্তার কুকুরদের নিয়ে । তাতে আমি…
বিশাখা এবার বাড়তি রাগটা চেপে প্রমুখের কথার মধ্যেই বলে উঠলো, সেখানে উনি রাস্তার কুকুরদের স্টেরিলাইজেশন করা নিয়ে রংলি সেকশন চারশো আঠাশ আর চারশো উনত্রিশের কথা লিখেছিলেন, যেটা আদৌ অ্যাপলিকেবল নয় ।
প্রমুখ বললো, ওয়ান মিনিট, ওয়ান মিনিট, ইফ আই কারেক্টলি রিকল, আমি ওই দুটো সেকশন ইন্টারপ্রিট করার কথা লিখেছিলাম মাদাম। অনেক সময়ই পার্টিকুলার সেকশনের ইন্টারপ্রিটেশন আইনের জন্য নতুন রাস্তা খুলে…
প্রমুখের কথার মধ্যেই তীব্রস্বরে একটা কলিংবেল বেজে উঠলো পাশের অডিটোরিয়াম থেকে, মিটিং শুরু হবার আবাহন সংকেত ।
নীতিন দেশমুখ বললেন, চলো, চলো, মিটিঙয়ের বেল বেজে গেলো। এখন তর্ক থাক, চেম্বারে হেলদি তর্ক করার অনেক সময় পাবে । প্রমুখ, আজ তুমি আমার পাশে বসবে। অ্যাজ মিটিং প্রসিডস, আমি তোমাকে মঞ্চে-বসা কাউন্সিলের অফিস বেয়ারারদের খুঁটিনাটি পরিচয় দিতে পারবো। কাউন্সিলে তুমি নতুন, ওটা জেনে রাখা তোমার জন্য জরুরী ।

লাঞ্চে ব্যুফের ব্যবস্থা ।
লাইনে দাঁড়িয়ে বিশাখা পছন্দসই খাবারগুলো প্লেটে নিয়ে খুঁজেপেতে কোণের দিকে একটা খালি টেবিল পেয়ে বসে পড়লো ।
বার কাউন্সিলের এজিএম মিটিং-এর মূল অ্যাজেন্ডা ওর কাছে বিশেষ ইন্টারেস্টিং লাগেনি।
কোর্টের অ্যাডমিনিসট্রেশন কিভাবে চলবে, কোন কেস কোন জাজের কাছে যাবে, কজলিস্ট অন্তত তিনদিন আগে নোটীফাই করা উচিৎ, এসব কচকচি নিয়ে মাথা ঘামাবার বয়স বা অভিজ্ঞতা কিছুই তার হয়নি।
তাই ওপর ওপর সব বক্তৃতা শুনে আর কাউন্সিলের অডিট রিপোর্টে ভাসা ভাসা চোখ বুলিয়ে সময়টা ও কাটিয়ে দিয়েছে ।
মাঝে মাঝে ফোনে তিন-চারটে মেসেজের জবাবও দিয়েছে।
তার মধ্যে আবার কাউন্সিলের নতুন মেম্বারদের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো।
অন্য নতুন মেম্বারদের সঙ্গে প্রমুখ সুনাওয়ালাও হাত উঠিয়ে অডিয়েন্সের হাততালির মধ্যে দাঁড়িয়ে উঠে ঘুরে ঘুরে নমস্কার করলো।
বিশাখা যখন ভাবছিলো ওর ভাগ্য ভালো যে দেশমুখ স্যার ওকে ওঁর পাশে বসতে বলেননি।
ঠিক সেই সময় পাশ থেকে আওয়াজ এলো,

