৫ম পর্ব

কলকাতার ফেব্রুয়ারি মাসের আবহাওয়া নিবেদিতার কাছে বসন্ত কালের মতোই মনোরম মনে হয়। নিবেদিতা সকাল সকাল আজ তৈরি হয়ে বসে আছেন। রবিবার আজ। পাটভাঙা কমলা রঙের গাউনের উপর কমলা রঙের পাতলা শাল নিয়েছেন জড়িয়ে। চুল বেঁধেছেন গোছ করে মাথার পেছনে টেনে। রুদ্রাক্ষের মালাটি ঝুলিয়ে নিয়েছেন গলায়। কোমরে বেঁধে নিয়েছেন একটি বড় কর্ড বা সুন্দর মোটা দড়ি। সকালের রোদ উঠেছে ঝলমলিয়ে। নিবেদিতাকেও খুব তরতাজা লাগছে। তাঁর আসার সময় হয়ে গেল! নিবেদিতা দোতলার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়ি দেখে নেমে এলেন নীচে। তিনি সবসময় সময় মেনে চলেন।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক ধাঙড়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন স্বামীজি। নীচের বারান্দাতে এসেই শুনতে পেলেন তাঁর গলার আওয়াজ। গলার স্বর চিনেই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললেন। গেরুয়া আলখাল্লার উপর লং-কোট পরেছেন গুরুদেব। মাফলার নিয়েছেন গলায়। ক’দিন আগেই সর্দি-কাশিতে ভুগেছেন। হাঁপানি এখন একটু কম। তাই এত সতর্ক। এই শীতটা খুব ভোগাচ্ছে! শীতের বাতাস শুকনো বলেই হয়তো এখন একটু সুস্থ। স্বামীজির জন্য বেশ কয়েকদিন গোলমরিচ, লবঙ্গ, আদা ইত্যাদি জলের সঙ্গে ফুটিয়ে পাচন করে পাঠাচ্ছিলেন নিবেদিতা। তাতে সর্দি-কাশির দমক কিছুটা কমেছে। সেটা যে উনি খুব তৃপ্তির সঙ্গে পান করছেন, তাতেই নিবেদিতার খুশির অন্ত নেই। স্বামীজি তাকালেন। গভীর চোখ। বলিষ্ঠ মুখমণ্ডলে কোথাও ক্লান্তির ছাপ নেই। চোখের কোণে কোনও কালো ছোপ আজ নেই। উজ্জ্বল উদ্ভাসিত চোখ। স্বপ্নাতুর। সুদুরাকাঙ্ক্ষী। আছেন এখানেই তবু মনে হয় যেন নেই, বহুদূরে আছেন। নিবেদিতা ওই চোখের উপর চোখ রাখলে হারিয়ে যান। তলিয়ে যায় নৌকা। নোঙর টেনে তোলেন স্বামীজি।
‘চলো বেরিয়ে পড়ি আমরা! তুমি রেডি তো?’
সম্বিত ফেরে নিবেদিতার। ‘হ্যাঁ। আমি প্রস্তুত। চলুন।’
নিবেদিতা দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দেয়। ‘ঝি’ এসে বন্ধ করে দেবে। তাকালেন একবার আড়চোখে স্বামীজির দিকে।
আশ্চর্য দেবদ্যুতি তাঁর মুখমণ্ডলে।

শীতের নরম আলো মেখে বাগবাজারের অন্ধকার এঁদো গলিতে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললেন দু’জন।
‘সরলা ও সুরেন্দ্রনাথ এই ব্যবস্থা করেছেন। ওঁরা থাকবেন আজকে ওখানে। রবিবাবু এখন শিলাইদহে আছেন। তিনি থাকতে পারবেন না।’

