মাহেশ হাইস্কুলে আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন ৷ সংস্কৃত আর ইতিহাস পড়াতেন ৷ বাবা খুবই রাগী অথচ ছাত্রদরদী শিক্ষক ছিলেন ৷ স্কুলে যত ছাত্র সবাইকে বাবাকে ভয় পেতে এবং ভীষণ সম্ভ্রম করতে দেখেছি ৷
হেডমাস্টারমশাই ছিলেন সুধীরবাবু , সুধীর মুখোপাধ্যায় ৷ লম্বা প্রায় ছ’ফুট , ঘন শ্যামবর্ণ শরীর , সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবী পায়ে কালো জুতো ৷ ব্রতচারী করা মানুষ ৷ আমি তাঁর থেকে অনেক কিছু শিখেছি ৷ এরকম ডিসিপ্লিন্ড শিক্ষক আমি খুব কম দেখেছি ৷ প্রার্থনার সময় তিনি বলতেন – একে যবে কথা কয় / অন্য সবে মৌন রয় ৷ প্রতি ক্লাস শেষ হলেই তিনি হাতে একটা বেত নিয়ে ঘুরতে শুরু করতেন একতলা থেকে তিনতলা ৷ প্রতি ক্লাসে একটি করে ছোট্ট ডাস্টবিন থাকতো , ছাত্রদের বলতেন – নোংরা দেখলেই এখানে ফেলবে , এরপরেও তিনি যদি কোনও কাগজ বা ময়লা পড়ে থাকতে দেখতেন নিজে বাঁ হাতে তুলে ডাস্টবিনে ফেলতেন ৷ যদি দেখতেন কোনও ক্লাসে মাস্টারমশাই আসতে দেরী করছেন , নিজেই ক্লাসে ঢুকে যে বিষয়ের ক্লাস সেই বিষয়টিই পড়াতে শুরু করতেন ৷ আশ্চর্যের বিষয় বই না দেখেই সুন্দর বুঝিয়ে দিতেন ৷
যাঁর ক্লাস তিনি আসতেই বলতেন – আসুন মাস্টারমশাই , এই একটু এদের সঙ্গে গল্প করছিলাম ৷ মাস্টারমশাই বেশ অস্বস্তি বোধ করতেন ৷ ফলে আর পরে দেরী করে আসতেন না ৷ আমাদের মাঝে মাঝে মনে হত হেডস্যার যেন ওই মাস্টার মশাইয়ের চেয়ে বেশি ভালো বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন ৷ সবই যেন তাঁর পড়া ছিল ৷ মনে মনে রাগ হত আর ভাবতাম – নির্ধারিত মাস্টার মশাই আর একটু দেরীতে এলে ভালোই হত ৷


আমি ফাইভে হাফইয়ার্লিতে অঙ্কে দুটো শূন্য পেলাম যখন , (যদিও আজও জীবনের অধিকাংশ অঙ্কেই শূন্যটাই আমার বরাদ্দ , মেলাতে পারি না ৷ বন্ধু কবি পিনাকী ঠাকুর যখন “অঙ্কে যত শূন্য পেলে” কাব্যগ্রন্থ লিখেছিল , আমি ভেবেছিলাম আমাকেই নিয়ে লেখা হয়ত বইটি ) যাই হোক তখন গৌরবাবু , গৌরসুন্দর গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের হিন্দী পড়াতেন ৷ দেখলেই এক একটা ক্লাসে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন – অঙ্কে কত পেয়েছিস ?
আমি বলতাম শূন্য ৷
স্যার বলতেন – দ্যাখো দ্যাখো হে ছেলেরা , মাস্টারের ছেলে গুণোধর , অঙ্কে শূন্য ৷ য্যাঃ
বলে হাত নেড়ে তাড়িয়ে দিতেন ৷
এইভাবে স্যার ক্লাস টেনে একবার ডেকে একই ব্যবহার করেছিলেন বলে টেনের একজন ছাত্র প্রণবদা গিয়ে সুধীরবাবুর কাছে অভিযোগ জানানোয় আমার ডাক পড়েছিল হেডস্যারের ঘরে ৷ স্যার যখন জানলেন সব বিষয়ে ৭৫ শতাংশ পেলেও অঙ্কে শূন্য ৷ তখন স্যার ধমক দিয়ে বলেদিলেন বার্ষিক পরীক্ষায় ষাটের ওপর অঙ্কে না থাকলে প্যান্ট -জামা খুলে বেত মেরে পিছনের ছাল তুলে নুন-লঙ্কা মাখিয়ে দেবেন ৷ যাই হোক অবশেষে পিছনের ছাল তুলে নুন লঙ্কার জ্বালার কথা ভেবে আর বাবার হাতযশ মায়ের বকুনি আর মনোজবাবুর শাসনে কিভাবে যেন বার্ষিক পরীক্ষায় অঙ্কে ৭৬ উঠে গিয়েছিল ৷ জানুয়ারী মাসে স্কুল শুরু হলে হেডস্যার ডেকে পাঠালেন ৷ ৭৬ শুনে হাসি মুখে বললেন – বেশ সামনের বছর ৮০ চাই ৷
বলে নিজের টিফিন বাক্স থেকে একটা মিষ্টি বের করে আমায় দিয়ে বললেন – জানিস তো এটা মৃত্যুঞ্জয়ের
তারপর বলললেন

