৬ পর্ব

বৈশাখ মাসের গরম হলেও গঙ্গার ধারে এক মনোরম হাওয়া দেয় এই সময়ে। গঙ্গার ধারের ঘরের সব জানালা খোলা। হু হু করে হাওয়া আসছে।
কাঁসার থালায় ভাত, ঘি, আলুভাজা, শাকভাজা। বাটিতে বাটিতে ডাল, ছানার ডালনা। পাথরের বাটিতে ঘরে পাতা দই। দু’জনের আসন পাতা। বসলেন বিবেকানন্দ। বসলেন নিবেদিতা। দুপুরের খাওয়া। আচমন করে খাওয়া শুরু করলেন।
‘তুমি কি কোনও বিষয়ে খুব চিন্তিত মার্গট?’
‘না। তেমন কিছু বিষয় নয়! তবে একটা প্রশ্ন বারবার করতে চাইছি!’
‘বলো, বলো, সংকোচ কোরো না!’
‘মি. বোসের বাড়ি যাওয়া বোধহয় আমার পক্ষে ঠিক হচ্ছে না! আমি স্বীকার করছি আপনার কাছে! I tell you this as a priest, Swami।’
স্বামীজি তাকালেন শিষ্যার দিকে। মার্গট কি অপরাধবোধে ভুগছে? হীনমন্যতা থাকলে তা তো কাটিয়ে দিতে হবে! তিনি সতর্ক হলেন, ‘না না, এখানে অমন কনফেশন করার মতো করে বোলো না। আমরা দেশের সেবক হিসেবে এখন কথা বলছি!’
‘আমি অপরাধবোধে ভুগছি স্বামী!’
‘না না। ওরকমভাবে ভেবো না। তোমার যেমন মন চাইছে তেমন করো।’
‘তবু নানা জায়গায় যাওয়া, নানান মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা কি অপরাধ? খুব দ্বিধায় আছি আমি!’ নিবেদিতা পরিষ্কার করে বললেন।
‘না অপরাধ নয়।’ স্বামীজি আশ্বস্ত করলেন।
নিবেদিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ঠিক করেই ফেলছিলেন আর সচরাচর যাবেন না তিনি বসুদের বাড়ি। যে-কোনও অনুষ্ঠানে যাবেন না ঠাকুরবাড়ি। মনে চাপ হচ্ছিল। প্রিয় মানুষ তাঁরা! এখন ভারমুক্ত হলেন স্বামীজির কথায়।
বিবেকানন্দ খোলামনে নির্ভার কথা বলছেন, ‘সপ্তাখানেকের মধ্যেই দেখবে সে ( ডা. বোস) আমার পক্ষে এসে যোগ দিচ্ছে!’
নিবেদিতা তাকালেন। সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। বিবেকানন্দ বলে গেলেন, ‘এদের মতো লোকেরাই ব্যক্তিপূজা নিয়ে হইহই করে। তারা বোঝেই না…।’
স্বামীজি তামার ঘটি থেকে জল খেলেন। ঢেকুর তুললেন। খাওয়া শেষ। সোজা হয়ে বসলেন একটু।

নিবেদিতা তখনও মাথা নিচু করে খাচ্ছেন আর ভাবছেন — যদি যদি শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সহায় হোন, যদি যদি একবার প্রিয় বন্ধুটিকে, ‘বেয়ার্ন’ আর ‘বো’ কে বেলুড় মঠে আনতে পারি… স্বামীজি বিলেত যাবার আগেই যদি তাঁকে আনা যায়!
খাওয়া শেষে নিবেদিতা ওঠেন। হাত-মুখ ধুয়ে এসে বসেন মঠের সামনে গাছের ছায়ায় দু’জনে। গঙ্গার দাপুটে হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে চুল, পোশাক। উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায় যেন। উড়োঝুরো হয়ে পড়ছে চিন্তা-ভাবনা। স্বামীজি কি প্রকারান্তরে অনুমতি দিলেন ড. বোসের সঙ্গে নিবেদিতার সখ্যে! ব্রাহ্মদের সঙ্গে মেলামেশায় কোনও বিধিনিষেধের কথা তো বললেন না স্বামী! উনি কি চাইছেন না এখন মেলামেশা! নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন তরঙ্গায়িত গঙ্গার দিকে। কীভাবে স্বামীজি ভাবলেন যে এক সপ্তাহের মধ্যে ডা. বোস তাঁর ভাবানুগত হবেন! কীভাবে! এমন কোনও ইঙ্গিত তো পাওয়া যায়নি! ঠাকুরবাড়ির তুলনায় বোসেদের স্বামীজি যে বেশি পছন্দ করেন সেটা বোঝা গেছে। যদিও ঠাকুরবাড়ির তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একটা প্রভাব তো পড়েছেই। তবুও এক সপ্তাহের মধ্যে জগদীশচন্দ্র…!

আজ তিনি চলে গেলেন। নিবেদিতা চলেছেন নৌকায় বাগবাজার থেকে বেলুড় মঠে। স্বামীজিকে ‘শেষ দেখা’ দেখবেন। এর পরেই পঞ্চভূতে লীন হয়ে যাবেন। এই তো কিছুদিন আগে নিবেদিতা স্বামীজির কোষ্ঠী গণনা করিয়েছিলেন। তখন জানা গিয়েছিল বৃহস্পতি গ্রহ আর নয় বছর সক্রিয় থাকবে। কিছুদিন স্বাস্থ্য খারাপ গেলেও এর পরেই সাফল্য ও যশ পাবেন। যতক্ষণ বৃহস্পতি জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে, ততক্ষণ জাতকের মৃত্যু নেই। নিবেদিতার বিশ্বাস ছিল কোষ্ঠী গণনায়। বিখ্যাত হস্তরেখাবিদ কিরো ( Chero) -এর সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধুত্ব। অপরদিকে বিবেকানন্দ এটাকে মনে করতেন মেয়েলি কুসংস্কার। প্রচণ্ড রেগে যেতেন। নিবেদিতা একদিন বলতেই স্বামীজি ক্ষেপে গেলেন — ‘কু-সংস্কারের একটি শব্দও আর উচ্চারণ করবে না! এসব তাড়াতে হবে। তার জায়গায় বসাতে হবে খাঁটি অদ্বৈততত্ত্ব।’ মনে পড়ছে আজ। সব অতীত হয়ে গেল!
