‘দি টিউলিপ বার’, সাইনবোর্ডে ঝোলানো নামে ফুলের বাহার থাকলেও বারের ভিতরের চেহারাটা প্রায় নরকতুল্য। তাই বলে খদ্দেরের অভাব আছে তেমনটা নয়। ‘গুলজার’ শব্দটা নরকের পাশেই বেশি মানায়, তাই মাঝ রাতেও ‘দি টিউলিপ বার’ থেকে ভেসে আসে উন্মত্ত উল্লাস…
সেই উল্লাসে কতটা কান্না আর কতটা হা-হুতাশ মিশে থাকে তা অবশ্য মেপে দেখা হয়নি। এখন রাত প্রায় বারোটা। গোটা ছয়েক টেবিলের প্রায় সব কটাই ভর্তি। প্রতিটা টেবিলের মাথায় ঝুলছে নিভন্ত হলুদ বাতি। বারের বাকী অংশ অস্পষ্ট অন্ধকারে ঢাকা। আনাচ কানাচে জমে থাকা দারিদ্র্য আর অযত্ন যে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে বাঁচে।

একদল ঝাঁঝালো দেশি আর নরম বিলিতি মুখোমুখি বসে মদ খাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেশী-বিলিতির গেলাস বদল হচ্ছে। চড়া পেটে বিলিতি আর ভরা পেটে দেশী পড়লে মৌতাত জমছে দ্বিগুন…
স্টেজের ঠিক সামনে লম্বাটে টেবিলটায় এখন যারা বসে আছে, তাদের বিত্তে মিল না থাকলেও তারা এক গেলাসের ইয়ার। একমাত্র মাতালরাই অনায়াসে ‘বিত্তের কাঁটাতার’ পেরিয়ে যেতে পারে। এদের মধ্যে একজন হল সেলস এক্সিকিউটিভ বিমান গাঙ্গুলী। কিছুদিন আগে ডিভোর্স হয়েছে। তাতে যে বিশেষ দুঃখ হয়েছে তেমন নয়, কিন্তু পেটে মদ পড়লেই বিমানের শোক উথলে ওঠে। ইদানীং বেশ্যাবাড়ি যাচ্ছে, বেশ কিছু বাড়তি পয়সা বেরিয়ে যাচ্ছে। শোকটা বোধহয় বেশ্যার খুঁটে বাঁধা। চোখের জলটা সেই কারণেই…

আজ বিমান গাঙ্গুলী কিছুতেই থামতে পারছে না। টেবিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মিস রুপালির ঘষা গলার গান ওকে এতটুকুও উত্তেজিত করতে পারেনি। নেশা আর কান্নার বেগ সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। সেই সুযোগে বিমান গাঙ্গুলীর রামের বোতল ফাঁকা করে দিয়ে গজা ঝিম মেরে বসে আছে। এই গজা আদতে চোর। যদিও টেবিলের বাকী মানুষ তা জানে না। তার পরিচয় টিকিট ব্ল্যাকার। ইদানীং ব্যাঙের ছাতার মতো সিনেমাহল গজিয়েছে। কোনো হলই হাউসফুল হয় না। কিন্তু তাই বলে গজার ব্ল্যাকার উপাধি কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। চুরিটা পেটের দায়েই করে, যদিও এই নিয়ে ওর অনুশোচনার শেষ নেই। বিমান গাঙ্গুলীর পিঠে বার কতক হাত বুলিয়ে জড়ানো গলায় গজা বলল, “একটু চোলাই খাও ভাই, জ্বালাটা জুড়োবে। এই কারণে আমি কোনো লেডিসের চক্করে পড়ি না।”

জ্বালাটা যে আসলে কীসের সেটাই বিমান গাঙ্গুলী নিজেই বুঝে উঠতে পারেনি। আজ বেহালাটা শোনার পর থেকেই…
বিমানের ঠিক উল্টোদিকে বেজার মুখে বসে আছে এক্স ক্রাইম রিপোর্টার অজয় তরফদার। কান্না ভুলতে বারে আসে, সেখানেও রেহাই নেই। নেশাটা ছুটে গিয়েছে। মেজাজটা খিঁচড়েই ছিল, টেবিলের উপর এক চাপড় মেরে বলল “সব দোষ ওই পালের। শালা! বারে কেউ পিড়িং পিড়িং করে বেহালা বাজায়? গিটারখানা বেচে খেয়েছ নাকি?”

