অমলকান্তি রোদ্দুর হয়ে থাক
২৫ ডিসেম্বর ২০১৮, যিশুর জন্মদিনেই চলে গেছিলেন ‘কলকাতার যিশু’র স্রষ্টা। সত্যিই কি তিনি চলে গেছেন?
নাকি অমলকান্তি, কলকাতার যিশু, বাংলায় অনূদিত টিনটিন, ডিটেকটিভ ভাদুড়িমশাই, দয়াময়ী, অমু, উলঙ্গরাজাকে নিয়ে রয়ে গেছেন আমাদের মধ্যে! হ্যাঁ, শতবর্ষ স্পর্শ করেও তিনি রয়েই গেছেন। এত দীর্ঘ সময় ধরে কোনো কবি কবিতা লেখেননি। জীবন-বেঁচে থাকা-মৃত্যুর কাছে অবনত না হওয়া আর তাঁর কবিতার মধ্যে বিশেষ কোনো ফারাক নেই। তিনি তাই লিখতে পেরেছিলেন — ‘আমি পাহাড় থেকে পড়তে পড়তে / তোমাকে ধরে বেঁচে রয়েছি, কবিতা / আমি পাতালে ডুবে মরতে মরতে / তোমাকে ধরে আবার ভেসে উঠেছি / আমি রাজ্যজয় করে এসেও / তোমার কাছে নত হয়েছি,কবিতা।’
তাঁর বহু পরিচয় দেওয়া যায়। তিনি কবি, তিনি কবিতা-ভাবুক, ছড়াকার, গদ্যকার, ভাষা সংস্কারক, ঔপন্যাসিক, ছোটোদের জন্যও স্বাদু-সাহিত্যিক।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায় আমরা পাই এক ধরনের ইতিবাচক জীবনদৃষ্টি ও মনোভাব। কখনো তাঁর কবিতায় খেলা করে অতীন্দ্রিয় রহস্যবাদ। তিনি গীতিকবি ছিলেন না — নিজের গহীনে ডুবে থাকা অন্তর্মুখী কল্প-কবি তিনি নন, তাঁর সংবেদনশীল কবি-চোখ ছিল জীবন, সমকাল, সমাজ ও পৃথিবীর দিকে। তিনি লিখেছেন — ‘কোথায় শুনেছে কে বা কবে / লাঠির দাপটে পরপর / এভাবে পুকুর চুরি হবে, / থাকবে শুধুই বাড়িঘর। / যেখানেই আজ চোখ থুই, জল নেই, শুধু সারি-সারি / প্রহেলিকা সাজানো, শুধুই / আটতলা দশতলা বাড়ি।’ আর এই দৃষ্টি ছিল স্নিগ্ধ, তার সৃষ্টি নাগরিক-শহরতলির রোজনামচার কথন। তাঁর কবিতায় জানলা একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। জানলা মানে জানলা দিয়ে দেখা দৃশ্যমান এক লোকজগৎ তাঁর কবিতার স্রোত বেয়ে পাঠকের চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। যেমন —
‘সকালবেলায় ভাবনা হঠাৎ ভেসে গেল। জানলার
ধারে গিয়ে দাঁড়ালুম। তুকতাকে বিশ্বাস না-থাকা সত্ত্বেও নিজের ছেলের কঠিন
অসুখের সময় অতি বড় অবিশ্বাসীও যেমন ওঝার কাছে খবর পাঠায় এও প্রায় তেমনি ব্যাপার।’
নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় ‘একা’, ‘নিজে’ বড়ো হয়ে ওঠেনি; কিন্তু কথকের একটা বড়ো ভূমিকা রয়েছে। তিনি কৌতুক করে বলতেন, ‘আমার অত কল্পনা নেই, কল্পনালতা নেই, আমি যা দেখি তার থেকে তুলে নিই, তার থেকে বেশি উপাদান আমার দরকার নেই।’ নীরেন্দ্রনাথ আরেক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন — ‘কবিতা জিনিসটা হচ্ছে স্বগতকথনের ব্যাপার।’ তাঁর কবিতা সবসময় স্বগতকথা নয়, আবার স্বগতোক্তির মতো হলেও প্রেমের মতো গভীর অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে অন্যভাবে। যেমন, তিনি লিখছেন — ‘মর্মমূলে বিঁধে আছে পঞ্চমুখী তীর, তার নাম ভালোবাসা।’
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বিংশ শতকের চার দশকের এক অবিরাম অন্তহীন কবিপ্রতিভা। এই কবিতাকে নিয়ে তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষাও ছিল অন্তহীন। এই প্রসঙ্গে একটি কথা, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী শুধু কবি নন, গদ্য সাহিত্যেও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি — প্রাবন্ধিক, রহস্য ঔপন্যাসিক, ভাষা-ভাবুক, বাংলা বানান নিয়ে নিয়মাবলির পথিকৃৎ তিনি। ছিলেন কবিদের অভিভাবক স্থানীয়, আশ্রয়। আর তাঁর যে পরিচয় না বললেই নয়, তিনি ছিলেন দক্ষ সম্পাদক। ছোটোদের ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকাকে আরও মনোগ্রাহী করে তুলতে তাঁর অবদান ছিল হীরের মতো উজ্জ্বল।