নৌকায় চলেছেন নিবেদিতা এই ভোরে বাগবাজার থেকে বেলুড় মঠে।

‘প্রাণ সর্বত্র, এমনকী ধাতুও প্রাণবন্ত। একদিন তার প্রাণকে পাকড়াও করবই। প্রথমে গাছপালায়, তারপর পাথরেও যে প্রাণ আছে তা প্রমাণ করবই।’ জগদীশচন্দ্র একবার তাকালেন নিবেদিতার দিকে।
নিবেদিতা আস্তে আস্তে টবের উপর লজ্জাবতী চারাগাছটির কাছে গেলেন। আঙুল ছোঁয়ালেন লজ্জাবতীর ঝিরিঝিরি পাতায়। সঙ্গে সঙ্গে পাতাগুলি গুটিয়ে গেল! নুয়ে পড়ল গাছটি। জগদীশচন্দ্র বলে চলেছেন অণু, পরমাণু এবং বিদ্যুৎ তরঙ্গের প্রতিক্রিয়ার সূক্ষ্ম আলোচনা। বলতে বলতে যেন পাতার শিরা-উপশিরায় পৌঁছে যাচ্ছেন তিনি তরঙ্গে তরঙ্গে। পাতার সক্রিয় উত্তেজনায় জগদীশচন্দ্র নিজেই উত্তেজিত হয়ে উঠছেন, ‘উদ্ভিদ-শরীর যখন বিভিন্ন পরিবর্তনে বা বাইরের প্ররোচনায় সাড়া দেয় তখন তার এক অংশ থেকে আরেক অংশে প্রবাহিত হয় নানান সংকেত, সিগন্যাল। এই সংকেত-প্রবাহ প্রাণীর দেহে ঘটে স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে, এটা এক ধরনের তড়িৎ-ক্রিয়া। উদ্ভিদের শরীরেও এই একই ধরনের বার্তা আদান-প্রদান হয়। সে এক অনিন্দ্য জৈব ছন্দ, এক ঐকতান…। বুঝতে পারছেন! সেই অপূর্ব ছন্দের চিত্র এই গ্রাফগুলি যেন সাংকেতিক কবিতা!’
জগদীশচন্দ্র উদাস তাকিয়ে থাকেন, যেন সেই অনিন্দ্য জৈব ছন্দের সুরটি ভেসে আসছে কোনও অতীন্দ্রিয় জগৎ থেকে।
নিবেদিতা তাকালেন। কাছে গিয়ে খুব ধীরে বললেন, ‘আমাক যা বলছ তা তোমার লিখে ফেলা উচিত। এসব কাজের কথা, লেখা থাকা দরকার।’
গোল চশমার ভেতর থেকে দু’টি উজ্জ্বল চোখ ঝলসে উঠল, ‘যা বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মনের ভেতরে খেলছে, তাকে আমি রূপ দেব! কী করে আশা করো? ও তো আমার কাছে মরীচিকা! আমি তার দিকে এগিয়ে যেতে পারি মাত্র, ধরতে পারি না, ধরে রাখব কেমন করে!’
নিবেদিতা তাকালেন, ‘আমি তো আছি। আমার কলম অনুগত ভৃত্যের মতো তোমার কাজ করবে। মনে করো এ-লেখা তোমারই।’
নিবেদিতা স্থির তাকালেন। জগদীশচন্দ্র ঝুঁকে পড়েছেন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের উপর। বিভিন্ন বৈদ্যুতিক তারের জাল ঝুলছে এপাশে-ওপাশে। মাথার মাঝখানে সিঁথি। দু’পাশে কোঁকড়ানো চুল। কপালের উপর নেমে এসেছে কোঁকড়ানো চুলের কুচি। চোখ তুললেন। দুলে উঠল চশমার ধারে জড়ানো সিল্কের সুতো। টেবিল বোঝাই নানান মাপের নানা গ্রাফ করা কাগজ। সংবেদনের আঁকিবুকি। টেবিল থেকে গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। ছড়িয়ে যায় সংবেদন-অঙ্কন, প্রাণের রেখা-চিত্র, সংকেত। নিবেদিতা ধীর পায়ে গিয়ে গুছিয়ে তুলে দেন একটি একটি করে।
‘আমি তোমার এই কাজের মধ্য দিয়ে অদ্বৈততত্ত্বের রহস্যের ভেতরে প্রামাণিক সত্য অনুভব করতে পারি বেয়ার্ন।’
‘মিস নোবেল! সত্য একদিন প্রতিষ্ঠা হবেই। সমস্ত বাধা অতিক্রম করে সত্য প্রতিষ্ঠা হবেই।’
‘আমি তোমার এই যুদ্ধে পাশে থাকতে চাই বেয়ার্ন! তোমার পাশে আছেন সারা, ম্যাকলয়েড সর্বক্ষণ।’ নিবেদিতা শান্ত তাকালেন।
জগদীশচন্দ্র তাকালেন, ‘জানি। মিস সারা বুল আমাকে পুত্রস্নেহে দেখেন। মিস ম্যাকলয়েডকে যখনই চিঠি লিখবে আমার ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানাবে।’
‘অবশ্যই বেয়ার্ন! আমি জানি প্রেসিডেন্সি কলেজে তোমার হেনস্থার কথা। তোমাকে আমার দেশের লোকেরা ল্যাবরেটরি ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। তুমি ভারতীয় বলে কম বেতন পাচ্ছ!’
‘ মিস নোবেল! আমি ওসব নিয়ে ভাবি না!’
‘আমি খুব লজ্জা পাই। আমার দেশের মানুষ…’
‘তোমার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি আমাকে বৃত্তি দিয়ে সম্মানিত করার পর এখানকার বৃটিশ সরকার কিছুটা হলেও মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছে।‌ তবে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অনেক! মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে। এত লড়াই!এত লড়াই! একটি পরাধীন দেশে জন্ম গ্রহণ যে কতবড় অভিশাপ!’
