এক অন্তহীন ভেসে চলা জীবন-নদীর পথে পথে। এখানে ওখানে অদৃশ্য বা দৃশ্যমান ঘাটের পর ঘাটে, ঘাটের পর ঘাটে ক্ষণিকের জন্য থামা। কে কোন ঘাটে নোঙর ফেলে আর কে কোন ঘাট থেকে নোঙর তোলে কেউ তার হদিস জানে না। ভেসে পড়া। আবার কোথাও নোঙর ফেলা। নিবেদিতা গঙ্গার স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমাকে হাত ধরে এনেছেন এই দেশে, এই পথে, এই কাজে; গুরু আমার, পিতা আমার, স্বামী আমার! মুক্তির পথ দিয়েছেন তিনি। তবু ছিলেন মাথার উপর হাতটি রেখে। হঠাৎ ‘মুক্ত’ শব্দটি অসম্ভব ভারী বোধ হচ্ছে। চাপা কষ্ট উঠে আসতে চাইছে গলা ছিঁড়ে। ভেসে চলেছেন নিবেদিতা মঠের দিকে আজ নৌকায়। বেলুড়ে গঙ্গার তীরে শায়িত আছেন তাঁর প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, শ্রদ্ধা, স্বপ্ন, আধার, সব সবকিছুর সমষ্টি এক পুরুষ। নোঙর ছেঁড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন খুব ভেতরে।

বিকট শব্দ ও দোলা দিয়ে গোলকুন্ডা জাহাজ তীর ছেড়ে নেমে গেল জলে। ভোঁওও শব্দটা কানে তালা লাগিয়ে দিল যেন! নিবেদিতা তাকিয়ে আছেন তীরভূমে যেখানে একদিন এসেছিলেন একা। যাঁর ডাকে তিনি এসেছিলেন তিনি আজ তাঁর যাত্রাসঙ্গী। জাহাজ জলরাশি ভেঙে ভেঙে পাড়ি দিল সেই দেশের উদ্দেশ্যে যেখান থেকে নিবেদিতা একদিন একা রওনা হয়েছিলেন অজানা অচেনা ভারতবর্ষের দিকে। ২০ জুন থেকে ৩১ জুলাই ১৮৯৯ সালের মেঘলা বিকেল। অনন্ত জলরাশির উপর অখণ্ড ভেসে চলা শুরু হল। স্বামীজিকে এত আপন করে এতটা সময় পাননি নিবেদিতা। দিন-রাত ভেসে চলা। অনন্ত জলরাশির মতো ভাবনার স্রোতে উথাল পাথাল নিবেদিতা। প্রথম শ্রেণীর যাত্রী তিনি ও স্বামীজি। স্বামীজির শরীর ভাল নয়। তবে তিনি অনিঃশেষ বলে চলেছেন দর্শনের কথা, চিন্তা, ভাবনা। নিবেদিতা রাতে জাহাজের কেবিনে পাতার পর পাতা লিখে চলেছেন — স্বামীজিকে তিনি কেমন দেখেছেন সারাদিন।

সুন্দর সাজানো বাগানের মধ্য দিয়ে পথ গিয়েছে ওক গাছের আড়ালে আড়ালে এদিক সেদিক। আকাশ-ঢাকা ওক গাছের সারি। হাডসন নদীর তীরে এই প্রকাণ্ড বাগানঘেরা বাড়ি। সবুজ লন। হেমন্তের বিকেল। আকাশে নরম আলো। গাছে গাছে রোদের খেলা। নিবেদিতা ও স্বামীজি হাঁটছেন প্রাচীন ওক গাছের ছায়াঘেরা পথে। গাছের প্রাচীনত্বে এবং তাদের প্রকাণ্ড সব ডালপালার বিস্তারে এক গম্ভীর পরিবেশ তৈরি করেছে। দু’জনে হাঁটছেন ধীর পায়ে। এক সময় থামলেন প্রাচীনতম ওক গাছটির তলায়। এইখান থেকে বাগানের পায়ে চলা চারটি পথ চারদিকে চলে গেছে। ইতস্তত ওক ফল পড়ে আছে। খুব মহার্ঘ এই ফল।
স্বামীজি তাকালেন নিবেদিতার দিকে, ‘এখান থেকেই তোমার একলা চলা শুরু হোক। সমস্ত কামনা যখন বিশীর্ণ হয়, তখন হৃদয়ের বিকিরণ হয়।’
নিবেদিতা সজল চোখে তাকালেন গুরুর দিকে, ‘কোথায়, কোথায় পাব মনের শান্তি?’
‘দেখো, ভালবাসা এক আর সাযুজ্য আরেক। সাযুজ্য ভালবাসার চেয়ে বড়। যা নিয়ে জীবনপাত করলাম, অন্তরের সিদ্ধি রূপ ধরেছে যার মধ্যে — ভালবাসি বললেই সব বলা হয় না। এই অর্থেই আমি ধর্মকে ভালবাসি, যা আমার সর্বস্ব।’ বিবেকানন্দ থামলেন। একটু কেশে নিলেন।
শরীর ঠিক থাকলেও ক’দিনের যাতায়াতের ধকল গেছে শরীরে। এক মাসের উপর সমুদ্রযাত্রার ধকল। লন্ডনে নিবেদিতার বাড়িতে উঠেছিলেন। সেখানে কমবেশি পনেরো দিন থাকা। স্বামীজির প্রতি নিবেদিতার মায়ের যত্ন ছিল খুব। মেরি নোবেল ভারতের এই সাধুকে ভালবেসে ফেলেছেন বেশ। আর স্বামীজি মাতৃস্নেহ উপভোগ করেছেন। নিবেদিতার বোন ও ভাই, মে আর রিচমন্ড, স্বামীজির মধ্যে যীশুকে দেখতে পেয়েছেন। প্রতিদিন বিকেলে আশেপাশের লোকজন সব জড়ো হত। স্বামীজি কথা বলতেন। নিবেদিতা শোনাতেন ভারতবর্ষের কথা। আমেরিকার দুই শিষ্যা এসেছিলেন স্বামীজিকে নিয়ে যেতে নিউইয়র্কে মিস লেগেটের বাড়ি। তাঁদের সঙ্গে স্বামীজি চলে গেলেন উইম্বলডনের নিবেদিতাদের বাড়ি ছেড়ে ১৭ আগস্ট, ১৮৯৯। নিবেদিতা তখন যাননি। থেকে গিয়েছিলেন নিজের পরিবারের সঙ্গে। বোনের বিয়ে ছিল কয়েকটা দিন পরেই। বোনের বিয়ে শেষ হতেই নিবেদিতা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। বারণ করেছিলেন মা মেরি নোবেল চোখের কোণে জল নিয়ে — ‘এত তাড়াতাড়ি চলে যেতেই হবে? থেকে যা কয়েকটা দিন!’ ম্যাকলয়েডের দেওয়া বিয়েবাড়ির পোশাক পরিবর্তন করতে করতে নিবেদিতা ছোট্ট করে বলেছিলেন, ‘আমার আরও অনেক মায়েদের জন্য অনেক কাজ জমে আছে মা ভারতবর্ষে। আমাকে ছেড়ে দাও।’ নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নিবেদিতা।
সেদিনই তিনি স্কটল্যান্ডের ট্রেন ধরলেন। সেখান থেকে জাহাজ। নিউইয়র্কে মিস লেগেটের বাড়ি। এখানেই স্বামীজি আশ্রয় নিয়েছেন। মিস ম্যাকলয়েডের বড় বোন মিস লেগেট খুব ধনী। হাডসন নদীর তীরে তাঁর প্রাসাদোপম বাড়ি। বাড়ির চারদিকে বিরাট বাগানে নানান বৃক্ষরাজি, সবুজ লন, ওক গাছের সারি আর কয়েকটি আউট হাউস। হেমন্তের পাতা খসার সময় আশ্চর্য রঙিন হয়ে ওঠে প্রকৃতি। চারিদিকে হলুদ, লাল, খয়েরি রঙের নানান শেডে সেজে উঠেছে মিস লেগেটের এই বিশাল ওক গাছের বাগান। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা চলে এসেছেন দু’জনে।
‘দেখো মার্গট, যাকে ভালবাসি তাকে ঠিক আত্মসাৎ করতে পারি না। ভক্তি আর জ্ঞানের মধ্যে এই তফাত, আর এইজন্য ভক্তির চেয়ে জ্ঞান বড়।’ স্বামীজি তাঁর উজ্জ্বল চোখদু’টি যেন ভাসিয়ে দিয়েছেন।
নিবেদিতা মাথা নিচু করলেন। খুব খুব ভেতরে কেঁপে উঠলেন থরথর করে। নিচু স্বরে উচ্চারণ করলেন, ‘আমি তো মুক্ত, আমার সংকল্প নেই, বাসনা নেই।’
শিরায় শিরায় তাঁর ভয়ের কাঁপন, ‘গুরুদেব, একলা এগিয়ে যাবার শক্তি আমার আছে কি?’
‘নিজেকে জানো। নিজের শক্তিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াও। সমাজ-সংস্কারের এই মায়াডোর ছিঁড়ে এগিয়ে যাও মার্গট। ইন্দ্রিয় তৃপ্তির এই আয়োজনের বিরুদ্ধে অটল থাকার শক্তি সঞ্চয় করো। সে শক্তি তোমার ভেতরে নিহিত আছে।’ স্বামীজি থামলেন। শ্বাস নিচ্ছেন ঘন ঘন।
নিবেদিতা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন, ‘আমি ধ্যানযোগে…’
‘মুক্ত আত্মার পক্ষে ধ্যানও একটা বন্ধন। এইসব কসরত করার সময় এটা নয়, মার্গট! যাও…।’ স্বামীজি তাকিয়ে আছেন দূরে।
‘আমি Kali the Mother লিখতে চাই এই মৌন ব্রত পালনের সময় গুরুদেব।’ নিবেদিতা সভয়ে বললেন কথাটা।
‘শুরু করো। নিজের উপলব্ধি থেকে লেখো। নিজের ভেতর ডুব দিয়ে তুলে আনো…’
নিবেদিতা স্বামীজির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালেন।
স্বামীজি নিবেদিতার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘যাও মার্গট। মৌনব্রত পালন করো একপক্ষ কাল।’
গোধূলির শেষ আলো শুষে নিচ্ছে প্রাচীন ওক গাছের সারি ও নানান ঘন বৃক্ষরাজি। এক মোহময় আলোকরশ্মি গায়ে মেখে ত্যাগের বসনে দাঁড়িয়ে আছেন এক সন্ন্যাসী। আর শ্বেতবস্ত্রে দিনের শেষ আলো নিয়ে নির্জনে এগিয়ে চলেছেন এক সমর্পিতা।

