এই কয়েকটা বছর! ১৮৯৮ এর জানুয়ারি মাস থেকে আজ ৫ জুলাই ১৯০২। অজস্র ঘটনা। সংঘাত ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে চলা পথ। স্রোত বয়ে চলে। মানুষ নতুন স্রোত তৈরি করে। কখনও জোয়ার। কখনও ভাটা। নৌকা ভাসে। মাঝি দাঁড় টানে। নিবেদিতা বসে আছেন। চোখের জল শুকিয়ে যায়। তাঁর জীবন-নৌকার মাঝি আর নেই। কার কাছে ছুটে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন – আমি কি কোনো অপরাধ করেছি স্বামী!

২২ মার্চ ১৮৯৯। মার্চ মাসের মনোরম আবহাওয়া কলকাতায়। ঠান্ডা গড়িয়ে গড়িয়ে যাওয়ার আগে ভোররাতে শিশিরের ছাপ ফেলে যাচ্ছে ছাদের কার্নিশে, জানালার শিকে, গাছের পাতায় পাতায়। দুপুরে আদরের রোদ বসন্তের গন্ধ এনে রাখে এঁদো গলির কলকাতায়, বসত- ঠিকানায়। বাগবাজারের বোস পাড়া লেনের বাড়ির দোতলার জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বসন্তের একটা খবর আসে প্রকৃতিতে। নতুনের খবর। জানালার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। খুব ভেতরে উত্তেজনা বোধ করেন নিবেদিতা। ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের স্বামীজির দিকে আনার কাজ তা’হলে কি শুরু হয়ে গেল! ব্রাহ্মসমাজ সম্ভবত বিনাশের মুখে! (‘I see what happened – the Tagores are won and perhaps the modern Brahmo Samaj are trembling on the verge…’ [ Letters, page 103])।
নিবেদিতা তক্তপোশে বসতে না বসতেই বাইরে গাড়ির হর্ণ বেজে‌‌ উঠল। ঐ এসে পড়েছে! সন্দেহ হচ্ছিল, যদি যশোদি না আসে! শেষ মুহূর্তে যদি বানচাল হয়ে যায় কোনো কারণে! উৎকন্ঠা ছিল বই কী! এই কিছু দিন আগেই তো স্বামীজি সাবধান করে বলেছিলেন – মার্গট, ঠাকুরবাড়ির ‌সংস্রব ত্যাগ করো। দু’সপ্তাহও যায়নি! তবুও নিবেদিতা সংস্রব ত্যাগ করেননি! তড়িঘড়ি সরলার বেলুড়ে আসার দিনক্ষণ ঠিক করেতে দৌড়োদৌড়ি কম হয়নি। আর সে তো নিবেদিতাকেই করতে হয়েছে। নিবেদিতা প্রবল উদ্যমে সমস্ত রকম ব্যবস্থা করেছেন। একদিন ঠাকুরবাড়ির সবাইকে মাথা নত করতে হবে গেরুয়া সন্ন্যাসীর কাছে – এমন স্বপ্ন নিয়েই নিবেদিতার প্রাণপাত উৎসাহ। ব্রাহ্মদের ভেতরে অনুপ্রবেশ, make inroads into Brahmos, এর কাজটির সাফল্য নিয়ে সংশয়হীন নিবেদিতা আজ। আজই সেই বোধনের দিন। ঠাকুরবাড়ির তরুণ প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি দু’জন আসছেন। তাদের নিয়ে যাবেন নিবেদিতা বেলুড় মঠে এবং দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দিরে। হঠাৎ গাড়ির হর্ণের আওয়াজ এলো যেন! ভুল হচ্ছে কি! আবার শোনা গেল গাড়ির হর্নের আওয়াজ। নিবেদিতা দৌড়ে নীচে নেমে গেলেন সদর দরজা খুলতে।

মোটর গাড়িটা বাড়ির দরজায় এসে আবার হর্ন দিতেই নিবেদিতা সদর দরজা খুললেন এক গাল হেসে। সরলা গাড়ির দরজা খুলে ভেতর থেকেই হেসে বলে উঠলেন, ‘উঠে আসুন মিস নোবেল!’

‘গাড়িতে! আমি ভাবছিলাম নৌকায় গেলে…’।

নিবেদিতার কথা শেষ করার আগেই সুরেন ড্রাইভারের সিট থেকে বলে ওঠে, ‘জয় মা কালী! আমি ভেবেছিলাম নতুন কেনা গাড়িতে আপনাকে বসিয়ে একটু ঘোরাঘুরি করব! যদিও ব্রিটিশদের তৈরি গাড়ি!’

