মোবাইল ফোনকে একটা স্ক্রীনের সঙ্গে যুক্ত করে টিভির পর্দার মতো সাজিয়ে নিয়ে বসন্ত নিজের ছায়াছবি দেখার ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে রাখে সারাক্ষণ।
শব্দটা যে জোরালো হয় না, এমনও নয়, অনেকদূর থেকে তো কানে বাজে। ‘তাহলে সব ঠিকই আছে কী বলেন?’ বসন্ত খুব জোরের সঙ্গেই উচ্চারণ করে। ঠিক বলতে ওর মনের কোনায় কীসের বাজনা বেজে উঠল, দেখে কি বোঝার উপায় আছে! বসন্ত আত্মমগ্ন হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে কি যেন বোঝার চেষ্টা করে। কত প্রশ্ন এসে যে দানা বাঁধে, ও নিজেও যে খেই হারিয়ে ফেলে। প্রশ্নগুলো ঘুমিয়ে ছিল, না রোজকার ছবির জগৎ নিয়ম করে খুলে দিচ্ছে ওর অদেখা অজানা স্বপ্নের হদিস এই কথাটাই ও জনে জনে জিজ্ঞেস করে বেড়ায়। নিজেকে আয়নায় দেখে মুখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করে, কোথায় দাঁড়িয়ে আছে ও। প্রশ্নটা বুড়বুড়িয়ে ওঠে, এই জীবনে ও কি করেছে আর কি করেনি। ও কি ইচ্ছে করলেই পেছনে হাঁটা অভ্যাস করতে পারে! ইস্ একবার যদি ফিরে যেতে পারত। বড় সাধ জাগে দেখার, মা ওকে কেমন করে কোলে নিয়ে বুকের দুধ খাইয়েছে আর ও চুক চুক করে টেনে নিয়েছে মার শরীর থেকে সেই রস, পেটটা ভরে যাচ্ছে কি যাচ্ছে না, টের পাবে আর কে! আহা! মার চোখের ভাষা যদি ও টের পেত, মাকে জড়িয়ে ধরে ফিরিয়ে দিতে, কত কি। আচ্ছা এই ভাবনাটা কেন জন্মাল এই অসময়ে। ঘরে তো ফিরে গেছে অনেকে সময়ের জলাঞ্জলিতে। অরুণ, ইন্তেখাব,গগন, চাঁদ,বাতাস,আলমরা ঘরে তো ফিরে গেছে, নাকি যায় নি বসন্ত হিসেব রাখার সুযোগ পায় নি, তাড়না তো ছিল পুরোদমে, এক পা-ও নড়েনি, অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করছিল। কী বলবে একে উচাটন! উদ্বীগ্ন হয়েই নজর রাখছিল ওর নিজেরই তৈরি পর্দায়। এমন একটা অস্বস্তিকর অবস্থার ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি, মরে তো যাচ্ছে, কিংবা মরার অবস্থা তো তৈরি হচ্ছে, এই খবর কানে যে আসছে না, এমনও তো নয়। ঠিক এমনি সময় এমন একটা ধারণা যে পিলপিল করে উঠবে, অসম্ভবই তো ছিল, তবুও তো ছিল। কদ্দিন ধরেই মনে হচ্ছিল নেতাজিই শেষ কথা বলেছে। তবে যে ওরা বলে গান্ধীজি। কে বড়, আর কে ছোট, পরে জন্মেছে কিনা, উত্তরটা কুরে কুরে খায়। পেছনে হাঁটতে চাইলে কী এমন দোষের হবে! না, কোনকালেই বসন্ত নিজের চাওয়া পাওয়ার কোন সীমারেখা টেনে দেয়নি। বই-ই তো বাঁধায়, এই বিদেশ বিভুঁয়ে, এক চিলতে ঘর, চার পাঁচ জনের ঘর, যে যার মতো কাজ খুঁজে বেড়ায়, শেষ হলেই তো শুরুর ঘন্টা বাজে। অস্বস্তিকর কালো সময়ে অর্থহীন জীবনের সন্ধানে শুধুই কালঘাম ছোটানো। সকলেই পথের সন্ধানে পা বাড়িয়েছে। অনিচ্ছায় দেখার ইচ্ছেটাকে তাড়িয়ে মারে। ঘরের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়, চোখ ফেরাবে এমন দুঃসাহস কি ওর আছে! রক্তের দাগ পিচের আস্তরণে মিশে হচ্ছে পিচ্ছিল। চেহারাগুলো পলে পলে পাল্টাচ্ছে। ধ্বসে যাচ্ছে জীবন, চাওয়া বা না চাওয়া গুরুত্বহীন করে দিয়ে ছুটে আসছে এরা বা ওরা, চোখের জলে বলে চলেছে, ‘বাবু ঘর যাব, পথ বলে দাও, চেনা পথে আগুন লেগেছে। ‘আগুন! কীসের আগুন?’ ‘ শুধু কী আগুন! আতঙ্ক, চিরবিদায়ের ভয় এসে নাচানাচি করছে সব কোনে।’ বসন্ত চোখ পাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে, কেমন দেখতে ওরা, লম্বা বেঁটে বামন, নানাজনের নানা বুলি ‘চোখ নাক মুখ বন্ধ করে রাখা।’ ‘দেখবটা কেমন করে? শ্বাস প্রশ্বাস, খাবার দাবার! কী জ্বালা বল দিখিনি! জিন ভূত দৈত্য দানো, কোন গোত্রে পড়ে? দেশি, না সাগর পাড় থেকে উড়ে এসেছে?’