‘মহৎ হৃদয়কে কী করে বৃহৎ কর্মে উদ্দীপিত করতে হয় তা তুমি জানো বেয়ার্ন! তোমার প্রতিভা, তোমার শ্রম, অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা ব্যর্থ হবার নয়। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি!’ নিবেদিতা কেটে কেটে বললেন কথাগুলো।
‘আমি জানি মিস নোবেল! কিন্তু আমি ওসব গুরুত্ব দিই না! আমি শুধু দেখি প্রাণের স্পন্দন সর্বত্র । আমি দেখেছি জড়ের মধ্যেও প্রাণ। কোনও ভুল নেই, জড়ও চৈতন্যময়! এটা শুধু বিশ্বাস নয়। সত্য। আমি প্রমাণ করব বিজ্ঞানের পথে এই সত্য।’
জগদীশচন্দ্রের উত্তেজিত চোখের দিকে তাকিয়ে নিবেদিতা বললেন, ‘একদিন পৃথিবীর মানুষ তোমাকে গ্রহণ করবে এ বিশ্বাস আমার আছে বেয়ার্ন। তুমি থেমে যেয়ো না। মিস সারা, মিস ম্যাকলয়েড আমরা তোমার চারপাশে এক ভালবাসার বলয় গড়ে তুলব।’


জগদীশচন্দ্র একটি টেস্ট টিউব তুলে নিলেন হাতে। তীক্ষ্ণ তাকিয়ে আছেন। ‘দেখো যেদিকে বাধা পেয়েছে এই ছোট্ট চারাটি সেই বাধা এড়িয়ে মাথা তুলছে অন্যদিকে! তার মানে…’
‘কোনও বাধাই তোমার কাজকে আটকে রাখতে পারবে না’। নিবেদিতা বেশ জোরের সঙ্গে কথাগুলো বললেন।
‘আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি, তোমার লেখার কাজে, কপি করার কাজে, গুছিয়ে তোলার কাজে!’ নিবেদিতা থেমে জগদীশচন্দ্রের দিকে তাকালেন। অসম্ভব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষের চোখ যেন আশ্রয় চাইছে। দু’টি হাত ধরতে চাইছে এক শিশু। কলেজের লড়াইতে আহত, ক্ষত-বিক্ষত। পিতার ঋণ শোধ করতে গিয়ে পরিবারে অর্থনৈতিক সমস্যা অসহনীয় হয়ে উঠছে। মাঝে কিছুদিন চন্দননগরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়েছিল। এক আশ্চর্য অসম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন জগদীশ। এই লড়াকু মনটাই নিবেদিতার অত্যন্ত প্রিয়। জগদীশচন্দ্রের একক সংগ্রাম সমগ্র পরাধীন ভারতবাসীর বৃটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে জয়ের পতাকা তোলার সংগ্রাম। নিবেদিতা ধীরে ধীরে সহযোদ্ধা হয়ে উঠছেন।
দুপুরে অবলা খুব যত্ন করে খাওয়ালেন নিবেদিতাকে। বাৎসল্য অবলার অলঙ্কার। অবলা ও নিবেদিতা একসঙ্গে দুপুরের খাওয়া শেষে পায়চারি করতে থাকে ছোট্ট বাগানে গাছের ছায়ায়। বাগানের এক পাশে দু’টি সাইকেল দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠে নিবেদিতা।
‘বো! তোমরা কি সাইকেল চালাও! কার সাইকেল?’ নিবেদিতা অবলার দিকে তাকান।
‘আমাদের। তোমার বেয়ার্ন তো সাইকেল চালানো খুব পছন্দ করেন। সে আর এক কথা!’ অবলা হেসে উঠেন।
‘কী কথা? আমি শুনতে চাই বো।’
‘তিন সাইকেল প্রেমিক। বুঝলে!’
‘তিনজন?’
‘প্রফুল্লদাদা মানে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, নীলুদা ডা. নীলরতন সরকার আর তোমাদের বিজ্ঞানী — তিনজনের কী সাইকেল চালানোর উৎসাহ! ওঁদের উৎসাহ দিতে সাইকেল দরদী আমাদের হেমেন্দ্রমোহন বসু, হেমেন তো সাইকেলের দোকান দিয়ে দিল হ্যারিসন রোডে! প্রেসিডেন্সি কলেজের কাছেই। বাংলায় প্রথম সাইকেলের দোকান।’
‘তারপর, তারপর?’
ওরা হাঁটতে হাঁটতে হাসতে হাসতে বসার ঘরে এসে বসলেন।
‘এই পাশের বাড়ির লন, ৬৪/২ মেছুয়াবাজার স্ট্রিটে ছিল অনুশীলনভূমি! মি. বোসের তত্ত্বাবধানে চলত আমাদের অনুশীলন! প্রফুল্লদাদা, নীলুদা ও তাঁর বউ নির্মলা বউদি, আমি, মি. বোস — চলত রোজ ভোরে কঠোর সাইকেল প্র্যাক্টিস। প্রবল উৎসাহ দিতেন মি. বোস। আরও সব বন্ধুদের জুটিয়ে ছিলেন সাইকেল প্রেমিক করার জন্যে!’
‘ইটস্ গ্রেট!’
‘তারপর শোনো না! বেশ কিছুদিন প্র্যাক্টিসের পর সবাই মিলে যাওয়া শুরু করলাম গড়ের মাঠে সাইকেল চালিয়ে হাওয়া খেতে রোজ ভোরে। সে এক মজার কাণ্ড! রাস্তায় লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকত!’
‘ওহ্ তাই? খুব মজার নিঃসন্দেহে!’
