সন্দীপ ছিল বিরাট, অতিকায়
আমাদের ভেতর সন্দীপ ছিল বিরাট, অতিকায়। সন্দীপ দত্তের মৃত্যুতে, আমরা, যারা লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক, কর্মী, আমরা হয়েছি হতশ্রী, আমাদের মনে পর্বত পতনের কম্পন জেগেছে।
সন্দীপের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সূত্রপাত ১৯৭৭-৭৮ সালে, ওঁর লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি শুরু করার বেশ কিছুদিন আগে। সেইসময় সন্দীপ লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি করা নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে মাত্র। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের কর্মী-সম্পাদকের সঙ্গে তখন তাঁর যোগাযোগ- মেলামেশা শুরু হয়েছে। সেই সময় আমার সঙ্গে ওঁর প্রথম পরিচয় ১৯৭৭ সালে, যখন জরুরি অবস্থা শিথিল হয়েছিল। নির্বাচনও তখন ঘোষিত হব হব করছিল। সেসময় জনমনে একধরনের মুক্তির আনন্দ দেখা যায়। ময়দানে, রবীন্দ্রসদনের উল্টোদিকে কলকাতা বইমেলাও সেসময় শুরু। লিটিল ম্যাগাজিন লেখক কবির যশখ্যাতিপ্রাপ্তির সোপান নয়, সাহিত্যের সুতিকাগৃহ নয়, লিটিল ম্যাগাজিন সাহিত্যের মূলধারা, এমনটাই ছিল সন্দীপের অবিচল বিশ্বাস। আমাদের আমন্ত্রণে সন্দীপ কৃষ্ণনগরে শত জলঝর্নার ধ্বনি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল, সেখানে সে একথা বলেছিল, ওই সম্মেলনে সন্দীপ লিটিল ম্যাগাজিনের এক প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করেছিল। প্রতি বছর লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির বার্ষিক সভায় পশ্চিমবঙ্গ, বহির্বঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি লিটিল ম্যাগাজিনকেও পুরস্কৃত করা হত। গবেষণার কাজে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির সাহায্য নিয়ে যাঁরা কৃতী হয়েছেন, সন্দীপ তাঁদের পুরস্কৃত করত। বাংলার সর্বমান্য গুণী মানুষেরা এসেছেন লাইব্রেরির বার্ষিক সভায়। মনে পড়ছে উত্তরবঙ্গ থেকে সন্দীপের লাইব্রেরির বার্ষিকসভায় এসে সাগ্রহে অমিয়ভূষণ মজুমদার লাইব্রেরির জন্মদিনের পদযাত্রায় পথও হেঁটেছিলেন।
লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির উদ্ভাবক, প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সন্দীপ বিরাট, একথা সবাই মানবেন। কোনও সাহায্য, সহায়তা ছাড়াই একার এই উদ্যোগ বিস্ময়কর, কিন্তু সন্দীপের কীর্তির বিচ্ছুরণ আরও বিবিধক্ষেত্রে অতিকায় মানুষের রামধনু সমতুল বর্ণিল ছটায়, যা অনেকের অজানা। ওই বন্দিমুক্তির আন্দোলনে যোগ দেওয়া শুধু নয়, পরবর্তী দশকগুলিতে অরাজনৈতিকভাবে গণমানুষের ক্ষোভবিক্ষোভে সন্দীপের যোগদান, কোনও কোনও ক্ষেত্রে লিটিল ম্যাগাজিনের কর্মীদের নিয়ে সংগঠক হিসেবেও সে ছিল মানুষের সাথী। জরুরি অবস্থার অবসানে গৌরকিশোর ঘোষ ও আরও কেউ কেউ একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন কলকাতা তথ্য কেন্দ্রে। জরুরি অবস্থায় গোপনে যে সব প্রতিবাদী পুস্তিকা প্রচারপত্র বের হয়েছিল, সেসবের ওই প্রদর্শনীতে বেশ কিছু পত্রপত্রিকা পুস্তিকা ছিল সন্দীপের সংগ্রহের। মরিচঝাপির ঘটনার পুস্তিকাও বিলি হয়েছে লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি থেকে। নন্দীগ্রাম ঘটনায় শঙ্খ ঘোষের ডাকা মহামিছিলের লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক কর্মীদের নিয়ে অন্যতম সংগঠক ছিল সন্দীপ দত্ত।আসানসোলের সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনায় সম্প্রীতি মিছিলের আহ্বান করেছিলেন শঙ্খবাবু, তাতেও সন্দীপ ছিল ওই মিছিলের অন্যতম সংগঠক ।