গৌরবাবু যখন যে যে ক্লাসে থাকবেন তুমি সেই সেই ক্লাসে অনুমতি নিয়ে ঢুকে স্যারকে বলবে ৭৬ পেয়েছো ৷ যাও
শুনে বুঝলাম পিছনের চামড়া বেঁচে গেল ৷ অতি উৎসাহে আমি দু’তিনটে ক্লাসে এভাবে বলার পর স্যার গেলেন খেপে ৷

বজ্জাত ছেলে ৭৬ পেয়ে মাথা কিনে নিয়েছিস ? চল হেডমাস্টারের ঘরে ৷
বলে গৌরবর্ণের অতি সুন্দর নাতিদীর্ঘ ধুতি পাঞ্জাবী গায়ে গৌরবাবু রাগে লাল হয়ে নড়া ধরে নিয়ে এলেন সুধীরবাবুর কাছে ,
সুধীরবাবু আমায় ঘর থেকে বাইরে যেতে বললেন ৷ তারপর বাবার মুখে শুনেছিলাম – হেডস্যার তাঁর কাছে ঘটনাশুনে বলেছিলেন

মাস্টার মশাই ছেলেটা অন্যায় করেছে তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু ও যখন ডবল জিরো পেয়েছিল আপনি কি ক্লাসে ডেকে ওর নম্বর জিজ্ঞাসা করতেন ?
গৌরবাবু বললেন – অবশ্যই , মাস্টারের ছেলে শূন্য পেলে বলতেই হবে

ঠিকই বলেছেন পদ্ধটি, এখন ও ৭৬ পেয়েছে , তাহলে সেটাতো আপনাকে ওর ওভাবেই ষবলা উচিত ৷ এটা করতে আমিই ওকে বলেছিলাম ৷
গৌরবাবু চুপ করে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বাইরে এসে আমায় বললেন – ব্যাকরণটা লাইব্রেরীতে এসে বুঝে যেও ৷
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম গৌর বর্ণের সুন্দর স্যারের দিকে ৷ গৌরসুন্দর গঙ্গোপাধ্যায় সেদিন থেকে আরও সুন্দর আজও ৷ পরে শুনেছি ,বাবার সঙ্গে তাঁর পাঠ্যবিষয় সংক্রান্ত কিছু অসুবিধে ছিল ৷ সেভেন এইটে বাবা সংস্কৃত পড়াতেন , গৌরবাবু হিন্দী , সংস্কৃতে বেশি নম্বর উঠতো বলে অধিকাংশ ছেলে এবং আমিও সংস্কৃতকেই পছন্দ করতাম ৷ ৬২ জন ছাত্রের মধ্যে যদি ৯জন হিন্দী আর বাকি সবাই সংস্কৃত নে তাহলে যে শিক্ষকের অস্বস্তি হবে সেটাই স্বাভাবিক ৷ তবে পরে গৌরবাবু আলাদা ভাবে আমাকে হিন্দীটাও পড়িয়ে দিয়েছিলেন ৷
সেই থেকে আমিই তাঁর প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলাম ৷
স্কুলে তখন নানা কঠিন অথচ বেশ মজার শাস্তি ছিল ৷ চেয়ার ডাউন , মোচড়ে মোচড়ে মধু ঝরে , কানচিমটি , নীলডাউন এরকম আরও নানা নতুন নতুন শাস্তি আবিষ্কার করতেন প্রবীণ মাস্টারমশাইরা আর সঙ্গে চড় থাপ্পর বেঞ্চের ওপর দাঁড়ানো তো ছিলই ৷ আরও মুশকিল ছিল বাড়িতে এসে শাস্তির কথা বললেই বাবা বাবা মা শাস্তির বিষয়ে বুজতে পারলেই উপড়ি কিছু জুটে যেত ৷ ফলে বাবা মায়ের কাছে অভিযোগ টভিযোগ করাই যেত না ৷ মারধোর খেয়ে হাসিমুখে থাকতে হত ৷