‘তবে আমাদের প্রভাতী সাইকেল অভিযান শীতকালের বেশি স্থায়ী হয়নি।’ হেসে ওঠেন অবলা। নিবেদিতাও মজা পান বলার ভঙ্গিতে।
‘তুমি সাইকেল চালানো শিখেছ তো…!’ নিবেদিতা কথা শেষ করতে পারেন না । অবলা বলে ওঠেন,
‘হ্যাঁ, ইংল্যান্ডে। টেমস্ নদীর পাশে। মি. বোস পেপার পড়তে গেলেন ফিজিক্সের উপর! তখনই উনি আমাকে শিখিয়ে দিলেন সাইকেল চালানো। দাঁড়াও দাঁড়াও বছর দুই হয়ে গেল। তোমাকে একটা লেখা পড়াই, ওই ফিজিক্সের পেপারেই ছিল।’
‘বেয়ার্নের লেখা?’
‘হুম। ফিজিক্স সাইকেল মিলেমিশে গেছে! বোসো এক মিনিট।’ অবলা দ্রুত উঠে গেলেন ভিতরে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অবলা এলেন হাতে একটা খাতা নিয়ে। পড়তে শুরু করলেন – “…যে জিনিসটাকে এক মুহূর্ত খাড়া রাখা যায় না একজন মানুষ তাহার উপর উঠিয়া বায়ুবেগে গমন করিতেছে ইহাতে লোকের কৌতুহল হইবার কথা নয়ত কি? অল্পদিন হইল এদেশে বাইসিকেল প্রচলিত হইয়াছে তাহাতেই এত লোকের সখ হইয়াছে। বিলাতে তাহা হইলে ব্যাপারখানা কি তাহা বোঝা কঠিন হইবে না।… আজকাল বাইসিকেল আমাদের পুষ্পক রথ!”
নিবেদিতা হাততালি দিয়ে ওঠেন। জগদীশচন্দ্র ঘরে ঢোকেন গলায় আওয়াজ করে, জানান দিয়ে। অবলা লুকিয়ে ফেলে লেখাটা। নিবেদিতা ও অবলা দু’জনেরই হাসি-হাসি মুখ।
‘বেয়ার্ন, তুমি সাইকেল শিখেছ কার কাছে?’ নিবেদিতা জগদীশচন্দ্রকে প্রশ্নটা ছুড়ে দেন।
‘কেন হঠাৎ! আমি, ডা. নীলরতন, আমাদের অগ্রজ বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সবাই সাইকেল শিখেছিলাম হেমেনদার কাছে, হেমেন্দ্রমোহন বসু, প্রথম বাঙালি সাইকেলপ্রেমী শুধু নন, সাইকেলের দোকান করেছিলেন কলকাতায় প্রথম।’
‘ব্যস! আবার সাইকেল নিয়ে বলতে শুরু করবে। ওঁর সাইকেল প্রীতি কম নয়। মিস নোবেল, তুমি সাইকেল চালানো জানো?’
নিবেদিতা ঘাড় নাড়েন, ‘আমি তো স্কুল বাজার সব সাইকেলেই করতাম। এখানেও শুরু করব ভাবছি। আমাকে এবার উঠতে হবে বো! সন্ধ্যা হয়ে এল।’
অবলা জোর করেন, ‘বোসো না আরেকটু। বেশ গল্প হচ্ছিল! আমি চা করে আনছি। আর সেজবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে আসি।’

অবলা উঠে যান কাজে। জগদীশ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান। পড়ন্ত বিকেলের রাঙা আলো ছড়িয়ে পড়ছে। নিবেদিতা এসে দাঁড়ান বারান্দায়।
‘আরেকটু থেকে যাও মিস নোবেল! তোমাদের সঙ্গে কথা বলে ও একটু প্রাণবন্ত থাকে, কাজে মন দেয়।’
মরা আলোয় নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন জগদীশের দিকে। বারো বছরের বিবাহিত জীবন সন্তানহীন। এই নিঃস্বতার কথা ‘বো’ বলেছেন নিবেদিতাকে। নিবেদিতার থেকে মাত্র তিন বছরের বড় অবলা। নিবেদিতা এখন ৩১। অবলা ৩৪ আর জগদীশ ৪০। এক আশ্চর্য বন্ধুত্বের বাঁধনে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে কি নিবেদিতা? মায়া? ভালবাসা? শ্রদ্ধা? না কি সব কিছুর মিশ্রিত এক অনুভূতি? যার জন্য বারবার ছুটে আসতে হয় তাঁকে। এড়াতে পারেন না কিছুতেই।


সন্ধ্যা নেমে এল কলকাতার আকাশ জুড়ে। কাছেই কবরখানার দিক থেকে ভেসে আসছে শিয়ালের ডাক। মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে পেঁচা। বাদুড়ের ঝটপটানি শুরু হয়েছে সামনের গাছে গাছে।‌ ভেসে আসছে ফুলের গন্ধ গঙ্গার মিষ্টি বাতাসে। জগদীশচন্দ্রের দৃষ্টি বহু দূরে। একমনে সিগারেটে টান দিয়ে চলেছেন। অবলা এক-একটা ঘরে আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, আর বাড়িটা আশ্চর্য মায়াবী আলোয় ভরে উঠছে। হঠাৎ জগদীশচন্দ্র আপনমনে যেন বলে উঠলেন, ‘মিস নোবেল, আমি তোমাকে এমন ভাবি, যে-উচ্চতায় তুমি হয়তো এখনও উঠতে পারোনি, কিন্তু আমার বিশ্বাস তুমি একদিন ঠিক সেখানে পৌঁছবে।’
নিবেদিতা তাকালেন। খুঁজছেন সেই উজ্জ্বল চোখ দু’টি। যার কৃষ্ণকালো মণির অতলে কষ্টের সিন্দুক লুকোনো আছে। সমস্ত কষ্টই কি জীবনের জিয়নকাঠি? সংগ্রামের শক্তি? স্তম্ভিত নিবেদিতা। সুমহান এক উচ্চারণ বলে মনে হয় তাঁর। পবিত্রতম এই সময়। দূর থেকে মন্দিরের আরতির ঘণ্টাধ্বনি ভেসে এল। ভেসে এল শঙ্খধ্বনি। নিবেদিতা প্রণাম করলেন দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে। শিখিয়েছেন সারদা মা। সন্ধ্যার এই ক্ষণ নিবেদিতার অত্যন্ত প্রিয় সময়। এই প্রিয় সময়ে তাঁর প্রিয় মানুষটির এমন অকপট উচ্চারণ!