‘সিন্ধুতে বিন্দুবৎ’ বলে একটা কথা আছে। সন্দীপের ক্ষেত্রে কথাটাকে উল্টে বলা যায়, সন্দীপের লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির আয়োজনটি বিন্দুতে সিন্ধুকে ধারণ করার। মধ্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিট সংলগ্ন নিজেদের সাবেকি বাড়িটির একতলার একটি ঘর, যেটি ওই বাড়ির বসার ঘর, সেই ছোটঘরটিতে সে তার লাইব্রেরি সাজিয়ে নেয়। সামনের টেবিলে চারটি চেয়ারে ঠেসেঠুসে জনা চারেক বা এক চেয়ারে দুজন ভাগাভাগি করে ছ’সাতজনও বসতে দেখে। পরে সন্দীপ পাশের ঘরটিও লাইব্রেরির দখলভুক্ত করে। তাতে বাড়লেও লাইব্রেরিটির অপরিসর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়নি, লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রের গৌরবে গ্রন্থাগারটি জ্বল জ্বল করে ওঠে। একথা আমি ঢাকায় সায়ীদ ভাইকে বলেছিলাম। ১৯৮৬ সালে প্রথমবার ঢাকায় গিয়ে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র যখন দেখি, তখনও কেন্দ্র নবীন, যেন সবে পাখনা মেলছে। সুপরিসর এমন ক্ষেত্র কলকাতায় আমাদের বন্ধু সন্দীপ পায়নি, এমন পরিকাঠামো সে গড়ে তুলতে পারেনি। সে ইচ্ছেও সম্ভবত সন্দীপের ছিল না। সে কেবল লিটিল ম্যাগাজিনের, পশ্চিমবঙ্গ, বহির্বঙ্গ, পরে বাংলাদেশেরও লিটিলম্যাগাজিনগুলির সংরক্ষণের কথা ভেবেছিল (পরে অবশ্য আরও বড় জায়গার কথা ভাবছিল)। তা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে ওই ১৯৮৬ সালে আমি সন্দীপের কথা, তার লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি কথা বলেছিলাম। কৌতৃহল প্রকাশ করেছিলেন সায়ীদ ভাই। কলকাতায় ফিরে সন্দীপকে জানিয়েছিলাম সায়ীদ ভাই আর তাঁর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কথা। ঢাকায় গিয়ে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র দেখে কলকাতায় ফিরে শঙ্খ ঘোষও লিখেছিলেন একটি লেখা।
একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। সন্দীপের লাইব্রেরির সূচনাতেই আমি তাঁর লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির সদস্য হয়েছিলাম। আমি তখন ‘যুগান্তর’-এ কাজ করি, প্রথমে বাগবাজারে, তারপরে নোনাপুকুরে আমাকে নিয়মিত যেতে হত। বিকেলের দিকে মাঝেমধ্যেই আমি সন্দীপের লাইব্রেরিতে আসতাম। এরপরে আমি যখন ‘আজকাল’-এ যোগ দিলাম, তখন আমার অফিস হল আমহার্স্ট স্ট্রিটে, সেসময় সন্দীপের লাইব্রেরিতে যাতায়াত আরও নিয়মিত হল। যেকোনও ভাল, উল্লেখযোগ্য লিটল ম্যাগাজিন বেরোলে সন্দীপ তা আমাকে দেখাত । আমার মনে আছে দক্ষিণবঙ্গের এক রিক্সাচালকের কথা, তিনি নিজে একজন কবি, একটি ছোট পত্রিকাও প্রকাশ করতেন, নিজের লাইব্রেরিতে সন্দীপই আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। আমার পেশাগত কাজের প্রয়োজনেও নানাভাবে সন্দীপের সাহ্যায্য পেয়েছি। মনে আছে, ‘লজ্জা’ উপন্যাস লেখার পরে তসলিমা নাসরিন তখন ঢাকায় মৌলবাদীদের চাপে আত্মগোপন করে আছেন। একমাত্র তাঁর আইনজীবী কামাল হোসেন ছাড়া তসলিমার খোঁজ কারও কাছে ছিল না। ঢাকার একটি সূত্রে আমি অনেক রাতে খবর পেলাম, তসলিমা ইউরোপগামী একটি বিমানে উঠেছেন। সম্ভবত আন্তর্জাতিক লেখক সঙ্ঘ পেন-এর আশ্রয়ে সুইডেন যাচ্ছেন। আমি ঢাকা থেকে রাত দুটোর সময় এখবর পেয়ে সন্দীপকে ফোন করলাম। আমার জানা ছিল সুইডেন থেকে এক বাঙালি ভদ্রলোক বাংলায় একটি পত্রিকা বের করেন। সন্দীপ একবার লাইব্রেরির বার্ষিক সভায় ওই প্রবাসী বাঙালি ভদ্রলোককে সম্বর্ধনা দিয়েছিল। সন্দীপ আমাকে গজেন্দ্রকুমার ঘোষের ফোন নাম্বার দিল, সেই রাতেই সন্দীপ আমার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ করিয়ে দিল। গজেনবাবু আমাকে তসলিমার রেডিও ফটোসহ সুইডেনে তাঁর পৌঁছোনোর খবর দিয়েদিলেন। আজকাল-য়ে প্লেট চেঞ্জ করে তসলিমার সুইডেনে পৌঁছনোর খবর দিয়ে দেওয়া হল।