বিবেকানন্দ কোনও উত্তর দেন না। ঘোড়ার গাড়ি দাঁড় করান। দু’জনে ওঠেন। গাড়োয়ানের চিৎকারে গাড়ি চলতে শুরু করে দুলকি চালে। মাটির রাস্তা। পাশে কাঁচা নর্দমা। নর্দমার ধারে ধারে ঘাসের আস্তরণ রাস্তায় এসে পড়েছে। আগাছা দু’পাশে। তার উপরে চকচক করছে শিশির-জল তখনও। গাছগাছালিতে ছাওয়া বাগবাজার অঞ্চল এমনিতেই ঠান্ডায় জড়োসড়ো। ছায়া-ছায়া। শান্ত পল্লী বাগবাজার। নিবেদিতা ও বিবেকানন্দ চললেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। আজ ২০ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ সাল, রবিবার। সোমবার ২১ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ দুপুর আড়াইটের সময় চিঠিতে লিখছেন— “Yesterday, Sunday morning, I went to the Tagore with the King.” হ্যাঁ রাজা বলতেন তিনি চিঠিতে মাঝে মাঝেই। মানে ২০ ফেব্রুয়ারি নিবেদিতার কাছে খুব উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। বিশেষ করে জানুয়ারি মাসের শেষের সেই মেঘ-জমা চা-পার্টির পর। আবার একটা চেষ্টা! বাস্তবতা হল সেই সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত আদি ব্রাহ্ম সমাজ সাংগঠনিকভাবে বেশ দুর্বল। রবীন্দ্রনাথ তখন সংগঠনকে মজবুত করার লক্ষ্যে সম্পাদক পদে নিযুক্ত। ভারতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার কাজ চলছে। এইরকম পরিস্থিতিতে ব্রাহ্ম সমাজের শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়কে রামকৃষ্ণ মিশনের ভাবনায় ভাবিত করার সেতুবন্ধনের কাজটি খুব জরুরি হয়ে উঠেছে কি? এক মাস যেতে না যেতেই মহর্ষির আশীর্বাদ নিতে স্বামীজির জোড়াসাঁকো যাওয়ার ব্যবস্থাপনায় নিবেদিতার উৎসাহের পেছনে কি কাজ করছে সেই নির্দেশ ‘make inroads into Brahmos’?

সকালের নরম রোদে জেগে উঠছে আদুল গায়ের বাগবাজার। জেগে উঠছে রাস্তায় রাস্তায় উপচে পড়া গরিবগুর্বোর সংসার। বাঁশের চালা ঘরের সংসার ভোর হলেই নেমে আসে সামনের রাস্তায়। এক জায়গায় টালির চালের জটলা পাকানো বাড়ির সামনে দাওয়ায় দাওয়ায় মাটির ঠাকুর দেখে অবাক নিবেদিতা। অপূর্ব তাদের রং ও গড়ন। শৈল্পিক উৎকর্ষতা দেখে নিবেদিতা স্তম্ভিত। এদিকে-ওদিকে মাটির তাল। জঞ্জাল, নোংরা যত্রতত্র ডাঁই করা। মাছি ভনভন করছে। তার পাশেই শিশুরা চট পেতে রোদে বসে খেলা করছে। একটা চাদর ঘাড়ের কাছে গিঁট বাঁধা। ওটাই ওদের শীতবস্ত্র। কারও কারও তাও নেই! কারও গায়ে বাবুর বাড়ির ফেলে দেওয়া বেঢপ সোয়েটার। নাক দিয়ে সর্দি গড়াচ্ছে। বিবেকানন্দ গাড়ি থামাতে বললেন গাড়োয়ানকে। নামলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাতে পায়ে মাটিমাখা লোকগুলো এসে ঘিরে দাঁড়াল। সবাই নমস্কার করতে চায়। নিবেদিতা অবাক হয়ে চারিপাশ দেখছেন ঘুরে ঘুরে। বেশ কয়েকটি সরস্বতী ঠাকুর অবিক্রিত পড়ে রয়েছে কুমোরপাড়ায়। কী সুন্দর শুভ্র মুখমণ্ডল! চোখের মধ্যে আশ্চর্য প্রজ্ঞা। শান্তি। আলুলায়িত চুল। এক হাতে বীণা। নীচে বাহন শ্বেতহংস। বিদ্যার দেবী। নিবেদিতা বিস্মিত। দেখছেন। দরিদ্র অর্ধনগ্ন শিল্পীদের অসম্ভব শিল্পনিদর্শন। কেমন এক শুভ্র পবিত্রতা জড়িয়ে আছে প্রতিমার উপস্থাপনায়। কে শেখাল এই অশিক্ষিত দরিদ্র শিল্পীদের দেব-দেবীর শরীরের কাঠামো, ভারসাম্য, বিভঙ্গ সবকিছু নিয়ে এই সুষমা! মাঝে উঠোন। চারপাশে মাটির ঘর। ঘরের দরজা জানালার ফাঁক দিয়ে কৌতূহলী মহিলাদের চোখ। ম্লেচ্ছ মেমসাহেব একেনে কী কচ্চে! সতর্ক তারা। নিবেদিতা হাসেন ওদের দিকে তাকিয়ে। ওরা ঘোমটা নামিয়ে আঁচল চাপা দেয় মুখে। উঠোন জুড়ে আবর্জনার স্তূপ। ওদিকে কুমোরদের সঙ্গে কথা বলছেন স্বামীজি খুব আন্তরিকতার সঙ্গে। ‘শোন তোরা মন দিয়ে, এই ময়লা নোংরা সব পরিষ্কার করে ফেলতে হবে পরের মাসের মধ্যেই। না হলে আবার মহামারী দেখা দেবে শীত শেষে গরম পড়লেই! গত বছর কতজন মারা গেছে তোদের পল্লীতে!’
‘ওকথা আর বলবেন না মহারাজ। একটা ঘরও বাদ যায়নি। মেমসাহেব এসেছিলেন তো!’
‘তবে? এই বছরে আগে থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। ব্লিচিং পাঠানো হবে মঠ থেকে, তা ছড়াতে হবে। জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হবে। বুঝলি?’