  • আমি কি এখানে বসতে পারি ?
    মুখটা ফিরিয়ে বিশাখা দেখলো সুনাওয়ালা দাঁড়িয়ে, একহাতে খাবারের প্লেট আর অন্য হাতে দুটো ছোট জলের বোতল।
    -‘এ তো দেখছি এখানেও এসে হাজির হয়েছে ! দূর…খাওয়াটা মাটি হলো ! অপরিচিত মানুষের সামনে ঠিকঠাক খাওয়া যায় না কি !’
    মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে বিশাখা বললো, হ্যাঁ, বসুন না !
    প্রমুখ সুনাওয়ালা বিশাখার মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে থ্যাঙ্ক ইউ বলে বসে পড়লো ।
    হাতের প্লেটটা নামানোর পর একটা জলের বোতল বিশাখার প্লেটের পাশে ঠক করে রেখে বললো, দিস ইজ ফর ইউ মাদাম !
    বিশাখা মুচকি হেসে বললো, আপনি কি আমাকে জলের বোতল দেওয়ার জন্য এখানে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন ?
    বিশাখার গলার স্বরে ঠাট্টার আভাসটা সুনাওয়ালার না বোঝার কথা নয়।
    কিন্তু প্রমুখ সুনাওয়ালা একটু অপ্রতিভ না হয়ে বললো, ইন ফ্যাক্ট, ইয়েস ! আমি তো আপনাকে খুঁজছিলাম। তবে জলের বোতলের জন্য নয়। ওটা হচ্ছে কোল্যাটারাল বেনিফিট…ফর ইউ !
  • আমার আরও কিছু বেনিফিট আছে না কি ! ওই আউট অফ বক্স ইনটারপ্রিটেশন অফ আইপিসি ফোর টোয়েনটি এইট এন্ড ফোর টোয়েনটি নাইন ?
    বিশাখার গলায় এখনও ঠাট্টার সুর।
  • ওঃ ফরগেট ইট ! আপনার এই ঝগড়া করার ফাঁদে আমি পা দেবো না মাদাম শিরকে ! তখন আপনার একটা কথা শুনে আমার কৌতূহল হয়েছে, সেটাই ক্ল্যারিফাই করার জন্য আপনাকে খুঁজছিলাম ।
  • কি কথা ? বিশাখা সামান্য কৌতূহলী হলো।
    প্রমুখ চারপাশটা একবার দেখলো। তারপর একটু সামনে ঝুঁকে গলার স্বর নামিয়ে বললো, ওই যে আপনি তখন বললেন না খবরের কাগজে আমার চিঠিটা পড়ে আপনি গেস করেছিলেন প্রমুখ সুনাওয়ালা একজন বয়স্ক মানুষ । ওইটা কেন ভেবেছিলেন মাদাম ? প্রমুখের ঠোঁটের কোণে যেন হালকা হাসি।
    বিশাখা হাসলো, ওঃ এই ব্যাপার !
    তারপর একটু থেমে হাসিমুখে বললো, দেখুন আমার তো মনে হয়, বয়স বাড়লে কোন মানুষ ধীরে ধীরে যখন তার চারপাশের মানুষের ওপরে আস্থা হারাতে থাকে তখন পশুপাখির ওপর তাদের নজর বেশি করে পড়তে শুরু করে । এটা অবশ্য সব বয়সেই হতে পারে, আর আমার এই ফ্যালাসি যে কারেক্ট তা-ও আমি বলছি না।
    প্রমুখ বোঝার মতো করে মাথা নাড়লো, হুম, ইনটারেসটিং ! বুঝলাম।
    তারপর একটু থেমে বললো, তারপর যখন দেখলেন আপনার আগের ভাবনাটা ভুল ছিল, তখন আমাকে দ্যাখার পর কিরকম নতুন ভাবনা আপনার মনে এলো ?
    বিশাখা প্রমথ সুনাওয়ালার মুখের দিকে তাকালো…’ব্যাপারটা কি লোকটার…দেখতে শুনতে ভালো বলে গর্ব আছে মনে হচ্ছে’…
    মুখে হাসির ভাব করে বললো, আপনার এ প্রশ্নের উত্তর তো আমার কাছে নেই। বয়সের আন্দাজটা আমার ভুল হয়েছিল, ব্যস ওইটুকুই।
  • কিন্তু আমার ভাবনায় তো বিশেষ ভুল নেই মাদাম। আপনার সেই চিঠি পড়ার দিনই ভেবে রেখেছিলাম, যদি এই বিশাখা শিরকে মহিলা রাস্তার কুকুরদের ব্যাপার নিয়ে কোনদিন কর্পোরেশনের এগেন্সটে পি আই এল করেন তাহলে আমি নিশ্চয়ই বিবাদী পক্ষের হয়ে লড়বো !
  • আর সে মামলায় যদি চারশো আঠাশ আর চারশো উনত্রিশ নিয়ে মাতামাতি করে সওয়াল করতেন তাহলে ডাহা হারতেন ! কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে সেটাও আর সম্ভব নয়।
    একথা বলে বিশাখা মুচকি হাসলো।
    প্রমুখ বিশাখার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে বললো, কেন ? কেন সম্ভব নয় বলে আপনার মনে হচ্ছে জানতে পারি কি ?
    বিশাখা ছদ্মচিন্তার ভাব মুখে ফুটিয়ে বললো, অবশ্য একই ফার্মে কাজ করে কলিগ লইয়ারের বিপক্ষে কেস লড়াটা কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট-এর আওতায় পড়ে কি না আমার ঠিক জানা নেই, দেশমুখ স্যারকে জিজ্ঞেস করতে হবে ।
    বলেই বিশাখা প্রমুখকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাসিমুখে হাতে প্লেটটা নিয়ে চেয়ার ঠেলে ওঠবার উপক্রম করে বললো, এক্সকিউজ মি !
    তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, থ্যাঙ্ক ইউ ফর দি কম্পানি। গুড ডে, মিঃ সুনাওয়ালা । সি ইউ !
    বিশাখার এই ফরম্যাল ভাবের ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। সুনাওয়ালা উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু বিশাখার সঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করলো না। একদৃষ্টে বিশাখার চলে যাওয়া দেখতে লাগলো।

