খবরটা অনিমেষই প্রথম চাউর করলো অফিসে ।
টি-ব্রেকের সময়ে ক্যান্টিনে চায়ের কাপ সামনে নিয়ে তার তিন চারজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বসে আছে, গত শনিবারের মোহনবাগান আর মহামেডানের খেলা নিয়ে তর্ক বেশ পেকে উঠেছে, এমন সময়ে হাঁফাতে হাঁফাতে অনিমেষের প্রবেশ ।
ধপ করে টেবিলের একমাত্র খালি চেয়ারটায় বসে পড়ে গলার স্বরটা সকলের থেকে উঁচুতে তুলে বলল, তোরা এখন থাম তো…থাম ! এতদিনে এই কোলকাতার অফিসটার একটা হিল্লে হতে চলেছে মনে হচ্ছে । বাপ রে, দিনের মধ্যে আট ঘণ্টা তেঁতুলে ইংরেজি বলতে বলতে জিভটাই বেঁকে যাবার জোগাড় হয়েছিল !
ফিনান্সের সঞ্জয় পাকড়াশি বললো, টিপ্পনী ছেড়ে ঝেড়ে কাশ না ! ব্যাপারটা কি ?
-নিশ্চয়ই কোন স্কুপ নিউজ…ফ্রম মুম্বাই ! অ্যাকাউনট্যানট হেমন্তর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য !
-কাকা কহিন ! এইচ আর-এর বিকাশ চোখ টিপে বললো ।
অনিমেষের কাকা এই বিদেশী কোম্পানিটার মুম্বাই হেডকোয়ার্টারে উচ্চপদে কাজ করেন। সেখান থেকে কিছু কিছু অফিসিয়াল খবর ও আগাম পেয়ে প্রায়ই বন্ধুদের সাপ্লাই করে।
অনিমেষ বিকাশের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে তারপর বললো, বাঙালি রিজিওনাল ম্যানেজার আসছেন এ অফিসে,পার্মানেন্ট ট্রান্সফার। একেবারে লন্ডন অফিসফেরত, সুবিমল গাঙ্গুলি । কাকা একটু আগে ফোন করেছিলো। এলএসই থেকে পাশ করা ঘ্যামা অফিসার । পঞ্চাশের ওপর বয়েস। সুব্রমনিয়ম মুম্বাই যাচ্ছে। অর্ডার বেরিয়ে গেছে।

সঞ্জয় বিজ্ঞের মতো বললো, এখন থেকে অতো নাচিস না, লন্ডনফেরত বলছিস, দ্যাখ এঁর সঙ্গে হয়তো এবার তোকে সবসময় কুইনস ইংলিশে কথা বলতে হবে ।
সঞ্জয়ের কথা শুনে উপস্থিত সকলেই ঘাড় নাড়ল, যার মানে হয় ‘হতেই পারে’ !
অনিমেষ রিজিওনাল ম্যানেজারের আপ্তসহায়ক, গোলা বাংলায় যাকে বলে পারসোন্যাল অ্যাসিসট্যানট ।
সবসময় আরএম-এর সঙ্গে লেপটে থাকা ওর প্রধান কাজ।
তাই এই খবরটা কোলকাতার অফিসে আগে ওরই পাওয়া উচিত, এই ভেবে হয়তো ওর বুঝদার কাকাবাবু স্কুপ নিউজটা ওকে জানিয়ে দিয়েছেন।
অনিমেষের জন্য ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও সুবিধা হয়, এই রিজিওনাল অফিসের কিছু কিছু জরুরি খবর গোপন রাখার কড়ারে তারা আগে থেকে জানতে পারে ।
অনিমেষ সকলের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে একটু ভাবিত গলায় বললো, কিন্তু সুবিমল গাঙ্গুলি সম্বন্ধে একটা কথা কাকা কেন বললো বুঝতে পারছি না ।

  • কি কথা ? ব্যাড টেম্পার, খুঁতখুঁতে, সন্দেহবাতিক না কি হাইলি ডিসিপ্লিনড ?
    সঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলো ।
    ও জানে, সকলের মনেই এই একই প্রশ্ন উঠবে।
    সকলে উৎসুক হয়ে অনিমেষের দিকে তাকিয়ে রইলো ।
  • না, ওসব কিচ্ছু নয় । ভদ্রলোকের না কি দারুণ সুন্দর ব্যবহার, এক মাসেই মুম্বাই অফিসের সকলের মন জয় করে নিয়েছিলেন।
  • তাহলে ! কি বললেন তোর কাকা ? বিকাশ জিজ্ঞেস করলো ।
  • বললেন, এসজি-র সবকিছু একসেলেন্ট, কেবল একটু ক্র্যাঙ্কি আছে।
  • সে কি রে ! তুই ডিটেলটা জিজ্ঞেস করলি না…কি ব্যাপারে ক্র্যাঙ্কি ?
  • করেছিলাম তো ! কাকা ভাঙলো না । বললো, এলেই দেখতে পাবি !