ওরা হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের নানা সমস্যার কথা বলছে। সন্ন্যাসীরা এর মাঝে এসেছিলেন। বলে গেছেন সন্ধ্যায় বেশ ভাল করে ঘরে ধুনো দিতে আর বাইরে শুকনো কাঠ-পাতা জ্বালাতে! তাতে মশার প্রকোপ কমে। নিবেদিতা তাকিয়ে আছেন স্বামীজির দিকে। গতবছরের প্লেগ মহামারীর আকার নিয়েছিল। এই বছরে আগাম সতর্কতা নিতে চাইছেন স্বামী। এই বছরে প্লেগের সঙ্গে যুদ্ধ করার কমিটি তৈরি হয়েছে বেলুড় মঠে। তার প্রধান কর্মকর্তা করা হয়েছে নিবেদিতাকে।

১৪ ফেব্রুয়ারি নিবেদিতা একা গিয়েছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। সরস্বতী পুজোর আগের দিন। সেদিন দেখেছেন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কী আশ্চর্য উন্মাদনা এই সরস্বতী পুজো নিয়ে। ছোট ছোট মণ্ডপ করেছে নিজেরা। ছোট্ট প্রতিমা। তার সামনে যত্ন করে আলপনা দিচ্ছে। ক্লাবে ক্লাবে পুজো। অনেকেরই বাড়িতে পুজো। বাড়ির বাইরে সুন্দর আলপনা দিয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় বেশ উৎসবের আমেজ এই সরস্বতী পুজো নিয়ে।

একটা গদি আঁটা হেলানো চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন মহর্ষি। সামনের কাঠের কারুকাজ করা গদিমোড়া পা-দানির উপর ধপধপে ফর্সা পা। লাল আভা পা যেন মোমপালিশ করা। নীল শিরার রেখাগুলো জীবন্ত। উজ্জ্বল লম্বাটে মুখমণ্ডলে প্রশান্তি। দুধসাদা চুল-দাড়ি ফিনফিনে উড়ছে একটু একটু। বয়সে হালকা হয়ে এসেছে।‌ প্রশস্ত কপাল। বলিরেখা গভীর নয়। চোখের পাশের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ চোখদুটিকে ঈষৎ কুঁচকে দিয়েছে। তবুও তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অন্তর্ভেদী। তাকালেন নিবেদিতার দিকে, তারপর সরলা, সুরেন্দ্রনাথ।
মহর্ষিকে নমস্কার করে বসলেন পায়ের কাছে। মহর্ষি ধীরে ধীরে কথা বলছেন। মাঝে মাঝে মৃদু হাত নাড়াচ্ছেন।