পাল বলে যাকে সম্বোধন করা হল তার আসল নাম পল এডওয়ার্ড। বো ব্যারাকের এক চিলতে ঘরে বউ, মেয়ে আর অভাব নিয়ে থাকে। চোখের নীলচে রঙ ছাড়া পূর্বপুরুষ আর কিছুই রেখে যায়নি। সে মাথা ঝুঁকিয়ে হাসল। বলল “বউ বেচে দিয়েছে। মেয়েটার স্কুলের ফিজ…”

“শালা পৃথিবীর কোথাও কি একটু সুখ নেই? শান্তি নেই?” অজয় তরফদারের গলায় আকুতি।

“শান্তি শ্মশানে” বলল গজা।

“একথা বিশ্বাস করি না। এই যে আমার চব্বিশ বছরের ছেলেটা খুন হয়ে গেল। নিজে হাতে শ্মশানে দাহ করে এলাম, সে মরে গিয়ে সুখে আছে বলছিস? এক সময় ক্রাইম রিপোর্টার ছিলাম। খুন দেখা ছিল জলভাত। যেদিন ছেলেটা গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল আর কুকুরের মতো শুঁকে শুঁকে খবর খুঁজছিল রিপোর্টারের দল সেদিন ওদের মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজছিলাম। শুধু ক্রাইম রিপোর্ট লিখে পাতা ভরিয়েছি। যারা খুন হয়েছে তাদের বাপ-মায়ের দুঃখ ছুঁতে পারিনি। শালা, সেই শাস্তিই পাচ্ছি…”

“মরেও সুখ নেই আর এই জীবন বেঁচেও সুখ নেই। সুখ কোথায় জানো, ত্যাগে… মোহ-মায়া মুক্ত জীবনই একমাত্র সুখের। তোমরা তথাগতর গল্প জানো?” পল ধীরে গলায় জিজ্ঞাসা করল।

“জানি, শালা, মহা হারামি মাল। আমার সঙ্গে পড়ত, নেতার জুতো চেটে একটা ইস্কুলের চাকরি বাগিয়ে ছিল। এখন তো সে চাকরি গেছে। বেশ হয়েছে।” গজার ক্ষোভে ফেটে পড়ল।

হালকা হেসে পল বলল , “না না সে নয়। আমি ভগবান বুদ্ধের কথা বলছি। তখনো তিনি বোধি লাভ করেননি। কঠোর তপস্যা করছেন, ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর। প্রায় মৃতপ্রায় দশা, একদিন নদীতে স্নান করতে গিয়ে দেখলেন এক দেবপুরুর তিন তারের সুরেলা যন্ত্র বাজাচ্ছে। যার এখকানি বেশ টান করে বাঁধা, একটি ঢিলা আর একটি না ঢিলা না টান…”
কথা বলতে বলতেই পল নিজের চার তারের বেহালাখানা হাতে নিল। দ্বিতীয় তারে ছড় বুলিয়ে মধুর সুর তুলল। তারপর আবার গল্প শুরু করল। “তথাগত বুঝলেন দেহকে কষ্ট দিয়ে নয়, আবার আয়েসে থেকেও নয়, এই মর্ত্যে শান্তি পেতে হলে ওই মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। সেদিনের পর সুজাতার হাতে পায়েস খেলেন। তারপর তপস্যা করে বোধি লাভ করলেন। সে এক পরম সুখ। ত্যাগের সুখ, সাধনার সুখ। সংসারে সেই সুখ কোথা?”