দিন সাতেকের মধ্যেই এক সোমবার একেবারে ফার্স্ট আওয়ারেই নতুন রিজিওনাল ম্যানেজার সুবিমল গাঙ্গুলি, এসজি, এসে পড়লেন ।
অফিসে ঢুকেই সোজা একেবারে আর এম-এর চেম্বারে ।
আধুনিক ওপেন অফিস ডিজাইনের বিরাট হল, তিনদিক ঘেরা টেবিলমুখো চেয়ারে সকলে কাজ করছে ।
তাই ওঁর অফিসে ঢোকাটা কেউ ততোটা খেয়াল করেনি ।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে আরএম চেম্বার থেকে তিনজন বেরিয়ে এসে সামনের জায়গাটায় দাঁড়িয়ে গেলো, আউটগোইং আরএম সুব্রমনিয়ম, অনিমেষ আর নতুন আরএম সুবিমল গাঙ্গুলি ।
সকলে যে যার চেয়ার ছেড়ে এসে চওড়া প্যাসেজটায় ভিড় করলো ।
স্যুট টাই-এ দুজনেরই ঝকঝকে পোশাক।
আপ্তসহায়ক অনিমেষের কাছে আজ নতুন আরএম আসার আগাম খবর ছিল, তাই ও-ও আজকে একটু মাঞ্জা দিয়ে এসেছে ।
সুব্রমনিয়ম ইনট্রো দিতে শুরু করলেন।
এসজি তো হাসিমুখে এদিক ওদিক সকলের দিকে তাকাচ্ছেন।
মুখ দেখলেই মনে হচ্ছে মানুষটা ভালোই হবেন ।
দক্ষিণী ইংরেজি ভাষণের দিকে মন না দিয়ে সঞ্জয় অনিমেষের দিকে তাকালো । ও দেখলো, অনিমেষ ব্যাটা বড়ো বড়ো চোখের ইশারা করে মেঝের দিকে দেখাচ্ছে ।
কিছু বুঝতে না পেরে সঞ্জয় নীচে মেঝের দিকে তাকালো । ও হরি !
এসজি-র স্যুটেড পোশাকের সঙ্গে ‘বুটেড’ নেই ! দুপায়ে রয়েছে সাধারণ চপ্পল !
সঞ্জয় ভাবলো কোন একটা পায়ে নিশ্চয়ই কোন আঘাত লেগেছে, তাই জুতো পরতে পারছেন না ।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই করিডর মিটিং শেষ ।
সুব্রমনিয়মকে ধন্যবাদ জানিয়ে সকলের সঙ্গে পরে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্য দুজনের সঙ্গে এসজি তো আবার আরএম চেমবারে ঢুকে পড়লেন।
এবার হয়তো হ্যান্ডিং-টেকিং ওভার সব ফরম্যালিটি হবে ।
কিছুক্ষণ পরেই সুব্রমনিয়ম চেম্বার থেকে বেরিয়ে সকলের দিকে হাত-টাত নেড়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন ।
অনিমেষ তো এখনও চেম্বারের ভেতরে।
যা কিছু ব্রেকিং নিউজ এখন টি-ব্রেকের সময়ই পাওয়া যাবে ।
সকলে ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকলো ।