নিবেদিতা তন্ময় শুনছিলেন মহর্ষি বলছিলেন বিবেকানন্দের কথা। বিবেকানন্দ প্রথম জীবনে ব্রাহ্ম সমাজের একজন দীক্ষিত সদস্য ছিলেন। শুনছিলেন বিবেকানন্দের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার কথা। মহর্ষি খুব পছন্দ করেন বিবেকানন্দকে।
‘আপনি আশীর্বাদ করুন উনি যেন তাঁর কাজে সফল হতে পারেন। আমি আপনার আশীর্বাদ তাঁর কাছে পৌঁছে দেব।’ বলে তাকালেন মহর্ষির চোখের দিকে।
মহর্ষি তাকালেন। ঠোঁট ঢাকা গোঁফের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল শান্ত হাসি। শ্বেতশুভ্র হাত তুলে আশীর্বাদ জানালেন, ‘আমার আশীর্বাদ ওর সঙ্গে আছে। ও ওর কর্মে সফল হবে।’

নিবেদিতা তাঁর গুরুদেবের জন্য মহর্ষির আশীর্বাদ নিয়ে ফিরে এলেন।‌ ঠাকুরবাড়িতে তাঁর যাতায়াত অবাধ হয়ে গেছে। যে-কোনও অনুষ্ঠানে তাঁর নিমন্ত্রণ হচ্ছে। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গুণমুগ্ধ হয়ে উঠেছে। সরলা ঘোষাল তো আছেনই। ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা সেদিনই সন্ধ্যায় বেলুড়ে গিয়ে স্বামীজিকে বলে এলেন নিবেদিতা। পরের দিন অর্থাৎ ১৫ তারিখে নিবেদিতার স্কুল ছুটি ছিল সরস্বতী পুজোর জন্য। সেদিন লিখছেন মিস্ ম্যাকলয়েডকে এক দীর্ঘ চিঠি। সেখানেই বলছেন — “Yesterday morning I went early to be blessed by the old Devendranath Tagore. Swami sent word round early that he was particularly pleased and I told the old man this and said I felt that I was making Swami’s pranama as well as my own… He was quite touched.” (Letters p- 53)।

নিবেদিতার দিকে তাকালেন স্বামীজি। গঙ্গার জলে তখন বিকেলের রং। বেলুড়ের ঘাটের পাশে গাছের নীচে বসেছেন নিবেদিতার সঙ্গে। পিঠে রোদ পড়েছে হালকা। রোদ চলে গেলেই তিনি চলে যাবেন মঠে। সন্ধ্যারতি হবে।

‘সত্যিই উনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান? আমাকে ডেকেছেন?’ বড় বড় চোখ মেলে তাকালেন তিনি।
নিবেদিতা মৃদু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ। আমি বললাম তাঁকে নমস্কার করে — আমি স্বামীজির জন্য আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছি। উনি আশীর্বাদ করলেন দু’হাত ভরে। আর বললেন আমার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল যখন সে তরুণ ছিল এবং ঈশ্বরের সন্ধানে বিচলিত ছিল। আবার দেখা হলে আমার ভাল লাগবে।’
‘সত্যিই এই কথা বললেন?’
‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়লেন খুশিতে নিবেদিতা।
‘আমি অবশ্যই যাব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা দিন ঠিক করো। তুমি সঙ্গে থেকো।’ বিবেকানন্দের উৎসাহী চোখে অস্তমিত সূর্যের রং।
‘আগামী রবিবার সকালে ব্যবস্থা করি জোড়াসাঁকো যাবার দিন?’
নিবেদিতা লক্ষ করেছেন স্বামীজির চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘ঠিক আছে। যাব। এখন উঠি। চলো সন্ধ্যারতির সময় হয়ে গেল!’