ছোট্ট দিন কখন টুপ করে ডুবে গেল। হেমন্তের পূর্ণ চাঁদ উঠেছে আকাশে। চাঁদের আলোয় নিবেদিতা ভেসে ভেসে চলেছেন একার সঙ্গে একা হতে। ওক গাছের ভেতর দিয়ে নুড়ি-পাথর বিছানো পথ ধরে এগিয়ে চললেন বাগানের প্রান্তে গাছে গাছে ঢাকা এক কুটিরের দিকে। শিকার-কুঠি। গাছের ফাঁক দিয়ে মাটিতে আলপনা তৈরি করছে জ্যোৎস্না। শুকনো পাতার উপর দিয়ে নিবেদিতা সেই আলপনা ভাঙতে ভাঙতে চলেছেন মৌনীব্রতে। চারিদিকে হিমেল অন্ধকার নামছে বনপথে। ভেতরে, খুব ভেতরে, তছনছ হয়ে যাচ্ছেন নিবেদিতা। যে স্বপ্ন সফলের জন্য অশক্ত শরীর নিয়ে গুরুদেব এতদূর এতটা পথ অতিক্রম করেছেন, তাকে সফল করার দায়িত্ব যে তাঁকে নিতেই হবে! আকাশ পরিষ্কার। অন্ধকার বনানীর ফাঁক-ফোঁকরে গলে গলে নামছে জ্যোৎস্না। কাঠের একতলা বাড়ি। দরজা ভেজানো। ঠেলতেই খুলে গেল। ঘরের ভেতরে সেজবাতির হলুদ আলো। আলোয় দেখা যাচ্ছে বিছানা পরিপাটি। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। ছোট্ট টেবিলের উপর সেজবাতি, জলের জাগ, গ্লাস ও একটি ফ্লাস্ক। সামনে একটি চেয়ার। আলো-আঁধারে এক রহস্যময় নির্জনতা তৈরি করেছে। ঝিঁঝি ডাকছে সমস্বরে। সামনের জানালা খুলে চেয়ারে বসলেন। কাচের শার্সিতে হিম পড়ছে। বাইরে ঘন কৃষ্ণবর্ণ প্রকাণ্ড সব গাছেদের জট। তার পেছনে ঘোর শ্বেতশুভ্র চাঁদ। তাকিয়ে থাকেন নিবেদিতা একদৃষ্টে। সিলিউটে প্রকাণ্ড ডালপালাগুলি আশ্চর্য ঘন কালো। আলুলায়িত চুলের মতো যেন আকাশের কোলে হেলান দিয়ে আছে। মগ্ন হলেন। চোখ বুজলেন তিনি। বীজমন্ত্র জপ করলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুললেন নিবেদিতা। কেমন অস্থির লাগছে ভেতরে। কেন এমন লাগছে! লেখার খাতা ও কলম নিয়ে বসলেন টেবিলে। কিছুই লিখতে পারছেন না। ভাবনাকে সংঘবদ্ধ করতে পারছেন না। জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন। কোথাও কোনও শব্দ নেই। হাওয়া স্তব্ধ। আশ্চর্য কেশদামের মতো বড় বড় বৃক্ষের ডালপালা ঘন কালো হয়ে ঢেকে আছে। তাকিয়ে থাকেন পলকহীন।
‘কোথায় গেল মনের শান্তি!’ মনে মনে বলেন নিবেদিতা।

‘আমার খুশিতে এসেছ। মনে থাকে না কেন তোমার! মনে রেখো প্রশ্ন আমিই তৈরি করি, উত্থাপনও করি আমি। জবাবের ইশারাও আমিই দিই।’ কোথা থেকে যেন ভেসে আসে কথাগুলো। কে? কে ভেতর থেকে উচ্চারণ করে উঠল?
চমকে ওঠেন নিবেদিতা, ‘মা গো, যাঁকে ভালবাসি, তিনি আজ বহু দূরে। তাঁর মনে আজ খুব কষ্ট। আমি তাঁর সহায় হব। তাঁকে ভালবাসি, কিন্তু তাঁর দুঃখ ঘোচাতে পারি না। মা, কেন এমন হয়!’

ছায়া যেন বলে, ‘এই দুর্বার ভালবাসা রুখতে হবে। তোমার মন তো আমার নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বের এই আনন্দ বেদনায় তোমার কোনও অংশ নেই, শুধু সাক্ষীর মতো চেয়ে দেখো। তাহলেই আর কিছুতে জড়িয়ে পড়বে না। তবেই শান্তি পাবে।’

‘মা, আমার শান্তি আমি চাইছি না। তাঁকে শান্তি দাও। তাঁর শান্তির জন্য যেন আমি কাজ করতে পারি, এই বর দাও। তাঁর নিঃসঙ্গতার বেদনাকে উপেক্ষা করতে পারব না মা!’

‘বোকা মেয়ে! তাঁর স্নেহের বিনিময়ে তুমি যে ভালবাসছ তাকে, সেই ভালবাসা লোহার শিকলের মতো তাঁকে বাঁধছে! যন্ত্রণাময় জীবন তাঁর দীর্ঘায়িত করছে। আয় বাছা, আমার বুকে আয়, তবেই তাঁকে তৃপ্তি দিতে পারবি। নিজেকে সরিয়ে নিতে পারিস যদি, তাহলেই শান্তি দিবি তাকে।’

‘আর পিছন ফিরে তাকাতে দিয়ো না আমায়! তুমি ডেকে নাও। তোমার বুকে ঠাঁই দাও মা।’ নিবেদিতার চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসছে।

অন্ধকার যেন বলে ওঠে, ‘পাখির মতো ছোট্ট ডানা মিছেই ঝটপট করে মরছিস। চোখ মেলে চেয়ে দেখ, বৈরাগ্যের সাধনা এনেছে তোর হৃদয়ে আনন্দের ধারা।’

সেজবাতির আলোয় নিবেদিতার মাথা ঝুঁকে পড়েছে। ছোট ছোট চুলগুলি ঢেকে ফেলেছে মুখ। লিখে চলেছেন নিরলস — “Mother! Far away, one whom I love is very sad today. His heart calls to mine for help, but though I tell him how I love him, I leave him still uncheered. How is it? I know he thinks towards me, I know I talk with him. Yet I long to see him, and hear him, and comfort him face to face.”
অনর্গল সত্যের মুখোমুখি হচ্ছেন নিবেদিতা। এক আশ্চর্য কথোপকথন লিখে চলেছেন পাতার পর পাতা। সারারাত। সারাদিন। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন। তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে প্রবল স্রোত ঝাপট মারছে। নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। বিলীন করছেন। লিখে চলেছেন তিনি Kali the Mother.
পাঁচদিন এইভাবেই কেটে গেল। নিবেদিতাকে খাবার দিয়ে যাচ্ছে এক রাঁধুনি। আবার নিবেদিতাও মাঝে মাঝে সবার মাঝে বসছেন। কিন্তু নির্বাক। মৌন তিনি। নিবেদিতা এক পরম রক্তপাত টের পাচ্ছেন নিজের ভেতরে। সেই ক্ষরণের নিরাময় খুঁজে চলেছেন কেবলই।
“But, oh mother, what can I now do to ease this craving pain?…”
কাগজের উপর কালির আঁচড়ে আঁচড়ে উঠে আসছে আত্মকথা।
“Cease, My child, from inordinate affection. Give Me your heart, and let Me Govern it alone. Be the witness of earth’s joys and sorrows, sharing them not. Thus only can you keep yourself from entanglement, and attain to peace.”

ঠক্ ঠক্ ঠক্। চমকে ওঠেন নিবেদিতা। ঠক্ ঠক্ ঠক্। এই দরজারই কড়া কেউ অধৈর্য হয়ে নাড়াচ্ছে। কে আসতে পারে এমন অসময়ে! তিনিই এসেছেন! এই গভীর রাতে। তিনি! দ্রুত উঠে দরজা খুললেন। পেছনে গাঢ় অন্ধকার বনরাজি। সামনে উজ্জ্বল গেরুয়া পোশাক। মোটা চাদর জড়ানো। মাথায় কালো উলের টুপি। উজ্জ্বল চোখে হাজার সূর্যের আলো। তাকিয়ে আছেন স্থির। গভীর রাত। পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে। গাছেরা স্থির। চরাচর স্তব্ধ। নিবেদিতা পাশে সরে দাঁড়ালেন। স্বামীজি প্রবেশ করলেন ঘরে। বসলেন চেয়ারে। নিবেদিতা দাঁড়িয়ে আছেন। স্বামীজি তাকালেন। তাঁর নির্দেশেই মৌনীব্রত পালন করছেন নিবেদিতা। পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন নিবেদিতা। স্বামীজি মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। কথা শুরু করলেন শক্তি সাধনা নিয়ে, আত্মনিয়ন্ত্রণের পথ, বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন ইদানিং। শিব-শক্তির কথা উঠে এল তাঁর কথায়।
‘শিব আর কালী সব অবতারের আরাধ্য, এই বিশ্বাস রামকৃষ্ণের। শিবই পরম গুরু। নিত্যবুদ্ধ পুরুষই শিব। সমস্ত কলুষ পান করে তিনি নীলকণ্ঠা।’
নিবেদিতা মৌন। শুনে চলেছেন। ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করার পরীক্ষা নিচ্ছেন কি স্বামীজি? নিবেদিতা নিশ্চল। ভাবলেশহীন।
স্বামীজি কথা বলতে বলতে চলে যান রামায়ণের গল্পে। তাঁর কাছে রাবণ হলেন রামায়ণের প্রধান কেন্দ্রীয় চরিত্র।
নিবেদিতা লিখছেন — “Swami came in and blessed me on Sunday night, while I was still in retreat. He stayed about an hour, and told me how it was Sri Rama Krishna firm belief that every great Incarnation either in public or in secret had been a worshipper of Mother. “Or how could he have got the Energy?” Siva and Kali had had to be worshipped. Then he talked about the Ramayana.” ( Letters, Page.221 to Miss MacLeod dated 27th October 1899)
দু’দিন পরেই স্বামীজির নির্দেশে নিবেদিতা মৌনব্রত ভাঙলেন।
‘এবার কাজের সময় এসেছে। মা তাঁর সকল শক্তি নিয়ে তোমার সঙ্গে আছেন। মার্গট ওঠো এবার!’
স্বামীজির দিকে তাকিয়ে থাকেন নিবেদিতা। স্বামীজিকে খুব অস্থির মনে হয়। পণ্ডশ্রম হচ্ছে বলে ধারণা তৈরি হয়েছে। মাঝে মাঝে নৈরাশ্য দেখা দেয় তাঁর মধ্যে। সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে যেন! শরীরে আগের শক্তি পান না। হঠাৎ-হঠাৎ তাঁর মেজাজ খারাপ হয়।
‘মার্গট, আর কতদিন এখানে মাটি কামড়ে বসে থাকবে? কবে যাবে?’
খাবার টেবিলে সবার মাঝে স্বামীজির আচমকা কথায় নিবেদিতা জলখাবার খেতে খেতে স্থির তাকালেন, ‘আপনার নির্দেশেই এখানে আছি। আপনি আদেশ করলে এক্ষুনি চলে যাব!’
স্বামীজি কখনও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন। নিজের অশক্ত শরীর একটি বড় কারণ। অপর কারণ, তিনি যতটা ভেবেছিলেন ইংল্যান্ডের লোকজন এগিয়ে আসবেন রামকৃষ্ণের নামে, ততটা সাড়া পাননি। ছন্নছাড়া ভাব লক্ষ করেছেন। বিরক্ত তিনি। ছটফট করছেন।
‘তোমার মতো শক্তি ও স্বাস্থ্য থাকলে জগৎ জয় করে ফেলতাম। তুমি ক্ষত্রিয়াণী। তোমার কাজ কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে তপস্যা নয়। তুমি লড়াই করবে। লড়ো, কাজ করো। যে-কোনও অবস্থায় মনে রাখবে তুমি স্বাধীন। মুক্ত। তোয়াক্কা কোরো না কিছু মার্গট!’
নিবেদিতা স্থির বসে থাকেন। স্বামীজি পায়চারি করছেন দ্রুত পায়ে। মিস বুল আছেন। আছেন অনেকেই। সবাই চুপ।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল আগামী পরশু অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বর মিস বুলের সঙ্গে স্বামীজি রওনা হবেন নিউইয়র্কের উদ্দেশে।
নিবেদিতা বসে আছেন। সব স্থির হয়ে গেল। নিবেদিতা যাবেন দু’দিন পর অর্থাৎ ৭ ডিসেম্বর। স্বামীজি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন নিবেদিতার কাছে, ‘নিবেদিতা, আমার ব্যাগ-পত্তর গুছিয়ে দেবে? আমি তো এসব ঠিক পারি না!’
নিবেদিতার চোখে খুশির সূর্য। তাকালেন। উঠে গেলেন স্বামীজির ঘরে। বইপত্র, কাগজ, কলম, সবকিছু গুছিয়ে রাখছেন নিবেদিতা। পোশাক রাখছেন ব্যাগের ভেতর। স্বামীজি এগিয়ে এসে দু’টি ভাঁজ করা গেরুয়া পাগড়ি বাঁধার সিল্কের কাপড় নিজে আলাদা করে তুলে নিলেন হাতে। নিবেদিতার দিকে তাকালেন। নিবেদিতা স্বামীজির চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করলেন। একটা কিছু পরিকল্পনা আছে নিশ্চয়ই! তারপর নিবেদিতাকে অবাক করে ঝুঁকে ভাঁজ করা দু’টি গেরুয়া সন্ন্যাসিনীর পোশাক তুলে নিলেন হাতে। গেরুয়া চাদর নিলেন। তারপর নিবেদিতার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সারা কোথায়?’
‘মিসেস বুল বোধহয় আমার ঘরে, হয়তো চিঠি লিখছেন।’ নিবেদিতা কথা শেষ করতে না করতেই স্বামীজি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এসো’।
ঘরে ঢুকেই স্বামীজি দরজা বন্ধ করে দিলেন। সামনে নিবেদিতা ও সারা বুল হতচকিত। স্বামীজির চোখেমুখে খুশির উৎসব। দু’হাত দু’পাশে প্রসারিত।

“First he shut the door — then he arranged the cloth as a skirt and chudder round her waist — then he called her as Sannyasini and putting one hand on her head and one on mine he said, I give you all that Ramakrishna P. gave to me. What came to us from a Woman I give you two women. Do what you can with it. I can not trust myself. I do not know what I might do tomorrow and ruin the work.” ( Letters 11th November 1899, p- 232) নিবেদিতা জানাচ্ছেন গত রবিবার ও সোমবার অর্থাৎ ৪ নভেম্বর ও ৫ নভেম্বরের ঘটনা তাঁর প্রিয় ইয়ুমকে। আজ ১১ নভেম্বর শনিবার ১৮৯৯ সাল। গত ৫ নভেম্বর সোমবার স্বামীজি ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে এসেছেন আমেরিকায়। নিবেদিতা বেরিয়েছেন স্বামীজি বেরোনোর দু’দিন পরে অর্থাৎ ৭ নভেম্বর।
কিন্তু মিস লেগেটের বিশাল অট্টালিকা রিজলি ম্যানর ছাড়ার আগের দু’দিন স্বামীজির মেজাজ ছিল অত্যন্ত উত্তেজিত। সাফল্য নেই। সারা বুল ও নিবেদিতার উপর সমস্ত অসফলতার দায় বর্তেছে। শনিবার রাতে স্বামীজির মুখ থমথমে। ভীষণ অসন্তোষ ঝরছে চোখে।
“All evening I saw him look with occasional fierceness and he slipped away about 10… On Sunday morning after breakfast the volcano burst. He turned on me before everyone and asked how much longer I intended to hang on. He was quite abusive — and then he uttered a relenting word — you know how.”( Letters P- 232) সকালের আলো এসে পড়েছে হিমশীতল জানালার কাচে। জমাট শিশির গলে গলে জলধারা নানান নকশা তৈরি করছে গড়িয়ে গড়িয়ে। নিবেদিতা তাকিয়ে আছেন। টেবিলের উপরে তাঁর অন্তস্তল থেকে উঠে আসা সমস্ত কথাগুলো বলে যাচ্ছেন অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রিয় ইয়ুমকে। দ্য অডিটোরিয়াম হোটেল, ৬১৬ শিকাগো। নিবেদিতার বর্তমান ঠিকানা।
টেবিলের উপর চিঠি লেখার প্যাড। হাতে জন্মদিনে পাওয়া কলম। সেই কলম আঙুলের ফাঁকে নিয়ে হাতের উপর থুতনি রেখে তাকিয়ে থাকেন নিবেদিতা জানালায় রোদ ও হিমের খেলা। স্থির। চিন্তাটা সেইদিন থেকেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রামকৃষ্ণ যেদিন স্বামীজিকে ‘ষোল আনা’ দিয়ে নিজে মুক্ত হলেন, তার ঠিক দেড় বছর পর রামকৃষ্ণ পরমলোকে মহানির্বাণে গিয়েছিলেন। স্বামীজি কি মুক্ত হলেন সেই দিন, যেদিন সারা বুলকে সন্ন্যাস-বেশ দিলেন আর দু’জনকে দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করলেন — এক মায়ের থেকে যা শক্তি পেয়েছিলাম আজ দু’জনকে তার সম্পূর্ণ দিয়ে দিলাম! নিবেদিতা ঝুঁকে পড়লেন লেখার প্যাডের উপর। তেরচা রোদ পড়েছে টেবিলে। কাগজের উপর রোদ। সেখানে লেখা হচ্ছে মনের গভীর কথাগুলো —
“But I cannot conceal his innermost thought from myself – that as his Master lived only 1½ year after giving his Power to him – so he has but a short time to live. Life has been torture to him, and I would not ask him to endure it longer – merely for our pleasure…”( Letters p- 235). প্রিয়তম মানুষের প্রতি পরম ভালবাসার উচ্চারণ। এই শিকাগো থেকেই শুরু হয়েছিল তাঁর প্রিয়তম পুরুষটির বিশ্বযাত্রা। আজ ছ’বছর বাদে সেই শহরে বসে সেই মানুষটির অশক্ত শরীর ও মনের কথা লিখছেন নিবেদিতা এই হেমন্তের সকালে।
খুশির খবর এটাই, স্বামীজি আবার বিশ্ববাসীর কাছে শোনাবেন হিন্দু ধর্মের ঐতিহাসিক প্রাচীনত্বের কথা। ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বমেলা। ১৯০০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ১২ নভেম্বর। আর কয়েক মাস আছে। এখন ১৮৯৯ সালের নভেম্বর মাস। ‘ধর্মীয় ইতিহাস কংগ্রেস’-এ স্বামীজি অন্যতম বক্তা হিসেবে নিমন্ত্রিত। আবার আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনেই হবে ‘ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ফিজিসিস্ট’। পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের মহামিলনক্ষেত্র হতে চলেছে। সেখানে ভারত থেকে প্রতিনিধিত্ব করার কথা প্রিয় বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুর। ভারতের ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিরা চাইছেন না জগদীশচন্দ্র ফ্রান্সের কংগ্রেসে যোগ দিক। সে এক চরম সংগ্রাম ও ধৈর্যের পরীক্ষা জগদীশচন্দ্রের কাছে। ছোটলাট উডবার্নকে গভর্নর পাঠায় জগদীশচন্দ্রের গবেষণাগারে গবেষণা পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট পাঠাতে। এদিকে কলেজের প্রিন্সিপাল ও ডিরেক্টর ছুটির প্রশ্নে আপত্তি তুললেন। জগদীশচন্দ্র অতদিন ছুটি নিয়ে বিদেশে গেলে নাকি কলেজের ক্ষতি হবে! শেষ পর্যন্ত নানা ইন্টারভিউ, নানা রিপোর্ট ও পাল্টা-রিপোর্টে ধ্বস্ত জগদীশচন্দ্র প্যারিস কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার ছাড়পত্র পেলেন। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন। সেই উচ্ছ্বাস দেখা যায় নিবেদিতার প্রিয় ‘গ্র্যানি’ ওলি বুলকে লেখা ১৩ মে ১৯০০ তারিখের চিঠিতে — Oh how pleased I am about Boses! I felt sure they would come. (Letters; page- 345)

ধর্ম ও বিজ্ঞানের এই যুগল প্রতিভার বিকাশ বিশ্ববাসীর কাছে মেলে ধরবেন দু’জন ভারতীয়। তাঁদের প্রতিভার স্ফুরণ দেখতে চান নিবেদিতা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দু’টি পুরুষের সংগ্রামের বিশ্বজয় দেখতে চান নিবেদিতা। ব্রিটিশদের চোখে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি দেশ ভারতের জয় দেখতে চান নিবেদিতা। বিশ্বের প্রতিভাধরদের মিলনক্ষেত্রে ভারতবাসীদের প্রতি বিদেশিদের অবজ্ঞার বিরুদ্ধে একটা হুঙ্কার শুনতে চান। এই চাহিদাটি কি তাঁর আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যের ধারা, যা তাঁর রক্তের মধ্যে প্রবাহিত! স্বাধীনচেতা, ক্ষত্রিয়াণী নিবেদিতা।
সারাদিন নিবেদিতা ছুটে বেড়াচ্ছেন। বক্তৃতা দিচ্ছেন। বলছেন ভারতের কথা। বলছেন হিন্দু ধর্মের কথা। বলছেন তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা। বলছেন বাংলার নারীদের কথা, নারী শিক্ষার কথা। ছোট ছোট দল গঠনের চেষ্টা করছেন। কিছুতেই হচ্ছে না। ব্যর্থ হচ্ছেন। ক্লান্ত হচ্ছেন। তাঁর স্কুলের জন্য তো বটেই, মঠ পরিকল্পনায়ও কোনও আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি নেই। নানান ধরনের প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠে আসছে যেখানে যাদের বলছেন তাদের মধ্য থেকেই। এমনকি তাঁর পোশাক ও জীবনযাত্রা নিয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্ন করতেও আটকাচ্ছে না। নিবেদিতা ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে চলেছেন। শেষে ব্যক্তিগত বিষয়গুলি বাদ দিয়ে ভারতবর্ষ, দেশ, জাতি, ধর্ম, সেখানে বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্য, নারীশিক্ষা কাদের জন্য ও কেন, তাদের শিক্ষণীয় বিষয়, ইত্যাদি ইত্যাদি সমস্ত রকম সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর এক জায়গায় লিখে একটি পুস্তিকা ছাপিয়ে বিলি করতে শুরু করলেন তিনি। কাজ সহজ হল অনেক। শিকাগোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্কুল, বাড়িতে, পার্কে, চেনা-অচেনা সব জায়গায় একটু সুযোগ বা ডাক পেলেই নিবেদিতা দৌড়ে গেছেন বক্তৃতা দিতে। শিকাগো, নিউইয়র্ক, বস্টন, কেম্ব্রিজ, ডেট্রয়েট — ছোট ছোট দল তৈরি করলেন। ‘রামকৃষ্ণ সাহায্য মণ্ডলী’ নামকরণ হল। প্রতি কেন্দ্র একজন করে সম্পাদিকার দায়িত্বে থাকল। যেমন, নিউইয়র্কের সম্পাদিকা হলেন মিস জোসেফাইন ম্যাকলয়েড, ডেট্রয়েটের সম্পাদিকা হলেন ক্রিস্টিন গ্রীনস্টাইডেল। ক্লান্তি ও অবসাদ ঘিরে ধরছে মাঝে মাঝে। ধকল যাচ্ছে শারীরিক ও মানসিক। সংঘাতে সংঘর্ষে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন। সেই সময় স্বামীজির চিঠি এল — ‘আদরিণী নিবেদিতা, প্রাণ ঢেলে আশীর্বাদ করছি তোমায়। কোনও মতেই ভেঙে পোড়ো না। তোমার শিরায় ক্ষত্রিয়ের রক্ত। আমাদের এই গেরুয়া হল কুরুক্ষেত্রে মরণের সাজ। আমাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যসাধনের জন্য প্রাণপাত, সাফল্য অর্জন নয়।’