এর পরে প্রায় ছমাস সময় দেশমুখ স্যারের ল-ফার্মে একরকম নির্ঝঞ্ঝাটে কেটে গেল।
ইতিমধ্যে জগতের স্বাভাবিক নিয়মে আইন ব্যবসার দুই নব্য সার্থবাহ পরস্পরকে সম্বোধনের ঔপচারিকতার দায় শিথিল করে ‘তুমি’-র পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে।
এতে দ্বিপাক্ষিক সবরকম আলোচনা নিরঙ্কুশ আবহাওয়ায় সুষ্ঠুভাবে চলছে।
এমনই এক দিন সোমবার সকালে নিজের চেম্বারে শ্রী নীতিন দেশমুখ একটু চিন্তিতভাবে ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পায়চারি করছেন ।
চিন্তার কারণ হচ্ছে কোর্টের সময় হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রমুখ এখনও এসে পৌঁছায়নি। আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কেসে দেশমুখ স্যারকে অ্যাসিস্ট করার কথা আছে তার।
নীতিনের নির্দেশে বিশাখা একটু আগেই প্রমুখকে ফোন করেছিলো, কিন্তু ওর মোবাইল স্যুইচড অফ !
দুজনেই কিছুটা অবাক এবং সামান্য চিন্তিতও বটে।
প্রমুখ তার মোবাইল কখনও স্যুইচ অফ করে না।
আর তাছাড়া ওর বেশ ভালোরকম দায়িত্ববোধ আছে।
কোন এমারজেন্সীতে আটকে পড়লে ও নিশ্চয়ই ফোন বা মেসেজ করে সেটা জানিয়ে দিতো ।
ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজার পর দেশমুখ আর অপেক্ষা করতে পারলেন না।
ব্রীফকেসটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, আর অপেক্ষা করা চলবে না, কোর্ট অ্যাটেনডেন্সে দেরি হয়ে গেলে খুব মুশকিল হবে। বিশাখা ওঠো, অন্য ব্রিফ থাক এখন, তুমি চলো আমার সঙ্গে। বনমালীকে বলো চেম্বার বন্ধ করে দিতে ।
বিশাখা অবাক হয়ে বললো, আমি যাবো স্যার ! আমি তো এই কেসটার প্রায় কিছুই জানি না ।

  • সে আমি গাড়িতে যেতে যেতে জিস্টটা বলে দেবো, কাগজগুলোও দেখিয়ে দেবো । তাছাড়া আমি শিওর আজ আমার আর্গুমেন্টের পরে অন্য পার্টি নিশ্চয়ই ডেট চাইবে। এখন চলো তো তাড়াতাড়ি, দেরি হয়ে যাচ্ছে । দেশমুখ ঘরের বাইরে যেতে যেতে বললেন।
    চেম্বারের পিওন বনমালী ঘরের বাইরে একটা টুলে বসে ছিল। এদের দেখে ঝটিতি দাঁড়িয়ে পড়লো। নীতিন হনহন করে এগিয়ে গেলেন। বিশাখা বনমালীকে চেম্বার বন্ধ করতে বলে প্রায় ছুটে নীতিনের সঙ্গ ধরলো।

মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠতেই বিশাখা সাবধানে ওটাকে টেবিলের নীচে নিয়ে দেখলো প্রমুখ ফোন করছে ।
একবার ও তাকালো নীতিন স্যারের দিকে…দাঁড়িয়ে আর্গুমেন্ট করছেন । বিশাখা খুব তাড়াতাড়ি মেসেজ করলো…কোর্টে আছি, আর্গুমেন্ট চলছে, রিসেসে ফোন করছি ।
মেসেজটা লিখেই বিশাখা ফোনটা কেটে দিলো।
কোর্টরুমের মধ্যে পরের পনেরো মিনিট সময় বিশাখা বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটালো…’প্রমুখের নিশ্চয়ই কোন এমারজেন্সি সিচুয়েশন হয়েছে…তাই আজ আসতে পারলো না…এমন কি না আসতে পারার কথাটা পর্যন্ত ঠিক সময়ে স্যারকে জানাতে পারেনি…কি এমন হতে পারে…বাড়িতে সিনিয়র কারুর দারুণ মেডিক্যাল এমারজেন্সি ? ওর কি তাঁকে হসপিট্যালে নিয়ে যেতে হয়েছে ? কিংবা অন্য কিছু এমারজেন্সি ? কি হতে পারে ? নাহ, কিছু তো ভেবে পাচ্ছি না’…প্রমুখের ফোনটা আসার পর বিশাখা বেশ অস্থির বোধ করতে লাগলো ।
আর এই সব ভাবনার মধ্যেই বিশাখা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলো প্রমুখের ভালমন্দ কোন কিছু হয়েছে কি না এই চিন্তাটাও কিভাবে কখন তার মনটা জুড়ে বসেছে !
তার সচেতন মনে ভাবনার গতির এই প্রকৃতি অনুভব করে সে অবাক হলো। আবার অবচেতনে কোথাও যেন একটা অজ্ঞাতপূর্ব আনন্দের অনুভূতি রিনরিন করে বাজতে থাকলো।
প্রমুখের কল আসার পরে কোর্টের কথাবার্তা প্রায় কিছুই তার মাথার মধ্যে ভালোভাবে ঢুকলো না।
কেবল জজসাহেব যখন হাতুড়ি ঠুকে আগামী শুনানির একটা দিন ঘোষণা করে উঠে পড়লেন তখন ও হাঁফ ছেড়ে সকলের সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো ।
নীতিন দেশমুখ ব্রিফকেসটা তুলে নিয়ে বললেন, বিশাখা আমি লাইব্রেরিতে যাচ্ছি। তুমি এখন কি করবে…চেম্বারে গিয়ে হাতের কাজগুলো শেষ করো। গাড়ি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসছে।
বিশাখা ঘাড় নেড়ে বললো, স্যার, প্রমুখের ফোন এসেছিলো ।
নীতিন বললেন, ওহ তাইতো ! প্রমুখের কথাটা মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গিয়েছিলো ! কি ব্যাপার ওর ? আজ আসতে পারলো না কেন ?
বিশাখা বললো, কথা হয়নি স্যার। কোর্টে শুনানি চলার সময় ফোনটা এসেছিলো, তাই ধরতে পারিনি। মেসেজ করেছিলাম, এখন কথা বলবো।