সোঁ সোঁ শব্দে যানবাহনরা উড়ে বেড়িয়ে যায়। বনবন করে মাথাটা ঘুরে মরে। ভাঙাচোরা টুলটা নিজের মতো করে পাক খায়। ডাকে যেন ‘বসন্ত, ও বসন্ত’। বসন্ত শুনতে পেল তো! ডাকটা কোন ফাঁক দিয়ে আসে। ভুল তো শোনেনি। আসাটা তো সত্যি। বেমালুম সত্যি। পাওনাগণ্ডার হিসেব কষা তো সোজা ব্যাপার নয়। সময়টা তো মুঠোয় চেপে ধরে রাখতে পারে নি। চেপে থাকলেও ফুরুত করে বেরিয়ে গেছে। টুলটা নড়েচড়ে ওঠে। দলে দলে ওরা চোখের জলে বুক ভাসায়। এত কান্নার স্রোত একসঙ্গে চলতে থাকলে কোথাও কোন পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে, কেউ বলতে পারে নি। পেটে তো দানাপানি পড়েনি। ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে যে দলটি হুমড়ি খেয়ে পড়ে, চেনা মুখটা ধরাই পড়ে যায়। আবুল দেশ ছেড়ে এসেছিল কিসের টানে, রাজমিস্ত্রি সালামত আর হাসিনা মিঞাবিবির সঙ্গেই ড্যাং ড্যাং করতেই চলে এসেছে শিবাজীনগরে, পরে পরে ধারাবীতে। কে বলতে পারে কোনটা, অভাবে না স্বপ্নের জোড়াতালিতে মনের কোনে রঙ মেখেছে, না জানে পাতানো চাচা চাচী না আবুল নিজে। জলে জলময় হয়ে নদীর জল ডাঙা ছেড়ে ভিটেয় উঠলে ব্যাঙ ডেকে উঠেছিল ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ তখনই ভেবেছিল, এই বুঝি পালাবার সময়। পোটলাপুটলি নিয়ে ওই তো যায়। বসন্তের মরা ছেলের মুখটা যেন। ঘর ছেড়ে রাস্তায় আসার উপায় তো নেই। বসন্ত দরজা ঠেলে বসে থাকে, যদি কোন বেহুদা বিপদ ঘটে বসে। কোন নিস্তার নেই। অনন্ত নিদ্রায় গেছে কে কোনপাশে, কে জানে। অস্থিরতায় ওইটুকু এক মানুষ ঘরে চোখ বুজে থাকা, জেগে যাওয়া। আনচান তো করে। বাসি ভাতের দলা আবুলের গালে দিলে জোরটা পেত – ‘ওই দাঁড়া, দাঁড়ারে’। বাকিটা চেনা বটে আবুলের, এত নিঃশব্দেও শব্দগুলো আটকে যায়। বসন্ত আবারও গলা ফুলিয়ে ডাকে, টিকিটিও খুঁজে পায় না। ওইটুকু ফাঁক দিয়ে আপাদমস্তক দেখা আর মেলে কই। আবুল অদৃশ্য হলে বসন্ত জন্মের মতো ছেলের মুখখানি হারিয়ে ফেলে। যদি অন্য কোন ঘরের লোকের দেখা মেলে আশায় আশায় চুপটি করে বসে থাকে। স্ক্রিনের দিকে নজর ঘোরালেই দেখে সব ধবধবে সাদা। ধুবুলিয়ার রাস্তাটায় ষাঁড়ের দল লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে। চাষীদের লাঠির বাড়ি সপাং সপাং। ওই দলেই মিশে গেছিল বসন্ত, কেন যে মরতে এসেছিল এই মুল্লুকে,মরার দেশে। স্বপ্নের জাহাজে চেপেছিল, রঙিন চশমাটা খুললেই উবে গেল যত আঁকিবুঁকি আর যত আয়োজন। অরুণ ইন্তেখাবরা স্পটবয় হয়ে আয়ের অঙ্কটা বাড়ালেও স্বপ্নটাকে জড়িয়ে ধরে হাপুস হুপুস করে কেঁদেকেটে হয়েছিল একশা। বাসায় ফিরে এলেই বিন্দাস বলে কী করে। পায়ে পায়ে গা লাগে আর গায়ে লাগে পা। লেট্রিনের গন্ধে ভূত পালায়। বসন্ত ভাবতেই পারেনা কে বড় আর কে ছোট, সব মাথাগুলো জোড়ায় জোড়ায়। বসন্ত আপনমনেই নিজের কথা বলে। বর্ষায় টিপটিপ বৃষ্টির জলে ধুলোয় মাটি জমাট বাঁধে। রাস্তায় গড়াগড়ি খায় ছাগলছানা। দু’একটা এঁটুলি পোকা এসে আঁচড় কাটে। কীসের দোহাই দেবে, আর কাকেই বা দোহাই দেবে। ভিজে ভিজে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চায়। দাপুটে হাওয়া বটে, তালগাছের ডাল এসে ধপাস, একটু হলেই মুণ্ডুটা থেঁতলে যেত আর কি। মড়াৎ করে শব্দ হলে আছাড় মারল বটে। ভূতটা তালগাছেই ছিল কিনা। পই পই করে দম আটকানো ছুট। ঘরের মাটির দেয়ালটায় ফাটল ধরে। কল্পনায় আমল দিতে না চাইলেও সে কি আর ছাড়ে।

দেশে ফিরে গিয়ে সবজির দোকান পেতে বসেছিল। ডেকে হেঁকে খরিদ্দারের মনও জিতে নিয়েছিল। ভেবেছিল ধারাবিতে গিয়ে রোজগারের পাট চুকিয়ে দেবে। বাজ তো ভেঙে পড়লই, কপালও চাপড়াল, বাপটা স্ট্রোকে ঘুমের মধ্যেই মরে গেল যে। বলেছিল তো ‘বেটা ওই ভিনদেশে গিয়ে কাজ নেই, দুই ভাই মিলে ব্যবসাটাকে মিলেঝুলে চাঙ্গা করে নে।’ লোভ নয়, সবটাই এই বয়সের ঘরছুট পালাই পালাই স্বভাব। আলমই উসকে দিত ওর মন যমুনার নাওকে। বসন্ত বলত ‘ঝেড়ে ফেলে দে, তাকিয়ে দেখ তো দেখি, আমি কেমন বাদশা সেজেছি।’ আলম হাত উপরে তুলে, পায়ের তালু এপাশ ওপাশ করে দেখাত,’এইরকম করে নাকি গো।’ ‘বিটকেলপনা করিস না বাপ, আমি যখন দুনিয়ায় এসেছি, তুই তখন…’ ‘ কী করছিলাম, বল লিখিনি, ওপরওয়ালা আমাকে নিয়ে মাটির তাল পাকাচ্ছিল বুঝি, আর সময় বুঝে দিল ছুঁড়ে, তারপর গড়াতে গড়াতে আঁতুড়ঘরে, বাঙলার মাঠেঘাটে জঙ্গলে, খালেবিলে, হাটে বাজারে।’ ‘তোর কথার কত বাহার’ ‘জানিনি গো দুঃখের জ্বালায় কথাগুলা বের হয়ে আসে, আমি কি আর বলি, আমাকে দিয়ে কেউ যেন বলিয়ে নেয়।’ ‘ সুখ দুঃখের ভাবখানা এত সহজ কথায় বোঝা যায় না পাগল। ভাগ বাটোয়ারা না জানলে চলে কেমন করে? ‘তুমি যে ইস্কুলের স্যার হয়ে গেলে গো বসন্তদা।’ জীবন আসে, জীবন যায়, সময় এসে জবাবখানা দিয়ে যায়, এতো জীবন থেকেই শিখেছি রে আলম।’ এক ঘরের মধ্যে ঘর থাকলে গলাগলি করে কত কিছুই না শেখা রায়। বসন্ত ভাবতই বা কেমন করে – ওই তো রাজার হাতি মেলায় যায়, ঘরের সামনে ঘর বানিয়ে ইজিচেয়ারে ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং দুলিয়ে নিজের আনন্দে নিজেই মাতে। সনকা এসে বলে, ‘করছটা কি, পেয়াদার কানমলা খাওয়ার সখ হয়েছে?’ রাজার ঘর দিন দুনিয়ায়, ঘরের মাঝে রাজা সাজলে কার কি এলো গেলো। সকলে তো কেনা গোলাম নয়, যে নাকে খত দিতে হবে।’ ‘রাজার হুকুম তো মানতেই হবে।’ ‘তবে আমরা কারা?’ ভারি সোন্দর কথা বলেছিলে গো,আমরা কারা। চল যাই কচুবনে, কচুপাতায় গা ঘষিগে, টেরটি পাবি কারে বলে রাজা, কারে বলে প্রজা। আলমের চক্ষু চড়কগাছ। কোথাকার কথা কোথায় এনে ফেলল। বসন্তদাগো তোমার চরণ দুখানি দাও, একটা পেন্নাম ঠুকিগে।

(২)

বসন্ত ইতঃস্তত পায়চারি করে ভাবতে শুরু করল, কোথায় আসলে আসন পেতে বসে আছে সেই মানুষটি যে সব কিছু হারিয়ে ফেলেও না পাওয়ার সুখে ঘুরে মরে। কত তো আয়োজন, মন্ডা মিঠাই, লুচি হালুয়া, চিকেন রোস্ট, রেশমি কাবাব, হরিয়ালি কাবাব, আরও কত কি। বসন্ত লোহার কড়াইয়ে নাড়েচাড়ে, ডিমের ওমলেট, আলু পটলের তরকারি, মসুরের ডাল। বাছা বাছা কোন এক দিনে মাছের ঝাল, জিভের স্বাদ পাল্টাতে কষা খাসির মাংস কালে ভদ্রে, আনন্দ আর ধরে না। সুখের সংসারে জোড়া লেগে যায়। ওরা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে – তাক ধিনা ধিন ধিন। যাবে রে কোনপথে, আনন্দের রস যে গলে গলে পড়ে। বসন্তের খানা পাকাতে আনন্দ, পরিবেশনে আনন্দ, খেয়ে আর খাইয়ে আনন্দ। ওরা ভরপেট খেয়ে যে যার কাছে চলে যায়, ভরপুর তৃপ্তিতে আলমের দু’গালের দু’পাশে টোকা মারে – ‘খাওয়াতেই পেট ভরে, খুশিতে না?’ আলমের কপালের ভাঁজটা চওড়া হয়েছে। মালিক লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে আগুন লাগিয়েছে, তাইতে কাঁই কাঁই। সান্ত্বনা বাক্য যে শোনাবে, কই সেই লোকগুলো, বাপরে বাপ সেই কি কম ঝক্কি। টুসকি মেরে উড়িয়ে দেয় বসন্ত। রোজগারপাতি করার রকমসকম আলাদা। রাতে অন্যরা এসে ঘরের দখল নেয়, মালিকানাও পাল্টে যায়।