যুক্তি ও বিজ্ঞানের নির্ভরতার জায়গাটা নিবেদিতা ধর্মভাবের বিরোধিতা দিয়ে নষ্ট করতে চান না। সন্ন্যাস ও বিজ্ঞানের পরম ও পবিত্র সমন্বয়ই কি ভারতবর্ষের মূল সুর? দুই তীব্র শক্তির সংঘর্ষে এক পবিত্র বেদনায় ছিন্নভিন্ন হচ্ছেন নিবেদিতা। সে যন্ত্রণায় অমল আনন্দ আছে। নিজেকে নিঃস্ব করে সেবার ও ত্যাগের দ্যুতি আছে। সে দ্যুতির ছটায় সুন্দর হয়ে ওঠে সমগ্র।
নিবেদিতা নড়ে ওঠেন, ‘আমাকে এবার যেতে হবে বেয়ার্ন। আমি দীক্ষিত ব্রহ্মচারিণী, অতীত বা ভবিষ্যতের নির্দিষ্ট পথ নিয়ে এগিয়ে চলা আমার কাজ নয়। গুরুর পথই আমার পথ। তুমি খসড়া লেখাগুলি গুছিয়ে রেখো, আমি এসে নিয়ে যাব।’
কলকাতার আধোছায়া রাস্তায় দু’জন বেরিয়ে আসেন। কিছুটা এগিয়ে এসে ঘোড়ার গাড়ি পেলেন নিবেদিতা। ‘শুভরাত্রি!’ বলে গাড়িতে উঠলেন নিবেদিতা। জগদীশচন্দ্র প্রতি-উত্তরে জানালেন শুভেচ্ছা, ‘শুভরাত্রি! আমাদের খুব শিগগিরিই দেখা হচ্ছে!’
নিবেদিতাকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি কলকাতার মায়াবী সন্ধ্যায় হারিয়ে গেল দূরে। গাছে গাছে জমাট অন্ধকার। কলকাতার মায়াঘেরা ম্লান হলুদ আলোয় পড়ে থাকা পাথর বিছানো পথে মিলিয়ে গেল নিবেদিতার ঘোড়ার গাড়ি।

“I have just been telling Yum how I spent last Sunday at the Bose’s. It was just heaven – and for the first time I entered into the full possession of the heart of my dear Dr. Bose. (Letters, page 119) বৈশাখ মাসের দুপুরের গরমে অস্থির নিবেদিতা। ঘাম গড়িয়ে নামছে গাল বেয়ে। কিন্তু সময় পেয়েছেন এখন। অনর্গল বলে চলেছেন ভেতরে খুব ভেতরে জমে থাকা আবেগ।
“It filled me with reverence – and left me dragging a heavier load than ever of Anglo Indian. When I see you again I shall be able to tell you all, but now I must not.(Letters, page 119)
নিবেদিতা ব্লটিং পেপার লাগানো ডাস্টার দিয়ে চাপ দিলেন লেখার উপর।‌ কাগজের উপর অক্ষরে অক্ষরে জমে থাকা অতিরিক্ত কালি শুষে নিল ব্লটিং পেপার। কলম ডোবালেন দোয়াতে।‌ নিবে উঠে আসে কালি। লিখে চলেন। জ্যৈষ্ঠের গরম হাওয়া ঢুকে পড়ছে মাঝে মাঝে। ওলটপালট করে দিচ্ছে টেবিলের উপরে রাখা চিঠি লেখার কাগজ, প্যাড। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন নিবেদিতা। তাকিয়েই আছেন। একটু দূরেই আমগাছে পাকা আম দুলছে বাতাসে। কোথাও কোনও পাতার আড়াল থেকে কোকিল ডেকে উঠল। উঠোনের পায়রাগুলোর গম্ভীর বকবকম গল্পগুজব দুপুরটাকে ভারী করে তুলছে। চারটে বাজলেই সেলাইয়ের ক্লাস আছে। তার আগে দ্রুত শেষ করতে হবে চিঠি লেখার কাজ।
নিবেদিতা কলম ডোবায় কাচের দোয়াতে। তাঁর প্রিয় সারা বুলকে লিখছেন নিবেদিতা। সারা বুলের সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের সম্পর্ক ছেলে ও মায়ের সম্পর্কে বেঁধে দিচ্ছেন নিবেদিতা। নিবেদিতা জানেন অগাধ সম্পত্তির মালিক ধনী সারা বুল যদি জগদীশচন্দ্রকে তাঁর পুত্র হিসেবে ভাবতে থাকেন এবং তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণার গুরুত্ব বুঝতে পারেন, তবে জগদীশচন্দ্রের দুশ্চিন্তা অনেকটাই লাঘব হয়। স্বামীজি তাঁকে ধীরামাতা বলে ডাকেন। স্বামীজি তাঁর ধর্ম-সন্তান। জগদীশচন্দ্র যদি তাঁর বিজ্ঞান-সন্তান হন!
“He loves you as a son – ( he told me never to write to you without sending his love and admiration, for “it was always going on”). Do write to him and treat him just like one! You know how to inspire a great man to do great work …”( Letters, page 119) লিখব, লিখব না করেও লিখে ফেললেন – জীবন ওঁর কাছে এখন বোঝা। তবু জগদীশচন্দ্র চারিদিকের বিরোধাভাসের মধ্যেও তাঁর কাজের প্রতি তিতিক্ষা ও সততা ধরে আছেন শুধু দেশবাসীর কাছে এটুকু প্রমাণ করবার জন্য – প্রয়োগবিজ্ঞানে তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা ইউরোপীয়দের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। এই যোদ্ধার মেজাজ নিবেদিতার প্রিয়। বিশ্বের কাছে ভারতবর্ষের এই উচ্চাসনের জন্য জগদীশচন্দ্রের একনিষ্ঠ সংগ্রাম, তাঁর নাছোড় দৃপ্ত পৌরুষকে পছন্দ করতেন বিবেকানন্দও।

‘গৃহীর মুক্তি নেই। যদি সাহস থাকে একথা তাঁকে জানিয়ে দিয়ো।’ বিবেকানন্দ হঠাৎ যেন ফেটে পড়লেন রাগে। তাঁর চোখ উত্তেজনায় অগ্নিগোলক। ফুলে ফুলে কেঁপে উঠছে গলার শিরা। জগদীশচন্দ্রের উদ্দেশে চিৎকার করছেন, ‘তাঁকে বলো, যদি বিরাট কোনও ত্যাগ না করেন, তাহলে কখনওই শক্তিশালী হবেন না। বিয়ে! জঘন্য!’