  • ঠিক আছে । কি হয়েছিলো আমাকে লাইব্রেরীতে জানিয়ে তারপর চলে যেও।
    দেশমুখ লাইব্রেরীর দিকে চলে গেলেন ।
    বিশাখা করিডরে বেরিয়ে মোবাইলে প্রমুখের নম্বরটা ট্যাপ করলো।
    দুবার রিং হবার পরই প্রমুখের গলার আওয়াজ ভ্বেসে এলো।
  • হ্যালো বিশাখা ! আজকের কেসটার নতুন ডেট পাওয়া গেছে ?
    বিশাখার শুনে মনে হলো প্রমুখের গলার স্বরে স্বাভাবিক প্রফুল্লতাটা নেই।
    ও বলে উঠলো, সে তো পাওয়া গেছে, সামনের সোমবারের পরের সোমবার। তুমি আজ এলে না কেন…তুমি এখন কোথায়…বাড়ি থেকে কথা বলছো ?
    বিশাখার একঝাঁক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে প্রমুখ বললো, ওহো ! চোদ্দ দিন পরে ডেট ! তাহলে আমি তো সেদিনও থাকতে পারবো না ! বিশাখা, তুমি তাহলে কেস ফাইলটা নিয়ে আমার সঙ্গে এখন দেখা করবে ? আমি তাহলে তোমাকে পুরো কেসটা ব্রিফ করে দেবো ।
    বিশাখা প্রমুখের কথায় যৎপরোনাস্তি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার বলো তো ? কি বলছো ? তুমি থাকতে পারবে না মানেটা কি ? তুমি কোথায় আছো ?
    ফোনের ওপারে কোন জবাব নেই । বিশাখার স্বর এবার বেশ উৎকণ্ঠিত, কি হলো প্রমুখ, তুমি কোন কথা বলছ না কেন ?
    এবার প্রমুখ বললো, বিশাখা, আমার একটা ছোট অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে আজ সকালে, ওই চেম্বারে আসার সময়ই ।
  • সে কি ! কোথায় ? কেমন করে ? তুমি কোথায় এখন প্রমুখ ?
    উদ্বেগে বিশাখার গলার স্বর কেঁপে গেলো ।
    ফোনে প্রমুখ যেন সামান্য হাসবার চেষ্টা করলো, চিন্তা কোরো না, আমি একদম ভালো আছি । তুমি তো কোর্টে আছো, স্যারকে খবরটা দাও। বোলো আমি পরে বাড়িতে ফোন করে নেবো ।
  • কিন্তু কি করে হলো অ্যাকসিডেন্ট প্রমুখ ? কোথায় চোট লেগেছে?
    বিশাখার স্বর এখনও কেঁপে যাচ্ছে, হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত ।
  • ওই ব্যালান্স টাল খেয়ে বাইক শুদ্ধু পড়ে গিয়েছিলাম। পায়ের ওপর বাইকটা পড়ে গিয়ে ডান পায়ের পাতাটায় বেশ চোট লেগেছে। এক্স-রে বলছে দুটো আঙুলের হাড় ভেঙ্গেছে । তিন সপ্তাহের জন্য প্লাস্টার করে দিয়েছে । তাই তো বললাম, নেক্সট শুনানিতেও স্যারকে অ্যাসিস্ট করতে পারবো না । তুমি যদি এখন ফাইলটা নিয়ে আসো তাহলে আমি তোমাকে ব্রিফ…
    প্রমুখের কথার মধ্যেই বিশাখা অধৈর্যস্বরে বলে উঠলো, সে হবেখন। তুমি এখন কোথায় আছো…বাড়িতে না হাসপাতালে ?
  • ওই যে…কি যেন…হ্যাঁ, মেয়ো হাসপাতালে… লোকেরা রাস্তা থেকে তুলে আমাকে এখানে…তুমি যদি ফাইলটা নিয়ে আসো…
  • হ্যাঁ, জানি জানি, মোমিনপুরায়, মেয়ো হাসপাতাল । আমি স্যারকে জানিয়ে এক্ষুণি আসছি । এখান থেকে গাড়িতে দশ মিনিট লাগবে । এখন ফোনটা রাখো।
    ফোন কেটে দিয়ে বিশাখা দ্রুত বার লাইব্রেরির দিকে হাঁটতে থাকলো।

বার লাইব্রেরির বড়ো হলটা একেবারে নিস্তব্ধ।
ওপেন অফিসের মতো ছোট ছোট কিউবিক্যালে সিনিয়র জুনিয়র অ্যাডভোকেটরা সব মোটা মোটা জার্নালের আড়ালে প্রায় অদৃশ্য হয়ে রয়েছে।
বিশাখা খুঁজে খুঁজে নীতিন দেশমুখকে দেখতে পেয়ে তাঁর পিছনে গিয়ে প্রায় ফিসফিস করে ডাকলো, স্যার !
দেশমুখ ঘাড় গুঁজে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা জার্নাল পড়ছিলেন।
বিশাখা দ্বিতীয় বার ডাকতে মুখটা তুলে বললেন, ও বিশাখা ! বলো।