নিবেদিতা দেখে নিয়েছেন ঝাঁ চকচকে নতুন অস্টিন গাড়িটাকে। গাড়ির নম্বরটিও সমান আকর্ষণীয় ১৩৫৪। বেশ মজা আছে নম্বরটিতে। নিবেদিতার গণনা, কুষ্টি-বিচার, ইত্যাদি সম্পর্কে বেশ আগ্রহ।
‘আমার আপত্তি নেই কোনো! চলো! তবে এই সময়ে নৌকায় যাওয়া বেশ মনোরম!’
‘না না। বসে পড়ুন মিস নোবেল। গাড়ি রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছে না।’ সুরেন জোর দিয়ে কথাটা বলতেই নিবেদিতা পিছনের সিটে বসেন সরলার পাশে। আশ্চর্য সুন্দর গন্ধ গাড়ির ভেতরে। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের রূপচর্চার কথা নিবেদিতা শুনেছেন মেয়েদের থেকেই। তবে তা কখনও প্রকট নয়। মার্জিত ও রুচিশীল। এটা নিবেদিতার ভালো লাগে। তবে তার সাথে শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তার সৌন্দর্য যুক্ত হলে সে নারী সর্বজয়া। যেমন পাশে বসে থাকা সরলা। সোনারঙা মসলিন পরেছেন সরলা। লাল-সবুজ সুতোর নকশা করা পাড়। সারা জমিতে ফুলতোলা জড়ির কাজ। হালকা গয়না পরেছেন। কানে ঝুলছে ছোট্ট ছোট্ট ঝুমকো ফুল। গলায় মটর হার বুক ছাড়িয়ে নেমেছে। হাতে রিস্টলেট। ব্যাস্। নিবেদিতা প্রশংসা না করে পারেন না।
‘চলো বাগবাজার ঘাট। বাগবাজার থেকে নৌকায় যাবো বেলুড়।’ সরলার কথায় নিবেদিতা অবাক তাকায়। ‘তুমি তো এমন চাইছিলে নিবেদিতা! সুরেন জোর করছিল গাড়িতে বেলুড় যাওয়ার। চলো!’
‘হ্যাঁ, নৌকা ঘাটে রাখাই আছে। মাঝিকে বলাও আছে। আমার তো খুব ভালো লাগে এই নৌকায় বেলুড় যেতে!’ নিবেদিতা স্বস্তি পান।
‘আসলে ঠাকুরবাড়ির লোকেরা তো বজরা ছাড়া চাপেন না! তাই…।’ সুরেন গাড়ি স্টার্ট দেয়।
এটা ঠিকই ঠাকুরবাড়ির পরিবারের কেউ বিশেষ করে কোনো মহিলা এইভাবে খোলা নৌকায় গঙ্গাবক্ষে – সরলা সঙ্কোচ গোপন করে। নিবেদিতাকে যত দেখে বিস্মিত হয়, কী করে একজন বিদেশিনি এইভাবে জীবনকে যাপনযোগ্য করে তুলতে পারেন! এটাকেই কি সাধনা বলে! ত্যাগ! এই কৃচ্ছসাধন কোন মুক্তির পথ দেখাবে? বিবেকানন্দের সাথে সাক্ষাতের নিমন্ত্রণ নিয়ে এসেছেন তাঁর দূতী নিবেদিতা। বিবেকানন্দের উত্থান এক আশ্চর্য সময়ে। যখন দেশের জাতিগত আত্মমর্যাদা নিয়ে সবাই দ্বিধান্বিত সেইসময় শিকাগো বক্তৃতা দিয়ে ফিরে এসেছেন বিবেকানন্দ। স্টার থিয়েটারে সভা করে অভিনন্দিত করা হয়েছিল। সেই অভিনন্দনের উত্তরে তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই দিন সেই বক্তৃতা শুনতে যেতে পারেননি সরলা। কিন্তু ‘ভারতী’ পত্রিকায় লিখেছিলেন তিনি বিবেকানন্দের বক্তৃতা নিয়েই। সেই লেখা পড়ে বিবেকানন্দ চিঠি দেন ভারতী পত্রিকার সম্পাদিকা সরলা দেবীকে। সরলাও তাঁর চিঠির উত্তর দেন। ঐ চিঠি এবং তার উত্তর, উত্তরের আবার উত্তর আলাপের সূচনা। একটা বোধের সাঁকো তৈরি হয় যেন বা!
আমন্ত্রণ এলো নিবেদিতার মাধ্যমে স্বামীজির কাছ থেকে। একা যেতে সাহস পাননি সরলা। সুরেন কে সঙ্গী করেছেন। এমন মুক্ত ভাবে খোলা পরিবেশে গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তি হয় সরলার। মাঝি ঘাটে নৌকা ভেরায়। সুরেন উঠে পড়ে ঝট্ করে। নিবেদিতা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। নিবেদিতার হাত ধরে সরলা ওঠেন নৌকায়।
নিবেদিতা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন, ‘সরলা তোমার অসুবিধা হচ্ছে কোনো!’
‘না না। আমি ঠিক আছি। আমি এখনও পর্যন্ত ট্রামে বাসেও কোথাও যাতায়াত করিনি। পছন্দও করি না। নিজের ঘরটুকু ছাড়া বাইরে খুব একটা যেতে ভালো লাগে না। ওখানে বসে বসেই লক্ষ্যভেদে নিযুক্ত থাকতে পছন্দ করতাম।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল সরলা। ঘাটের লোকেদের কৌতূহলী চোখের বাইরে চলে এসেছে নৌকা লগি ঠেলে ঠেলে।
‘স্বামীজির ডাক তোমাকে বাইরে এনেছে সরলা।’ নিবেদিতা কথাটা বলে তাকান একবার।
‘এ কথা অস্বীকার করব না, স্বামী বিবেকানন্দ আমার অন্তরে এক নতুন তত্ত্বের সমাবেশ করলেন!’ সরলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন কথাটা।
‘কেমন সে নতুন তত্ত্ব!’ সুরেন জিজ্ঞেস করে।
‘সেটি হচ্ছে আধ্যাত্মিক জীবনের আকাঙ্ক্ষা! বিষয়টি ভাবনা চিন্তার বাইরেই ছিল এতদিন!’ সরলা ভাবলেশহীন বলে।
‘আমিও সেই অনুভবে ভাবিত। বিশেষ করে মিস নোবেল যে ভাবনায় আর্ত দরিদ্রদের সেবার মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিকতাকে দেখছেন!’ সুরেন গঙ্গার সুদূর পাড়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।
‘এতদিন আধ্যাত্মিকতা মানে ছিল ভগবদ-ধ্যানে ভোঁ হয়ে বসে থাকা আর কলকে টানা। অং বং চং বড় বড় কথার জাগলারি আর মিস্টিসিজম। স্বামীজির আধ্যাত্মিকতার মানে আর্তের, দুঃস্থের, বিপন্নের সেবাকার্য। জাতপাত নির্বিশেষে সেবা কাজের মাধ্যমে দেশপূজা।’ সরলা আশ্চর্য সহজ ও সরলভাবে নিজেকে উন্মুক্ত করছেন।
দিগন্ত বিস্তৃত প্রবহমান গঙ্গা চারপাশে। খোলা আকাশ। শ্যামলিমায় ঢাকা দুপাশের পাড়। গঙ্গার এমন খোলা বুকে ভাসমান সরলা মেলে ধরছেন নিজেকে যেন। খুলে যাচ্ছে বন্ধ জানালার কপাট! নিবেদিতা বিস্মিত তাকিয়ে আছেন।
‘খুব সুন্দর করে বলছ সরলা। এই কারণেই স্বামী বলতেন, “সরলার ‘education perfect’, এই রকম education ভারতের সব মেয়েদের হওয়া দরকার”।’
‘এই কথা আমি সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করি!’ সুরেনের বলার ধরনে তিনজনেই হেসে ওঠে।
‘না না সে কথা নয়। আমি স্বামীজির ধর্মমত ও সমাজ সংস্কারের বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছি জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। দেখো মহাত্মা গান্ধী স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কর্মশীল, তাঁর কর্ম বিপ্লবমুখী দ্বন্দ্বের মধ্যে। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মত সেবা করেন, বিপ্লবের থেকে শত হস্ত দূরে থাকেন। কিন্তু তাঁদের জাতীয়তা বহুভাবে প্রসারিত এবং সর্বমানবিকতায় বিস্তৃত।’
‘আজ তোমাকে নতুন রূপে দেখতে পেলাম সরলা। যদিও সেদিন বাগবাজারে আমার বাড়িতে এসে এমন সব কথাই বলছিলে! তোমার কি মনে হয় না একদিন সবাই স্বামীজির পতাকাতলে আসবে!’ নিবেদিতা উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন।
‘সে কথা আমি বলতে পারিনে! কালীদুর্গার বিদ্বেষপুষ্ট ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব আমার উপর খুব বেশি…

‘এটা সত্য। সাকার নিরাকারের পর্দা কি জ্ঞানচক্ষুর আলোয় নিশ্চিহ্ন হবে! হয়তো! জানিনে আমি!’
‘আমরা বোধহয় এসে পড়েছি! ঐ যে বাঁদিকের পাড়ে সবুজ বনাঞ্চলের মাঝে গেরুয়া রঙের কিছু একটা দেখা যাচ্ছে না!’ সুরেন নৌকার ছৈ ধরে উঠে দাঁড়াল।
‘মনে হচ্ছে উনি অধৈর্য হয়ে গেছেন অপেক্ষা করতে করতে।’ নিবেদিতা তাকালেন।
সরলা টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ালেন নৌকার ছৈ ধরে। দূরে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে গেরুয়া পোশাক। এক সন্ন্যাসী। একটি বারুদের স্ফুলিঙ্গ। প্রচন্ড তার তেজ। প্রচন্ড ভাঙাগড়ার শক্তি। সেই বারুদের আগুন থেকে একটি স্ফুলিঙ্গ এসে পড়েছিল যেন সরলার ভেতরে। ভেঙ্গে গড়ে উঠছিল একটা দর্শন- দ্বন্দ্ব। স্বামীজির কর্মযোগ পড়ার পর ভগবদ্গীতার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। ঠাকুর পরিবারে শ্রীকৃষ্ণের কোনো কোনো রকম মহিমা কোনো মহলেই ছিল না। হিন্দুর হিন্দুত্ব বিষয়টি খোলনলচে জানার আগ্রহে পড়াশোনা শুরু করতে গিয়ে সরলা দেখল – দুই পাড়ে দুই দর্শন নিয়ে আকচাআকচি করা হচ্ছে। মাঝে বয়ে চলেছে গঙ্গা নিরবধি। একদিকে ঔপনিষদিক বেদান্তের ব্রহ্মোপাসনা। অপর প্রান্তে পৌরাণিক প্রতিমার ধ্যানধারণা ও পূজার্চনার নানান নিয়মাবলী। এক অবশ্যম্ভাবী দ্বন্দ্ব জীর্ণ এই সময়। কোরাণ ও বাইবেল দু’চোখে নিয়ে রামমোহন রায় সাকার পূজার বিরোধী নিরাকার ব্রহ্মোপাসনার দল গড়লেন। আকারবর্জিত ঈশ্বর! চরণ কল্পনা না করে প্রণাম রাখবে কোথায় মানুষ! হাতের কল্পনা না করে হাত ধরা যায়! চোখে চোখ রাখতে গেলেও চোখ কেমন তার রূপ কল্পনা করতেই হয়। কল্পনায় রূপময় দেবমূর্তি – সাকার হয়ে ওঠেন দেবতা। রামমোহনের ব্রাহ্মধর্মের যুগে প্রতিমা পূজা তুলে দেবার চেষ্টা হল। শুরু হল নিরাকার ব্রহ্মোপাসনার মাধ্যমে পরমের কাছে পৌঁছানোর প্রার্থনা। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের নেতা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী দল ভেঙ্গে বেরিয়ে সাধনার সহায় হিসেবে প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করলেন। ব্রাহ্মসমাজের লোকেরা হিন্দু বলেই ঘোষণা করা শুরু করল। এর পরেই এলেন বিবেকানন্দ নামক ধূমকেতু।
‘আমরা এসে পড়েছি সরলা! ঐ দেখো স্বামীজি অস্থির হয়ে উঠেছেন!’ নিবেদিতা সরলার পাশে এসে দাঁড়ায়।
‘হুম। দেখতে পাচ্ছি। ধন্যবাদ মিস নোবেল এত সুন্দর জার্নি করার সুযোগ করে দেবার জন্য!’ সরলা তাকায় নিবেদিতার দিকে।
নিবেদিতা সরলার চোখে চোখ রাখে, ‘আমি নয়। পবিত্র গঙ্গার সারস্বত চিরন্তন স্রোত তোমাকে এনেছে সরলা।’
সরলা উত্তর দেয় না। তাকিয়ে থাকে। নৌকা দুলে ওঠে। ঐ তীরভূমে দাঁড়িয়ে আছেন। ঋজু সটান তাঁর দাঁড়ানোর ভঙ্গি। হাওয়ায় উড়ছে গেরুয়া বসনের প্রান্ত। মাঝি ধীরে ধীরে পাড়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জলের উপর বৈঠার চাপড় পড়ার শব্দ উঠছে – ছলাৎ ছলাৎ ছলাৎ।

    ব্রাহ্মধর্ম থেকে অনেক দূরের পথে কি ভেসে ভেসে যাচ্ছে সরলা! নাকি এক সত্য থেকে আরেক সত্যের দিকে চলেছে সে। যুগ-দ্বন্দ্বের অগ্নিদগ্ধ সময়কে প্রত্যক্ষ করতে কি চায় সরলা! ঠাকুরবাড়ির তথা ব্রাহ্মধর্মের অবিসংবাদিত কঠোরতার অর্গল ভেঙ্গে সরলা কি তৈরি করতে চান একটি সাঁকো সাকার ও নিরাকারের মধ্যে!