সিকিউরিটির পোশাকটা গলিয়ে নেয়। তিন মাইল দূরত্বের রাস্তা ঘাটকোপার, হেঁটেই মেরে দেয় গুটি গুটি পায়ে পথচলা, ভাঙা পাথরের টুকরোগুলো জুতোর নিচে খোঁচা মারে, দোকানপাট থেকে কর্মচারীরা উঁকিঝুঁকি মারে, ওর হাঁটার ভঙ্গি দেখে হেসে কুটিকুটি হয়। নিজেও নিজেকে দেখে বলতে থাকে, ‘ও হালার বেটা হালা, দিন দুপুরে বাঁধাইকর, রাতে চোর ধর। চল বেটা চল, জোরসে হাঁট।’ নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার মজাই আলাদা। পেটের ভাত হজম হয়, খিদের ইচ্ছেটা ঘন ঘন এসে পেটে মোচড় লাগায়। বসন্তের চাই তো ঐটুকুনি। তবে বাপু ভাবল ডিউটি কেন, ঘরবাড়ি খাওয়া খরচ, বাড়িঘরদোর সামলে কুলিয়ে উঠতে পারে না বসন্ত। না হয় প্রাণভরে শ্বাস নিতেই ওর মনের যত আনন্দ। আহা গাঁয়ের পুকুর পাড়ে ঘেঁটু শাক তোলাতেই কেমন পাগলপারা, পায়ের গোড়ালিতে কেমন সুড়সুড়ি দেয়। ঘাসের আগা, আঁশশেওড়া গাছ আর গাঁদালি গাছের ডগাগুলো পায়ের সঙ্গে কেমন জড়াতে চায়, আহা, কেমন নরম সুরে বেঁকে বলে, ‘থাক না একটু।’ মানসিক পাড়ার ছেলে ছোকরারা বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কত মনের কথা, প্রাণের কথা বলে। ভেতরটা মনে পড়লে কেমন জ্বলেপুড়ে যায়, মনটা তাইতো কেমন থলথলে হয়ে আছে। বসন্ত বুঁদ হয়ে থাকে। আলম যে গলা ফাটায়, শুনতেও পায় না।

মোবাইলটা ক্রিং ক্রিং করছে যে বুঝতেও পারে না। কেমন জগৎটা এল, একটু স্থির হয়ে বসতে দেবে না, অস্থির করে মারবে, নালিশ যে জানাবে, বিচারক শুনলে তো, কোর্ট চত্বরে মাড়িয়ে তো দেখেছে, হাজারো মামলার ফাইলের ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে আছে স্বয়ং, আমাদের মুখগুলো চিনবে কখন! ওই তো দূরে কত বড় বাড়িটা, খালিই তো পড়ে থাকে, লোকজনের আনাগোনা নেই, দিনেরাতে ওদের ঘরবাড়ি পাল্টে যায়। আরে দূর এসব ছাইপাশ কেন ভাবছে, লোকগুলো যেমন থাকছে মজা করে ওদের গাড়িবাড়ি নিয়ে,থাকুক না, তাতে ওর কী! কত গাড়ি তো ছুটছে হুশ হুশ করে, ওদের ভ্যানগাড়িটা মোরাম বাঁধানো রাস্তা দিয়ে তখন ধাপুসধুপুস করে যেত, আহা, দুপাশের নারকেল সুপুরির বাগানরা কেমন চোখ পাকিয়ে দেখত, ন্যাড়া মাথায় ছানাপোনারা আর তাদের বছর উনিশ কুড়ির মায়েরা ফুলকাটা তাঁতিবাড়ির শাড়ি পরে মনের আনন্দে ছায়ায় ছায়ায় ঘুরে বেড়াত। দেখা কি যেত লেজ দোলানো গরুছাগলের শরীরেই তো ঢেকে যেত বাড়ির পর বাড়ি, গ্যারামের পর গ্যারাম, চোখের এত ক্ষ্যামতা কোথায়, ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে দেখে, না দেখার আনন্দেই হেঁচড় পেঁচড় করেই বাকি পথটা পেরিয়ে যেত। মাঝিদের গলাখানেও তো কম দরদ ছিল না। ‘ আরে ও বসন্তদা অত কী ভাবতেছ? ভেবো নি বেশি, কুল কিনারা পাবে নি।’ আলমের কথাটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কিছু কি করার আছে, বলেও তো ‘জীবন তো এমনই, যখন দেয়, ছপপর মাইরা দেয়, না হইলে এমন ডোবান ডুবাইব, হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করে জানটা কাইরা নিব।’ বসন্ত ভাবে জীবনের মায়া এমন করে ধরা দেয় ক্যান। ‘বসন্তদা, এই দুনিয়া বড় আজব দুনিয়া, খাও দাও আর মস্তি কর, যত খুশি চিবাই নাও।’ আলমটা বলে কীরে! বেটার মাথায় গোলমাল হয়েছে। কোন দিকটা দেখবে, আর কোন দিকটা দেখবে না, না বুঝতে পেরে আবোল তাবোল বকছে, সদ্য কাজে লেগেছে তো, মনটা কাঁচা, ভাবটা ভাগাভাগি করতে শেখে নি। মোবাইলটা আবারো বেজে ওঠে। জনগণের ভালো করবে বলে উঠে পড়ে লেগেছে। ছদ্মবেশের জুড়ি নেই, মানুষের বাড়া। হরবোলা না বহূরূপী কোন দলে যে যেতে চায় কে জানে। কত কারসাজি মনে মনে বাবুলোকদের। বসন্তের কল্পনার সময়টা কৌশলে কেড়েকুড়ে নিতে চায়। ভুলিয়ে দিতে চায় ফেলে আসা দিন, টাটকা সময়। ওরা যে ভাবে ভাবাতে চায় সেভাবে ভাব, তবেই না ওই ইমারতগুলোর মালিক হবে, ভাবলেশহীন আগামীর স্বপ্ন গড়ে দেবে। কোটির স্বপ্ন চুরি করে একা অধীশ্বর সাজার মন্ত্র শেখাবে। তাই তো ক্রিং ক্রিং শব্দগুলো দিনেরাতে বাজাতেই থাকে। ‘ওই চুদির ভাইদের আর কোন কাম নাই, খালি মোদের রক্তচোষা।’ কিছু বুঝলে বসন্তদা। আলমের কথাগুলো নিয়েই নাড়াচাড়া করে বসন্ত। আবার নিজের কাছে ফিরে যায়। আলম ভাবতেই পারেনা চারধারে এত অন্ধকার, তবু কেমন করে মানুষটা পথ চলে! ‘তুমি কেমনি করে শিখলে এই বিদ্যা?’ ‘কোন বিদ্যার কথা বলছিস?’ ‘এই বেখেয়াল হওয়ার বিদ্যা।’ বসন্ত হাসে। আসলে ও যে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে, চিন্তার ভুবনে কখন অন্যরকমের গন্ধ লেগেছে, কি জানি, ভেবে বসে আছে এটাই তো পথ, বাকি পথ তো ওর জানাই নেই।