রোদ হেলে পড়েছে ছায়ার গভীরে। গঙ্গার জলের রং গেল পাল্টে। ক্রমে ধূসর, তারপর গাঢ় হতে থাকে। কালো হয়ে উঠবে। বিবেকানন্দ উঠলেন। দ্রুত এগিয়ে চললেন মন্দিরের দিকে। নিবেদিতার এই সময়টা খুব প্রিয়। স্বর্গীয় আভা ছড়িয়ে থাকে প্রকৃতিময়। আশ্চর্যতম মায়ার আলো। দূরে শাঁখ বেজে ওঠে। কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসে বিভিন্ন মন্দির থেকে। অনির্বচনীয় এক প্রশান্তি নেমে আসে অন্যলোক থেকে। পাখিরা ফিরে আসে শাখে শাখে। দিনের শেষ কথাটি বলে নেয় সকলে। দিনের চঞ্চলতা মাথা রাখে রাতের কোলে। মায়ার আঁচল দিয়ে ঢাকে রাত প্রকৃতিকে।

আজ সেই আকাঙ্ক্ষিত রবিবার। নিবেদিতার মনের ভেতর উত্তেজনা। কিন্তু ব্যক্তিগত আবেগকে সংযত করার পাঠ তিনি নিয়েছেন। সংযত রেখেছেন। ২৮ জানুয়ারির পুঞ্জীভূত মেঘময় চা-পানের সাক্ষাৎকারের পরে-পরেই এত তাড়াতাড়ি সুযোগটি যে আসবে নিবেদিতা তা ভাবেননি। চেষ্টা একটা ছিল না যে তা নয়। ঠাকুরবাড়ির শীর্ষস্থানীয় থেকেই যদি একটা সূত্র পাওয়া যায় মেঘমুক্তির! কিছুই বুঝতে পারেন না নিবেদিতা। তবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর প্রবেশ অবাধ হলেও অনুপ্রবেশ ঘটেনি এখনও আদি ব্রাহ্ম সমাজের ভেতরে। কোথাও একটা বাধা!
কে দাঁড়িয়ে আছেন? রবীন্দ্রনাথ? জানা নেই। জানা নেই আজও মেঘ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠবে কি না আরও প্রবলভাবে জোড়াসাঁকোর আকাশে এই সাক্ষাতের পর! শঙ্কা আছে। তাই নিবেদিতা উত্তেজিত। প্রিয় মানুষ রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তিনি একটু বেশি অত্যুৎসাহী হয়ে মহর্ষির সঙ্গে বিবেকানন্দের সাক্ষাতের দিন স্থির করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপস্থিতি কি একটি অন্যতম কারণ?

কুমোরটুলির পরে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলের সামনে দাঁড়ালেন বিবেকানন্দ। স্কুল বন্ধ। সরস্বতী পুজো। ছেলেরা অনেকেই ভিড় করে আছে গেটের সামনে। সবাই ইস্তিরি করা কাপড়-পাঞ্জাবি বা পাজামা- ঝুলশার্ট পরে, নিপাট চুল আঁচড়ে এসেছে কলেজে। সরস্বতী পুজোর প্রস্তুতি। অনেকেই আবার কোট-প্যান্টে সেজেছে।

বিবেকানন্দ নামলেন ঘোড়ার গাড়ি থেকে।
‘এই স্কুলে পড়েছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। যুক্তিবাদী পণ্ডিত অক্ষয়কুমার দত্ত পড়েছিলেন এইখানে। মহর্ষির সঙ্গে অক্ষয়কুমারের চারদিন তর্ক হয়েছিল জানো! বাহ্য বস্তুর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কোনও ঐশ্বরিক ক্রিয়া নয়, কোনও ব্রহ্ম কিছু করছে না, সম্পূর্ণভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক — এই ছিল অক্ষয়কুমারের যুক্তি। উপাসনা ও প্রার্থনাকে তিনি গুরুত্বহীন আচার বলতেন।’