    নিজের আবেগকে সংযত করতে চেষ্টা করছে সরলা। স্বাভাবিক থাকতে হবে তাকে। কোনো উচ্ছ্বাস বা আবেগ বা অনুজ্ঞা দেখানো যাবে না।

    অস্থায়ী বাঁশের তৈরি ঘাট। ঘাটে নৌকা ভেড়ায় মাঝি। উঁচু পাড়ে বিবেকানন্দ ও দু’জন সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছেন। সুরেন লাফিয়ে নেমেই বাঁশের গড়ান পথ ধরে উঠে গেল তরতর। নিবেদিতা সরলার হাত ধরে ধরে ভারসাম্য রেখে নামালেন নৌকা থেকে। চেরা বাঁশের তৈরি ঢাল বেয়ে উঠে এলো সবাই ডাঙায়। বিবেকানন্দ এগিয়ে এসে নমস্কার করলেন সরলাকে, ‘আসুন।’
    সরলা নমস্কার করলেন। সুরেন এগিয়ে গেছে স্বরূপানন্দের সাথে। গঙ্গার ধারেই হয়েছে বসার ব্যবস্থা। মাটি ফেলে ও পিটিয়ে উঁচু করা হয়েছে বেশ কিছুটা জায়গা। জলে ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনা নেই। মাথার উপর খোলা আকাশ। পায়ের কাছে কল্লোলিনী গঙ্গা বয়ে চলেছে। পরিবেশটা বেশ অভিনব মনে হলেও সরলা প্রাথমিক জড়তায় আক্রান্ত। বেতের চৌকির উপর বসার ব্যবস্থা হয়েছে। একদিকে চায়ের সরঞ্জাম রাখা আছে। তার মানে এখানেই বসে কথা বলার ব্যবস্থা! সরলার অস্বস্তি এখানেই। কিন্তু উদার প্রকৃতির মাঝে বসতেও বেশ ভালো লাগছে। গঙ্গার ঠিক ওপারেই দক্ষিণেশ্বরের মন্দির ছবির মতন দাঁড়িয়ে আছে রামকৃষ্ণদেবের অসংখ্য কাহিনির প্রবাহ নিয়ে। পিছনে দাঁড়িয়ে আছে একটি পুরোনো বাড়ি যা সারিয়ে ও পরিবর্তন করে মঠ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঘাস বিছানো মাঠ আর গাছে ছাওয়া বাগানে নানা পাখির কলতান। সুন্দর বাতাস।
    নিবেদিতা ওনাদের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন সরলা ও সুরেনের। ওনারা তিনজনে নানা কথা বলে চলেছেন মঠ নিয়ে। ব্রহ্মানন্দ কথা বলে চলেছেন অনর্গল। আর্ত জনে সেবা থেকে শুরু করে সংস্কারের কাজের ধারা। স্বামী বিবেকানন্দ চুপ। চুপ সরলারাও। সুরেন তবুও কো-অপারেটিভ গঠনের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের কথা অল্প আধটু বললেও। সরলা চুপচাপ শুনছে সব।
    বিবেকানন্দ একবার তাকালেন সরলার দিকে, ‘রাজযোগ বইটি পাঠিয়েছিলাম। পড়েছেন?’
    ‘পড়েছি। আপনার জন্য ‘ভারতী’ পত্রিকার দু’টি সংখ্যা এনেছি দেব বলে।’ সরলা সিল্কের সুতোর কাজ করা সিল্কের ব্যাগের ভেতর থেকে ‘ভারতী’ পত্রিকার দু’টি সংখ্যা বার করলেন।
    স্বামীজি হাত বাড়িয়ে নিলেন।১৩০৩ চৈত্র সংখ্যায় লিখেছেন ‘আশা ও নিরাশা’। বৈশাখ ১৩০৪ লিখেছেন ‘প্রত্যাহার’। দু’টি সংখ্যা। সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্বামী বিবেকানন্দ।

    স্বামীজি পত্রিকা উল্টে পাল্টে দেখতে থাকেন। গেরুয়া পাগড়ি পরা স্বামীজির ছবিটা ছিল সরলার মনে। বারবার দেখছেন ছোট ছোট করে কাটা চুল তাও অবিন্যস্ত! কী আশ্চর্য স্বাভাবিক লাগছে ওনাকে। সাজপোশাকে কোনো আড়ম্বর নেই। খুব আটপৌরে ব্যবহারে কোনো আড়ষ্টতা নেই। আর গভীর চোখে অসম্ভব এক আত্মবিশ্বাস। সুদূর প্রসারী দৃষ্টি। স্বপ্নদ্রষ্টা।
    ‘শুনলাম আপনার শরীর ভালো ছিল না, এখন কেমন?’ সরলা কথা শুরু করে।
    ‘আপাতত ভালোই আছি। বহু কাজ পড়ে আছে।
    খুব শীঘ্রই বিদেশ যাওয়ার সব ব্যবস্থা করতে হবে।’
    ‘আপনার কি মনে হয় বিদেশের মানুষজন আর্ত পীড়িত ভারতবাসীর জন্য কিছু করবে!’ সরলা সরাসরি প্রশ্নটা করলেন।
    ‘আলবৎ। করছেও। বিদেশে ধর্ম প্রচারের মূল উদ্দেশ্যই ভারতবর্ষের মানবতাবোধের কথা তাদের কাছে তুলে ধরা। তারা ভাবে ভারতবর্ষ এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ব্ল্যাক ম্যাজিকের দেশ। কিন্তু ভারতবর্ষের এক সুমহান ধর্মীয় ঐতিহ্য আছে যা বেদ বেদান্তে ছড়িয়ে আছে। আছে সুমহান সাম্যবাদের কথা। বলতে হবে। যদিও কাজে আমাদের মহাভেদবুদ্ধি। মহা নিঃস্বার্থ নিষ্কাম কর্ম ভারতেরই প্রচারিত হয়েছে কিন্তু কার্যে আমরা জড়পিন্ডবৎ নকলনবীশ। এ’সব সত্ত্বেও ভারতের ধর্মীয় ঐতিহ্যের কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতেই হবে।’ বিবেকানন্দ বেশ জোরের সাথে কথাগুলো বললেন। তাঁর কন্ঠস্বরের গাঢ়তা তাঁর বিশ্বাসকে অতল থেকে তুলে আনে।

    সরলা শান্ত তাকিয়ে থাকে, ‘সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা কি স্বামীজি?’ খুব ধীরে প্রশ্নটি রাখল।

    ‘একদিকে গতানুগতিক জড়পিন্ডবৎ সমাজ, অন্য‌ দিকে ‌অস্থির ধৈর্যহীন অগ্নিবর্ষণকারী সংস্কারক। কল্যাণের পথ এই দু’য়ের মধ্যবর্তী। এই হতশ্রী বিগতভাগ্য লুপ্তবুদ্ধি পরপদবিদলিত চিরবুভুক্ষু কলহশীল ও পরশ্রীকাতর ভারতবাসীকে প্রাণের সাথে যদি ভালোবাসে তবে ভারত আবার জেগে উঠবে। শত শত মহাপ্রাণ নরনারী তাদের সকল বিলাসভোগসুখেচ্ছা বিসর্জন দিয়ে দারিদ্র্য ও মূর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত কোটি কোটি স্বদেশীয়দের কল্যাণ কামনা যেদিন করবে, সেদিন ভারত জাগবে। জাগবেই। সেই দিন আর দূরে নেই মিস ঘোষাল।’ স্বামীজি তাকিয়ে থাকেন গঙ্গার দিকে।

    বিকেলের হু হু হাওয়ার দামালপনায় এক সুন্দর মায়া জড়িয়ে আছে। সবকিছু নিয়ে পরিবেশটি খুব সুন্দর লাগছে সরলার। কিন্তু কথায় ও ভাবে প্রকাশ করতে পারে না।

    নিবেদিতা, ব্রহ্মানন্দ এবং তুরিয়ানন্দ ট্রেতে করে ফল, মিষ্টি, কেক, চা, ধোকা এনে সাজিয়ে রাখে সামনে।
    ‘এই কেক কিন্তু আমি বানিয়েছি সরলা!’ নিবেদিতা প্লেট গুছোতে গুছোতে বলে। মুখে খুশির আলো।
    ‘তবে তো খেতেই হচ্ছে! সুরেনের কথাকে সমর্থন করে সরলা শব্দহীন হাসি দিয়ে।
    ‘আমার মনটা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই চা-চা করছিল। দাও দেখি এক টুকরো কেক আর চা। ওনাদের আগে দাও, ওনারা আফটার অল গেস্ট! বলেই হেসে ওঠেন স্বামীজি।
    ‘না না। আমাদের গেস্ট হিসেবে ট্রিট করবেন না!’ সুরেন এগিয়ে এসে চায়ের কাপ নেয় নিবেদিতার হাত থেকে।
    ‘ওনারা ভাবছেন এ ব্যাটারা কেমন সন্ন্যাসী হয়েছে রে সামান্য চায়ের লোভ ত্যাগ করতে পারেন না!’ বলেই আবার অট্টহাসি স্বামীজির।
    ‘আপনাকে ধোঁকাভাজা দিই স্বামীজি!’ নিবেদিতা স্বামীজির দিকে তাকান। আজ খুশি ডানা মেলেছে আকাশে।
    ‘দাও তবে ওনাদের আগে দাও, ওনারা কিছুই নিচ্ছেন না!’ স্বামীজি চায়ের কাপ আর প্লেটে ধোঁকাভাজা নেন নিবেদিতার হাত থেকে।
    ‘সরলা তোমাকে ডালের ধোঁকাভাজা দিই? এগুলো ব্রহ্মানন্দজি ও তুরিয়ানন্দজি তৈরি করেছেন, গরম গরম ভেজে এনেছেন!’ নিবেদিতা ব্যস্ত হয়ে পড়েন সবাইকে পরিবেশনে।
    সরলা বিস্মিত হয়, ‘বলেন কি!’
    নিবেদিতা ঝরঝর করে ওঠেন, ‘আমাদের স্বামীজি খুব ভালো রান্না করেন সরলা। তোমাদের একদিন মাছ-মাংস রান্না করে খাওয়াবেন! দেখো খেয়ে।’
    ‘সে হবেখন! এখন তাড়াতাড়ি চায়ের পর্ব শেষ করে চলো ওনাদের মঠ মন্দির দেখাও!’ স্বামীজি তাড়া দিলেন।

    স্বামীজির পাশে পাশে হাঁটছেন সরলা। মাথায় নানা প্রশ্নের জটলা। কিছুদূরে নিবেদিতার সঙ্গে বকবক করতে করতে চলেছে সুরেন। যেখানে বসেছিলেন তার ঠিক পিছনেই জীর্ণ পুরোনো মঠের বাড়ি। পুরোনো বাড়ি নতুন করে রঙ করা হয়েছে। সুন্দর পরিবেশে প্রকৃতির মাঝে এই উপাসনাস্থল।

    সবুজ ঘাসের উপর ধীর পায়ে গঙ্গার ধার ধরে বাগানের পথে দু’জন। নীল আকাশ। চারিপাশ গাছে গাছে সবুজ। নানা পাখির কিচিরমিচির।
    ‘আপনি আমাদের কার্যপ্রণালী নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন!’ বিবেকানন্দ কথা শুরু করলেন।
    ‘প্রশ্ন নয়। আগ্রহ।’ সরলা শুনতে চান বেশি।
    ‘যে দেশে শিক্ষা ও বিদ্যাবুদ্ধি যত বেশি ভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারিত হয়েছে সে দেশ ততধিক উন্নত হয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষা তথা বিদ্যাভ্যাস মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যে আবদ্ধ এবং তা শাসকের অনুগ্রহে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে শিক্ষা।’
    ‘সমাজ সংস্কারকরা কি সেই কাজটি করেননি বা করছেন না?’ সরলা মৃদুস্বরে তোলেন প্রশ্ন।
    ‘অর্ধশতাব্দী ধরে দেশে সমাজ সংস্কারের ধুম লেগেছে! দশ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে দেখলাম সমাজ সংস্কারকদের খালি সভার পর সভা হচ্ছে। কিন্তু যাদের রক্তের ও ঘামের বিনিময়ে ভদ্রলোকেরা তথাকথিত ‘বাবু ভদ্রলোক’ হলেন তাদের কথা কোথাও আলোচনা হচ্ছে না তো! শিক্ষা শিক্ষা শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে হবে একদম ধুলো কাদায় পড়ে থাকা মানুষের মধ্যে। তাদের মধ্যে নেমে কাজ করতে হবে। ইংরেজ-পদ – নিপীড়িত, বিগতশ্রী, হৃতসর্বস্ব, মহা দরিদ্র, মহামূর্খ আমার দেশের মানুষ। শিক্ষাবলে তাদের ভেতরে তৈরি হবে আত্মপ্রত্যয়, আত্মপ্রত্যয়বলে অন্তর্নিহিত ব্রহ্ম জেগে উঠবে। ‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত’, ওঠো জাগো, জাগিয়ে তুলতে হবে।’ উত্তেজিত হয়ে উঠছেন স্বামীজি। প্রদীপের শিখার মতো তাঁর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। গলার শিরা ফুলে ফুলে উঠছে। নাভিমূল থেকে শব্দ উচ্চারণ করছেন তিনি। শ্বাসাঘাতে ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে বিশ্বাসী শব্দবন্ধগুলি।
    ‘আপনার প্রতিটি কথা অনুধাবন করতে পারছি আমি।’ সরলা শান্ত করতে চান স্বামীজিকে।

    হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা এসে পৌঁছলেন ঘাটের কাছে। বাঁশের উপর তক্তা ফেলে তৈরী হয়েছে অস্থায়ী ঘাট। ঘাটে নৌকা বাঁধা আছে। মাঝি ও প্রস্তুত। সূর্য নরম হয়ে ঢলে পড়ছে পশ্চিমে। আশ্চর্য সোনারঙ গঙ্গার জলে ঢেউ ঢেউ ঝিলিক মারছে।
    ‘অজ্ঞতা কি মূল কারণ নয় এই অন্ধকারে থাকার?’ সরলা আবার শুনতে চান স্বামীজির কথা।
    ‘অবশ্যই। একদম সঠিক বলেছেন। ‘অজ্ঞশ্চাশ্রদ্ধাধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি’ – আমরা বিনাশের পথে। যে শ্রদ্ধা বেদবেদান্তের মূলমন্ত্র, সে শ্রদ্ধা লোপ পাচ্ছে অজ্ঞতায়। প্রত্যেক জীবে শক্তি বর্তমান। শক্তির বিকাশ ঘটে শিক্ষায়। সেই শক্তির উদ্বোধন করতে হবে হতদরিদ্রদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে।’
    গঙ্গার হাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছেন দু’জন। ওপারে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের উন্নত চূড়ায় চূড়ায় নরম রোদের খেলা। সরলা তাকিয়ে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে স্বামীজি ও। নীরবতার এক শব্দপ্রবাহ বয়ে চলেছে দু’জনের মধ্যে। দু’জনেই যেন বুঝতে পারছেন কে কী বলতে চাইছেন।
    ‘আপনি ভাবছেন এই অযুত মুর্খ ভারতবাসীর মধ্যে শিক্ষা কীভাবে প্রচারিত হবে! এতো প্রলাপ মাত্র!’ স্বামীজি গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। সরলা চমকে উঠলেন, এই কথাটাই তো ভাবছিলেন তিনি।
    ‘না। সেটা একটা বিষয় তো বটেই ভাববার!’
    বিবেকানন্দের চোখে অস্পষ্ট হাসি, ‘স্বাভাবিক! আমাদের দেশে সহস্রাধিক নিঃস্বার্থ, দয়াবান, ত্যাগী পুরুষ আছেন। তাঁদের মধ্যে অর্ধেক যদি বিদ্যাশিক্ষা দেন! যেমন তাঁরা বিনা বেতনে ধর্মশিক্ষা দিচ্ছেন তেমনভাবেই! যদি এইরকম মানুষ নিয়ে গড়ে তোলা যায় বিদ্যাশিক্ষা কেন্দ্র! সমাজের নিম্নতম স্তরে গিয়ে শ্রুতির মাধ্যমে পড়াশোনার কেন্দ্র, হাতে-কলমে শিল্প কর্মশালা কেন্দ্র তৈরি হবে। দু’টি এমন কেন্দ্র তৈরি হয়েছে একটি কলকাতায় অপরটি মাদ্রাজে। পুরুষদের যেমন এই কাজে দরকার তেমনই দরকার স্ত্রীলোকদের, পাওয়া মুশকিল আমাদের সমাজে এ আপনি জানেন!’ স্বামীজি একটু থামলেন।
    সরলা অবাক তাকিয়ে থাকেন। শুনেছিলেন স্বামীজির শরীর ভালো নেই। কিন্তু উনি যে বিশ্বাস ও চেতনার স্তর থেকে কথা বলছেন।