লোকগুলোর সঙ্গে ও পাড়ি জমাবে কিনা কি জানি। আলমও যাবার বেলায় অনেক অনুরোধ উপরোধ করে বলেছে, ‘চল ঘরে ফিরে চল।’ ও গা করে নি। লাশের খবর ওর স্ক্রিনে ধরা পড়ছে না, এমন তো নয়। অতিমারীর তান্ডবলীলা তার সংহারমূর্তিকে যত দানবীয় চেহারা নিয়ে হাজির হচ্ছে, বসন্ত’র মায়ার বন্ধন ততই আঁটোসাঁটো হচ্ছে। এমন প্রশ্নও জন্ম নিচ্ছে – ওর ভাগাভাগির ঘরটা দিনেরাতে একার কেবলই একার হচ্ছে! শুধুই কি এক সংশোধনাগারের চেহারা নিচ্ছে, না অন্য কিছু। প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর খুঁজছে ও কী সব দায়িত্ব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে বিদায় নিতে পারে, না পারা যায়! কত তো মূল্যবান বইয়ের বাঁধাই ও নিজে হাতে করে। রাতের নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্বও ও নিজে হাতে সামলায়। তবুও ওদের চলার পথের দিকে ও যে চেয়ে থাকে, একটুও তো পলক পড়ে না। কত মুখই তো দল বেঁধে এসেছিল কত আশায় বুক বেঁধে, একদিন সুদিন আসবে। কত তো বাড়তি রোজগারের আশায় সাগর পাড়ি দিয়েছে, আকাশের সীমানা ছেড়েছে। ওই মুল্লুকে চুক্তির জীবন, আর কি কোনও কথা থাকে, আইনের ঘেরাটোপে বন্দী হতে কত আর সময় লাগে। এক একটা দলে যেন দেখা মেলে, ওর বাড়ির পাশের লোক, নিজের জেলার কিংবা অন্য জেলার। টলমল করছে পা, তৃষ্ণায় বুক ফাটছে, এলোমেলো চুলে কত না দৈন্যতা, কোথায় যাবে ওরা? কতদূর যেতে পারে এমন দশায়, পকেট তো গড়ের মাঠ। এত তো অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে, বসন্তের প্রশান্তির অন্ত কেন নেই, সকল কষ্টকে ও এমন করেই গলা টিপে মেরে ফেলতে শিখে গেছে, বাঁচার আনন্দেই মিল খুঁজে পাচ্ছে মৃত্যুকে বুকে টেনে নেওয়ার অভিনব কৌশল। ‘ওরে ও সমীর একটুখানি দাঁড়িয়ে যা। আফজল নেই বুঝি। তোকে একলা দেখেই তো বুঝেছি।’ বসন্ত জানে সমীরকে পথই টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় গিয়ে যে ঢুঁস খাবে? ও জানে পথ একসময় রূদ্ধ হয়ে যাবে, তবু বিরামহীন যাত্রা। বসন্ত এ-ও ভালো করে জানে, ওদের নিস্তার নেই। তবু মুখগুলো ধরে আদর করে নেওয়া, ছোট ছোট কথায় চেনা স্বরে কথা বলে আপনজন সাজা, যে সাজে ওরা ওকে দেখতে চায়। আনমনে মোবাইলে হাত পড়লেই স্ক্রিনটা নড়েচড়ে ওঠে। কী দেখছে ও!

(৩)