‘বাহ্। তারপর?’
‘পণ্ডিত মানুষ ব্রাহ্ম সমাজে থেকে তার সংস্কার করতে চেষ্টা করলেন।’
‘খুব আগ্রহ তৈরি হচ্ছে! তারপর? আমি কি তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?’
‘উনি মারা গেছেন। যে বছর রামকৃষ্ণ ইহলোক ত্যাগ করলেন সেই বছরেই এই যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষটি মারা যান। তোমার জোড়াসাঁকোর কবিবন্ধুটিও এখানেই পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। তারপর তো আর স্কুলমুখো হননি!’
‘ওহ্! এটা পবিত্র জায়গা একটি। আমাদের কি এখানে অনেক সময়ের কাজ আছে?’
‘তোমার আগামী বক্তৃতা আছে প্লেগ ও তার প্রতিকারে ছাত্রদলের ভূমিকা নিয়ে। তাই ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেই যাচ্ছি। উপস্থিত থাকার জন্য বলি।’
নিবেদিতা বেশ খুশি হলেন। ঘুরে ঘুরে দেখছেন স্কুলবাড়িটি। দেখছেন কোলাহলে মুখরিত স্কুল। অসংখ্য উজ্জ্বল ছাত্রদল পড়াশোনা করছে গভীর মনোযোগের সঙ্গে। কচিকাঁচাদের কলকাকলিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে স্কুলবাড়ির প্রতিটি দেওয়াল, ব্ল্যাকবোর্ড, চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চি-ডেস্ক।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই দারোয়ান ঝুঁকে প্রণাম করে নিয়ে গেল ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে চাকর চলে গেল ভেতরে খবর দিতে। গাড়ি বারান্দায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর এগিয়ে এসে নমস্কার করে নিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে।‌ সবার সুন্দর ব্যবহারকে অতিক্রম করে উজ্জ্বল সরলা এগিয়ে আসে।‌ নমস্কার-বিনিময়ে আভিজাত্য লক্ষ করলেন নিবেদিতা। বিবেকানন্দের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর সরলা আর সুরেন ওঁদের নিয়ে সিঁড়ির পথ ধরে। বিবেকানন্দ নিরাসক্ত উঠে চলেন সিঁড়ির পর সিঁড়ি। দু’-একটি কথা সরলার সঙ্গে। আর সুরেনের উচ্ছ্বাসের প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসি বিনিময়।‌

মহর্ষি হাসিমুখে তাঁর হাতের ইশারায় নিবেদিতা ও বিবেকানন্দকে বসতে বললেন। প্রসন্নতা তাঁর আয়ত চোখের ভাষায়।