এরপর তিন-চারদিন কেটে গেছে ।
নতুন আরএম সুবিমল গাঙ্গুলি অফিসে আসছেন ঘড়ি ধরে ।
সকলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা। সাবলীল ভদ্র ব্যবহার ।
সকলেই নতুন বসের ব্যাপারে অজানা উদ্বেগের চাপ থেকে মুক্ত ।
সাহেবের পোশাকে কোন পরিবর্তন নেই, সেই নিখুঁত সুট-টাই, পায়ে কিন্তু ওই পাড়ার দোকানের সাধারণ স্ত্র্যাপ দেওয়া চপ্পল বা ফ্লোটার ।
এটাই কি তাহলে কাকাবাবু-কথিত ক্র্যাঙ্কি ব্যাপার !
অফিসের কর্মীদের থেকে শুরু করে পিওন চৌকিদার পর্যন্ত তো কৌতূহলের দম আটকে থেকে থেকে বেদম হওয়ার অবস্থা !
সকলের ভরসা সেই সাহেবের আপ্ত-সহায়ক অনিমেষ রায় !
ইতিমধ্যে যা খবর অনিমেষ বন্ধুমহলে সাপ্লাই করেছে, তা হলো, এসজি একজন কনফার্মড ব্যচিলর, সংসারে মা আছেন, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে নিজস্ব বাড়ি। প্রেসিডেন্সী কলেজের গ্রাজুয়েশনের পরে প্রায় পঁচিশ বছর দেশের বাইরে। লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের গ্রাজুয়েট ও মাস্টার্স। দেশে পারমানেনটলি ফিরে এসেছেন মাস দেড়েক আগে ।
লাঞ্চব্রেকে এসব শোনার পর সঞ্জয় অনিমেষকে বললো, তুই তো দেখছি একটা অপদার্থ রে ! আরএম-এর পারসোন্যাল ফাইল নিশ্চয়ই তুই হাতে পেয়ে গেছিস। সেখান থেকে এইসব ইনফরমেশনগুলো ঝাড়ছিস! আমাদের জানবার আসল মিস্ট্রিটার কথাটা তো আর ওই পারসোন্যাল ফাইলে লেখা থাকবে না। সেটা তো তোমাকে সাহস করে ওঁকে জিজ্ঞেস করতে হবে বাবা ভোম্বলদাস !
অনিমেষ বেশ বিরক্ত হয়ে বললো, করবো তো। আমি ওনার পিএ, আমি ছাড়া আর কে জিজ্ঞেস করতে পারবে ! আমি ঠিক সময়টার অপেক্ষায় আছি । কাল উইক এন্ড আসছে। কাল জিজ্ঞেস করবো ভাবছি ।
বিকাশ বললো, হ্যাঁ, সকালে ফার্স্ট আওয়ারে লাঞ্চের আগেই কাজটা শেষ করে ফ্যাল । তাহলে তোর কালকের লাঞ্চটা আমার অ্যাকাউন্টে, শেষ পাতে বাড়তি দুটো রসগোল্লাও পাবি ।
পরের দিন ক্যান্টিনে সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে । আরএম-এর পিএ, তাই অনিমেষ একটু দেরি করেই লাঞ্চে আসে।


মিনিট দশেক কেটেছে, কাঁচের দরজা দিয়ে সবাই দেখলো, অনিমেষ আসছে, ধীরগতি, যেন কোন তাড়া নেই ।
দরজা ঠেলে অনিমেষ ভেতরে ঢুকে টেবিলে এসে বসলো ।
কেমন যেন গম্ভীর নির্লিপ্ত হাবভাব, চারপাশের আগ্রহী মানুষগুলো যেন অনুপস্থিত।
ঠাণ্ডা গলায় বললো, আমার লাঞ্চটা অর্ডার করেছিস তো বিকাশ ?
আটকানো দমটা ছেড়ে দিয়ে টেবিলের চারপাশের সকলে চাপা হইহই করে উঠলো ।
বিকাশ উদ্ভাসিত মুখে বললো, যাক, শেষ পর্যন্ত চপ্পল-রহস্য জানা গেছে তাহলে! বল,বল,শুনি সবাই । আর তর সইছে না আমাদের !
অনিমেষ সকলের দিকে একবার ঘুরে ঘুরে তাকালো ।
তারপর কেমন একটা ক্লান্ত স্বরে বললো, শুনবি, শোন তাহলে ।