মোহিনীবাবু আর নিবেদিতা ছিলেন সেদিন মঠে বিকেলে। মঠ থেকে যাওয়ার কথা দক্ষিণেশ্বরে। আকাশে কালবৈশাখী ঝড়ের লক্ষণ দেখে গেলেন না। চা খেলেন একসঙ্গে মঠের বারান্দায় বসে। চায়ের পর নিবেদিতাকে সঙ্গে নিয়ে পায়চারি করতে বেরোলেন। একজন গেরুয়া। আরেকজন কমলা রঙের । উজ্জ্বল লাগছিল দু’জনকে বিকেলের নরম আলোয়। বিবেকানন্দের শরীর ভাল নয়। রাতে ভাল ঘুম হয় না। বিকেলের হাওয়ায় খোলা বাগানে ধীরে ধীরে পায়চারি করা ভাল। ভাল লাগে স্বামীজির। নিবেদিতা থাকেন বেশিরভাগ সময় পাশে পাশে। নানা কথা হয়। কিন্তু ইদানিং মেজাজ-মর্জি ঠিক থাকছে না। অল্পেই রেগে যাচ্ছেন। জগদীশচন্দ্র আর অবলাকে নিয়েই কথা বলছিলেন নিবেদিতা। অতি সাধারণ কথা। ভারতীয় বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর পাশে সবার থাকার কথা। স্বামীজি স্বাভাবিক উত্তর দিচ্ছিলেন। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। নিবেদিতা চুপ করে যান। ধীরে ধীরে ফিরে আসেন মঠের বারান্দায়। হাওয়া উঠেছে। মাথা নিচু। নিবেদিতা জানেন। বোঝেন। তবুও ক’দিন ধরেই এক ধরনের অপরাধবোধের অনুভূতি নিবেদিতার মনের ভেতর বসে আছে। স্বামীজি কি পছন্দ করছেন না তাঁর এই ব্রাহ্ম বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা? বিশেষ করে বসু পরিবারের কাছে তাঁর নিয়ম করে যাওয়া! বসুর সংগ্রাম নিয়ে অত্যধিক উৎসাহ, ভাবনা! তিনি কি বিরক্ত হচ্ছেন? বুঝতে পারেন না নিবেদিতা। স্বামীজি বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, “Marriage was horrible, it was the door to birth and so on”. নিবেদিতার মাথা নিশ্চুপ। কাঠালচাঁপা গাছের নীচে দাঁড়ালেন দু’জন। স্বামীজি ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছেন। কিছুদিন আগে বললেন, ‘তুমি যা মনে করো করবে!’ আর আজ? মোহিনীবাবুর সঙ্গে মামুলি দু’-চার কথা বললেন। উনি নিবেদিতার স্কুলের জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা করতে চান। তারপরেই তিনি তীব্র উত্তেজনা প্রকাশ করলেন নিবেদিতার প্রতি। নিবেদিতা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। চিন্তিত হন স্বামীজির শরীর নিয়ে।
‘আপনি শান্ত হন স্বামী। আমি ভুল করেছি!’
কিন্তু মনের দিক থেকে এই রাগের প্রকাশ ও উত্তেজনা মেনে নিতে পারছেন না নিবেদিতা। স্বামীজি কি ব্রাহ্মদের সঙ্গে মেলামেশায় সম্মতি দেননি? প্রশ্রয় দেননি?
স্বামীজি তাকালেন নিবেদিতার দিকে, ‘মার্গট, এসব এখন তুমি বুঝবে না, আরও এগিয়ে গেলে বুঝতে পারবে। And this is what I have been brought up to believe.’
নিবেদিতা ভয় পেয়ে গেছেন স্বামীজির এই রুদ্ররূপ দেখে। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন মঠের থামের আড়ালে। তাকিয়ে আছেন, তাকিয়েই আছেন বয়ে যাওয়া গঙ্গার দিকে। দেখছেন স্রোত। দেখছেন ভেসে যাওয়া নৌকা। দেখছেন ভাসমান কচুরিপানার সারি। পাছে তিনি আরও উত্তেজিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেই ভয়ে নিবেদিতা চুপ করে থাকলেন। মোহিনীবাবুর সঙ্গে দু’-একটি কথা বললেন। খুব অস্ফুট স্বরে ‘গুড বাই’ বলে ফিরে আসেন দ্রুত নিবেদিতা।
ফিরে আসছেন নিবেদিতা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। আকাশে জলজ মেঘ পুঞ্জ-পুঞ্জ। গঙ্গায় বিষণ্ণ বিকাল। সূর্য হারিয়েছে তার প্রখরতা মেঘভারে। তাঁর কথায় উগ্রতা এবং সম্পূর্ণ অযৌক্তিকতা নিবেদিতা বুঝতে পারছেন। তবুও স্বামীজির ওই রাগ প্রকাশকে নিবেদিতা পবিত্র বলে মেনে নিচ্ছেন। ১ মে ম্যাকলাউডকে লিখছেন শনিবারের এই ঘটনা বিস্তারিত। নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছেন নির্দ্বিধায় — “You know, in spite of the violence and utter unreasonableness of much that he said, how holy and rapt the mood was. As for the friend for whom it was meant, I feel that when the time comes for me to give the message, courage will not be waiting.”( Letters, page 129) স্বামীজি যে বলেছেন, ‘যদি সাহস থাকে একথা তাকে জানিয়ো’, সেই কথার উত্তর কি নিবেদিতা জানাচ্ছেন এই চিঠিতে?