পলের কথা শুনে হা হা শব্দে হেসে উঠল অজয় তরফদার। “শালা অ্যাংলোর বাচ্চা আমাদের বুদ্ধের গপ্পো শোনাচ্ছে। তোকে কি আর সাধে পাল বলে ডাকি! তবু যীশু-টীশুর কথা হলেও হত। এ একেবারে বোধি, সন্ন্যাস, ত্যাগ! অত সোজা নাকি? বললেই সব ছাড়া যায়?”

বিমান এখন হাফ মাতাল। চোখের জল অনেকক্ষণ আগেই বন্ধ হয়েছে। জিজ্ঞাসা করল – “পাল’দা, সন্ন্যাস নিলে মেয়েদের সঙ্গে শোয়া যায়? মানে ওই সাধন সঙ্গিনী ? পাব নাা ?”

“কার মতো লাগবে? মিস রুপালি?” গজা খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল।

“স্টেজে তখনও গান গাইছিল মিস রুপালি। সেদিকে তাকিয়ে বিমান গাঙ্গুলী মুখটা কুঁচকে বলল, “ও তো বুড়ি।”

অজয় তরফদার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল, “ছুড়ি সাধন সঙ্গিনী চাই ? এই পাল, শুনছ? কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দাও দেখি।” বারের টেবিলে সুখ আর দুঃখ সর্বক্ষণ কানামাছি খেলে বেড়ায়। কখন কাকে ছুঁয়ে দেয় কে জানে…
পল বেহালার বাক্সটা হাতে নিয়ে এক দৃষ্টে সেটার দিকেই তাকিয়েছিল। যার গায়ে সোনালী অক্ষরে Peace Of Lord লেখা। চারটে তার আর এই শব্দগুলো কিছুতেই ওকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। অজয় তরফদারের কথাগুলো পলের কানে যায়নি, বলল “আজ উঠি।” পকেটে থাকা একশোটা টাকা কিছুতেই খরচা করা যাবে না। মেয়েটার জুতোটা ছিঁড়ে গিয়েছে। এখানে বসলে টাকাটা মদে উড়বে। বেহালার বাক্সটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল পল, ফিরে এল। গজার দিকে একশো টাকার নোটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, একশো কুড়ি পেতিস তো? এইটা এখন রাখ।

বারের আলো আঁধারি মাড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এক দীর্ঘদেহী পুরুষ। মিস রুপালি টেনে টেনে গাইছে, “আভি না যাও ছোড়কে, কে দিল আভি ভরা নেহি……”

ওরা তিনজন এক সঙ্গেই গিয়েছিল। বেশ সঙ্কোচ ভরে কড়া নেড়েছিল বো ব্যারাকের একটা লড়ঝরে বাড়ির দরজায়। গম্ভীর মুখে দরজা খুলে বসতে দিয়েছিল প্রতিমা। যার নামের পাশে এডওয়ার্ড পদবীটা কোনোভাবেই মানায় না। একসময় চেহারায় একটা আলগা শ্রী ছিল ঠিকই, কিন্তু অভাবের সঙ্গে ঝুঝতে ঝুঝতে সেটা এখন মলিন। ঘরের অবস্থা অবশ্য আরও খারাপ। প্লাস্টার খসা দেয়ালে দারিদ্রের সাক্ষী হয়ে যীশু আর মা কালী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন। একটা বছর চারেকের মেয়ে খাতায় রঙ ঘষছে। আসেপাশে বই খাতা, ভাঙা পুতুল ছড়িয়ে আছে। মেয়েটা একবার মুখ তুলে তাকিয়ে আবার আঁকায় মন দিল। দেখা গেল ওর চোখ পলের মতোই নীলচে…
এই একটা ঘরেই রাঁধা-শোয়া-খাওয়া-বসা। তিনকাপ চায়ের জল বসালো প্রতিমা। দুধ চায়ের বিলাসিতা এ’ঘরে নেই। মেপে মেপে গুঁড়ো চা দিল। চুপ করেই আছে, নিঁখোজ স্বামীর জন্য ঠিক কতটা শোক করা উচিত বুঝতে পারছে না। পল থাকা আর না থাকার ফারাক কতটুকু? ইদানীং বিছানাও সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। কেবল মেয়েটা থেকে থেকে বাবা কই ? বাবা কই ? বলছে…