সন্দীপ একটা স্কুলে পড়াত। এছাড়া তাদের কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে একটি পারিবারিক ব্যবসা ছিল। আমাদের শ্রীরামপুরে ওদের একটি পারিবারিক অট্টালিকা আছে গঙ্গাতীরে। সেখানে সন্দীপ লাইব্রেরির অনেককে নিয়ে পিকনিকের আয়োজন করেছিল। সন্দীপ মন-প্রাণ, অর্থ ও সময়— সব ঢেলে দিয়েছিল তাঁর লাইব্রেরিকেই। অনেকেই হয়তো জানেন না, সন্দীপ প্রথম জীবনে কবিতা লিখত। ‘পত্রপুট’ নামে সে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করত। কিন্তু কবিতা এমন একটা জিনিস, যে অন্য কোনও কাজ করলে কবিতা লেখা যায় না। সন্দীপ তাই কবিতা লেখা ছেড়ে লাইব্রেরির কাজেই মনোনিবেশ করেছিল। এছাড়াও ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ নামে সে আরেকটি পত্রিকা বার করত। অন্য কোনও লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত পুরনো ভাল লেখা সে ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’-এ প্রথম প্রকাশের ঋণস্বীকার করে ছেপে দিত। যেকোনও প্রাচীন ও দুরূহ পত্রপত্রিকার খোঁজ তার কাছে ছিল, যখনই কোনও গুরুত্বপূর্ণ লেখার জন্য সেইসব লিটল ম্যাগাজিনের দরকার পড়েছে, সন্দীপ ঠিক তা খুঁজে বার করে হাতে তুলে দিয়েছে। সন্দীপের লাইব্রেরিতে বসে বাংলার প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রীরা গবেষণা করে গেছে৷ টেমার লেনের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র থেকে নানা বিষয়ের প্রচুর নবীন গবেষক উঠে এসেছেন।
আমি সন্দীপের স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলাম। সেখানে সন্দীপের মা, ভাই, স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হল। তাঁরা প্রত্যেকেই সন্দীপের অবর্তমানে তাঁর এই লাইব্রেরিকে রক্ষা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন৷ একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে, তারা লাইব্রেরিটির দায়িত্বে থাকবেন। আমি আশাবাদী, সন্দীপ যে অসামান্য স্বপ্ন দেখছিল পরবর্তী প্রজন্ম তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে৷
আহা পড়তে সেই আট দশকের দিনগুলো স্মরণে এসে যাচ্ছে ৷ লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে এত নিষ্ঠা এত গভীর প্রেম আর কারও দেখেছি বলে মনে নেই আমার ৷ খুব আন্তরিক লিখেছে মৃদুল ….ধন্যবাদ পরম্পরা সম্পাদককে এরকম একটি লেখা প্রকাশের জন্যে ৷
লেখাটি যন এক মূল্যবান দলিল। সম্ভবত ১৯৮৬ থেকেই সন্দীপ দার সাথে পরিচয় কোলকাতা বইমেলায়। ‘খুঁজে বেড়াই’ পত্রিকার তসলিমা সংখ্যাটি বইমেলার ওঁনার হাতে তুলে দিতেই খুব আহ্লাদিত হয়েছিলেন সন্দীপ দা । ২০১৯ এ কফিহাউসের বই-চিত্র সভাঘরে ওঁনার হাতে ‘বর্ণালী স্মারক সম্মাননা’ তুলে দিতে পেরে গৌরব বোধ করছিলাম ‘উত্তরের রোববার’ এর সবাই । মৃদুল দাশগুপ্ত দাদার এই লেখাটি পড়ে আরও কতকিছুই না জানা হলো আমাদের। আপনার লেখনী এভাবেই চলমান থাকুক দাদা 🙏
খুব ভালো লাগলো।
চমৎকার লেখা। সন্দীপবাবুর সঙ্গে খুব কম দিনই পরিচিত হয়েছি। মনে আছে, “ঢাল তলোয়ার ” পত্রিকা প্রকাশের পরপরই পত্রিকাটি সংগ্রহ করার জন্য চাইলেন। সেই অনুযায়ী ২য় ও ৩য় সংখ্যা লাইব্রেরিতে দিয়ে এলাম। লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে মানুষটির অনেক ভাবনাচিন্তা ছিল। আজকের লেখাটি এক সময়ের দলিল।
প্রয়াত সন্দীপ দত্তের স্মৃতি চারণ, অপূর্ব!
মৃদুল দাশগুপ্ত একটি মূল্যবান দলিল লিখেছেন।
প্রয়াত সন্দীপ দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই।