নুড়ি পাথরের সঙ্গে চলতে চলতে পর্ব (৪)
বাবা রামতারণ আগেই মারা গিয়েছিলেন ৷ রামনারায়ণ আর রামজীবন দুই ভাই আর মালতী আর যগু বা যোগমায়া মোট চার ভাই- বোন মিলে মায়ের সঙ্গে ভালোই ছিলেন ৷ মালতীর বিবাহ হয়ে গেল ৷ অসুস্থ যোগমায়া মারা গেলেন ৷ দাদা রামনারায়ণ চাকরী অধ্যাপনার চলে গেলেন পার্লাকেমিডি ৷ সেখান থেকেই অর্থ পাঠাতেন ৷ ইতিমধ্যে মাও মারা গেলেন ৷ ততদিনে সংস্কৃতে ব্যাকরণতীর্থ ও বেদান্তশাস্ত্রী হয়ে গিয়েছেন ৷ সেতারে এম.মিউজ এবং এম.এ পাশ করে রাঁচি কাঁকে সবে গবেষণার কাজ শুরু করেছেন ৷ কিন্তু অর্থের অভাবে ছেড়ে ফিরে আসতে হল বেনারসে ৷
অনেক অল্প বয়সেই রামজীবন যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ির থেকে দীক্ষা নিয়ে হরিশ্চন্দ্রঘাটে নিয়মিত ধ্যান আর যোগসাধনা করতেন ৷ তারই সঙ্গে প্রতিদিন চণ্ডীপাঠ ৷ এরমধ্যেই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে স্বাধীনতাউত্তর রাজনীতিতে জড়িয়ে গেলেন বেনারসে ৷ তৎকালীন রাস্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের হয়ে একটি রাজনৈতিক ঘটনায় জড়িয়ে যাওয়ায় বন্ধুদের পরামর্শে বেনারসের ৬/৭৩ পিতাম্বরপুরার বাড়ি তালা দিয়ে ফেলে রেখে চলে এলেন বাংলায় হুগলির পাওনান স্কুলে প্রধান শিক্ষক হয়ে৷ সেখানে মাসিক মাইনে কম থাকায় সেখান থেকে ১৯৫২-৫৩ সালে মাহেশ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহ শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন ৷
এরই সঙ্গে লেখা শুরু করলেন সংস্কৃতের পাঠ্যবই ৷ কলকাতার বিখ্যাত প্রকাশক মডার্ণ বুক এজেন্সির দীনেশ চন্দ্র বোস এর স্নেহচ্ছায়ায় ও পরে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের আন্তরিক সহযোগিতায় সপ্তম থেকে অনার্স ক্লাস পর্যন্ত গ্রন্থ লিখলেন ৷ যা তাঁকে চূড়ান্ত খ্যাতি এনে দিয়েছিল ৷
তৎকালীন আশুতোষ কলেজের অধ্যক্ষ পঞ্চানন সিংহ তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে নিজে তাঁকে এনে অতি স্বল্প ভাড়ায় শ্রীরামপুরে তৎকালীন একান্ন নং নিউগেট স্ট্রীটে নিজের বিরাট বাড়িতে একতলায় স্থান দিলেন ৷ সেখানেই বেনারসের আসাক আলি খাঁ সাহেবের ঘরানার মুস্তক আলি খাঁয়ের গুরুভাই সেতারে এম. মিউজ রামজীবন “শাস্ত্রীয় সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়” নামে একটি সঙ্গীত শিক্ষাকেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করলেন ৷ এলাহাবাদের “প্রয়াগ সঙ্গীত সমিতি”র নিবন্ধীকৃত কেন্দ্র হিসাবে এই শিক্ষাকেন্দ্রে রামজীবনই একমাত্র শিক্ষক ৷ তাঁকে কিছু কিছু সহযোগিতা করতেন পঞ্চানন সিংহ মশায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র কালীপদ সিংহ ৷ কনিষ্ঠ অলোক সিংহ তাঁর কাছে সেতার শিখতেন ৷
ধীরে ধীরে রামজীবন ভট্টাচার্যের পাণ্ডিত্যের সেতারের খ্যাতি বহুদূর ছড়িয়ে গেল ৷ পাশাপাশি কলকাতার একটি বিখ্যাত পঞ্জিকার পণ্ডিতমন্ডলীর সদস্য মনোনীত হলেন ৷
সেটা ছিল ১৯৫৪ সালের এক গ্রীষ্মের মধ্যাহ্ন ৷ রামজীবনের কর্মক্ষেত্র মাহেশ উচ্চ বিদ্যালয়ে টিফিনের সময় এসে উপস্থিত হলেন হাঁটু ধুতি , গায়ে ফতুয়া হাল্কা কৃষ্ণবর্ণের এক অতি সাধারণ পোষাকের বৃদ্ধ ৷ তিনি রামজীবনের সাক্ষাৎপ্রার্থী শুনে , দ্রুত রামজীবন হাজির হলেন তাঁর সামনে ৷ বৃদ্ধ হাতজোড় করে প্রণাম করে বললেন , আপনি আমার অনেক ছোট , আমি আপনার বংশকে এবং আপনার পাণ্ডিত্যকে প্রণাম জানালাম ৷ আপনার প্রত্যেকটি বই আমার সংগ্রহে আছে ৷ আমিও একজন সংস্কৃত গ্রন্থের অথর ৷ বৃদ্ধকে প্রণাম করলেন ৷
এই বৃদ্ধই হলেন নবদ্বীপের যোগনাথতলার বিখ্যাত পণ্ডিতবাড়ির সেজপুত্র যোগেন্দ্রনাথ সাংখ্যতীর্থ (ভট্টাচার্য) ৷ পরবর্তীকালে তাঁরই কনিষ্ঠা কন্যা এগারো বছর বয়সের চিন্ময়ীর সঙ্গে ১৯৫৪ সালেই রামজীবনের বিবাহ হয় ৷ ১৯৫৬ সালে তাঁদের প্রথম পুত্রটি জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায় ৷ এরপর ১৯৫৮ সালের ৬ই জুন অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠমাসের ২৩ তারিখে জন্ম হয় আমার ৷ আমি বর্তমানে জ্যেষ্ঠ পুত্র হলেও , আমি বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান ৷
যেহেতু আদরের কনিষ্ঠা কন্যার প্রথম পুত্রটি মারা গিয়েছিল তাই যোগেন্দ্রনাথ কন্যার পরের সন্তানটির জন্যে কামাক্ষ্যা মায়ের কাছে ডোর বাঁধেন ৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি জন্মানোর আগেই দাদামশাই যোগেন্দ্রনাথ হঠাৎ অত্যাধিক পরিশ্রম ও শরীরের প্রতি যত্ন না নেওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন ও মারা যান ৷ তাই নাতির মুখ আর দেখা হয়নি তাঁর ৷
দিদিমা বিন্দুবাসিনী তাঁর আদরের নাতির নাম দিলেন পার্থসারথী , কিন্তু যেহেতু তার পিতৃকুলের পরম্পরায় সবার নামের আগে রাম শব্দটি রাখাই রীতি , তাই বাবা নাম রাখলেন রামকিশোর ৷ কিন্তু সবার কাছেই আমি তখন পার্থ নামেই পরিচিত ছিলাম ৷ সারথী লুপ্ত হয়েছিল ৷
দিদিমার অতি আদরে আমার শৈশব কেটেছে নবদ্বীপেই ৷ কনিষ্ঠা কন্যার নাতি হলেও তিনতলা দু’মহলাবাড়ির সমস্ত জুড়েই ছিল আমার রাজত্ব ৷ মাসিমণির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে সেভাবে আমার মতো গুরুত্ব পায়নি মোটেই ৷
যৌথপরিবারে আমার নিজের মামা সোমনাথ ভট্টাচার্যের চার ছেলে জয়ন্তনাথ শেখরনাথ , অম্বরনাথ (ডুম্বুরি) , নীলকান্ত (তোতন), দুই মেয়ে কল্পনা আর শুক্লা (শান্তু) ৷ আর মেজদাদুর ছেলে সোনামামা বিখ্যাত পণ্ডিত কুমারনাথ ভট্টাচার্যের দুটি ছেলে জয়দেব ও বাসুদেব এবং দুটি মেয়ে কল্যানী ও করুণা ৷
মেজদা শেখরদা আর আমিই ছিলাম সমস্ত দুষ্টুমির নাটের গুরু ৷ যাবতীয় অন্যায় কাজ করেও দিদিভাই , যাকে আমি দীর্ঘ দিন মা বলেই ডেকেছি , আর মাকে নাম ধরে , সেই দিদিভাই অর্থাৎ দিদিমার জন্যেই আমার সব দোষ মেজদাদু মাফ করে দিতেন ৷ তিনিই তখন বাড়ির কর্তা ৷ শৈশবে একটা দীর্ঘসময় আমি মনেই করতাম দিদিভাই আমার মা আর মা আমার দিদি ৷ বাবা একদিন আমায় বুঝিয়ে দিয়েছিল মা আর দিদিমা কি ৷ তখন আমি ৬ কিম্বা ৭ ৷
শৈশবে আর একজন আমায় সব সময় নজরে রাখতো সে মামার বাড়ির অতিবৃদ্ধা কাজের লোক কাননের মা , যার প্রকৃত নাম ছিল মহামায়া চক্রবর্তী ৷ তিনতলার বারান্দায় আগের দিনের লোহার রেলিং এ ধাপে ধাপে উঠে ৪-৫ বছরের আমি যদি ঝুঁকে কাউকে ডাকতাম কোমরভাঙা বৃদ্ধা মানুষটি বাসন ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে তিনতলায় উঠে এসে আমায় কোলে করে নিয়ে যেত একতলায় ৷ আর আমি তার সঙ্গে খুনশুটি করতে করতে হাসতাম ৷ যেন সেটাই আমার খেলা ৷ সেখান থেকে একবার পতন হলে যে সব খেলা মিটে যেত সেটা বোঝার বয়স ছিলনা সেটা ৷
বাড়ির দ্বিতীয় অংশে ৩৭৫ বছরের বিরাট মন্ডপঘর আর প্রাচীনবেদী ৷ সেখানেই পুজো হত লালদুর্গার ৷ সে ছিল এলাহি ব্যাপার ৷ আশেপাশের গ্রাম থেকে আসতেন কত মানুষ ৷ ভোগ খেতেন ৷ আর ছিল গোয়াল ঘর ৷ দোতলায় নাচঘর ৷ সেখানে বিভিন্ন বড় পুজোর সময় অনুষ্ঠানে বড় বড় শিল্পীরা আসতেন গান গাইতে ৷ তারই সঙ্গে যন্ত্রসঙ্গীতের ও নাচের আসরও বসতো ৷
গোয়াল ঘরে গরু ছিল তিন চারটে ৷ আমার জন্যে বরাদ্দ ছিল কালী অর্থাৎ কালো রঙের এক বিশাল গরুর দুধ ৷ তার স্বাদই আলাদা ৷ পাশাপাশি ক্ষীর আর চাঁচির নাড়ু ৷ ক্ষীরের নাড়ু আর চাঁচির নাড়ু রাখা থাকতো দিদিভাইয়ের ঘরে ছিকের ওপর ৷ আমার লক্ষ্য থাকতো ওই ছিকের হাঁড়িটি ৷ কিন্তু ছিকে ছেঁড়া সম্ভব হয়নি কোনও দিনই ৷ চুরি করে খাওয়ার সুযোগই দেওয়া হত না ৷ অথচ সব পেলেও চুরি করে খাওয়ার আনন্দ বেশি বলে মন হত আমাদের ৷
মন্ডপ ঘরে প্রতিদিন সন্ধায় গৃহদেবতাকে শেতল দেওয়া হত ৷ একতলায় একটা ঘরে তিনটে আখায় (মাটির উনুন)কাঠ আর পাটকাঠির আগুনে সারা দুপুর লোহার কড়াইতে সেই দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে সন্ধায় দেবতাকে নিবেদন করা হত ৷ তারপর ঘরে ঘরে প্রত্যেকের জন্যে দেওয়া হত সেই দুধ বা দুগ্ধজাত মিষ্টি ৷
একবার আমি আর শেখরদা ঠিক করেছিলাম ওই ঘন দুধ চুরি করে খেতে হবে ৷ যদিও আমাদের জন্যে যথেষ্ট দুধ বরাদ্দ ছিল কিন্তু চুরি করে ঘনদুধ খাবার আনন্দই আলাদা ৷ দুজনে দুটো পাটকাঠির মধ্যের শাঁসটি পরিস্কার করে সেটাকেই স্ট্র বানিয়ে মোটা সর ফুটো করে দুধ খেতে শুরু করলাম কয়েকদিন ৷ পাটকাঠি তুলে নিলেই দুধের সরের ফুটো যেত ভরাট হয়ে ৷ কেঈ বুঝতেই পারতো না ৷
হঠাৎ একদিন মেজদিদা দেখে ফেললেন ব্যাপারটা ৷ বকাবকি করতে করতে আসামীদের নড়া ধরে সোজা মেজদাদুর দরবারে ৷
মেজদাদু তখন সবে মাথায় কলপ লাগিয়ে দিবাতন্দ্রায় ৷ সব শুনে গম্ভীর হয়ে বললেন – তোমরা অতি গর্হিত অন্যায় করেছো ৷ এঁটো জিনিস কয়েকদিন খাইয়েছো গৃহদেবতাকে ৷ পাপ হয়েছে ৷ শাস্তি পাবে ৷ কঠিন শাস্তি ৷
শেখরদা মাথা নীচু করে শাস্তি মেনে নিতেই আমি বলে উঠেছিলাম – আমরা দুধ এঁটো করে খাইনি ৷ আমরা দুধ খেয়েছি পাটকাঠি দিয়ে ৷ দুধে ঠোঁট মুখ না লাগলে তা এঁটো হবে কি করে !
দাদু আপনিই বলেন মুখ বা ঠোঁট লাগালে তবেই কোনও জিনিস এঁটো হয় !
কথা শুনে মেজদাদু আরও গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ ইজি চেয়ারে দোল খেলেন ৷ তারপর হঠাৎ মেজদিদাকে বললেন – চিনুকে ডাকো , সেজো বৌমাকে ডাকো ৷ সেজ বৌমা মানে দিদিভাই ৷
চিনু মানে আমার মা চিন্ময়ী সেদিনই এসেছে শ্রীরামপুর থেকে আমার সদ্যজাত বোন মানু অর্থাৎ তনুশ্রীকে নিয়ে ৷ মা আর দিদিভাই নেমে এলেন দোতলায় ৷ মেজদাদু মাকে অতি গম্ভীর মুখে বললেন – তোমার ছেলে আজ আমার শিক্ষাতেই আমায় শিক্ষা দিয়েছে ৷ আমার মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ আমি শাস্তি দিতে চেয়েও পারলাম না ৷
মা গম্ভীর হয়ে আমায় বকতে যাবে হঠাৎ বিরাট ঘোমটার আড়াল থেকে দিদিভাই আস্তে আস্তে বলে উঠলেন – আপনি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তো ?
দাদু বললেন – হুম
মেজদিদাকে দাদু বললেন – আজ থেকে ওদের জন্যে আলাদা একটা কড়াইতে দুধ জ্বাল দেওয়া হবে ৷ ওরা ইচ্ছে হলে সেটা থেকে দুপুরে দুধ চুরি করে খাবে ৷ ওই দুধ শেতলে যাবে না ৷ বাড়ির সবাই খাবে ৷ আমাকেও দিতে পারো ৷ তবে তারপর থেকে আমরা চুরি করে আর দুধ খাইনি কোনও দিন ৷
মেজদাদুর গাম্ভীর্যের জন্য আমরা তাঁকে একটু এড়িয়েই চলতাম ৷ খুব কম কথা বলতেন তিনি ৷ সেদিন থেকে তিনি আমাকে একটু বেশি নজরে রাখতেন ৷ কথাও বলতেন অল্প অল্প ৷
মাকে বললেন – জীবনকে বলবে ওকে ঠিক করে মানুষ করে তুলতে ৷ ওর ভালো হবে ৷ বাবাকে সবাই ওখানে জীবন বলেই ডাকতেন ৷
মা তিনতলায় গিয়ে বকাবকি করতে গেলে দিদিভাই উলটে মাকেই বকতে শুরু করে
দিলেন ৷ বললেন – তুমি এসেছো , নিজের সদ্যজাত মেয়েকে নজরে রাখো ৷ আমার ছেলের দিকে তোমায় নজর দিতে হবে না ৷ ও আমার নজরে ঠিক আছে ৷ বলে আমার নড়া ধরে আমায় তার কোলের কাছে টেনে নিলেন ৷
মামার বাড়ির লালদুর্গা পুজোয় তখন সপ্তমী থেকে দশমী বলি হত ৷ বিশাল বলির খাঁড়াটি ছিল আমার ঘোর আতঙ্কের বস্তু ৷ দূর থেকে দেখে ভাবতাম এটা দিয়ে নিশ্চই নরবলিও দেওয়া হয়েছে ৷ একবার মামাকে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম ৷ মামা হেসে বলেছিল – দূর বোকা ৷ কিন্তু আমার সন্দেহ যায়নি ৷
একবার সদ্য বলি হবার পর শোনা গেল একচুল আটকেছে ৷ হঠাৎ দেখি সারাবাড়ি কান্নার রোল ৷ আমার কানে তখন কালো রঙের ছোট্ট বলির পাঁঠাটার শেষ ডাকের করুন কান্নাটা বাজছে বারবার ৷ তার ম্যাআআআ ডাকটা মনে হচ্ছে মা আআআ৷ ৫-৬বছরের আমি দিদিভাইয়ে বুকে মাথা রেখে কাঁদছি , দিদিভাইও আকুল কাঁদছেন ৷ তবে আমি কাঁদছিলাম পাঁঠাটার জন্যে ৷ আর দিদিভাই তত আমায় বুকে জড়িয়ে রাখছিলেন৷ পরে দিদিভাইকে বলেছিলাম কথাটা৷ দিদিভাই আমায় বলেছিলেন- আমারও কান্না পায় রে৷ কিন্তু বলি বন্ধ করা যায় না মানিক৷ সেবার মামার বাড়িতে কয়েকদিনের মধ্যেই একটা বড় বিপর্যয় ও একটা মৃত্যু হয়েছিল৷ বলিও বন্ধ হয়েছিল কয়েক বছর পরে৷
নবদ্বীপে প্রতিবছর বন্যা হত৷ দামোদর আর খেরের জল মিলেমিশে সে কি ভয়ঙ্কর রূপ৷ বন্যার সময় একবার একতলায় হাঁটু সমান জল চলে এলে আমরা গামছা দিয়ে মাছ ধরা শুরু করলাম৷ আমার মামা আর মামাতো দাদারা ও বোনেরাও সেই দলে ছিল৷ মেজদিদু বকাবকি শুরু করলেও দিদিভাই ছিলেন আমাদের দলে৷ তারই পরম উৎসাহে ধরা মাছগুলি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাড়ির গোয়ালা আর কাজের লোকদের৷ আমাদের খেতে দেওয়া হয়নি৷
দিদিভাই বলেছিলেন- শোনো, মাছ ধরার আনন্দ যেমন তেমনই সেটা অন্যকে দেওয়ার আনন্দ আরও বেশি৷ অন্যের আনন্দকেও নিজের আনন্দ ভাবতে হবে৷ মাছ ধরেছো বলেই সেটা খেতে হবে তার কোনও মানে নেই৷ খাওয়ার আনন্দের থেকে অন্যকে দেবার আনন্দ অনেক বেশি৷
আমার দিদিমা পাঠশালাও পড়েননি৷ কিন্তু আমায় প্রথম মুখে মুখে ছড়া তিনিই শিখিয়েছিলেন৷ সেসব ছড়া আজও মুখস্থই আছে ৷ আমার দিদিভাই মঙ্গলগান জানতেন, চাঁদসদাগরের গল্প তাঁর থেকেই প্রথম শুনেছিলাম৷ মনে কাব্যচেতনা সেখান থেকেই তৈরি৷ আজ বুঝি কত গভীর জ্ঞান ছিল তাঁর৷
আমার মামার বাড়ি ছিল শাক্তবাড়ি৷ উল্টো দিকেই ছিল পরম বৈষ্ণববাড়ি৷ সেখানে এক তুলসির মালা গলায় দাদু রকে বসে সাদা ঝুলির মধ্যে মালা জপতেন৷ কপালে নাকে রসকলি, পাশেই ধিরু মামার সোনার গহনা তৈরির দোকান৷ আমি আর শেখরদা সেই দোকানে বসে ধিরুমামার দেওয়া কিঞ্চিৎ উৎসাহেই পা দোলাতে দোলাতে বা নেচে নেচে ছড়া বলতাম- “বোসটোম টোম টোম / ঝুলির মধ্যে মালা গুনে পাঁঠা খাবার যম”৷ সেই দাদু এসে বাড়িতে অভিযোগ জানালে দিদিভাই আমায় ডেকে অতি গম্ভীর গলায় শুধু বলেছিলেন- তোমাকে কিন্তু এটা মানায় না৷ ঘোর অন্যায় করেছো, ক্ষমা চাইবে দাদুর থেকে৷ তুমি ভেবে দ্যাখো এটা যদি তোমার নিজের দাদুকে কেউ এভাবে বলতো তোমার কেমন লাগতো৷ আমি সেই থেকে আর করিনি সে অন্যায়৷ ব্যাস এটাই ছিল আমার দিদিমার শিক্ষা৷
দারুন লাগছে ভাই। পুরোনো স্মৃতি খুব আনন্দ দেয়।
লিখে যাও।