  • স্যার, আজ সকালে প্রমুখের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
    বিশাখা খুব নীচুস্বরে বললো।
    নীতিন দেশমুখ স্থানকাল ভুলে বেশ জোরগলায় বলে উঠলেন, সে কি !
    তারপর চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, কোথায় হয়েছে ? কি রকম অ্যাকসিডেন্ট ? প্রমুখ ঠিক আছে তো ? তখন তোমাকে নিজে ফোন করেছিলো ? আমাকে ডিটেলসে বলো। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বোসো তো আগে, বোসো ।
    দেশমুখ পরপর অনেকগুলো প্রশ্ন করে তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে কলমটা তুলে নিয়ে মোটা জার্নালটার ভেতরে গুঁজে সেটা বন্ধ করলেন।
    বিশাখা নীচু গলায় ফোনে যা শুনেছিলো পুরোটাই নীতিন স্যারকে বললো।
    এমন কি অ্যাসিস্ট করার ব্যাপারে প্রমুখ যে কথা বলেছিল সেটাও বললো।
    কথা শেষ করে বিশাখা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, স্যার আমি একবার তাহলে হাসপাতাল ঘুরে তারপর চেম্বারে চলে যাই ?
  • হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই ।
    বিশাখা থ্যাংকস স্যার বলে ঘুরে এগোতে যাবে, নীতিন দেশমুখ অনুচ্চকণ্ঠে পেছন থেকে ডাকলেন, বিশাখা, শোনো ।
    বিশাখা সামনে এগিয়ে আসতে নীতিন বললেন, হসপিটালে যাচ্ছো তো, কিছু ফুল নিয়ে যেও, প্রমুখের ভালো লাগবে ।
    নীতিন স্যারের কথাটা শুনে বিশাখা চমৎকৃত হলো।
    ফুল নিয়ে প্রমুখকে দেখতে যাওয়ার ব্যাপারটা ও তো আগেই ভেবে রেখেছিলো। এখন নীতিন দেশমুখের অভিভাবক-বন্ধুসুলভ পরামর্শ শুনে বিশাখার ভারি ভালো লাগলো।
    ও ঘাড় নেড়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলো ।

ফুলের দোকান থেকে হলুদ গোলাপের একটা তোড়া কিনলো বিশাখা।
সেশন কোর্ট থেকে মেয়ো হাসপাতাল খুব জোর তিন কিলোমিটার হবে ।
হাসপাতালে ঢুকে রিসেপশনে জিজ্ঞাসা করে প্রমুখের রুমে ঢুকে দেখলো, চিত হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে প্রমুখ।
পরনে হাসপাতালের নীল গাউন আর পাজামা, ডানপায়ে প্লাস্টার আর দুহাতের কনুইয়ে ব্যান্ডেজ করা।
বিশাখা বুঝতে পারলো না প্রমুখ ঘুমোচ্ছে কি না…আমি কি ওকে ডেকে তুলবো, উচিৎ হবে কি সেটা!
খাটের পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে বিশাখা এইরকম ভাবছে এমন সময় প্রমুখের চোখ খুলে গেলো।
চোখ খুলে পায়ের কাছে বিশাখাকে দেখেই ওর সেই সুন্দর হাসিটা হেসে তাড়াতাড়ি উঠে বসে ইঙ্গিত করলো ঘরের কোণায় রাখা চেয়ারটার দিকে।
বিশাখা খাটের পাশের উঁচু টেবিলটায় ফুলের তোড়াটা সাবধানে শুইয়ে রেখে চেয়ারটা টেনে খাটের পাশে গিয়ে বসলো। তারপর বললো, কেমন আছো এখন ? কি করে পড়ে গেলে বাইক থেকে ?
প্রমুখ দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে বললো, একদম ভালো আছি । দুটো কনুইয়ের উন্ড সুপারফ্লুয়াস, ও দুদিনেই শুকিয়ে যাবে। ডান পায়ের দুটো আঙুল ক্র্যাক করে গেছে, রয়েল এনফিল্ড বুলেট পড়েছে তো, প্রায় দুশ কেজি ওজন ! বলে হাসলো।


তারপর বললো, প্লাস্টার তো একুশ দিনে খুলবে, তাই তোমাকে বলছিলাম…
বিশাখা বললো, তা তোমাকে তো এমারজেন্সি থেকেই ছেড়ে দিতে পারতো, ভর্তি করে নিয়েছে কেন ?