নিবেদিতা স্বামীজির বক্তব্যকে খুব একটা মান্যতা যে দিলেন তা কিন্তু নয়। জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ একই তাল ও লয়ে চলতেই থাকে। নিবেদিতা গড়ে তুলতে চান একটা সাঁকো, যে সাঁকোর অন্তর-দর্শন হয়তো বিবেকানন্দের মতো নয়! বিবেকানন্দের সেই স্ফুরণ – ‘make inroads into Brahmos’ কি নিবেদিতার কাছে তীব্রতা হারাচ্ছে!

কে আজ বকাঝকা করবে নিবেদিতাকে? কেউ সে অধিকার অর্জন করতে পারেনি একমাত্র স্বামী ছাড়া। নিবেদিতা চোখ বোজেন। চোখের পাতা ভিজিয়ে জল নেমে আসে গালে। গাল থেকে থুতনিতে। নিবেদিতা মোছেন।‌ স্বামী চলে গেলেন।‌ স্বামীজির সান্নিধ্য পেয়েছেন নিবেদিতা মাত্র চার বছর এই বাংলায়। তাঁর ডাকে চলে এসেছেন ভারতে আর্তজনের সেবার কাজে। আজ সব শেষ! কার কাছে গিয়ে সমস্ত স্বীকারোক্তি করবেন নিবেদিতা? তিনিই তো পিতা। তিনিই স্বামী। তিনিই তো সব! আজ নেই! পথহারা পাখির মতো নিবেদিতা অসীম দিগন্তে! আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। নৌকা ধীরে এগিয়ে চলে। শেষ একবার দেখতে চান নিবেদিতা। চোখ বন্ধ। শায়িত। চমকে ওঠেন নিবেদিতা। ‘মাঝিভাই, একটু তাড়াতাড়ি কি চালানো যায় নৌকা?’ নিবেদিতা অধৈর্য হয়ে ওঠেন।‌

বালিগঞ্জের এই বাড়িটিতে নিবেদিতা আসেননি আগে কোনওদিনও। নিবেদিতা চারিদিকে দেখছেন। মোহিনীবাবু এগিয়ে এসে নিবেদিতাকে সাদরে ভেতরে নিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে সরলা, সুরেন এগিয়ে আসে। বিরাট বাড়ি। সুন্দর কার্পেট মোড়া মেঝে। দেওয়ালে দেওয়ালে অসাধারণ সব অয়েল-পেন্টিং। পোর্সেলিনের টবে সুন্দর কেয়ারি করা ইনডোর প্ল্যান্ট। চারিদিকে আভিজাত্য ও রুচির আশ্চর্য মেলবন্ধন।‌ হলঘরে অনেকেই উপস্থিত। সরলা মার্জিত সুন্দর সেজেছেন। নিবেদিতাকে সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন। নিবেদিতাকে এনে সবার মাঝখানে দাঁড় করালেন। বেশ সঙ্কোচ হচ্ছে, আবার এক ধরনের মজাও লাগছে নিবেদিতার।


‘আজ আমাদের বিশেষ অতিথি নিবেদিতার জন্য আছে একটি সারপ্রাইজ!’ সরলা বেশ সুন্দর করে বললেন। সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। কেউ কেউ উৎসাহ প্রকাশ করল, কী সেই সারপ্রাইজ কী সারপ্রাইজ!
নিবেদিতা মুখে মৃদু হাসি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।
সুরেন বেশ নাটকীয় ভাবে এগিয়ে এল, ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টিলম্যান ন্যাউ দ্য টাইম কামস্…’
নিবেদিতার বেশ মজাই লাগছে। মৃদু হাসি মুখে নিয়ে সুরেনের দিকে তাকালেন। সরলা আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে নিবেদিতার হাত ধরে ঘরের মাঝখানে দাঁড়ালেন। সুরেনের পাশে সিল্কের কাপড়ে চাপা দেওয়া কিছু একটা। সেটার একপাশে সরলা, আরেক পাশে সুরেন। মাঝে বিপর্যস্ত নিবেদিতা। কী ঘটতে চলেছে! বুঝতে পারছেন না।
সুরেন সিল্কের কাপড়ের এক প্রান্ত ধরেছে। সরলা আরেক প্রান্ত। সুরেন চিৎকার করে উঠল, ‘হেয়ার ইজ দ্যা সারপ্রাইজ ফর মিস মার্গারেট নোবেল ।’ তারপরেই ওরা দু’জন এক ঝটকায় সিল্কের কাপড়ের ঢাকা সরিয়ে দিল। প্রবল চিৎকার ও হাততালির মধ্যে নিবেদিতা দেখলেন একটি সুন্দর লেডিস সাইকেল।
সরলা নিবেদিতার হাত ধরে বললেন, ‘তোমার পছন্দ হয়েছে নিবেদিতা? তোমার এখানে-ওখানে যাতায়াত করতে সুবিধা হবে।’
‘সত্যিই আমি বিস্মিত এমন উপহারে! কী বলে যে ধন্যবাদ দেব? আমার ভাষা হারিয়ে গেছে।’ নিবেদিতা সত্যিই আপ্লুত।
সবাই মিলে হইহই করে বাড়ির পেছনে বাগানে গেল। টেনিস কোর্টের পাশে টেবিলে আয়োজন করা হয়েছে মধ্যাহ্নভোজনের। কেউ কেউ তখনও টেনিস খেলে চলেছে। কেউ কেউ বিলিয়ার্ড রুমে বিলিয়ার্ড খেলছে। বাড়ি বললে ভুল হবে, এটা একটা ম্যানসন। সম্ভ্রান্ত সমাজের প্রায় সকলেরই আমন্ত্রণ ছিল। এসেছেনও সব সমাজের সম্ভ্রান্ত উচ্চশিক্ষিত মানুষজন। নিবেদিতাকে বেশ উৎফুল্ল লাগছে। দুপুরের খাওয়ার পর সবাই এসে বসল নিবেদিতার কাছে। ‘মডেল বস্তি নির্মাণ’ সম্পর্কে নিবেদিতার পরিকল্পনা শুনতে চায় সবাই। নিবেদিতা সবার আগ্রহ দেখে নিজের তৈরি স্কিমটি আলোচনা করলেন। স্বামীজি দেখতে পেলে খুশি হতেন যে তাঁর কাজকে কীভাবে ছড়িয়ে দিতে পারছেন — এমনই ভাবনায় মগ্ন নিবেদিতা। প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনা হল এই প্রোজেক্ট নিয়ে। সবাই সহমত হল। সরলা ও সুরেন দু’জনেই নিবেদিতার মতোই উচ্ছ্বসিত। সাফল্যের বিভা ওদের দু’জনের চোখে মুখে, লক্ষ করেছেন নিবেদিতা।