বাগবাজার থেকে বেলুড় মঠ। নৌকায় কতটুকু আর পথ! কতদিন এই পথে যাতায়াত করেছেন নিবেদিতা। এই নৌকায় যাওয়া-আসা করাটা ভীষণ পছন্দের তাঁর। ধীরে একা ভেসে ভেসে চলা। একদম নিজের মতো করে। আপনি আপন চিন্তায় বিভোর হয়ে চলা। কিন্তু আজ যেন সেই পথটুকু অনিঃশেষ ভেসে চলা। কত কত ঘটনা। কত কত কথা। কত কত যন্ত্রণা ও জয়ের আখ্যান আজ ছেঁড়া তুলোর মতো ভেসে ভেসে আসছে। স্বামীজির সঙ্গে বিদেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যেমন অনির্বচনীয় তেমনই যন্ত্রণাবিদ্ধ বিদেশ যাপন। মাঝে মধ্যে স্বামীজির সান্নিধ্যে থাকতে পারলেও নিবেদিতা বেশিরভাগ সময় ইংল্যান্ড ও আমেরিকা চষে বেড়িয়েছেন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে একা। স্বামীজিও নিজের মতো চলেছেন। চিঠিপত্রে যোগাযোগ হয়েছে। আবার মিলেছেন কখনও নিউইয়র্কে বা কখনও ইংল্যান্ডের প্রিয় বন্ধুদের বাড়ি। সে সাক্ষাৎ যে খুব মধুর হয়েছে তা সবসময় নয়। দু’জনেই স্বাধীন হতে চাইছেন, চাইছেন মুক্তি আর ততোধিক বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থ সংকট, আশানুরূপ সাড়া না পাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি এবং স্বামীজির দুর্বল স্বাস্থ্য, সবকিছু নিয়ে এক সংঘাতপূর্ণ ভালবাসার পথে হাঁটছিলেন নিবেদিতা। শারীরিক ও মানসিক ধকলে ক্লান্ত। প্যারিস কংগ্রেসের আগেই নিবেদিতা ঠিক করে ফেলেন ভারতে ফিরে আসবেন। স্বামীজি ফিরবেন প্যারিস কংগ্রেসের বক্তৃতা দেওয়ার পরে। তাকিয়ে থাকেন নিবেদিতা বয়ে যাওয়া গঙ্গার দিকে। মনে আসছে সেই সব সংগ্রামের দিনগুলি। মিস সারা বুল, লেগেট, ম্যাকলয়েড সবাই নিবেদিতাকে বোঝায় প্যারিস কংগ্রেসের মতো এত বড় সম্মেলনে তাঁর থাকা উচিত। মেলার সেমিনার সংক্রান্ত বিষয়গুলির কো-অর্ডিনেটর প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী প্যাট্রিক গেডেস যখন তাঁর সেক্রেটারি হিসেবে এই মহা সম্মেলনে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁকে। সেই সুযোগ ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। উপরন্তু স্বামীজির অংশগ্রহণ ও বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষেত্রে খানিকটা সুবিধা হবে নিবেদিতা থাকলে। প্রচারের সুবিধা হবে। স্বামীজি ফরাসি শিখে ফেলেছেন ফরাসি ভাষায় বক্তৃতা দেবেন বলে। নিবেদিতা ভেসে চলেছেন নৌকায়। ওই দূরে গঙ্গার কূলে তাঁর পিতা চিরনিদ্রায়।

প্যাট্রিক গেডেস

নিবেদিতা ১৮ জুন নিউইয়র্কের পাততাড়ি গুটিয়ে তাঁর ব্যাগপত্তর নিয়ে চলে আসেন প্যারিসে সোজা বিজ্ঞানী প্যাট্রিক গেডেসের বাড়িতে। সেই পরিচিত গেডেসের ঝাঁটার কাঠির মতো লম্বা লম্বা দাড়ি-গোঁফ। লম্বাটে রোগা মুখের কাঠামোর উপরে আলুথালু চুল আর তীক্ষ্ণ চোখ। জুন মাসের মনোরম আবহাওয়ায় নিবেদিতাকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত গেডেস দম্পতি। মি. গেডেস জানেন নিবেদিতার লেখালেখির দক্ষতা। মূলত বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণা-পত্রগুলির সংক্ষিপ্তসার করাই কাজ নিবেদিতার। তার সঙ্গে এই বিশ্বমেলার যাবতীয় বক্তৃতার সারসংক্ষেপ তৈরি করা। মিসেস গেডেস খুব যত্ন করে নিবেদিতাকে নিয়ে গেলেন চিলেকোঠার নিরিবিলি সাজানো ছোট্ট ঘরে। এখানেই নিবেদিতার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কাজের মানুষ মিস্টার গেডেস। দ্রুত কাজ নিয়ে বসে পড়লেন নিবেদিতাকে বোঝাতে।
‘তুমি কি এটা পারবে মিস নোবেল?’
‘মিস্টার গেডেস, আমি এখনও শুরুই করিনি কাজ!’
‘না, আমি জিজ্ঞেস করছি কারণ এই ধরনের কাজ তো তুমি করোনি, তাই!’
কাজের চাপ যত বাড়ছে, গেডেসের সঙ্গে নিবেদিতার মতবিরোধ তত বাড়ছে। নিবেদিতার স্বকীয়তার ছাপ থাকছে লেখাগুলির নির্মাণ ও সম্পাদনায়। আর গেডেসের বিরক্তি সেই কারণেই। সব বিষয়ে গেডেসের খিটখিটে মেজাজ। তাঁর মতানুযায়ী নিবেদিতাকে হুবহু নকলনবিশ হতে হবে। এভাবেই দু’জনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে নিবেদিতা কাজ করে চলেছেন সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত।
চিলেকোঠার ছোট্ট জানালা দিয়ে জুন-জুলাই মাসের রোদ যখন এসে পড়ার টেবিলে পড়ে তখন নিবেদিতার একটু ফুরসত হয় চিঠি লেখার।
তাঁর প্রিয় জোসেফাইন ম্যাকলয়েডকে লেখেন। জানান ৬৫০০ ডলার সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত টাকার ব্যবস্থাপনার কথা।
“Swami says that the interest on the present sum of $6500 will give me in Calcutta a monthly income of at least 50 Rs. and that that, with what I may gain in the next few months will be enough to begin enough. So he wants me to leave for Calcutta next January or Feb.!! Is’nt that joyful?”
গরম কফির কাপে চুমুক দিলেন একবার। সামনের রাস্তায় চিনার গাছের ফাঁক দিয়ে রোদের রেখা নেমেছে রাস্তায়। বিদেশে এসেছিলেন যে কাজের উদ্দেশ্যে তার কিছুটা সফল হয়েছে। সামনে আরেকটি কাজ। চিঠি দ্রুত শেষ করেন। নীচে মিসেস গেডেস ব্রেকফাস্ট টেবিল সাজাচ্ছেন — আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সত্যি বলতে কী, ওই ব্রেকফাস্ট টেবিল থেকেই গেডেস তাঁর কাজের ফিরিস্তি শুরু করে দেন। দ্রুত নীচে নামতে হবে।
নিবেদিতা চিঠিটি শেষ করেন স্বামীজির সংবাদ দিয়ে। দিচ্ছেন বোস দম্পতির খবর।
“Swami will follow to Paris I think as soon as he has been to Detroit, but I don’t know. I wonder if the Bose’s are yet in the West. You will know.”