  • না, হেলমেটটাও তো ভেঙ্গে গেছে তাই ডাক্তার বলেছেন একটা স্ক্যান করে নিশ্চিত হতে হবে যে মাথায় কোন ইন্টারনাল ইনজুরি নেই । আমার অবশ্য তার কোন সিম্পটম নেই ডাক্তার বলে গেলেন। আজকেই স্ক্যান করবে । স্ক্যানের রিপোর্ট ঠিক থাকলে কাল নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবে । আরে তুমি তো কেসের ফাইলটাই আনোনি দেখছি…তোমাকে অতো করে বলে দিলাম…প্রমুখ থেমে গেলো।
    প্রমুখ যতক্ষণ কথা বলছিলো বিশাখা একদৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
    মনের তোলপাড় তার মুখের ভাবে ফুটে ওঠেনি ।
    সেভাবেই একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বিশাখা নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করলো, কেস ব্রীফ করার জন্যই কি তুমি আমাকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে ডাকছিলে প্রমুখ ?
    বিশাখার প্রশ্নটা শুনে প্রমুখ বিশাখার চোখে চোখ রেখে এক মুহূর্ত চুপ করে রইলো। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, না, তা বোধহয় নয় ।
  • ‘বোধহয়’ নয় ! তাহলে কি জন্য আসতে বলছিলে বলে মনে হয় তোমার ?
    এবার দৃষ্টি বিশাখার মুখের ওপর ফিরিয়ে এনে প্রমুখ ধীরে ধীরে বলল, তুমি এখানে, এই হাসপাতালে, আমাকে দেখতে এলে আমার বোধহয় ভালো লাগবে, এইটা ভেবেছিলাম ।
    তারপর একটু জোর দিয়ে বললো, বোধহয় কেন, এটাই ভেবেছিলাম বিশাখা।
  • আমি জানি । বিশাখার সংক্ষিপ্ত উত্তর ।
  • তুমি জানো ! বিশাখা, তুমি আর কি কি জানো, আমাকে বলবে ?
    প্রমুখের গলার আওয়াজ এবার বেশ উৎফুল্ল।
    বিশাখা প্রমুখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে প্রশ্নের জবাব দিলো না।
    প্রমুখ একটু চুপ করে থেকে বললো, ওকে ! বোলো না ! এনি ওয়ে, মেনি থ্যাংকস ফর দি ফ্লাওয়ারস। বোধহয় তোমাকে আগে বলেছিলাম হলুদ গোলাপ আমার খুব পছন্দের…ইট ইন্ডিকেটস ডিপ ফ্রেন্ডশিপ ! তুমি মনে রেখেছো, থ্যাংকস এগেন !
    বিশাখা এবার প্রমুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো এক মুহূর্ত, তারপর বললো, স্যার বললেন, ফুল নিয়ে যাও। প্রমুখের ভালো লাগবে ।
  • ওহ, তাই ! প্রমুখ চুপ করে গেলো।
    এক মুহূর্ত পরে বললো, এবার আমি একটা কথা বলি ? স্যার না বললে তুমি কি ফুল নিয়ে আসতে না, বিশাখা ?
    বিশাখা এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললো, তুমি কিন্তু এখনও আমাকে বলোনি, কি করে অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটালে ! বাইক থেকে পড়লে কি ভাবে ?
    প্রমুখ বিশাখার চোখে চোখ রেখে একটু হাসলো ।
    তারপর হাসিমুখেই উদাস গলায় বললো, এটা বোধহয় দেবী থেমিস আমাকে আমার অপরাধের শাস্তি দিলেন বিশাখা ! আমি তাঁর কাছে দুটো ধারায় অভিযুক্ত হয়ে আমার প্রাপ্য এই শাস্তি !
  • আইনের দেবী নিজে তোমাকে শাস্তি দিলেন ! তাও দুটো ধারায় ! কি ব্যাপারে ? কেন ? বিশাখা প্রমুখের কথা শুনে বেশ অবাক ও কৌতূহলী হয়ে গেলো ।
  • তুমি ঠিকই লিখেছিলে ! রাস্তার কুকুরদের সংখ্যা যেভাবে বেড়ে চলেছে একটা সলিড কিছু করা অত্যন্ত জরুরী ।
  • তার মানে !
  • বিশাখা, আজ সকালে চেম্বারে আসার সময় দু-তিনটে কুকুর আমার বাইকের পেছনে ফেরোশাসলি তাড়া করেছিলো। আমি বাইক সামলাতে না পেরে দারুণভাবে পড়ে গিয়েছিলাম। আমাকে পড়ে যেতে দেখে অবশ্য ওরা আর তেড়ে আসেনি ।