নিবেদিতা সাইকেল চালিয়ে ফিরে আসছেন বাগবাজারে। এমন কিছু নতুন বিষয় নয় কলকাতায়। তখন সাহেব-মেমদের হামেশাই দেখা যেত সাইকেল চালিয়ে বিকেলে বা সকালে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে। নিবেদিতার কাছে নতুনত্ব এটাই যে, এই দেশে প্রথম সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলেন।
বড় বড় গাছের ছায়ায় ঘেরা পথ। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। মনটা আজ বেশ হালকা লাগছে। এত সুন্দর সুন্দর মানুষ তাঁর বন্ধু হিসেবে আছেন, ভাবতেই ভাল লাগছে। বালিগঞ্জ থেকে বাগবাজার অনেকটাই পথ। কালীঘাট অঞ্চলটি বেশ জঙ্গলাকীর্ণ। কিছুদিন আগেই নাকি হায়না বেরিয়েছিল। শেয়াল তো যখন-তখন গৃহস্থের বাড়ির দাওয়া থেকে শিশুদের তুলে নিয়ে যায়। মৃত্যু যাদের দোরগোড়ায়, মৃত্যুর সঙ্গেই যাদের জীবনযাপন, তারা মৃত্যুকে ভয় পায় না। মৃত্যুকে তারা জীবনের অঙ্গ করে নিয়েছে। তাড়াতাড়ি আজ ফেরার দরকার ছিল। বিকেলে যেতে হবে মঠে। সাইকেল নিয়েই? না। স্বামীজির শরীর ভাল যাচ্ছে না। মেজাজ ঠিক থাকছে না। উনি রাগারাগি করতে পারেন! তবে তাঁকে তো এই সুন্দর সাইকেলটি দেখাতেই হবে। এর মধ্যেই তিনি ইউরোপ যাবার পরিকল্পনা করছেন। আর ইউরোপ যাবার আগেই তাঁর জন্য বড় একটি উপহার তো আছেই! সরলা আর সুরেন দু’জনেই আসছেন বেলুড় মঠে। তাঁরা নানা বিষয়ে কথা বলবেন। স্বামীজি কথা বলবেন তাঁর ঐশ্বরিক মাধুর্যে। সেই সুন্দর দিনটির জন্য সব…সবকিছু করতে পারেন নিবেদিতা। আজকের দুপুরে সরলা ও সুরেনদের আমন্ত্রিতদের মাঝে স্বামীজির সমাজ-সংস্কারের কথা বলেও ভাল লেগেছে নিবেদিতার। বিকেল শেষ হয়ে আসছে। পার্ক স্ট্রিটের গায়েই কবরখানার জঙ্গল। আগে নাকি এখানেও বাঘ বেরতে দেখা গেছে। এইসব জঙ্গলে শিকার করতে আসত ব্রিটিশ কর্তারা। জঙ্গলের পাশ দিয়ে নিবেদিতা এসে পড়লেন পাথর বিছানো সাহেবপাড়ায়। পশ্চিম আকাশে রঙের খেলা। রাস্তা জুড়ে বড় বড় গাছেদের ছায়া দীর্ঘতর। সাহেব পাড়ায় ইদানিং বিকেলে মেমদের দল সাইকেল চালাতে বেরচ্ছে। সাইকেল চালানো এখন বেশ একটা ফ্যাশন হয়েছে। সাহেব, মেম, বাঙালি বাবুরা সাইকেল নিয়ে গড়ের মাঠে যাচ্ছে। যাচ্ছে স্ট্র্যান্ড রোডে। ফুরফুরে গঙ্গার হাওয়ায় রংবেরঙের রিবন উড়িয়ে চলেছে মেয়েদের দল। তরুণেরা চলেছে আগে-পিছু হ্যাট-কোটে। নিবেদিতা দ্রুত পাশ কাটিয়ে গেলেন। কেউ কেউ হাই হ্যালো করে হাত নাড়াল। কেউ কেউ নিবেদিতাকে এড়িয়েও গেল।
আজ দেরি হয়ে গেল। স্বামীজির শরীর ভাল নয়। টনসিলাইটিস আর জ্বরে ভুগছেন। ওদিকে হাঁপানির টান দেখা দিয়েছে। কিন্তু উনি মনস্থির করেছেন ইউরোপ যাবেন। নিবেদিতাকেও সঙ্গে যাবার কথা বলছেন। যদি সরলাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায়! খুব ভাল হয়। বিদুষী বাগ্মী সরলার খুব সুন্দর করে সমস্ত বিষয় উপস্থাপন করার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। অ্যাই অ্যাই অ্যাই রোক্‌কে রোক্‌কে…। চিৎকারে সম্বিত ফিরল নিবেদিতার। বেবি সাইকেল, দু’পাশে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে অসুবিধা হল না। চিনাপাড়ার মোড়ে ঢাউস চামড়ার স্তূপ নিয়ে ঠেলাগাড়ি পথের মাঝে।
বাগবাজারে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে গেল সাঁঝে। দিনের এই সময়টা নিবেদিতার অত্যন্ত প্রিয় সময়। বাগবাজার অলিগলির দিকে দিকে শাঁখ বেজে ওঠে। মন্দিরে মন্দিরে ঘণ্টাধ্বনি। আকাশের রং বদলায়। বদলায় গঙ্গার রং। বদলায় গাছের রং, বাড়ির রং, এই এঁদো পাড়াটির রং। মায়াময় হয়ে ওঠে চারপাশ। জগৎ ধীরে অতি ধীরে অন্ধকারের কোলে মাথা রাখে। রাত নামে। তার গর্ভে আরেকটা নতুন দিন।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, অক্টোবর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]