“যাওয়ার আগে কিছু বলে যায়নি? মানে চিঠি-টিঠি, দিন কয়েক পরে ফিরে আসবে এমনও তো হতে পারে।” অজয় তরফদার প্রতিমাকে স্বান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।

“বেহালাটা ফেলে গেছে। মাস খানেক ধরে ওটাই তো প্রাণ হয়েছিল। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করত আছাড় মেরে ভেঙে দিই। সংসারে ক্ষিধের আগুন জ্বলছে আর সে নিরোর মতো বেহালা বাজিয়েছে। আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, একরত্তি মেয়েটার কথা ভাবল না? অজয়দা, পল বেঁচে আছে তো? শক্ত প্রতিমাকে দিশেহারা দেখাচ্ছে। যেন কেউ ওকে জলে ফেলে দিয়েছে। মনের মাটি গলছে…

প্রশ্নটা যে বাকী তিনজনের মনে উদয় হয়নি তা নয়। বিমান বলল “থানায় তো ডায়েরী করা হয়েছে। কিছু হলে এতদিনে খবর পাওয়া যেত না?”

গজা চুপ করে থাকে। ভাবে, চলে যাবে বলেই কি পাল’দা টাকাটা শোধ করে দিয়েছিল? পকেট থেকে দুশো টাকা বার করে প্রতিমার হাতে দিয়ে বলল “বৌদি মেয়েটার জন্য কিছু আনা হয়নি। কিছু কিনে দেবেন।”

চোখের জলটা সামলে রেখেছিল প্রতিমা। যাদের সঙ্গে গেলাসের সম্পর্ক অন্তত তাদের সামনে সে ভেঙে পড়তে চায়নি। এই লোকগুলোকে উঠতে বসতে শাপশাপান্ত করেছে। এদের কাছে হাত পেতে টাকা নেওয়ার সময় জলটা আর আটকাতে পারল না। দুশো টাকায় চারটে দিন সে চালিয়ে নেবে, তারপর?

“দাদার বেহালাটা?” গজা অস্ফুটে প্রশ্ন করে।

“গতকাল বেচে দিয়ে এসেছি। লি রোডে একটা অ্যান্টিক শপ আছে, খুব বেশি দাম দেয়নি। আসলে বেহালাটাকে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। গিটারটা বেচে দেবার পর ওর মামার বাড়ি থেকে বেহালাটা নিয়ে হাজির হল, সেই কোন যুগ থেকে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে। নিজেই সারিয়ে নিল। তারযন্ত্রের প্রতি ওর মায়াটাকে আমি হিংসে করতাম…”

“বেহালাটা কার?” অজয় তরফদার প্রশ্ন করে। রিপোর্টারের স্বভাব যাবে কোথা।
প্রতিমা বোধহয় বিরিক্ত হল। বলল “খুব বেশি জানি না। বেহালাটা নাকি সম্পর্কে কোনো এক দাদুর ছিল। তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিঁখোজ হয়ে যান। তারপর থেকে বেহালাটা কেউ ছুঁয়ে দেখেনি। গল্পটা আমি পলের কাছ থেকেই শুনেছি। গল্পই বলছি কারণ এর সত্যি মিথ্যে জানা নেই। রাত হল, মেয়েটাকে খাওয়াবো…”