    ‘আপনার শরীরের যত্ন নেওয়া জরুরি। বিশ্রাম দরকার।’ সরলা খুব শান্ত স্বরে বললেন।
    হো হো হো করে হেসে উঠলেন স্বামীজি। ‘ বিশ্রাম! দাঁড়াবার যার সময় নেই, তাকে বলছেন শুতে! বুঝলেন মিস ঘোষাল, আমার মনে হয় ইউরোপ আমেরিকায় আমাদের এই ধর্ম প্রচার করা উচিত। আধুনিক বিজ্ঞান খ্রীষ্টান ধর্মের ভিত চূর্ণ করে ফেলেছে। তার উপর বিলাস – নষ্ট করেছে ওদেশের ধর্মবৃত্তি।’
    সরলা তাকান বিবেকানন্দের দিকে। মনের ভেতরে কথার ঝাঁক উঠে আসে প্রকাশ করেন না, ‘কী বলছেন স্বামীজি! পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোকে আলোকিত হচ্ছে আজ ভারতবর্ষ! বিজ্ঞানের অগ্রগতিই তো সভ্যতার প্রগতি – রবিমামা তো এইসব কথাই বলেন!’ চুপ থাকেন সরলা।
    ‘এই মুহূর্তে বিদেশে আমাদের ধর্ম আমাদের অবস্থান প্রচার করা খুব জরুরি কাজ। যে কথাটা আপনাকে বলতে চাই – যদি আপনার ন্যায় তেজস্বিনী বিদুষী বেদান্তজ্ঞা কেউ এই সময়ে ইংল্যান্ডে যান, আমি নিশ্চিত, এক এক বৎসরে অন্তত দশ হাজার নরনারী ভারতের ধর্ম গ্রহণ করে কৃতার্থ হবে।’

    দূরে জাহাজের ভোঁ বেজে উঠল। আর তৎক্ষণাৎ হৈহৈ করে সুরেন নিবেদিতা ব্রহ্মানন্দ তুরিয়ানন্দ উপস্থিত হল দলবেঁধে। ওদের মধ্যে কোনো একটা বিষয় নিয়ে তর্ক বেঁধেছে। স্বামীজির সামনে এসে সবাই চুপ।

    নিবেদিতা এগিয়ে এসে হাত ধরে গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন সরলার।
    ‘আমাদের মঠ তোমার কেমন লাগল সরলা?’
    সরলা সহজ উত্তর দেয়, ‘ভালো। আজকের জার্নিটাই খুব উপভোগ্য আমার কাছে। আর সৌভাগ্য স্বামীজির সঙ্গে এতোটা সময় কাটানো… তোমার জন্যই সম্ভব হলো।’
    ‘চলুন এবার দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের দিকে।’ ব্রহ্মানন্দ এগিয়ে গেল নৌকার দিকে। তুরিয়ানন্দও সাথে সাথে গেল। মাঝি লগি ঠেলে নৌকার এক দিক বাঁশের তৈরি জেটিতে ঠেকিয়ে দিল। ব্রহ্মানন্দ ও তুরিয়ানন্দ চেপে ধরল নৌকা পাটাতনের সাথে। তাও টলায়মান নৌকা। একে একে সরলা, সুরেন, স্বামীজি, নিবেদিতা উঠে নৌকার মাঝে পাতা গালিচার উপর বসলেন সবাই। নৌকা ঠেলে দিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ল ব্রহ্মানন্দ ও তুরিয়ানন্দ। ‘নৌকা ভেসে পড়ল জলে’।

    বিবেকানন্দ গেরুয়া উত্তরীয় দিয়ে মুখটা মুছে নিলেন। ঘাম হচ্ছে বেশ। যদিও গঙ্গার হাওয়া আছে। অনেকটাই সময় বেশ এক নাগাড়ে কথা বলে গেছেন। একটু শ্রান্ত লাগছে। কাশলেন কয়েকবার। নিবেদিতা একবার তাকালেন। স্বামীজি হাত তুলে আশ্বস্ত করলেন, ও কিছু নয়। চারিদিকে আশ্চর্য নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছে। গঙ্গার জলের রঙ গেল পাল্টে। মাঝগঙ্গায় নৌকা বাইছে মাঝি। তার মাথায় বাঁধা গামছায় পড়েছে লাল আভা। ধীরে ধীরে তার খালি পিঠের পেশিতে পিছলে আলো নেমে এলো গোলুইয়ে। গঙ্গার জলে কে যেন আবীর ছড়িয়ে দিল অগোচরে। গলে গলে পড়ছে রঙ সবার গায়ে গায়ে চোখের তারায় তারায়। আবীর রাঙা নদীতে ভাসতে চলেছে নৌকায় ওরা। আকাশের রঙ ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। মায়াবী আলোয় ভাসছে দক্ষিণেশ্বর মন্দির। ঘন্টাধ্বনি ভেসে আছে। আরতি হচ্ছে। পরম ঐশ্বরিক হয়ে ওঠে প্রকৃতি এই সন্ধ্যা লগ্নে। সবাই বাক হারা রঙের ভেতরে ডুবে যায়। ধীরে অতি ধীরে ঘোমটা টানে দিন। ঘাটে এসে আলোর মায়াজাল কাটিয়ে একে একে নৌকা থেকে নেমে এলেন নিবেদিতা, সরলা, সুরেন ও ব্রহ্মানন্দ। স্বামীজি বসে রইলেন নৌকায়। সঙ্গ দিচ্ছে তুরিয়ানন্দ। তখন সন্ধ্যায় আশ্রয় নিচ্ছে দিন।

    বৈকালিক স্নান করছিল বেশকিছু মহিলা-পুরুষ গঙ্গার ঘাটে। তারা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল – জয় গুরু মহারাজকি জয়। স্বামীজি হাত তুলে চিৎকার করে উঠলেন – জয় শ্রী রামকৃষ্ণকি জয়। সরলা অবাক দেখছেন সব। নৌকা থেকে নেমে ওরা সোনার আলো মেখে পড়ে থাকা বাগানে ঈশ্বরের দূতীর মতো প্রবেশ করলেন নিবেদিতা ঈশ্বরের বাগানে। মন্দিরে তখন সন্ধ্যারতি শেষ। শঙ্খধ্বনি দিন শেষের ঘোষণা করছে। গাছে গাছে অজস্র পাখির ফিরে আসার কোলাহল। গঙ্গার ধারেই গাছের নীচে বাঁধানো বেদীতে বসলেন।

    এই জায়গাটা নিবেদিতার খুব ভালো লাগে। নির্জন ও পবিত্র। শেষ যেবার এসেছিলেন সঙ্গে ছিলেন মিস ম্যাকলয়েড ও মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়। এটর্নি মোহিনীমোহন থিওসফিকাল সোসাইটির নেতৃ মাদাম ব্লাভাটস্কির একান্ত সচিব ছিলেন। মোহিনীমোহন বিয়ে করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে সরজাসুন্দরীকে। অত্যন্ত পন্ডিত এই মানুষটি ওকালতির সাথে সাথে সাহিত্য ও সমাজসেবায় ছিল আন্তরিক আগ্রহ। তার একাগ্রতায় মুগ্ধ নিবেদিতা। নিবেদিতা স্কুল চালানোর জন্য আর্থিক সাহায্য করছেন বন্ধু মোহিনীমোহন। বিবেকানন্দের সঙ্গে তার সখ্যতা সর্বজনবিদিত। ঠাকুরবাড়ির এই সদস্যটিকে দেখা যাচ্ছে কারণে অকারণে বেলুড় মঠে বা বাগবাজারের বোস পাড়া লেনে নিবেদিতার বাড়িতে। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা তার প্রিয় বিষয়।
    নিবেদিতা এবং ম্যাকলয়েডের জন্য সেদিনও বন্ধ ছিল দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির দরজা। আজও বন্ধ। সত্যি বলতে কি নিবেদিতা কোনো দিন দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে মায়ের মূর্তি দেখেননি। লিজেল রেমঁ এই কথা জানাচ্ছেন তাঁর বইতে। কিন্তু কালীঘাটের কালীবাড়ি মন্দির কমিটির আমন্ত্রণে নিবেদিতা কালীবাড়ীতে বক্তৃতা করেছেন। খালি পায়ে অন্যান্যদের মতন হেঁটে প্রবেশ করলেন বক্তা স্বয়ং নিবেদিতা।

