কলকাতা নগরী । প্রাসাদময়ী নগরী । ঔদ্ধত্যের নগরী। ভালবাসার নগরী । প্রতিবাদের নগরী । মিছিলের নগরী। হাসিকান্না ভরা সুখ-দুঃখের নগরী । এখানে প্রাচুর্য আর অভাবের সহাবস্থান । আনন্দ আর জীবন-সংগ্রামের হাত ধরাধরি করে চলা। বিরুদ্ধতাই এখানকার স্লোগান।
অভ্রংলিহ প্রাসাদ , বিশাল অট্টালিকা, বহুতল ভবন ,সুদৃশ্য হর্ম্য, ভেঙে পড়া ঝুপড়ি, ফুটপাথের সংসার- সব এখানে পাশাপাশি । এক সুরে বাঁধা। এই বৈপরিত্যই কলকাতা।
কিন্তু না । আজ এসব কথা নয় । এখন শুধু আলোর ঝলকানি । ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত’। সমস্ত শহরটা আজ যেন হাসছে । যেন সবাইকে ডেকে ডেকে বলছে ,-“দুঃখ ভুলে যাও । আনন্দ কর । আমাকে দেখ । আমি কেমন আলোর মালা পরে বসে আছি। ঐ দেখ সবার মুখে হাসি। আজ তো আনন্দেরই দিন ।“
আজ মহাষ্টমীর অপরাহ্ন । সন্ধ্যা নামছে। চারিদিক আলোয় আলোময় । ঝলমল করছে শহর। আলোর বান ডেকেছে । অন্ধকারের দৈত্যকে বলছে – দূর হটো । তফাৎ যাও ।

ঋণ ইন্টারনেট
ঋণ ইন্টারনেট


দুই

এইসবই দেখছিল অনিন্দ্য তাদের উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে। এখান থেকে অনেক দূর অবধি দেখা যায়। পুরো শহরটাকে যেন রঙিন আলোর ঝালরে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেন মনে হচ্ছে দুঃখ-কষ্ট বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। মাইকে গান ভেসে আসছে। ‘আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা’। আনন্দের অনুরণনে ঝংকৃত হচ্ছে আকাশ-বাতাস।
এত আনন্দের মধ্যেও অনিন্দ্যর হঠাৎ চোখে পড়ল – রাস্তার ওপারে রামরতিয়ার ঝুপড়িতে টিম্‌টিম্‌ করছে কেরোসিনের কুপি । ওখানে কোন বৈদ্যুতিক আলোর মাতামাতি নেই । শহরব্যাপী এই আলোর উৎসব থেকে ব্রাত্য – নেহাতই এক সাদামাটা বস্তির ঘর । বেড়ার দেওয়াল , টালির চাল ।
রামরতিয়া রুটি বেলছে । বাচ্চাগুলোর মুখে কিছু দিতে হবে তো । ওদের কোন নতুন জামা হয়নি এ বছর । হবে কী করে ? ওদের বাপ যে ফাঁকি দিয়ে ছেড়ে চলে গিয়েছে । কিন্তু আজকের এই মহাপার্বণের দিনে অভুক্ত তো রাখা যায় না ওই অবোধ শিশুদের ।
এই সেদিনও রামরতিয়ার স্বামী কৈলাস স্টেশনে স্টেশনে চা বিক্রী করত । কষ্টেসৃষ্টে চলে যেত ওদের। দুবেলা দুমুঠো জুটে যেত মোটামুটি । কিন্তু কী যে হল ! মাস চারেক আগে এক ধাবমান রেলগাড়ির নিষ্ঠুর চাকায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কৈলাসের দেহ । মুহূর্তের অসাবধানতা সব কিছু শেষ করে দিল । অপমৃত্যু ঘটল একটা স্বপ্নের। সেই থেকে রামরতিয়ার লড়াই শুরু । বাড়ি বাড়ি কাজ করে সারাদিন উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও বাচ্চাগুলোর মুখে দুবেলার রুটি যোগাড় করতে রীতিমত হিমসিম খেয়ে যায় সে ।
অনিন্দ্যর মনটা ভারী হয়ে ওঠে । অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরায় সে । দুঃখ- কষ্ট তো রোজই আছে । আজ দুঃখ ভোলার দিন। আলোয় মোড়া কলকাতাকে সে আজ উপভোগ করতে চায় । নিংড়ে নিতে চায় তার সবটুকু রস ।
কিন্তু ভাবলে কী হবে – মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক । হঠাৎ ছন্দপতন । নিমেষের অন্ধকারে ডুবে যায় চারিদিক । বৈদ্যুতিক গোলোযোগের ফলে শহরের মুখে কে যেন কালি লেপে দেয়। । নিভে যায় উৎসবের যত রংবেরঙের আলো। কী মুশকিল ! আজকেই লোডশেডিং হতে হ’ল ? আর দিন পেল না ? এত আয়োজন, এত হৈ চৈ- সব কি বৃথা হয়ে যাবে ? উৎসবের আনন্দে ভাটা পড়বে শেষ পর্যন্ত? বাঙালির শ্রেষ্ঠ পার্বণ এই দুর্গোৎসব । সবাই সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে এই দিনটির জন্য। আর আজকেই এই বিপর্যয় ? অনিন্দ্য রীতিমত বিরক্ত ।


তিন

রামরতিয়ার কিন্তু কোন হেলদোল নেই । তার ঝুপড়িতে কুপি জ্বলে । রুটিও বানানো চলে । কারণ বস্তিতে লোডশেডিং হয় না ।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, এপ্রিল ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
আইভি চট্টোপাধ্যায়
আইভি চট্টোপাধ্যায়
6 months ago

ভালো লাগলো ।