জীবনের কাছে ওরা কী চেয়েছিল? বেঁচে থাকার ঠিকানাই তো খুঁজেছিল। যাদের দেবার কথা ছিল ওরা পিছপা হয়ছে। অজুহাতের খাড়া তৈরি করেছে বলিতে চড়াবে বলে। স্ক্রীন থেকে সেই বার্তাই ফুটে বেরল। গাড়িগুলোর থেমে থাকা আর বাসের চাকা না ঘোরা আর মানুষগুলোর গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া একই পঙক্তিতে এসে জুড়ে গেছে। বসন্ত খুঁজতে থাকে হন্যে হয়ে সেই মুখগুলো যারা কিছুই তোয়াক্কা না করে আত্মীয়ের ছোঁয়া পেতে চেয়েছিল। বসন্ত আরো দু’একটা ইউটিউব নিউজে ক্লিক করতে থাকে। এই কী! মুখগুলো সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কেন? দূরত্ব হবে হয়ত কিংবা কোন বনজঙ্গল বা কোন উদোম মাঠ, মানুষজন সব মুখ লুকিয়েছে, শ্বাপদরা মুখ বাড়িয়ে আছে হাঁ করে, ধেয়ে আসছে কারা যেন, ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। ঘরটা কি আর একটু অন্ধকার লাগছে। এতটা আঁধার এসে জাপটে ধরতে পারে কোনদিন ও চিন্তার চৌহদ্দিতে জায়গা দেয় নি। এইমাত্র তো রাতপ্রহরার ডিউটি সেরে এল। ভোরের আলো এসে আকুলি বিকুলি করছিল যদি এক লহমায় চাঙ্গা করে দিতে পারে। কত তো ছায়া, সব এক এক করে নেচেকুঁদে বেড়াচ্ছে। সত্যিই কী তাই! ওরা কেউ কোনাকুনি, কেউ সোজাসুজি এসে কত কথাই তো বলা শুরু করে, ওদের না ছিল সকাল, না ছিল বিকেল, কতকাল পরে তো মুখ দেখাদেখি। মনের কথার দেয়ানেয়া। বসন্ত তো এইভাবেই পেতে চেয়েছিল। দাপাদাপি করবে ঘরময়, এমনি সুপ্ত আশা ছিল। যাবার বেলায় ওরা প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলেছিল। ওদের ফিরে আসা তো তাজ্জব কান্ড। কত দোষারোপ করছিল বাবা মায়ের উপর, এমন করে জন্ম দিয়েছিল বলে। বসন্ত চেয়েছিল হাত বুলিয়ে দেয়, চুলে বিলি কেটে দেয়, পারল কই, ওরা শেষে তো ওর কাছেই ফিরে এসেছে। ওরা এতক্ষণে ধরে যা শুনিয়ে গেল, বসন্তের তো মাথায় হাত। এমন একটা দিন যে আসবে, সময়টা যে এভাবে পাল্টি খাবে, এত আগাম ধরে ফেলা তো সহজ কথা নয়। ওরা আরও অনেক কথা বলতে চায়। ‘তোরা যা জেনেছিস, সবটাই বল, আমি শুনব।’ ওরা শুনল কি শুনলনা, এইকথা মনে করে ও কথা থামায় নি।

কত কথাই না বলেছিল প্রাণখুলে, হৃদয় ঝাঁকিয়ে। ওরা মাঠের মাঝে জড় হয়ে শুনেছে। আকাশ জুড়ে গুরুগম্ভীর ভাব। মেঘের কোলে মেঘ জমেছে। ঝরঝরে বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছে ওরা। লোম ভেজা গরুর পাল দৌড়চ্ছে, কত না সুখ ওই ঝড় ঝাপটায়। লোকগুলোর চোখেমুখে আনন্দ আর আতঙ্কের অদ্ভুত মিশেল। বসন্ত ওই দলেই ছিল। মেঘ গজরানোয় বিদ্যুত ঘেরা আকাশে কত না ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি। কে কোথায় যে ছুটে বেড়াবে। হাঁটুজলে কেউ কেউ জড়িয়ে যায় লতায় পাতায়। পা-টা টেনে ধরে হ্যাঁচকা টানে উল্টে ফেলে দেয়। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে টেনে তুলতে পারে না। বাজটা বোধ হয় কাছে কিনারে পড়ল। বলদটা হাম্বা হাম্বা চিৎকারে মাঠ ফাটাল। ওরা সব শক্তি জড় করে দিশাহীন হয়ে এই মাঠ থেকে ও মাঠে দৌড়ল। মাঠে মাঠে ধানের শীষ চোখ মেলে চেয়ে আছে, কেঁপে উঠলো ওই শব্দের মায়ায়, পাকা ধানের ছড়া দুলতে দুলতে সোজা হয়ে উঠল। জলের বাঁধন ঠেলে বসন্ত যখন সকলকে নিয়ে তালগাছের গোড়ায় পৌঁছল, ঠিক তক্ষুনি একটি তাল সোজা রতনের মাথার তালুতে পড়লে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, কিছুক্ষন গোঙাল। বসন্ত হাঁ হয়ে ওর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকালেই গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা চোখের জল রতনের ঠোঁটে, তারপর সব শেষ। এতক্ষণের প্রাণ বাঁচানোর জল ডিঙোন হায় হুতাশ মুহূর্তে নি:শেষ হলো। বসন্তের চোখের সামনে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ার শোক মনের গহীনে সেই যে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে জাগতে চাইলেও আজও জাগতে দেয় নি। কথার বাঁধনে চেপে রেখেছে,ভেবেছে হয়ত জীবন মরণ নিয়ে চিন্তার নেশা পেয়ে বসলে বুঝি আর ছাড়ে না। সেদিন তাল সুপুরির গাছ টপকে, পেয়ারা বাগান ছাড়িয়ে পুকুরের পাড়ে এসে পৌঁছল। নারকেল গাছের টুকরোয় বানানো সিঁড়ি টপকে নিচে নামিয়ে পা-টা জলে ভিজিয়ে বসে রইল চুপচাপ কিছুক্ষণ। মরণ সইফুল খালেক সঞ্জয় রতনের শরীরটাকে কাঁধে করে উঠোনে এসে ফেলল, ঠিক এই সময় কি একটা কামড়ে দিয়ে পালাল, কুঁচোমাছ না অন্য কিছু, শরীর বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে গেল তো বোধ হয়। এতক্ষণ মৃত্যুবোধ মাথায় চেপে বসলেও এবার বুকের মাঝে এসে ধাক্কা মারল।