গাছে গাছে রঙের উৎসব আজ। রঙিন হয়ে আছে চারপাশ। রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে আছে রঙিন চিনার। চিনার গাছের পাতায় পাতায় লাল রং ধরছে। সমাজবিজ্ঞানী প্যাট্রিক গেডেস তাঁর উস্কোখুস্কো চুল আর বড় বড় দাড়ি নিয়ে বেজায় ব্যস্ত পড়ার টেবিলে। রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, বিজ্ঞান এবং সর্বোপরি সমাজবিজ্ঞানী গেডেসের ‘রূপান্তরবাদ’ নিবেদিতাকে আগ্রহী করে তুলেছে মানুষটি সম্পর্কে। তবুও নিবেদিতার সঙ্গে খিটিমিটি লেগেই থাকে। নিবেদিতার কাজ ছিল, বিভিন্ন গবেষণা-পত্রের তালিকা বানানো, সূচীপত্র তৈরি করা, বক্তৃতার রিপোর্ট নেওয়া ও যথোপযুক্ত ভাষায় তা লেখা। আর একটা কাজ ছিল খুব আকর্ষণীয় — তিন মাসের মধ্যে একটি লাইব্রেরি তৈরি করা। নিবেদিতার মন সায় দেয় না শুধু রিপোর্টার হয়ে কাজকে সীমাবদ্ধ রাখতে। বিভিন্ন ভাষণের টুকরোগুলো নিজের মতো করে ‘মোজেইক’ বাঁধনে গড়ে তোলেন, কিন্তু তাতে চকচকে হয় বটে, কিন্তু নিবেদিতার মন সায় দেয় না। অতৃপ্তি তৈরি হয়। কিন্তু আজ খুব আনন্দের দিন তাঁর কাছে। ঘন ঘন তাকাচ্ছেন সামনে প্রশস্ত রাস্তার দিকে জানালা দিয়ে। অন্যমনস্ক আজ একটু।
ওদিকে রান্নাঘরে মিসেস গেডেস ব্যস্ত পরিচারিকার সঙ্গে। মাংসের চপ বা ওই জাতীয় কিছু ভাজার গন্ধ আসছে। বাইরে তাকালেন নিবেদিতা — কেউ কি আসছে এই পথে! প্যারিসের আকাশে যেন আজ রঙের মেলা বসেছে। সন্ধ্যা একটু নামতে দেরি আছে। গোধূলির আকাশ রঙিন হয়ে আছে। গেডেসের বাড়ির সামনের রাস্তাটা সোজা চলে গেছে। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা চিনার গাছের পাতায় পাতায় শেষ সূর্যের রং। রোঁয়া রোঁয়া গোল গোল ফলের গুচ্ছ। আর কিছুদিন বাদেই পেকে সোনালি রঙের হয়ে উঠবে। অপূর্ব সে দৃশ্য। ছড়িয়ে পড়বে বীজ পথে পথে। পথের ধারে ধারে রঙের বাহার। নিবেদিতা কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারবার তাকাচ্ছেন জানালায়। তাঁর প্রিয় বন্ধু এসেছেন এই হেমন্তের প্যারিসে।

আজ মনটা খুশিতে ভরে উঠেছে নিবেদিতার। স্তূপীকৃত বইপত্র, ফাইল ও কাগজপত্রময় ঘরের প্রতিটি কোণে কোণে আজ হেমন্তের ঝলমলে রং যেন। সে রঙের ছটা নিবেদিতার চোখের তারায় তারায়। অবলার হাত ধরে এনে বসালেন নিজের পাশের সোফায়।
‘বেয়ার্ন, তোমাদের নিশ্চয়ই শরীর ঠিক আছে! ঈশ্বরের অপার করুণা যে তোমাদের শেষ পর্যন্ত এখানে আসার অনুমতি তোমরা আদায় করে নিয়েছ!’ নিবেদিতা উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারছেন না।
অবলা শ্রান্ত ও শান্ত, ‘তা যা বলেছ! আমি তো একসময় ভেবেছিলাম হবে না আর প্যারিস কংগ্রেসে যোগ দেওয়া!’
‘আমি জানতাম বোস এই যুদ্ধে জিতবেই! আমি তো এই যুদ্ধের নাম দিয়েছি ‘বোস ওয়ার’!’
জগদীশচন্দ্র হেসে ওঠেন। হেসে ওঠেন গেডেস, হেসে ওঠেন অবলা, হেসে ওঠেন মিসেস গেডেস, হেসে ওঠে টেবিলের উপর স্তূপ করা কাগজপত্র, হেসে ওঠে বইয়ের সেল্ফ, হেসে ওঠে জানালা-দরজা, হেসে ওঠে কাচের শার্সি, হেসে ওঠে চিনার গাছের পাতা, হেসে ওঠে ফ্রান্সের আকাশ। আকাশে আকাশে বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের আকাশে আকাশে সে খবর ভেসে আসে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এক কবির লেখার টেবিলে।
‘আমি তোমার কলকাতায় ল্যাবরেটরির কথা, কলেজের ব্রিটিশ কলিগদের অসহযোগিতার কথা সবই বলেছি মি. গেডেসকে।’ নিবেদিতা উচ্ছল তাকায় জগদীশের চোখের দিকে।
‘সে কি! না না ওসব বিষয় অবান্তর!’