এরপর আর বসা চলে না। বিমান গাঙ্গুলী একটা চকোলেটের প্যাকেট নিয়ে এসেছিল, সেটা মেয়েটার হাতে দিয়ে উঠে পড়ল। মেয়েটা মিষ্টি করে ‘থ্যাঙ্কিউ’ বলল। বিমানের বিয়েটা টিঁকে গেলে এইরকম একটা মেয়ে আসতে পারত। ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অজয় তরফদার একটা তেলচিটে কার্ড টেবিলে নামিয়ে রাখল, – “দরকার হলে ফোন কোরো।”

তিনজনেরই মনটা ভার। টিউলিপ বারে বসলেই পল’কে মনে পড়ছে। নেশা আর আড্ডা কোনোটাই ঠিক জমছে না। পলের বলে যাওয়া কথাগুলো মাথায় ঘুরছে। ওরা পার্কে এসে বসল, মুখোমুখি। নামেই পার্ক, এক চিলতে রেলিং ঘেরা জমিকে পার্কের জাতে তুলতে দুটো দোলনা একটা স্লিপ বসানো হলেও সবগুলোই অচল। বেঞ্চের অবস্থাও তথৈবচ। বাহারি বাতি ভেঙেচুরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। পথবাতি আর হেড লাইটের আলো ভরসা। সন্ধ্যা হলে নেশাখোর মানুষ এসে গাঁজা টানে, প্লাস্টিক পেতে বসে তাস পেটায়। স্লিপের নীচে, ঝোপের পিছনে দু একটা প্রেমিক প্রেমিকারও দেখা মেলে। যাদের গায়ে চাঁদের আলোতেও ফোসকা পড়ে, তাই ছাতা খুলে রাখে।
আজকেও একদল লোক জুয়ো খেলছে। তাদের সঙ্গে আনা রেডিওতে বেশ জোরেই হিন্দি গান বাজছে। একদিকে পচা খাল অন্যদিকে কর্মব্যস্ত রাস্তা, মাঝের জমিতে বসে বোধি, মায়া আর ত্যাগ নিয়ে বেশ উচ্চস্বরেই আলোচনা করছে তিনজন।
“যারা সাধু হবার জন্য ঘর ছাড়ে তারা সব থেকে বড় ধান্দাবাজ। এসব সংসারের দায় এড়ানোর ধান্দা। একটা ছোট মেয়েকে ফেলে চলে গেল? অজয় তরফদার শূন্যে নিস্ফল ঘুঁষি চালালো। ছেলের মুখটা মনে পড়ছে বোধহয়।

“সে তো বুদ্ধদেবও গিয়েছিলেন।” কোল্ড ড্রিংকের বোতলে ঢালা মদ গলায় উপুড় করে বিমান গাঙ্গুলী বলল।

“তিনি শাক্য বংশের রাজার ছেলে। রাজার ঘরে খাওয়া পরার অভাব আছে? মেয়েটা কী খেয়ে বাঁচবে পাল ভেবেছে একবারও?” অজয় প্রতিবাদ করে।

“কারো জন্য কিছু আটকায় দাদা? পাল’দা যদি মরে যেত? মেয়েটা বাঁচতো না ? প্রতিমা বৌদি শক্ত মানুষ। ঠিক একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে।” গজা বেশ নির্লিপ্ত গলায় কথাগুলো বলল।

“ খুব তো বড় বড় বাত ঝাড়ছিস। তুই মরে গেলে তোর মায়ের চলবে?” খিঁচিয়ে ওঠে অজয়।

গজার মনে পড়ল কটা ওষুধ আর একটা মলম কিনতে হবে। পা আর পিঠ’ময় দগদগে ঘা থেকে আজকাল গন্ধ ছাড়ে। বুড়ির অবশ্য হুঁশ নেই। অসাড় শরীরের এই এক সুবিধে। নিজে টের পায় না, অন্যদের ভুগিয়ে মারে। যাই হোক মা তো, গজা ফেলে দিতে পারে না। দুশোটাকা দিয়ে দিল, হাত খালি। আজ একটা ধান্দা না হলে, কটা সাইকেল পার্কের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো, গজা সুযোগের অপেক্ষায় আরো কিছুক্ষণ বসে রইল ……