স্ক্রিনটা বেঁকে যেতে থাকলে বসন্ত টেনে সোজা করে দেয়। কেন এমন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে ভেবে পেল না। লাশের ভারটা বইতে পারছে না, তাই বলে কী! আবার ভাবল, মাথাটায় নিশ্চয়ই কিছু গোলমাল হয়েছে, এতটা অবাস্তব পৃথিবীর সাক্ষী হচ্ছে, এও কী ভাবা যায়! নির্বান্ধব মৃত মানুষের চিতা জ্বলছে দাউ দাউ করে নিঃসঙ্গ আগুনে। কে কাকে জবাব দেবে? কে কার কাছে জবাব চাইবে, বসন্তের কাছে এর অন্তত উত্তর নেই। সত্যটা হল এই, দুদিন বন্ধ থাকার পর আবার মানুষের ঢল নামছে রাস্তায় । এমন কতগুলো শব্দ স্ক্রীনে ভেসে আসছে যা এর আগে কখনও শোনেনি, খটকাও লাগে। প্রথম শব্দটি কানে এল, ‘লকডাউন’। শব্দটা নতুনই লাগল, এর ফলাফল যে এত মারাত্মক হতে পারে, অনুমানই করতে পারে নি। হাঁচি কাশি তে ভোগেননি, এমন মানুষ আবার ইহজগতে আছে নাকি, ওই নিয়ে অত ভাবাভাবির কি আছে। পর্দাটা জুড়ে এত ডাক্তারবাবুরা কথার পরে কথা বলেই চলেছেন, যার কথার মানে উদ্ধার করা বসন্তের কম্ম নয়। তবে সকাল সন্ধ্যে একই কথার পুণরুল্লেখে মাথায় ঝিম ধরে যায়। ‘চায়না’, ‘বাদুড়’, ‘ছয় ফুট দূরত্ব’ ‘ড্রপলেট’ শব্দগুলো মাথায় গেঁথে যায়। আর একটা ইংরেজি শব্দ কিছুতেই মাথায় রাখতে পারে না। বড্ড খটমট। এই আসে এই উবে যায়। কে যে এসব শব্দ বানিয়ে বাজারে ছাড়ে, সরকার না অন্য কেউ। দুটি শব্দে পিলে চমকে যায় ‘হোম আইসোলেশন’ ‘কন্টেনমেন্ট জোন’। প্রথম শব্দ নিয়ে ওর একটু আধটু বেদিশা লাগে। জনে জনে জিজ্ঞেসও করে বাঙালি মহল্লায়। কথাটার আধো আধো উত্তরে মানে উদ্ধারের চেষ্টা করে। একা হয়ে যাওয়ার জীবন কেমন হয়, একটু একটু করে বোঝার চেষ্টা করে। মনের অন্দরে বাসা বাঁধে কত রকমের রোগ, অভিজ্ঞতা যে ওকে শিখিয়েছে জড়িয়ে জড়িয়ে থাকা। ঘরের অন্দর বিষময় হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। মানুষগুলো ছন্নছাড়া হয়ে লুকোতে থাকে। এত ভয় কীসের! আর কি ওরা পৃথিবীকে চিনতে চাইছে না! অথচ প্রতি পদে পদে হারিয়ে ফেলছে শব্দমুখর এই জীবন। প্রশ্ন তো জাগে ক্লান্ত শ্রান্ত জীবনে এইভাবেই কি সমাপ্তি টানবে একদিন! দলে দলে নির্বাক হেঁটে যাওয়া মানুষগুলো কি সেই পথে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, অচেনা গলিপথ! এইভাবে চেনানোর কি খুব দরকার ছিল? এই জিজ্ঞাসার উত্তরই তো বসন্ত খুঁজে বেড়াচ্ছে। যা শিখতে ও চেয়েছিল, শিখতে ও পারেনি, যা শুনতে চেয়েছিল, শুনতে পায়নি, যা বুঝতে চেয়েছিল, বুঝতে পারেনি, আজ নির্জনতা ওকে কানে ধরে শিখিয়ে দিচ্ছে, বন্দী না হলে মুক্তি কাকে বলে জানবি কেমন করে। ওই তো গলির মোড়ে। মোড়ে মোড়ে লাল অঞ্চল, এরও নাকি বাঁচার কত
শর্ত আছে। হলুদ রং এর মাহাত্ম্যে তো কম কিছু জুড়ে দেওয়া হয়নি। সবুজে সবুজে মাতিয়ে দিলে ওরা খোলা হাওয়ায় মুক্তির আনন্দে দুলে ছিল। বসন্ত জানতে চায়, সাদা রঙের মেলায় মিশে গেছে বলেই না আলাদা করে ওরা চিন দেয় না। স্ক্রিনটা তিড়িং বিড়িং লাফিয়ে ওঠে, সময়ের দোহাই দিয়ে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়, আর ফেরত পাঠানো যায় না, বসন্ত ভাবল আবার কি এমন নতুন দুর্ঘটনা ঘটল, মনের ঘরটাই ওলটপালট হল।

(৪)