আমি এই কিছুক্ষণ আগে এসজিকে যখন চটির ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করলাম, উনি এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে জানলার দিকে গেলেন ।
তারপর আমাকে উনি এই কথাটাই বললেন, শুনবে অনিমেষ । শোন তাহলে । এই মাস তিনেকের মধ্যে কাউকে তো এসব বলিনি । বোধহয় সংকোচে সম্ভ্রমে কেউ জিজ্ঞেসও করেনি।
তারপর ফিরে এসে চেয়ারে বসে পড়ে ফোনটা তুলে রিসেপশনে বললেন পনেরো মিনিট কোন বাইরের লাইন না দিতে। তারপর বললেন, তুমি তো এখন জানো অনিমেষ, আমি প্রায় বাইশ বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ করেছি। যদি আমার বালিগঞ্জের বাড়িতে তুমি আসো তাহলে দেখবে একটা বড়ো শ্যু-ক্যাবিনেটে থরে থরে নানা ব্র্যান্ডের পেটেন্ট লেদারের জুতো সাজানো আছে, এস মার্কস, ট্যাফট, কারমিনা, ট্রিকারস, কার্লোস স্যান্টোস, সালভাতোর, জন লব…তাদের নানা ডিজাইন, তার সঙ্গে মানানসই রঙ। ওইটা আমার জীবনের প্রিয়তম জিনিস, আমার একমাত্র দুর্বলতা বলতে পারো । যেখানে যে শহরেই গেছি, সেই দেশের দামী ব্র্যান্ডের জুতো কিনেছি, একেবারে মহিলাদের শাড়িগয়না কেনার মতো । তো এইভাবেই চলছিলো বহু বছর। একলা ছিলাম, বেশ ছিলাম। ছেলের মতিগতি বুঝে মা-বাবাও বিয়ের জন্য তাড়া দিয়ে বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন বহুদিন। এসজি হঠাৎ থেমে গেলেন।
আমি তো চুপচাপ শুনে যাচ্ছি ।
এসজি জলের গ্লাসটা তুলে একঢোঁক জল খেয়ে আবার বলতে শুরু করলেন ।
মাস চারেক আগের কথা। কোন কঠিন অসুখ বিসুখ নেই, বাবা হঠাৎ তিনদিনের জ্বরে চলে গেলেন । অসুস্থতার খবর পেয়েই লম্বা ছুটির ব্যবস্থা করে ফার্স্ট অ্যাভয়লেবল ফ্লাইটে কোলকাতায় এলাম। বাপিকে আমি দেখতে পাইনি অনিমেষ । শ্রাদ্ধশান্তি করে ছুটি কাট করে আমি লন্ডনে ফিরে গেলাম। মনস্থির করলাম, মা একা হয়ে গেলো, এবার পারমানেনটলি দেশে ফিরে আসবো। লন্ডনের অফিস বললো, প্রথমে মুম্বাই যাও । ওখানে সিনিয়র পোস্ট খালি আছে । কোলকাতার সুব্রমনিয়মকে মুম্বাই-এ পোস্টিং করাতে অন্তত মাসখানেক সময় লাগবে। মুম্বাই চলে এলাম । ইতিমধ্যে মা কোলকাতা থেকে আমাকে বললো, সময় করে গয়ায় বাপির পিণ্ডদান করে আসতে। গেলাম গয়ায়। সব কাজ শেষ করে পাণ্ডা পুরোহিত আমাকে বললেন, একটা কিছু প্রিয় জিনিস, খাবার বা অন্য কিছু একটা, বাবার স্মৃতিতে সারাজীবনের মতো ত্যাগ করবার জন্য । অনিমেষ, সেই মুহূর্তে বাপির হাসিমুখটা ভেসে উঠলো আমার মনে। ব্র্যান্ডেড জুতোর প্রতি আমার দারুণ দুর্বলতা নিয়ে কতো যে হাসিঠাট্টা করতো বাপি । আমি মনস্থির করে পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করলাম, ত্যাগ দেওয়ার জিনিসটার নামটা কি বলতে হবে । তিনি বললেন, জরুর । হমকো তো মন্তর পঢ়ানা হ্যয়। বললাম, তাহলে আমি জুতো ছেড়ে…মতলব ম্যয় জুতে ছোড় দুঙ্গা । পুরোহিত শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলেন এক মুহূর্ত । তারপর স্থিরদৃষ্টিতে আমাকে দেখতে দেখতে বললেন, বাবুজি, আপ বড়ে শহরমে রহতে হ্যয়। মুঝে লাগতা হ্যয় বড়ে কাম ভী করতে হোঙ্গে। আপ সমঝতে হ্যয় না কি আপ কৌন সা চীজ ছোড়নে কা মন বনায়া হুয়ে হ্যয় ? ওয়াদা কভি তোড়নে পর আপকে পিতাজি কি আতমা কো শান্তি নহি মিলেগি। আমি বললাম, নহি তোড়ুংগা কভি ভি। পণ্ডিতজি, আপ কৃপা করকে মন্ত্র পঢ়াইয়ে মুঝে ।
বলে চোখ বন্ধ করলাম আমি । স্পষ্ট দেখলাম অনিমেষ, বাপির চশমাটা নাকের ওপর ঝুলে আছে, যেমন থাকতো, আর চশমার ওপর দিয়ে বাপির চোখ হাসছে ।
এসজি থেমে গেলেন ।