    সন্ধ্যা নেমেছে। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের স্থাপত্যের খাঁজে খাঁজে জোৎস্নার কবিতা। সন্ধ্যারতির পর প্রতিমা দর্শনের দরজাটি বন্ধ হয়ে গেছে। পুরোহিত চলে গেছে। একটি গাছের নীচে বসেছেন সবাই। জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। জোৎস্নার আলপনা আঁকা হচ্ছে গাছেদের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে সিঁড়ির ধাপে ধাপে। সরলা নিবেদিতাকে ডেকে দেখাল, ‘দেখো দেখো জোৎস্নার আলপনা। প্রকৃতিই সবচেয়ে বড় পেইন্টার।’
    নিবেদিতা তারিফ করেন, ‘গ্রেট। সুন্দর। খুব ভালো লাগছে। আরে একটু বসতে কি খুব আপত্তি আছে তোমাদের!’
    সরলার চোখেমুখে তৃপ্তি, ‘না না। ঠিক আছে।’

    রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ঘর দেখে এসে বসেছেন ঘাটের সিঁড়িতে। সামনে রূপোলি গঙ্গা চিকচিক করছে। অজস্র মণিমুক্ত বুকে নিয়ে ভেসে চলেছে গঙ্গা। অদূরে নৌকা দুলছে। বসে আছেন স্বামীজি। তার পাশেই তুরিয়ানন্দজি। জোৎস্নায় অপার্থিব হয়ে উঠেছে চারপাশ। কত সামান্য আয়োজনে বিরাটত্বের সম্ভাবনা। সরলা তাকিয়ে থাকেন। অন্ধকারের মধ্যেই কি থাকে আলোর উৎস-কথা!

    নৌকায় উঠলেন নিবেদিতা, সরলা, সুরেন ও ব্রহ্মানন্দ। স্বামীজি ও তুরিয়ানন্দ বসেই ছিলেন। নৌকা গঙ্গার উপর রূপোর জল ভেঙ্গে ভেঙ্গে এগিয়ে চলল বেলুড় মঠের দিকে। সবাই চুপ। নৈঃশব্দের শব্দ বয়ে চলে। বেলুড় মঠের ঘাটে নৌকা এসে থামে। স্বামীজি উঠে দাঁড়িয়েছেন। সরলা নিবেদিতা বসে ছিলেন নৌকার মাঝখানে। সরলা তাকালেন। স্বামীজির মাথার পিছনেই পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের ছটা।
    ‘নমস্কার। আমি আর তুরিয়ানন্দ নামব। আপনারা এগিয়ে যান। আশা করি খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে।’
    সরলা ও সুরেন প্রতি নমস্কার করলেন। নৌকা এগিয়ে চলল বাগবাজারের দিকে।

    আজ বৃহস্পতিবার ২৩ মার্চ। গতকাল নিবেদিতার কাছে একটি জয়সূচক দিন গেছে সরলা ও সুরেনকে বেলুড়ে আনতে পেরে। নিবেদিতা আজ সময় পেয়েছেন বিকালে চিঠি লিখতে তার প্রিয় ‘জো’কে, জোসেফাইন ম্যাকলয়েডকে। এটা তাঁর অভ্যাস। সমস্ত কিছু লিখে যাওয়া, বলে যাওয়া। নানা কথা বলতে বলতে সরলা ও সুরেনের বেলুড় মঠে আসার কথা লেখেন বেশ উচ্ছাসের সাথেই। সেখান থেকে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি দেখতে যাবার কথাও বলেন – “Kali was shut up but these two hopeful young Brahmos returned full of pleasure in the architectural magnificence of the Court.”। সরলার প্রসঙ্গটা গুরুত্ব দেন। “It is with Sarala that he talks now when we are all together. And she is beginning to love him as we do. HE says “ she is a jewel of a girl and will do great things.” ( Letters. Page, 90)

    আপাত বিচ্ছিন্ন কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন স্রোতের মতো ঘটনা প্রবাহের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বুকের ভেতর। মুচড়ে উঠছে। গলার কাছে কষ্টের ডেলা ঠেলে উঠতে চাইছে কান্না হয়ে। সব সবকিছু তো তাঁর ভাবনায় ভাবিত ভারতবর্ষ নামক এক দেশের জন্য। ভারতবর্ষকে দেখছেন আজ তাঁর চোখ দিয়েই। আজও কি স্বাধীন ভাবে দেখছেন এই দেশটিকে! তাঁর আরাধ্য কাজ করতেই তো এতো কৃচ্ছসাধন! ব্রহ্মচারিনী তিনি। দুঃখের প্রকাশ তো প্রসন্নতা! আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখেছেন গুরুর কাছেই। যিনি গুরু, তিনিই স্বামী, স্বামীজি। মানুষের মুক্তির জন্য তাঁর যে কাজ, অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাবার জন্য তাঁর যে কাজ, সেই কাজকে তাঁর অনুপস্থিতিতে করে যেতেই হবে। কী ভাবে! জানা নেই নিবেদিতার। প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি তাঁর গুরুর সান্নিধ্য পেয়েছেন, পেয়েছেন পথ বা পথের ইঙ্গিত। নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন শূন্যে।
    শূন্য। তাঁর নিথর দেহ শায়িত ঐ ঐ অদূরেই!

    নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন সরলার দিকে। সরলার চোখে চোখ রাখে। দুপুর এখনও বিকেলের দিকে গড়ায়নি। সুহাসিনী নতুন ঝি, উঠোনের কোণে বসে বাসন মাজছে। তাকে ঘিরে বকবকম পায়রাগুলো পা তুলে তুলে! এই সময়ে গেরস্থালি শব্দ ছাড়া তেমন কোনো শব্দ হয় না। পায়রার বকবকানি আর আলাদা করে শব্দ বলে মনে হয় না।
    ‘আমার এই মুহূর্তে তোমাদের সাথে বিদেশ যাওয়া হবে না। তোমাকে জানাতেই এসেছি। স্বামীজি কে আমি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি। হয়তো তুমি তার জানতে পেরেছ। ’ সরলা বেশ কেটে কেটে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন।
    ‘তোমার ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা! আমাকে বলার মতো হলে বলতে পারো। দ্বিধা কোরো না।’ নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন। অনেক আশা ছিল সরলাকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে রামকৃষ্ণের ভাবাদর্শ প্রচার করা। সরলা বিদূষী, সরলা চিন্তক, সরলা বাগ্মী, সুন্দর কথা বলেন ইংরেজি ও বাংলায়, সরলা এগিয়ে থাকা এক নারী। এমন নারী একজন সঙ্গে থাকা মানেই হাজার নারীকে বাইরে নিয়ে আসার শক্তি। কিন্তু সরলা আজ…। আজকের সরলা ও স্বামীজির সান্নিধ্যে সেদিনের সরলার মধ্যে একটা প্রভেদ লক্ষ্য করেছেন নিবেদিতা। তাই চোখের ভেতর চোখ ডুবিয়ে তুলে আনতে চাইছেন খুব ভেতরের সেই ভাষা। পড়তে চাইছেন।
    ‘দ্বিধা, দ্বন্দ্ব কিছু নেই নিবেদিতা। আমি ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। ঠাকুরবাড়ির একটি নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারা আছে, আছে ঐতিহ্য। আমি সে ঐতিহ্য, সেই পরম্পরা তুচ্ছ করে বেরিয়ে আসতে পারব না। প্লিজ!’ সরলা নিবেদিতার হাতটি তুলে নিলেন নিজের হাতে।
    ‘ঠাকুরবাড়িও তো চায় মানুষের অন্ধকার দূর করতে। তাঁরাও তো চান মানুষের মুক্তি। তাঁরাও তো সমাজে আলো জ্বালানোর কাজই করছেন সংস্কারের মধ্য দিয়ে!’
    ‘চাইছেন। ঠাকুরবাড়ির পথ আলাদা। এটা তুমি বুঝতে পেরেছ নিশ্চয়ই।’
    ‘পেরেছি কিছুটা কিছুটা। কিন্তু বহিরঙ্গের তফাৎ ছাড়া অন্তরঙ্গে বিশেষ পার্থক্য আছে বলে তো মনে হয় না সরলা!’
    ‘তুমি অস্বীকার করতে পারবে না বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা ও ভাবনায় আধুনিকতার ছোঁয়া এনেছে এবং আনার কাজটি সুন্দরভাবে করে চলেছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। এর বাঁধন যেমন সহজ ও সুন্দর তেমনই গভীর। সহজে ছেঁড়া যায় না। তুমি নিশ্চয়ই এর গভীরতা অনুভব করতে পারো বলেই আমার বিশ্বাস।’ সরলা গুছিয়ে কথাগুলো বললেন।
    ‘আমি বুঝতে পারি। যে সংস্কৃতি আদুল-গা, অমার্জিত, অশিক্ষিত লোকেদের মূর্তি নিয়ে ধর্মাচরণের হুল্লোড়ের থেকে আলাদা। সেটা আমি বুঝি। সাথে সাথে এই বিশ্বাস আছে উৎসে যখন উপনিষদ ও বেদ তখন একদিন সবাইকে স্বামীজির কাছে আসতে হবে। আজ অথবা কাল।’
    ‘না সে টুকুই সব নয় নিবেদিতা। ঠাকুরবাড়ির আভিজাত্য, জৌলুস, বিত্ত, পোশাক, জীবনযাপন নিয়ে আপনাদের অনেক কথা থাকতেই পারে কিন্তু অন্ধকারের বিরুদ্ধে বেদ, উপনিষদ থেকে শুরু করে আউল-বাউল সহজিয়া লোকধর্মের যে ধারা, যে সুমহান ঐতিহ্য, তাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে ঠাকুরবাড়ির অবদান তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। আমি এই মহান প্রভাবকে অস্বীকার করতে পারব না। তাকে ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতেও পারব না। মার্জনা কোরো!’
    ‘না না। ও’ভাবে বোলো না। তোমাদের মতো শিক্ষিত, বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী মহিলারাই তো সমাজ সংস্কারের অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।’ নিবেদিতা সংযত করে নিজেকে।
    ‘তোমার আত্মত্যাগ আমাদের বিস্মিত করে নিবেদিতা। তোমার সমর্পণ অপার্থিব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে যা তোমাকে ঘিরে রাখে।’
    ‘ধন্যবাদ সরলা। সুন্দরী তুমি। তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই আমাদের মঠের আর্থিক অবস্থা বেশ সঙ্কটজনক। স্বামীজির বিদেশ যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য অর্থ সংগ্রহ। সেক্ষেত্রে তুমি আমি সবাই গেলে হয়তো সুবিধা হতো!’
    ‘সরি নিবেদিতা! ঠাকুরবাড়ির সম্মান রক্ষার্থে আমি পারছি না। আজ ইয়ং বেঙ্গলের নেতৃত্বে আছে রবিমামা তাঁর সৃষ্টি বৈচিত্র্য নিয়ে।’
    ‘কিন্তু সরলা এই দু’টি দল সামান্তরাল ভাবে চললে কি এই দেশের দারিদ্র্য অশিক্ষা দূর করা সম্ভব! কেন তোমরা এগিয়ে আসছ না আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করতে! কেন দু’টি দল পরস্পরকে সাহায্য করছে না!’ নিবেদিতা সরাসরি তাকায় সরলার চোখে।
    ‘আমাদের পারিবারিক সম্ভ্রম ও সামাজিক সম্মান হয়তো একটা বড় বাধা!’
    ‘আমাদের কাজটা মানে স্বামীজির আন্দোলনের ব্যাপ্তি অনেক বড় সরলা!’ নিবেদিতা বেশ বিরক্তই।
    ‘হয়তো তাই!’ সরলা স্বভাবজাত ভঙ্গিতে চুপ।

    গত রবিবার অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল ১৮৯৯ তারিখে সরলা ঘোষাল এসেছিলেন নিবেদিতার কাছে তাঁর অপারগতা জানাতে। আর এই সমস্তটা সংক্ষেপে এবং বেশ বিরক্তি প্রকাশ করে লিখছেন নিবেদিতা আজ সোমবার ১ মে সন্ধ্যায়।

    বৈশাখ মাসের সন্ধ্যা। সারাদিন অসহ্য গরমে কষ্ট পেয়েছেন। একাধিকবার স্নান করেছেন বালতি বালতি জল ঢেলে। চৌবাচ্চা জিনিসটা প্রথম দেখেছেন। দেখেছেন টিনের মগ ও টিনের বালতি। সেসব লিখে রেখেছেন। এখন সন্ধ্যায় গুমোট আবহাওয়া। আকাশে মেঘ জমেছে। যে কোনো সময় দমকা কালবৈশাখীর ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যেতে পারে সবকিছু। দ্রুত কলম চালান নিবেদিতা। সেজবাতির আলো দপদপ করে উঠল যেন একবার! নিজের ভেতরেও ঝড়ের হাওয়া বইছে।
    Sarala came yesterday. She was sweet – but she has a curious nature and this worship of her own family is very irritating. (Letters, Page 131)

    বিরক্ত নিবেদিতা। নিবেদিতা নিয়ন্ত্রণ করেন না সবকিছু বলার বিষয়ে। যা তাঁর ভেতরে হয়ে চলে তার সত্যাসত্য প্রকাশ ঘটে চলে কলমের নিব ও কালির সংঘাতে।
    I asked her why couldn’t help us as we are. And she said their family credit would be lost. So we are to give up a custom deep in the hearts of all who knew Him, in order “to save the honour of the Tagores”. After all, who are these Tagores? ( Letters Page 131)

    কারা এই ঠাকুর পরিবার! নিবেদিতার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন দুই বেগবান নদীর মাঝে সাঁকো তৈরি করা – ভেঙ্গে গেল! আশাভঙ্গ হয়েছেন। সরলা যে চিঠি দিয়েছেন স্বামীজিকে তা তিনি জানতেন। স্বামীজি জানিয়েছেন নিজেই। আলোচনা করেছেন নিবেদিতার সাথে। ঔদ্ধত্যপূর্ণ চিঠিতে সরলা এক আশ্চর্য শর্ত দিয়েছেন – যদি স্বামীজিরা রামকৃষ্ণ ভজনা পুরোপুরি বন্ধ করেন তবেই তাঁদের সাথে যোগ দিতে পারেন। সরলা লিখেছেন – তিনি, সুরেন ও ঠাকুরবাড়ির অনেকেই দেশকে যথার্থ ভালোবাসেন এবং দেশের জন্য স্বামীজি ও নিবেদিতার সঙ্গে কাজ করতে পারলে তাঁরা খুশিই হবেন। কিন্তু…। এক বিরাট ‘কিন্তু’ নিবেদিতাকে আশাহত করল। জানালার সামনে বসে আছেন। ঝড় উঠেছে। দামাল বাতাস। এলোকেশী কালীর চুলের মতো কৃষ্ণকালো মেঘ ঢেকে ফেলেছে আকাশ। হু হু হাওয়ায় গাছে গাছে মাতন লেগেছে। স্বামীজি তাঁর মতো করেই ঔদ্ধত্যের জবাব দিয়েছিলেন ১৬ এপ্রিলে। সে চিঠি পড়িয়েছেন নিবেদিতাকে।