দরজাটা খুলেই গেল। মনের কোনে বাসা বাঁধল অন্য আশা। স্ক্রিনটা ওলটাতেই ভিড়ের মধ্যে চেনা মুখগুলো সেই যে বেরিয়ে এল, আর ফিরে এল না। বসন্ত কত চেষ্টাই তো করল, ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে গেল, কত চিন্তার রসদ এল, কিছুতেই যখন কিছু হল না, নিস্ফল আশায় মাথার চুল ছিঁড়ল। স্মৃতির কণাগুলো এলোমেলো হয়ে এল তো কাছাকাছি, আবার বিচ্ছিন্ন হল। আবার সুইচ অফ সুইচ অন করাতেই জ্যান্ত হয়ে উঠল স্ক্রিনটা, মুহূর্তগুলো ফিরে ফিরে এল। কী আশ্চর্য, ও যা দেখতে চাইছিল, তা নয়, অন্য জগৎ। বন্ধুর শৈশবের মুখ, বন্ধু কী, না বন্ধুর মতো! গ্ৰীষ্মের দাবদাহ কেটে গিয়ে হিমেল হাওয়া। ঘর্মাক্ত কলেবরে ওরা কারা! ওরা জড় হয়েছিল। বন্দী দশায় এর বেশি কিইবা ঘটতে পারে। অক্সিজেন ঢুকছে শ্বাস প্রশ্বাসে। পিপিই গ্লাভস মাস্ক আর গগলস পরে মুখে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডাক্তারবাবুরা। মরা মানুষগুলো অনাত্মীয় হয়ে চলে যাচ্ছে ভাগাড়ে নাকি শ্মশানে, জীবন থেকে মায়া ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কায় কতটা কান্না করেছিল কি জানি। স্যানিটাইজেশন শব্দটাও বড্ড ভারি লাগল। হলে মন্দ হতো না। মশা বনবন করছে চারধারে, কামড়াতে আসলে হাত দুটোকে হাতিয়ার করেই ফেলা যায়। এই অদৃশ্য ঘাতকের আক্রমণ প্রতিরোধ করবে কোন জাদুবলে! মোবাইলের সংযোগসূত্রটা আবারও বিচ্ছিন্ন হয় ওর চিন্তাসূত্রকে দুয়ো দিয়ে। লকডাউন শিথিল হলে পর পর দুটো দল ঘরমুখো হল। সিনেমাহলের বিরতি শেষে ঘন্টা বাজিয়ে আবার দ্বিতীয়ভাগ শুরু হলো যেন। এবার ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেল কোন অজুহাতে কি জানি। জানালাটা খুলেই দেখল সেই মুখ, সেই চোখ, অস্বীকার করবে কোন উপায় যে নেই। কবে এসেছে এই শহরে জানতেই পারে নি। না না, এই মানুষটাকে কিছুতেই ও অজানা পথে ঠেলে দিতে পারে না। ‘মোতালেব চাচা না! সেলাম চাচা।

পাড়ায় পাড়ায় গন্ডগোলের সময় প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে বসন্ত’র বাবা কাকার প্রাণ না বাঁচালে ও অনাথ হয়ে যেতো। ‘পালাচ্ছ কেন চাঁচা?’ ‘তুইও পালা, মরব, আমরা সবাই মরব। মরতে যখন হবেই, তখন ঘরে গিয়েই মরব। পোঁটলা পুঁটুলি গোছগাছ করে নিয়ে চল। গায়ে দুদিন ধরে জ্বর, জুতের লাগছে না শরীরটা।’ ‘পাগল হয়েছ, এই শরীর নিয়ে হাঁটা লাগিয়েছ, প্রায় তেরশ মাইল দূরের পথ, রাস্তায় পড়ে মরে থাকবে, কেউ দেখার থাকবে না, ঘরে এসে আগে একটু বিশ্রাম নাও দেখিনি।’ মোতালেব শুয়ে শুয়ে কত কি ভাবে। নজরটা ঘুরেফিরে ওই স্ক্রিনটার দিকেই চলে যায়। ‘এই বসন্ত, এত ছোট পর্দার টিভি পেলি কোথেকে?’ ‘টিভি নয় গো চাচা, গরীব মাইনষের বুদ্ধি, নিজেই বানিয়েছি।’ ‘তোর মাথাটা বরাবরই পরিস্কার।’ ‘টিভির মতোই তো লাগতেছে। চালা তো দেখি, কেমন তোর বুদ্ধির বহর!’ মোতালেব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ‘ এই দেখ বসন্ত, এই দেখছি তোর টিভিতে আমার জ্বরের কথাই বলে রে। বলতেছে জ্বর হলে আলাদা ঘরে থাকতে।’ বসন্ত ভালো করেই জানে আলাদা ঘর আর কোথায় পাবে। ‘থামো তো চাচা, ডাক্তারবাবুদের সক্বল কথা শুনতে নেই।’ দুপুর গড়িয়ে রাত হলে বসন্তেরও জ্বর জ্বর লাগে। বসন্ত ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে ওই রোগে ওকেও ধরেছে। ডাক্তারবাবুরা যা যা লক্ষণ বলেছে, দুজনের শরীরে ফুটে বেরুচ্ছে। বসন্ত এত দিনে জেনে ফেলেছে আর বোধ হয় বাঁচার আর কোন রাস্তাই খোলা নেই। ‘মোতালেব চাচা, চল, তোমাকে হাসপাতালে দিয়ে আসি।’ ‘ কেন রে বসন্ত? তবে কি আমাদেরও ওই করোনা হয়েছে?’ বসন্ত দেখল লুকিয়ে রেখে আর কী লাভ। ‘হ্যাঁগো চাচা করোনা।’ ‘তবে আর আমাকে বাঁচিয়ে কী লাভ! বিদেশ বিভুঁইয়ে তোকে ছেড়ে আর কোথায় আর যাব। এক গাঁয়ের লোক, মরব যখন চাচা ভাতিজা এক সঙ্গেই মরব।’ দুজন দুজনকে গলা জড়িয়ে ধরল। চোখের জলও ফেলল এ ওর গায়ে। দুজনের রোমকূপ সেই জল টেনে নিল। শ্বাসকষ্টটা তখন ওদের বেড়েই চলেছে। বসন্তের টিভির পর্দায় তখন সাংবাদিক বলেই চলেছে সেইদিনের মৃত্যুসংখ্যা, যোগ বিয়োগে দুটি সংখ্যার গরমিল রয়ে যাচ্ছে কিনা কি জানি। মোতালেব বসন্তকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সেলাম’।

[ছবি- আন্তর্জাল]


[পরম্পরা ওয়েবজিন, সেপ্টেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]