‘প্রণাম!’ নিবেদিতা ও স্বামীজি নমস্কার করলেন এক তোড়া গোলাপ ফুল উপহার দিয়ে।
স্বামীজির প্রণাম গ্রহণ করলেন করজোড়ে প্রতি-নমস্কারে।
স্বামীজি ও নিবেদিতা বসলেন পাশে রাখা চেয়ারে।
‘আমি তোমার শিকাগো ধর্মসভায় বলা বক্তৃতা শুনেছি। তোমার আহ্বান সঠিক। ভারতবর্ষের মানুষের মেরুদণ্ড সোজা করার জন্য তোমার ভূমিকাকে প্রশংসা করি আমি। সফল হও। তোমার লক্ষ্যে স্থির থাকো।’
নিবেদিতা উৎফুল্ল হন। দশ মিনিট কথা হয়েছে। বেশিটাই বাংলায়। কিন্তু নিবেদিতা লক্ষ করেছেন স্বামীজি কেমন আড়ষ্ট হয়ে আছেন।‌ আশ্চর্যভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন যেন। হ্যাঁ-হুঁ ছাড়া কোনও উত্তর দিচ্ছেন না। কথা বাড়ে না। মিনিট দশেকের পর নেমে আসেন সবাই। উপর থেকে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সবাই ঘিরে ধরে।
‘সে কী! এমন ভাবে চলে যাবেন কেন? একটু বসুন। একটু চা বা কফি তো…’
‘না না। সেসবের প্রয়োজন নেই তেমন। আমাকে মঠে ফিরতে হবে দ্রুত। অনেক কাজ আছে।’
বিবেকানন্দ বেরিয়ে আসতে চান। কিন্তু সবার অনুরোধে আটকে গেলেন।
‘ঠিক আছে। আমি শুধু একটা পাইপ নেব। চা-কফির প্রয়োজন নেই।’
স্বামীজি বসলেন। পাইপ ধরালেন আরাম করে। তামাকের সুমিষ্ট গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।
‘শুনলাম আপনি মঠে কালীপুজো শুরু করছেন?’ ইন্দিরা দেবী প্রশ্নটা করেই ফেললেন।
‘হ্যাঁ। মূর্তিপূজা আসলে একটা প্রতীকের উপাসনা। সিম্বলিজম।’ বিবেকানন্দ বেশি কথায় যান না। ঘন ঘন পাইপ টানেন।
সবাই গোল হয়ে স্বামীজিকে ঘিরে বসেন।
‘কিন্তু একটা মাটির তৈরি কল্পনাপ্রসূত প্রতিমা পুজোর মধ্য দিয়ে জনসচেতনতার বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে নাকি? আমরা কুসংস্কারের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি না তো! যখন প্রকৃতির সমস্ত কিছুতেই প্রাণ আছে তখন একটা মাটির মূর্তি গড়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে প্রতীকোপসনার দরকার কী?’
সুরেন ও সরলা বেশ অস্বস্তিতে পড়েন এমন প্রশ্নে।
বিবেকানন্দ যেন অনুমান করেছিলেন এইরকম প্রশ্ন আসতেই পারে। খুব শান্তভাবে বললেন, ‘আপনাদের মতটাই শাস্ত্রসম্মত, তা ঠিক। কিন্তু অপর মতটাও আপনাদের মেনে নেওয়া উচিত। অন্তত অদ্বৈতবাদের সঙ্গে প্রতীকোপসনার যে একটা সম্পর্ক আছে এটা স্বীকার করাই ভাল।’ স্বামীজি দু’দিক রক্ষা করলেন। নিবেদিতা, সরলা, সুরেন স্বস্তি পেল। নিবেদিতা ওঠার তোড়জোড় করতেই মনমোহিনীবাবু প্রশ্নটি খুব বিনীতভাবে রাখলেন যেন তাঁর প্রশ্ন এটা নয়।
‘সনাতন হিন্দু ধর্মের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রামমোহন রায়ের সংস্কার আন্দোলনকে আপনি কিভাবে দেখেন?’
ঠাকুরবাড়ির ভেতরে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিবেকানন্দ ও বেলুড় মঠ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। নিবেদিতা জানেন সেটা। বেশ অস্বস্তিতে আছেন। ঘন ঘন তাকাচ্ছেন সরলা আর সুরেনের দিকে। মনে মনে ভাবছেন, আর নয় অনেক হয়েছে, এবার উঠে পড়াই ভাল!
‘রামমোহন রায় এই দেশের এক মহান ব্যক্তিত্ব বলে আমি মনে করি। তিনি নব্য ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাঁর সংস্কারের পথকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনও ভুল নেই। তবে তাঁর সে পথ সমগ্র নিরন্ন অভুক্ত দরিদ্র মানুষের মধ্যে স্থান করে দেওয়া প্রয়োজন। তিনি তার জন্য লড়াই করার manhood তৈরি খুব দরকার।’ পাইপদানিতে পাইপটি রেখে উঠে পড়লেন স্বামীজি। নিবেদিতাও উঠলেন।‌ সংক্ষিপ্ত আসর ভাঙল। বেলা দশটা।
‘আজ কিন্তু তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন! আরেকদিন আসতে হবে স্বামীজি।’ ইন্দিরা দেবীর মুখে মুগ্ধতা।
‘হ্যাঁ, আরেকদিন বেশ কিছুটা বেশি সময় হাতে নিয়ে আসবেন! এদের এত সব ,প্রশ্ন!’ সুরেন গাড়ি-বারান্দা অবধি নেমে এল পায়ে পায়ে।
স্বামীজি সিঁড়ি দিয়ে নেমে দ্রুত এগিয়ে যেতে গিয়েও দাঁড়ালেন। পিছন ফিরে নমস্কার করলেন করজোড়ে। মুখে সেই বুদ্ধের অমল হাসি। প্রতি-নমস্কার জানালেন ঠাকুরবাড়ির উপস্থিত সবাই।
‘আপনারাও একদিন আসুন মঠে।‌ দেখে ভাল লাগবে।’ স্বামীজি নিমন্ত্রণ করলেন খোলা গলায়। নিবেদিতার মুখে হাসি ফুটে উঠল।
বাইরে তখন শীতের ঝকঝকে রোদ। পথে নামলেন স্বামীজি ও নিবেদিতা। কিছুটা এগিয়ে পেলেন জুড়িগাড়ি। চলে এলেন বাগবাজার ঘাট। নৌকা প্রস্তুত ছিল। নিবেদিতা দাঁড়িয়ে থাকলেন ঘাটে। স্বামীজিকে নিয়ে নৌকা ভেসে চলল গঙ্গায়।