জগদীশচন্দ্র বসু


‘আসুন! আমরা সবাই মিলে একটু কফি পান করি!’ মিসেস গেডেস পরিচারিকার হাত থেকে নিয়ে এগিয়ে দিতে থাকেন সবাইকে। নিবেদিতা সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।
গেডেস একসময় উদ্ভিদবিদ্যার প্রফেসর ছিলেন। তারপর একাধারে তিনি জীববিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, ভূগোলবিদ এবং নগর পরিকল্পনাবিদ। জগদীশচন্দ্র ও গেডেসের মধ্যে আলোচনা শুরু হয় উত্তেজনায় উদ্ভিদের সাড়া দেওয়া নিয়ে।
‘তোমার পেপারের যে টাইটেল ঠিক করেছ তা পদার্থ বিজ্ঞানের সম্মেলনে বলাটা কতটা যৌক্তিক বলে তুমি মনে করো মিস্টার বোস?’ গেডেস ঝুঁকে পড়েন জগদীশের দিকে।
‘ আমার বিষয়, Response of Inorganic and Living Matter, যা আমি বলব বলেই ঠিক করেছি।’
‘হ্যাঁ, তার সিনপটিক আছে আমাদের কাছে, তাই তো মার্গট?’
নিবেদিতা ছোট্ট ঘাড় নেড়ে বলেন, ‘আছে।’
‘সেখানে আপনি বলছেন জীব ও জড় পদার্থের মধ্যে কোনও সীমারেখা নেই, রয়েছে অখণ্ড প্রাণের স্পন্দন!’ গেডেস একটু থামে।
‘একেবারেই মিস্টার গেডেস। কোথায় জড়-প্রকৃতির শেষ, আবার কোথায় জীব-ধর্মের শুরু — এ এক অখণ্ড জীবনচক্র। আমরা আমাদের মতো করে মনগড়া নানান সীমারেখা তৈরি করেছি জড় ও জীবের মধ্যে। যা দৃশ্য ব্যতিক্রমকে ব্যাখ্যা করে কিন্তু তার আপাত-ব্যতিক্রমকে সূচিত করে।’ নিবেদিতা লক্ষ করেন জগদীশচন্দ্রের চশমার ভেতরে উজ্জ্বল চোখদুটি ঝলসে উঠেছে।
‘তুমি কি পদার্থবিদ্যা ও জীববিজ্ঞানের ভেদরেখা মুছে দিতে চাইছ! আশা করি সম্পূর্ণ এক নতুন দিক উন্মোচন হবে তোমার গবেষণা-পত্রে।’ গেডেস সিগারে আগুন ধরিয়ে মস্ত এক টান দেন। জগদীশচন্দ্রের দিকে এগিয়ে দেন সিগারের কৌটো। জগদীশচন্দ্র সিগার ধরান ধীরে অতি যত্নে।
‘ধন্যবাদ গেডেস। এই জগৎ এক প্রাণের লীলা। সর্বত্র প্রাণের অস্তিত্ব। সেই প্রাণের স্পন্দন আমি দেখাব, দেখাব জড় ও জীব সর্বত্র আছে প্রাণধর্ম, যা সর্ববিরাজমান। জড় চৈতন্যময়, ধাতুর মধ্যে সেই একই চৈতন্য। সেই প্রাণের কম্পনরেখা সর্বক্ষেত্রে এক এবং অদ্বিতীয়।’ জগদীশচন্দ্র সিগারে এক লম্বা টান দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়লেন মুখ দিয়ে।
নিবেদিতা বলে উঠলেন, ‘amazing wonderful, ‘যদিদং কিঞ্চ জগৎ প্রাণ এজতি নিঃসৃত’, এ তো উপনিষদের কথা!’
জগদীশচন্দ্র তাকালেন নিবেদিতার দিকে। দু’জনের চোখের পর্দায় কি দুলে উঠল সৌম্য দর্শন ঢেউ খেলানো রেশম চুল-দাড়ির আড়ালে এক কবির মুখ?
‘মিস্টার বোস, আপনার বক্তব্যের দর্শনগত ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে অপরাপর বিজ্ঞানীরা, তৈরি থাকবেন। যদিও এই সুদূরপ্রসারী দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি আমার খুব পছন্দের।’ গেডেস খুব শান্ত ভাবে কথাগুলো বললেন।
‘ধন্যবাদ মিস্টার গেডেস। আজ আমাদের উঠতে হবে।’ জগদীশচন্দ্র সিগারের অবশিষ্ট অংশ অ্যাশট্রেতে গুঁজে উঠে দাঁড়ালেন।
অবলা মিসেস গেডেসের সঙ্গে করমর্দন করে বিদায় নিলেন।
‘গুড নাইট মিস্টার বোস, মার্গারেট তোমার পেপারের সংক্ষিপ্ত অংশ পাঠিয়ে দেবে তোমার কাছে সংশোধনের জন্য, যা আমাদের এই কংগ্রেসের জন্য প্রয়োজন।’ গেডেস পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন বাগানের শেষে বেড়ার গেটের কাছে। মিসেস গেডেস এলেন। এলেন নিবেদিতা। পথে নামলেন জগদীশচন্দ্র, অবলা। সঙ্গে নিবেদিতা।
‘একি, তুমি চললে যে!’
‘কতদিন একসঙ্গে আমরা হাঁটিনি ‘বো’! চলো হাঁটতে হাঁটতে তোমাদের সঙ্গে যাই। আজ আমার বড় আনন্দের দিন।’
‘স্বামীজি এসেছেন শুনেছি। কোথায় আছেন তিনি? কেমন আছেন?’ অবলা প্রশ্নটা করে নিবেদিতার দিকে তাকালেন।
‘তিনি প্যারিসে এসে উঠেছিলেন মিসেস লেগেটের বন্ধু জেরাল্ড নোবেলের বাড়ি। সেখান থেকে গেলেন মিসেস লেগেটের প্যালেসিয়াল বাড়িতে নিরিবিলি পরিবেশে থাকবেন বলে। সেখান লেখক, শিল্পী, দার্শনিক প্রমুখ বিদ্বৎসমাজের সমাবেশে স্বামীজি ভালই ছিলেন। বর্তমানে ফরাসি লেখক জুল বোয়ার সঙ্গে তাঁর ওখানে থাকেন। অস্থির হয়ে উঠেছেন ভারতবর্ষে ফেরার জন্য। আর এক আশ্চর্য পরম নির্ভার নির্লিপ্ততা তাঁকে আবিষ্ট করে রাখে।’ এক নিশ্বাসে অনেকটা কথা বলার পর নিবেদিতার সম্বিত ফিরে এল।
অবলা নিবেদিতার কাঁধে আলতো করে হাত রাখেন স্নেহে।
‘জানো, ইদানিং তিনি আমার কথার ঠিক মতো উত্তর দেন না! কেমন এড়িয়ে যান। মতামত জানান না নিজের। গেডেসের সঙ্গে আমার বনিবনা হচ্ছে না, সে ব্যাপারে বললাম। উনি নির্বাক। খালি বলছেন আমি স্বাধীন! বুঝতে পারি না বো! উনি কী চাইছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। এই দুর্বোধ্যতা অসহনীয় হয়ে উঠছে, আমাকে অসহায় করে তুলছে বো!’
চিনার গাছের পাতা মাড়িয়ে মাড়িয়ে মৃদু আলো-ছায়া পথে তিন বন্ধু হেঁটে চলেছে। প্রকৃতির নির্জনতা বোধহয় এমন করেই মনের সমস্ত আগল আলগা করে দেয় প্রিয় বন্ধুদের কাছে।

একের পর এক ছবির মতো মনে পড়ছে সব কথা। এই তো সেদিনের ঘটনা সব। নিবেদিতা তাঁর জীবন সমর্পণ করেছেন তাঁর পিতা তথা গুরুর পায়ে। তাঁর ইচ্ছাকে মান্যতা দিয়েই চলেছেন। আজ তিনি চিরজীবনের মতো মুক্তির আলোয় ভাসতে ভাসতে চলে গেলেন অমৃতলোকে। আর ভারতবর্ষ নামক জীবন্ত দেশের নাড়ির সঙ্গে তাঁকে বেঁধে দিয়ে গেলেন তিনি। কত রাগ অভিমান, কত অনুযোগ, অনুরোধ, সব…সব নামিয়ে রাখার আধার কোথায় আজ? বহন করার শক্তি?

চিঠিটা বারবার পড়ছেন নিবেদিতা। স্বামীজি পাঠিয়েছেন। স্বামীজি লিখেছেন এই চিঠি!
তিনি যেন কষ্ট না পান মা তুমি দেখো। চোখ ভিজে উঠছে। সামনে ঝাপসা অক্ষরগুলি।
“… তোমার পত্র পড়িয়া মনে হইল, তোমার ধারণা – তোমার নূতন বন্ধুদের প্রতি আমি ঈর্ষান্বিত। কিন্তু চিরদিনের মত জানিয়া রাখ, অন্য যে কোন দোষ আমার থাকুক, কিন্তু জন্ম হইতেই আমার ভিতর ঈর্ষা, লোভ বা কর্তৃত্বের ভাব নাই।…”
দীর্ঘ চিঠিটি নিবেদিতা বারবার পড়ছেন।
গাল বেয়ে নেমে আসছে জলের নদী। নদীটির নাম প্রেম। স্রোতের নাম যন্ত্রণা।

সহযোগিতার হাত বাড়াতে ওপরের ছবিতে ক্লিক করুন

[৮ পর্ব]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জানুয়ারি ২৫, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

3 2 ভোট
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য