আমরা দুজনেই চুপ করে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে, আমি আস্তে করে বললাম, আর আপনার মা ? মা কিছু বললেন না ?
অতো বড়ো মানুষটাকে, জানিস বিকাশ, কেমন একটা ছোট বাচ্চা ছেলের মতো লাগছিলো । ধরা গলায় বললেন, গয়ার ফল্গুঘাটের কাছেই একটা দোকান থেকে তখনকার মতো একজোড়া হাওয়াই চপ্পল কিনে নিয়েছিলাম । আমার জুতোটা দিলাম হোটেলের সিকিউরিটি গার্ডকে। পাকানো গোঁফের প্রৌঢ় লোকটাকে প্রাক্তন জওয়ান মনে হলো । ট্যাফটের জুতোজোড়া হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে অবাক চোখে আমার পায়ের চপ্পলের দিকে তাকালো। তারপর আমাকে বললো, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ সার, গড উইল ব্লেস ইউ । কোলকাতায় ফিরে বাড়িতে ঢুকতেই মা প্রথমে আমার পায়ের দিকে অবাক চোখে তাকালো। তারপর দেখলাম মার চোখ জলে ভরে উঠছে । আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর কতো কতো বছর পর মা-র কোলে মাথা রেখে দুজনে অনেকক্ষণ কাঁদলাম অনিমেষ ।

অনিমেষ থেমে গেলো ।
সকলে চুপ ।
বিরাট ক্যান্টিনটাও যেন শব্দহীন হয়ে গেছে, তার চাপা গুনগুন আওয়াজ কারও কানে ঢুকছে না ।
সেই অপার নৈঃশব্দ্য ভেঙে দিয়ে দুটো ছেলে এসে চারটে লাঞ্চের থালি ঠক করে টেবিলে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো ।
অনিমেষ ওর থালি থেকে রসগোল্লার বাটিটা তুলে বিকাশের দিকে এগিয়ে দিয়ে ক্লান্ত গলায় বললো, রসগোল্লাটা আর খাবো না রে বিকাশ, জোর করিস না, প্লিজ ।

[লেখকের অন্য রচনা]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, ডিসেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

5 4 ভোট
Article Rating
9 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Sunil Kumar Chakrabarti
Sunil Kumar Chakrabarti
1 month ago

দারুন লেখা। রহস্যের শেষ খুবই চাচি।

Sunil Kumar Chakrabarti
Sunil Kumar Chakrabarti
1 month ago

Excellent. Ending is very touchy.

অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়
অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়
1 month ago

একেবারেই অন্য রকমের গল্প। এখন তো সব কিছুর জন্যেই, এমনকি পিতৃমাতৃশ্রাদ্ধে মাথার চুলের
জন্যেও মূল্য ধরে দেওয়াটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
বুকে ধাক্কা দেওয়া গল্প।

উজ্জ্বল কুমার পাল
উজ্জ্বল কুমার পাল
1 month ago

এই নিয়মটা আমার স্বর্গত পিতৃদেবকে দেখেছিলাম গয়ায় পালন করতে, এবং সেই সংস্কারে আমি নিজেও পালন করেছি।
সুন্দর ঝরঝরে লেখা, বিষয় বস্তু চয়ন মুন্সিয়ানার দাবি রাখে।
সুকৌশলে নানান রকম জুতার মার্কা বলা হয়েছে, এটা খানিকটা সত্যজিৎ রায়ের লেখার ধরনও বটে।

Dr. Sumsn Mukerji
Dr. Sumsn Mukerji
1 month ago

ফাটাফাটি লেখা, আর কিছু বলার নেই I

Debashis Banerjee
Debashis Banerjee
1 month ago

চমৎকার। শেষ অবধি অনুসন্ধিৎসা ধরে রাখে।

Anindita Bandyopadhyay
Anindita Bandyopadhyay
1 month ago

দারুণ! টানটান লেখা❤️

Anilesh Goswami
Anilesh Goswami
1 month ago

সিদ্ধার্থ সান্যালের “পিন্ডদান” একটি চমৎকার গল্প। দীর্ঘকাল বিদেশে বসবাস করে দেশে ফিরে আসা সুবিমল গাঙ্গুলীর পরনে স্যুটের সঙ্গে সাধারণ চপ্পল পরার কারণ কী হতে পারে – এই সাসপেন্স শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার জন্য এবং অফিসে সবায়ের কৌতুহলজনিত কথাবার্তায় স্বাভাবিক বাতাবরণ সৃষ্টি জন্য লেখকের মুন্সিয়ানার প্রশংসা করতেই হবে।

স্মিতা সান্যাল
স্মিতা সান্যাল
1 month ago

বেশ ভাল লাগল গল্পটা, বিষয়বস্তু নতুন ধরনের এবং শেষটা বেশ মর্মস্পর্শী, হৃদয় ছুঁয়ে যায়

Last edited 1 month ago by স্মিতা সান্যাল