আজ ৫ জুলাই ১৯০২ নিবেদিতা নৌকায় পাথরের মতো বসে। নৌকা ভেসে চলেছে বেলুড় মঠের দিকে। বেলুড়ের ঘাটে তিনি আর থাকবেন না দাঁড়িয়ে।

চমকে উঠলেন নিবেদিতা! সন্ধ্যারতি শেষ। শান্ত নদীতীর। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে ঘাটের কাছে যাচ্ছে। নৌকা বাঁধাই আছে। নিবেদিতা ফিরবেন বাগবাজার। হঠাৎ বিবেকানন্দ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন, ‘মার্গট, তুমি যতদিন ওই ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে মেলামেশা চালিয়ে যাবে ততদিন আমাকে সাবধানবাণী বলে যেতেই হবে। মনে রেখো, ওই পরিবার বঙ্গদেশে শৃঙ্গার রসের বিষ ছড়াচ্ছে।’
নিবেদিতা তাকান স্বামীজির চোখের দিকে। স্বামীজি অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে কতগুলো কবিতা বলে গেলেন। উদাহরণ দিলেন কী ধরনের ‘flood of erotic venom over Bengal’ ছড়াচ্ছে ঠাকুরবাড়ির কবি। তারপরেই গলা নামিয়ে বিবেকানন্দ নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার উদ্দেশ্য রামকৃষ্ণ বা বেদান্তর ভাবাদর্শ প্রচার নয়, মানুষের মধ্যে পৌরুষের জাগরণ ঘটানো।’
‘আমি আপনাকে সাহায্য করব স্বামীজি।’
নিবেদিতা বিবেকানন্দের দিকে তাকিয়ে ধীরে গভীর উচ্চারণ করলেন।
বিবেকানন্দ গঙ্গার জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছেন।
‘আমি তা জানি। তাই তোমাকে সতর্ক করি।’

দূরে গঙ্গার অসীম তরঙ্গে কোথাও জাহাজ ছাড়ার ভোঁ বেজে উঠল।

( He said “as long as you go on mixing with that [Tagore] family Margot I must go on sounding this gong. Remember that that family has poured a flood of erotic venom over Bengal.” Then he described some of their poetry. …my mission is not Ramkrishna’s nor Vedantas – nor anything but simply to bring MANHOOD to this people.” “I’ll help you Swami” I said. “I know it” he said – “And so I beat the alarm.” – letters dated 12/03/1899 pg. 82)

[৪র্থ পর্ব]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, সেপ্টেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

4 1 ভোট
Article Rating
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
দ্যুতি সুন্দর চট্টোপাধ্যায়
দ্যুতি সুন্দর চট্টোপাধ্যায়
1 month ago

খুব ভালো লাগছে। এতো কিছু জানতাম না। রজত ‘দার
লেখনী খুব সাবলীল। পরের লেখার অপেক্ষায় র‌ইলাম।

Rajat Chakraborti
Rajat Chakraborti
1 month ago

ঠেকে চা বিড়ি খাওয়াবো আয়। পড়তে পড়তে জানতে জানতে আমাদের পথ চলা। চল সাঁকো ধরে ধরে!

শিপ্রা ভৌমিক
শিপ্রা ভৌমিক
28 days ago

ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে বিবেকানন্দের সংঘাত ও সম্পর্ক বিষয়টি অজানা ছিল।সহজ কথা সহজে লিখছেন!ইতিহাসের সঙ্গে হাঁটতে বেশ লাগছে!

Syamali Bhadra
Syamali Bhadra
11 days ago

অনেক কিছুই নতুন করে জানছি। খুব সুন্দর লেখা। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।