    বিশাখা কয়েক মুহূর্ত একদৃষ্টে প্রমুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠেই সামলে নিয়ে বললো, সরি সরি, হাসপাতালের মধ্যে এভাবে হেসে ওঠাটা আমার উচিৎ নয়। ভেরি সরি ! তার ওপর আবার কুকুরের তাড়া খেয়ে পড়ে গিয়ে তোমার পায়ের দুটো আঙ্গুল ক্র্যাক হয়েছে…হাতে চোট লেগেছে… মাথায় কি হয়েছে কে জানে…আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি।
    সরি বললো বটে কিন্তু বিশাখার ঠোঁটের কোণে একটা দুষ্টু হাসি ঝুলেই রইলো !
    ছমাস কেটে গিয়ে পরিচয় কিছুটা ঘন হয়েছে, কিন্তু প্রমুখ কখনও বিশাখাকে এমন প্রাণোচ্ছল হাসি হাসতে দেখেনি।
    হোক না সে হাসি কয়েক সেকেন্ডের জন্য…সে মুগ্ধচোখে বিশাখার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
    কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো এইভাবে ।
    প্রমুখের ভাব দেখে বিশাখা আবার হাসতে হাসতে প্রমুখের চোখের সামনে হাতটা নেড়ে নেড়ে বললো, এই যে মিঃ কন্সামেট পশুপ্রেমী ! এবার কি ? চারশো আঠাশ আর চারশো উনত্রিশের ভুল ব্যাখ্যার শাস্তি তো হয়েছে ! তাহলে পিআইএল হবে তো ?
    প্রমুখের সম্বিত ফিরে এলো।
    সে-ও হাসতে হাসতে বললো, বিবাদী অ্যাডভোকেট উইথড্রস…প্লেনটিফ উইন্স !
  • আর দেবী থেমিসের অভিযোগের দ্বিতীয় ধারাটা কি ?
  • তোমার কথার গুরুত্ব না বুঝে কাগজে রিজয়েন্ডার দেওয়া।
    বলে প্রমুখ যেন একটু চিন্তিত ভাবেই বললো, কিন্তু সে ব্যাপারেই তো একটা আসল খটকা রয়েছে !
  • কি ব্যাপারে খটকা ? বিশাখার মুখ থেকে হাসি এখনও মিলিয়ে যায়নি ।
  • ওই যে তোমার কথা না শোনার কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট ! তোমার প্রথম চিঠির উত্তরে আমার রিজয়েন্ডার ! সেটা একটা কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট !
  • সে আবার কি !
    প্রমুখ ছদ্ম-সিরিয়াস স্বরে বললো, তাই তো ! কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট আরও আছে ! একই ল-ফার্মে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কাজ করলেও কি কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট হবে ! এটাও তো দেশমুখ স্যারই ঠিক করবেন, তাই না ? তুমি কি বলো ?
    এ প্রশ্নের উত্তরে বিশাখা কি বলবে !
    তার সমস্ত উকিলি স্মার্টনেস লাল রঙ মেখে তার মুখে এসে জমা হলো।
    প্রমুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়, তার দুচোখের দৃষ্টি উৎসুক ।
    কয়েকটা মুহূর্ত। বিশাখা সামলে নিয়ে কিছু বলতে যাবে, দরজায় টোকা পড়লো ।
    পরক্ষণেই ওয়ার্ডবয় আর নার্স দুজনে ঠেলে ঠেলে একটা স্ট্রেচার নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো ।
    ওদের দিকে একঝলক তাকিয়েই বিশাখা প্রমুখের চোখে চোখে রেখে বললো, না, আমার তো মনে হচ্ছে কোনো কনফ্লিক্ট নেই !
    প্রমুখের স্বরে এখন উল্লাস, গলা নামিয়ে বিশাখাকে বললো, তাহলে বাদীর ওই স্টেরিলাইজেশন স্কিমটা কি থাকবে ?
    বিশাখা ঘরে উপস্থিত দুজনের দিকে ইঙ্গিত করে চোখ পাকিয়ে নীচু গলায় বললো, পাবলিক প্লেসে ইন্ডিসেন্ট আটারিং কোরো না…সেকশন টু নাইনটি ফোর !

[পরম্পরা ওয়েবজিন, অক্টোবর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

5 1 ভোট
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
4 days ago

দারুন মিষ্টি একটা গল্প পড়লাম। দুই নব্য উকিলের কথাবার্তা, খানিক কোর্ট, আইনজীবী দের ব্যাপার স্যাপার বেশ নতুনত্ব লাগলো! লেখক কে অভিনন্দন!
লেখক নিশ্চয়ই প্রমুখের মত সিচুয়েশন এর বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে! আবার লিখবেন, শারদীয়ার শুভেচ্ছা জানাই।

সিদ্ধার্থ সান্যাল
সিদ্ধার্থ সান্যাল
18 hours ago

অনেক ধন্যবাদ॥ আপনাকেও শারদ শুভেচ্ছা, পুজো ভালো কাটুক সকলের।