পাশে যারা তাস খেলছিল তারা এখনো রেডিও বন্ধ করেনি। সেখান থেকে ভেসে আসছে- “জিন্দেগি কা সফর হ্যায় ইয়ে ক্যায়সা সফর,কোই সামঝা নেহি, কোই জানা নেহি…”

অতীতের গন্ধ ঠিক কেমন হয় সেটা অ্যান্টিক শপে গেলেই মালুম পড়ে। লি রোডের এই দোকানটায় কী নেই! যেন স্মৃতির কবরখানা। দোকানের ঠিক মাঝে শ্বেতপাথর বসানো বার্মাটিকের কাউন্টারে বসে আছেন দোরাব’জি। পুরু কাচের চশমাটা নাকের উপর ঝুলছে, উনি মন দিয়ে ডায়েরির পাতায় মিঃ বোসের ফোন নম্বর খুঁজে চলেছেন। এখনো আধুনিক যন্ত্র নির্ভর হতে পারেননি, নাম্বারটা পেয়ে ল্যান্ড ফোন থেকেই ডায়াল করলেন। অ্যান্টিক জিনিসের কদর জানেন এমন মানুষ এখন হাতে গোনা। মিঃ বোসের নজর আছে, আর পয়সাও…
দিন কয়েক হল জিনিসটা যৎসামান্য মূল্যে হাতে পেয়েছেন দোরাব’জি। ‘অ্যামেটি’ কোম্পানীর ভায়োলিন। আজকাল এমনটা আর পাওয়া যায় না। সব থেকে বড় কথা ভালো অবস্থায় আছে। বাক্সটার গায়ে সোনার জল দিয়ে Peace Of Lord লেখা। লাখ পাঁচেক পেলেও কম পাবেন। ফোনটা লেগেছে, ওপারে মিঃ বোস।
“বলুন দোরাব’জি, কিছু খবর আছে ? নাতিটার জন্মদিন…”
“স্যার একটা ভায়োলিন পেয়েছি, উনিশশো চার।”
“রাখুন আসছি। তবে দরটা আপনি বড্ড বেশী হাঁকেন।”
কথার পিঠে কথাটা আর বলা হল না দোরাব’জির। “এসে দেখুন” বলে ফোনটা কাটলেন। একটা সিড়িঙ্গে মতো লোক দোকানে ঘুর ঘুর করছে। দোরাব’জির পাঁচ পুরুষ কলকাতায় বাস করেছেন, বাংলাটা উনি আধুনিক বাঙালীদের থেকেও ভালো বলেন। মানুষ চিনতেও তার বিশেষ ভুল হয় না। লোকটা সন্দেহজনক। দোকান ভর্তি দামী জিনিস। লোকটা কি চোরাই কারবার করে? আগে কখনো এ চত্বরে দেখা যায়নি। যদিও চুরির মাল দোরাব’জি ঠেকায় না পড়লে কেনেন না। তাই বেশ কড়া গলাতেই বললেয়া, “কী ব্যাপার? কোনো দরকারে এসেছেন?”

গজা চারধারে চোখ বুলিয়ে বেহালাটা খুঁজছিল। বলল “একটা বেহালা…”

“আপনি কিনবেন?”

“হ্যাঁ, যদি দরে পোষায়…”

“আছে, সাড়ে পাঁচলাখ।” দামটা ইচ্ছে করেই পঞ্চাশ হাজার বাড়িয়ে বললেন।

“সাড়ে পাঁআআচ লাআআখ?” প্রতিমা বৌদি হাজার পাঁচেক পেয়েছে কিনা সন্দেহ। “জিনিসটা দেখা যায়?”