স্কুলের কাছেই ছিল দুটো কলোনী স্কুলের সামনেই মাহেশ কলোনী , জি টি রোডের ওদিকে নেহেরু নগর কলোনী ৷ বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষেরা কোনও রকমে মাটির ঘর টিনের চাল বাঁশের দেওয়াল দিয়ে থাকতে শুরু করেছেন অর্থাৎ তখন সবে গড়ে উঠছে কলোনী ৷ গত শতাব্দীর ৬এর দশক ৷ মাহেশ কলোনীতে তখন অনেক গাছ ছিল ৷ ভালো ভালো ফলের গাছ ৷ আমি তখন সিক্স কিম্বা সেভেন ৷ আমরা কয়েকজন টিফিনের সময় জাম জামরুল আর কাঁচা আম পেয়ারা পেড়ে খেতে যেতাম কলোনীতে ৷ একজন বুড়িমার বাড়িতে খুব মিষ্টি বড় জাম আর জামরুলের গাছ ছিল ৷ সরল স্বপনরা গাছে উঠে ফল পাড়তো আমি নীচে কুড়িয়ে নিতাম ৷ তারপর একসঙ্গে স্কুলে এসে সবাই মিলেমিশে খাওয়া হত ৷ আহা সেইসব সোনামাখা দিন আজ স্বপ্ন মনে হয় ৷ কত রকমের কুল গাছ ছিল ওই কলোনীতে ৷ নুন মাখিয়ে তাদের টক মিষ্টি স্বাদ আজ বা আরকোনও দিনই পাওয়া যাবে না ৷
একদিন দুপুরে বুড়িমা উঠে আমাদের তাড়া করলেন ৷ আমি তো দে দৌড় ৷ তিনি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে সরল তাঁর মাথায় একটা জামরুল ছুঁড়ে মারতেই তিনি ও মাগো বলে কপালে হাত দিয়ে বসে পড়তেই সরল স্বপন গাছ থেকে লাফিয়ে দে হাওয়া ৷
একটু পরেই সুধীরবাবুর ঘরে আমার ডাক এলো ৷ বুড়িমা এসে অভিযোগ করে বলেছেন ৷ কারও নাম বলতে না পারলেও মাস্টারের ছেলে ছিল শুনে আমার ডাক পরেছে ৷ আমি যেতেই হেড স্যার বেত নিয়ে বললেন – কে কে ছিল ৷ আমি কিছু বলার আগেই দেখি সরল আর আসে ৷ আর যেন আমার ফল ছুঁড়ে না মারে ৷ হেডস্যার বললেন – যাও ওনার পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাও ৷ কাছে যেতেই বুড়িমা আমাদের জড়িয়ে ধরে থুতনিতে হাত দিয়ে আদর করলেন ৷ বাইরে দেখি আদের ক্লাসের সব বন্ধুরা দাঁড়িয়ে ৷
হেডস্যার বললেন – তোমরা এসেছো কেন ! মৃত্যুঞ্জয় বলে উঠলো – আমরা সবাই তো মিলে মিশেই খাই ৷
আমাদের আর কোনও শাস্তি হয়নি ৷ সেই থেকে বুড়িমা আমাদের কেউ একদিন না গেলে খোঁজ নিতেন – ওই ডাকাইট পোলাপানটা আসে নাই ?


টিফিনে সে সময় গকুলদা আসতেন বুনোকুল , শুকনো কালো টোপাকুল , হজমিগুলি , ঘরে তৈরি কালো আমসত্ত্ব , ইলেকট্রিক নুন নিয়ে ৷ ইলেকট্রিক নুন জিভের ডগায় লাগালেই শক খাওয়ার মতো অভিজ্ঞতা হত ৷ বুনোকুলের স্বাদ ? যারা খায়নি তারা কোনও দিনই বুঝবে না ৷ সে সব স্বর্গীয় স্বাদ ৷ এখন হলে সবাই বলবে – ইস সেসব মোটেই হাইজেনিক নয় ৷ খেলেই নাকি একশো অসুখ জাপটে ধরবে ৷ অথচ আমাদের সে সময়ের সে সুখ দেখে অসুখ পালাতে পথ পেত না ৷ শীতের দুপুরে নেহেরুনগর কলোনীর কাছে গঙ্গার ধারে ইঁটখোলায় আলু বা রাঙালু পুড়িয়ে তেলনুন দিয়ে মেখে খাওয়ার দিনগুলো কখন যে বুড়ো হয়ে হারিয়ে গিয়েছে অজানার দিকে ৷ এই তো সেদিন আমার ছাত্র প্রকাশ প্রস্তাব রেখেছে আমাদের প্রাক্তনীরা একদিন ওই ইঁটখোলায় যাবো আলু পুড়িয়ে খেতে ৷ শুনে অনেকেই খুব খুশি ৷ আমি দেখলাম আমার কৈশোর আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে ৷ তার চোখে দুষ্টুমি খেলা করছে ৷ আমি তাকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই সে আমার বুকের ভিতরে ঢুকে গেল ৷..
তারপর বুকের.ভিতর থেকে পতাকা উড়িয়ে বললে এগিয়ে যেতে …আমরা বললাম – ফরোয়ার্ড মার্চ ৷ বুড়ির পাশের বাড়ির পেয়াড়াগুলো এত মিষ্টি অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে মিষ্টি করেছে ৷ এই ভাবে সেভেন থেকে এইটে উঠে গেলাম ৷ এখানেই অমি ?

[পর্ব- ৫]

সহযোগিতার হাত বাড়াতে ওপরের ছবিতে ক্লিক করুন

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জানুয়ারি ২৫, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

0 0 ভোট
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
6 days ago

অপূর্ব স্মৃতিচারণ! শ্রীরামপুর ইউনিয়ান স্কুল এ আমরাও এই রকম সব করতাম! আর কারেন্ট নুন এর স্বাদ পড়তে পড়তে পেলাম! আরো লিখুন!