    “মহাশয়াসু,
    আপনার পত্রে সাতিশয় আনন্দ লাভ করিলাম। যদি আমার বা আমার গুরুভ্রাতাদিগের কোনও একটি বিশেষ আদরের বস্তু ত্যাগ করিলে অনেক শুদ্ধসত্ত্ব এবং যথার্থ স্বদেশহিতৈষী মহাত্মা আমাদের কার্যে সহায় হন, তাহা হইলে সে ত্যাগে আমাদের মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হইবে না বা এক ফোঁটাও চক্ষের জল পড়িবে না, জানিবেন এবং কার্যকালে দেখিবেন। তবে এতদিন কাহাকেও তো দেখি নাই, সে প্রকার সহায়তায় অগ্রসর। দু-এক জন আমাদের hobby -র (খেয়ালের) জায়গায় তাঁহাদের hobby বসাইতে চাহিয়াছেন, এই পর্যন্ত। যদি যথার্থ স্বদেশের বা মনুষ্যকুলের হয়, শ্রীগুরুর পূজা ছাড়া কি কথা, কোনও উৎকট পাপ করিয়া খৃষ্টিয়ানদের অনন্ত নরক-ভোগ করিতেও প্রস্তুত আছি জানিবেন।” এক টানা পড়ে তাকালেন স্বামীজি নিবেদিতার দিকে। নিবেদিতার চোখে মুখে সম্মতিসূচক খুশি।
    ‘তারপর!’ নিবেদিতার শিশুসুলভ আগ্রহে বিবেকানন্দের মুখে মৃদু হাসি।
    “তবে মানুষ দেখতে দেখতে বৃদ্ধ হতে চলিলাম। এ সংসার বড়ই কঠিন স্থান। গ্রীক দার্শনিকের লন্ঠন হাতে করিয়া অনেক দিন হইতেই বেড়াইতেছি। আমার গুরুঠাকুর একটি বাউলের গান গাহিতেন – সেইটা মনে পড়িল :
    মনের মানুষ হয় যে জনা
    নয়নে তার যায় গো জানা,
    সে দু’এক জনা,
    সে রসের মানুষ উজান পথে করে আনাগোনা।”
    স্বামীজি বেশ স্বতঃস্ফূর্ত দু-এক কলি গেয়ে উঠলেন খোলা গলায়। মধ্য এপ্রিলের গরমে গঙ্গার ঝোড়ো হাওয়া কতদূর কোথায় কথাগুলো নিয়ে গেল কে জানে!
    ‘এখানেই শেষ!’ নিবেদিতা তাকায়।
    ‘না না আসল জায়গাটাই তো এখনও বাকি!’ স্বামীজি চিঠির বাকি অংশ পড়তে শুরু করেন।
    “এই তো গেল আমার তরফ থেকে। আর একটিও অতিরঞ্জিত নয় জানিবেন এবং কার্যকালে দেখিবেন।
    তারপর যে-সকল দেশহিতৈষী মহাত্মা গুরুপূজাটি ছাড়লেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেন, তাঁদের সম্বন্ধেও আমার একটুকু খুঁত আছে। বলি, দেশের জন্য বুক ধড়ফড়, কলিজা ছেঁড়-ছেঁড়, প্রাণ যায় যায়, কন্ঠে ঘড়-ঘড় ইত্যাদি – আর একটি ঠাকুরেই সব ক’রে দিলে?”
    স্বামীজি থামলেন। তাকালেন। নিবেদিতা হেসে বললেন, ‘যথার্থ হয়েছে স্বামী!’
    ‘এবার একেবারে শেষটুকু শোনো!’
    স্বামীজি পড়তে শুরু করেন। মুখে তাঁর শিশুর প্রসন্নতা।
    “তৃষ্ণার্তের এত জলের বিচার, ক্ষুধায় মৃতপ্রায়ের এত অন্নবিচার, এত নাক সিটকানো? কে জানে কার কি মতিগতি! আমার যেন মনে হয়, ও-সব লোক গ্লাসকেসের ভিতর ভালো; কাজের সময় যত ওরা পিছনে থাকে ততই কল্যাণ।
    প্রীত ন মানে জাত কুজাত।
    ভুখ ন মানে বাসী ভাত।”
    বিকেল গড়িয়ে পড়ছে। স্বামীজি দু-এক লাইন না পড়ে পড়ে মূল জায়গাগুলো শোনাতে শুরু করলেন। মন্দিরের আরতি শুরু হয়ে যাবে।
    “যাহা হউক, এ সম্বন্ধে আপনাদের সঙ্গে অনেক কথা কহিবার অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষা রহিল।
    এ সকল কথা কহিবার জন্য রোগ, শোক, মৃত্যু সকলেই আমায় এ পর্যন্ত সময় দিয়াছেন, বিশ্বাস এখনও দিবেন।
    এই নববর্ষে আপনার সমস্ত কামনা পূর্ণ হউক।
    কিমধিকমিতি
    বিবেকানন্দ “(জন্মশতবর্ষ স্মরণে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, অষ্টম খন্ড, উদ্বোধন, প্রথম সংস্করণ ১৩৬৭, পৃ: ৫৫)
    এই চিঠির তারিখ লেখা আছে ১৬ এপ্রিল ১৮৯৯। সরলা নিবেদিতার বাড়িতে এসেছিলেন এই চিঠি হাতে পাবার পরেই। ভব্যতা, আভিজাত্য, সৌজন্যবোধ তাঁকে নিবেদিতার বাগবাজারের বাড়িতে এনেছিল। নিবেদিতাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির কৌলিন্যের কথা। নিবেদিতা বিরক্ত হয়েছিলেন সেদিন শুধু নয় আবেগপ্রবণ নিবেদিতার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। অনেক দিন ধরেই স্বপ্নটা লালন করেছিলেন। ঠাকুরবাড়ির মানুষদের বংশ গৌরবের অতিসচেতনতায় নিবেদিতার স্বপ্ন ধূলিসাৎ। সরলা এসেছিলেন ৩০ এপ্রিল১৮৯৯। আরেকটি ঘটনা এখানেই উল্লেখ করে যাওয়া ভালো, সেটা ১৩ এপ্রিল ১৮৯৯। অর্থাৎ বিবেকানন্দের সরলার প্রতি ঐরকম ‘বুক ধরফর’ চিঠি লেখার ঠিক তিন দিন আগে ব্রাহ্মসমাজ ভাঙ্গার বদলে আরও মজবুত হাতে ধরলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুরবাড়ি নিশ্চিতভাবেই লক্ষ্য করেছিল সরলা ও সুরেন সহ অনেকেই নিবেদিতার মাধ্যমে বেলুড় মঠ তথা বিবেকানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের পদে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বসলেন সুরেন কে সঙ্গে নিয়ে। ক্ষিতীন্দ্রনাথের পরিবর্তে সুরেন্দ্রনাথকে নতুন দায়িত্বে আনা হল। নিবেদিতা এবং সুরেন্দ্রনাথের সখ্যতার বিপরীতে এই পদক্ষেপের পিছনে কি আরেক সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! রাশটা নিজের হাতে রাখলেন!

    ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে নিবেদিতার বিরোধাভাষ চূড়ান্ত। মন ভেঙ্গে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এদিকে মঠের আর্থিক অবস্থা স্থিতিশীল নয়। সবার দু’বেলা দু’মুঠো জোগাড় করা কঠিন হয়ে উঠেছে দিন কে দিন। স্বামীজির শরীর খারাপ কিন্তু বিদেশে যাবেন খুব তাড়াতাড়ি। বদ্ধপরিকর। অপরদিকে নিবেদিতা যে পরিকল্পনায় বুক বেঁধেছিলেন যে, একদিন ব্রাহ্মদের স্বামীজির পদতলে আসতে হবে, সে অনতিক্রম্য আজ নিবেদিতার কাছে।

    দুপুরে অসম্ভব গরম। ঘামে ভিজে যাচ্ছে পোশাক। দু’তিন বার করে জল স্নান করেও গরমে অস্থির হয়ে উঠছেন তিনি। গতকাল সদানন্দ একটা বরফ আইসক্রিম এনে দিয়েছিল খাবার জন্য। বিলাসিতা বলে মনে বোধ হলেও নিবেদিতার খেতে ভালো লেগেছিল। এক সুন্দর ঠান্ডা অনুভূতি শরীর মনে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজ খুব কষ্ট হচ্ছে গরমে। ঘরে থাকাই সম্ভব না। মনের ভেতরে এক ধরণের অস্থিরতাও কাজ করছে। এইরকম পরিস্থিতিতে নিবেদিতার প্রিয় আশ্রয়স্থান লেখার টেবিল। প্রিয়তম কাজ চিঠি লেখা। চিঠি লেখা মানেই নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলে চলা। বলতে বলতে হারিয়ে যাওয়া কথায় কথায় ঘটনায় ঘটনায় শব্দে শব্দে। বসলেন। গামছা দিয়ে ঘাম মুছলেন। কাগজের উপরে কিছুটা অংশ ব্লটিং পেপারে ঢেকে হাত রাখলেন চেপে তার উপর। হাতে কলম বলতে থাকে মনের কথা। ইচ্ছের কথা।
    জোসেফাইন ম্যাকলয়েডকে যে চিঠি লিখতে শুরু করেছেন সোমবার ৮ মে ১৮৯৯ তারিখে যেখানে বলছেন গরমের কারণে “I sleep on the roof at night”. অসংখ্য তারা নক্ষত্রময় উন্মুক্ত আকাশের নীচে শোয়ার এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা নিবেদিতার। সেই অসমাপ্ত চিঠি আবার লেখা শুরু করলেন আজ মঙ্গলবার ৯ মে সকালে। লিখছেন – “They say the King goes in a fortnight. If so I shall probably take 10 days up the river with the Rabindranath Tagores immediately after.”
    মনের ইচ্ছা জানিয়ে রাখলেন – স্বামীজির বিদেশ যাত্রার সাথে সাথেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের সঙ্গে নদীর ধারে সময় কাটাবেন দশ দিন। শিলাইদহে। পদ্মার তীরে।

    [পর্ব- ৬]