দোরাব’জির ইচ্ছে ছিল না, তবু বাক্সটা খুলে কাউন্টারে রাখলেন। গজা বাক্সটার গায়ে হাত বোলালো। বেহালার চারটে তার আলতো ছুঁলো। পাল’দা বলত “এই তারগুলো কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।” বেহালাটা তো গজার নয়। তবু তার ছুঁয়ে এমন কেন মনে হচ্ছে। ঘোরটা ভেঙে গেল। একজন হোমরা-চোমরা লোককে দোকানে ঢুকতে দেখে বেহালার বাক্সটা বন্ধ করে দিলেন দোরাব’জি। গজাকে বেশ অবজ্ঞার সঙ্গে বললেন, “এবার আপনি আসুন।”

ফুটপাতে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরালো গজা। এই অঞ্চলে যারা ঘোরাফেরা করে তাদের অনেক পয়সা। ফুটপাতে দামী দামী ফল, সবজি বিক্রি হচ্ছে। গজার মাকে ডাক্তার আপেল খেতে বলেছিল। পুরুষ্ট আপেল গুলো দেখে ওর সেই কথা মনে এল। এখন ওর মায়ের যা অবস্থা তাতে থাকা না থাকা সমান। গজার মনটা অকারণেই অস্থির হল। পাশেই একটা পুরনো রেকর্ডের দোকান। তার পাশে বিক্রি হচ্ছে পান সিগারেট চকলেট। অন্যদিন হলে গজা দু একটা জিনিস সরিয়ে ফেলত, আজ ইচ্ছে করছে না। অথচ পকেটে মাত্র বিশটা টাকা পড়ে আছে। লোকটা অনেকক্ষণ দোকানে ঢুকেছে। গজা উঁকি দিল। কেন জানি ওর মনে হচ্ছে লোকটা বেহালাটাই নেবে। একবার যদি হাতাতে পারে, সাড়ে পাঁচ না হোক দু’লাখ পাওয়া যাবে না? গজার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বহুদিন পর একটা বড় দাঁও…

ফুটপাত ঘেষে একটা সাদা মার্সিটিজ দাঁড়িয়ে আছে। সাদা পোশাকের ড্রাইভার পাশের দোকানে দাঁড়িয়ে মৌজ করে দামী সিগরেট ফুঁকছে। লোকটা বেরোচ্ছে, হাতে ভায়োলিনের বাক্স। কাচের দরজার সামনে দোরাব’জির সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। ড্রাইভার সিগারেট ফেলে তড়িঘড়ি গাড়িতে স্টার্ট দিল। বাঁদিকের সরু রাস্তাটা এ’সময় ওয়ান ওয়ে থাকে, এই সুযোগ। গজা ছোঁ মেরে ভায়োলিনের বাক্স নিয়ে দৌড় দিল। সরু রাস্তাটা ধরে একটু অলিগলি পেরোলেই বাস রাস্তা…

এর আগেও বহু দামী জিনিস কিনেছেন মিঃ বোস। এমনটা কখনো হয়নি। উনি দিশেহারা হয়ে থানায় ফোন করলেন। দোরাবজি হায় হায় করছেন। গজা ছুটছে, ছুটছে ছুটছে…
পিছনে পড়ে থাকছে চেনা অচেনা অসংখ্য মুখ। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কাকে ভায়োলিন বেচবে কিচ্ছু জানে না। গজাকে পালাতে হবে, মায়া ছেড়ে অনেক অনেক দূরে। চারটে তার আর ঐ কথাটা গজাকে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।

পুরনো রেকর্ডের দোকানে চোঙ লাগানো গ্রামাফোনে টানা টানা সুরে গান বাজছে- “ও যানেওয়ালে হো সকে তো লওট কে আনা……”

[পরম্পরা ওয়েবজিন, এপ্রিল ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
মহুয়া মীল
মহুয়া মীল
6 months ago

খুব ভালো লাগলো।

আইভি চট্টোপাধ্যায়
আইভি চট্টোপাধ্যায়
6 months ago

ভালো লাগলো।