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন ভাষা সচেতন, ভাবুক এবং সংস্কারকও। তাঁর ‘কী লিখবেন কেন লিখবেন’ একটি অসামান্য বই। শুদ্ধ-অশুদ্ধ বানান বিচার, কোথায় কোন্ বানান গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে তার একটা দারুণ খসড়া এই বই। এছাড়া কবিতার গঠনবিন্যাস, স্তবক, ছত্র ও ছন্দ বিন্যাস, প্রকাশভঙ্গি, শব্দপ্রকরণ নিয়ে নানা জায়গায় মত প্রকাশ করেছেন। কবিতার কারিগরি নিয়ে তাঁর ট্রিলজি — ‘কবিতার ক্লাস’, ‘কবিতার দিকে ও অন্যান্য রচনা’ এবং ‘কবিতার কী ও কেন’ আসলে কবি এবং বাচিক শিল্পীর প্রশিক্ষণ-পুস্তিকা। তাঁর ‘বাংলা ছন্দের মূলসূত্র’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সত্তর বছর পাঠ্যতালিকায় ছিল।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর প্রিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ, রাজশেখর বসু, জীবনানন্দ, শৈলজানন্দের প্রথম দিকের লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর এবং সুবোধ ঘোষ। আর আদর্শ ছিলেন বিদ্যাসাগর। তার দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ কেমন, জানতে ইচ্ছে করে বৈকি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ আছে তাঁর। ‘রবীন্দ্রনাথ ও আমরা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তিনি চমৎকার একটি কথা বলেহেন — ‘একদিকে যেমন তাঁরই নানা রচনা থেকে আমাদের আনন্দের সমর্থন ও শোকের সান্ত্বনা আমরা পেয়ে যাই, অন্যদিকে তেমনই সেই একই উৎস থেকে পাই ব্যক্তি জীবন ও সামাজিক জীবনের নানা ক্ষেত্রে আমাদের সংগ্রামের প্রেরণা। আমরা যখন ক্লান্ত, বিহবল, পরাস্ত, — তখন নতুন করে আবার উঠে দাঁড়াবার এবং প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আবার নতুন করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার মন্ত্রণা দেন তিনি। না, তিনি কোনো প্রাপ্তির লোভ দেখান না।’
আরেক অগ্রজ কবি জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে বলেছিলেন — ‘রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কবিতায় অন্য কেউ আলাদা ভাষা সৃষ্টি করতে পারেননি। জীবনানন্দ পেরেছেন। কিন্তু তাঁর মতো করে কবিতা লিখতে নেই। জীবনানন্দ আপয়ার স্বাতন্ত্র্যকে শেষ করে দেবে।’
নীরেন্দ্রনাথের ছদ্মনাম — বরুণদেব, রত্নাকর, কবিকঙ্কন প্রভৃতি। এঁরা সকলেই দৃঢ়চেতা। তাঁর কবিতাতেও ছিল সহজ বলিষ্ঠ উচ্চারণ। নীরেন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তার মূল কারণ, তাঁর কবিতা কাহিনি-নির্ভর, আবৃত্তিযোগ্য, সমকালীন এবং সর্বস্তরের মানুষের জন্য। এছাড়া তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন, অনেক মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, কবিকে সেই ভাষায় লিখতে হবে এবং একই সঙ্গে কবিতার মহিমাকেও বজায় রাখতে হবে। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন — কবিতার যাবতীয় উপাদান আমাদের চতুর্দিকেই ছড়িয়ে আছে। দরকার শুধু চিত্তে ঈষৎ বেদনা কিংবা চক্ষুতে ঈষৎ কৌতুক নিয়ে তাদের দিকে তাকানো। দরকার শুধু তাৎক্ষণিক অর্থের অতিরিক্ত কোনও অর্থ তাদের মধ্যে খুঁজে নেওয়া।
এই সমস্ত কিছুই তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে, তাই তিনি আজও বাংলা কবিতায় এক অনন্য আভিজাত্যপূর্ণ বৈভবে বিরাজ করছেন। তাঁর আন্তরিক স্বতঃস্ফূর্ততা, মূল্যবোধ এবং অভিজ্ঞতা-আশ্রয় তাঁর কবিতার প্রাণ। আত্মসর্বস্ব অন্ধকারকে ভেদ করে আলোর অভিমুখে তাঁর কবিতার যাত্রা। কবি শঙ্খ ঘোষ যথাযথ বলেছেন —
‘সহজ ভাষার টান টান চেতনার স্পর্ধিত কবি।’
[পরম্পরা ওয়েবজিন, জানুয়ারি ২৫, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]