মাত্র দেড় বছর হয়েছে ভারতে আসা। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে একটি অচেনা অজানা দেশের অজানা সম্পূর্ন ভিন্নতর মানুষজনের মধ্যে অবস্থান করে অজস্র ঘটনার স্রোতে ভাসমান নিবেদিতা। মাঝে মাঝে অত্যাশ্চর্যে তাকিয়ে থাকেন স্থির। তাকিয়ে থাকেন কিন্তু দেখা থেকে যায় বাকি। অসচ্ছ ঘটনা প্রবাহের মধ্যে জীবন তাঁর ভেসে চলেছে। ভারতবর্ষ। বাংলা। দেখা আর শেষ হয় না। যে কয়েকজন মানুষের সান্নিধ্য তাঁর কাছে বন্ধুত্বের সংজ্ঞাকে নতুন রূপে উপস্থিত করেছে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এক টান অনুভব করেন খুব গভীর থেকে।
মাঝি টেনে যাচ্ছে দাঁড়। নিঃস্তব্ধ গঙ্গার বুকে দাঁড়ের শব্দ ছপ্ ছপ্ ছপ্। আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। হাওয়া শব্দহীন। কোনো সংবাদ কোনো গল্পকথা বয়ে বেড়াচ্ছে না এইখানে। যাঁর হাত ধরে এই সুমহান ঐতিহ্যশালী এক দেশে এসেছিলেন তিনি শুয়ে আছেন চিরঘুমে। নৌকায় যোগিনের মা অনেকক্ষন অস্ফুট কান্নার পর এখন চুপ। স্থির। সঙ্গী তরুণ সন্ন্যাসী মাথা নিচু করে বসে আছেন। বেলুড় ও আশপাশে শোকের ছায়া। শোক প্রকাশ কি প্রসন্নতা আনে! শোক কি স্মৃতিবাহক এক নিরাময়! জলের স্রোতের মতো স্মৃতির চিত্ররেখায় হারিয়ে যাচ্ছেন নিবেদিতা।

বোসপাড়া লেন বাগবাজার,

কলকাতা শুক্রবার,

১৬ জুন,১৮৯৯

প্রিয় মি. টেগোর‌‌,
আপনি বোধ হয় অনেক আগেই শুনিয়াছেন যে, এই গ্রীষ্মে আমাকে ইংল্যান্ডে যাইতে হইতেছে। এবং সে-কারণে এতদিন সাগ্রহে অপেক্ষা করিয়া থাকিয়াও আপনার নৌকাগৃহে আতিথ্যগ্রহণের অমন আকর্ষনীয় নিমন্ত্রন গ্রহণ করিতে পারিব না। আমি দু-এক দিনের মধ্যেই লিখিতাম যে, আপনি রাজি থাকিলে স্বামীজি রওনা হইলেই আমি মিসেস টেগোর ও আপনার কাছে পৌঁছিয়া যাইব। সেকথা লিখিবার পূর্বেই আমার যে এরূপ ভাগ্য-পরিবর্তন হইবে তাহা ধারণা করি নাই।
যত অল্পদিনের জন্যই হউক, ভারত ছাড়িয়া এখন যাইতে আমি মোটেও আনন্দিত নই। পরিকল্পনা পরিবর্তনের ফলে আমার যেসব আক্ষেপ হইতেছে, তাহার মধ্যে আপনার সঙ্গে বিবিধ বিষয়ে দীর্ঘ তৃপ্তিদায়ক আলোচনা না করিতে পারাও অন্যতম…। ( নিবেদিতার চিঠিটি অনুবাদ করেছেন দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত।)
নিবেদিতা লিখে চলেছেন তাঁর প্রিয় বন্ধুকে অকপট।
“Besides, I really wanted to add a new friend to those with whom India has already blessed me, and you are so dear to my Dr.Bose, that I could not help hoping you should be my friend too!
নিবেদিতা ভাবেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে এই চিঠি পৌঁছানোটা জরুরি। অবলা প্রথম বলেছিলেন, শিলাইদহে কবির কুঠিবাড়ি আছে। আর সীমাহীন জল থৈ থৈ পদ্মার বুকে ভাসমান পদ্মাবোটে দিন যাপন এক অনন্য অভিজ্ঞতা। ড. বোস তারপর বললেন পদ্মাবোটে থাকার কথা। সর্বসময় সুন্দর নদীর হাওয়ায় হাওয়ায় কবির স্বকন্ঠে গান, গানের সুর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কবির ছেলে রথীনের সাথে জগদীশচন্দ্র বিস্তৃত বালিময় এই নদীর তীরে বালি খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনেন কাছিমের ডিম। এইসব গল্পকথা শুনেছেন নিবেদিতা। তার উপরে কবির নিমন্ত্রন। স্বামীজির বিদেশে যাবার অবসরে নিবেদিতা ঠিক করেছিলেন যে শিলাইদহে কবির সাথে কাটাবেন কয়েকটি দিন। আলোচনা হবে উপনিষদ থেকে ভারতীয় দর্শণ, শুনবেন ব্রহ্মসংগীত সমেত নানান গান, কবিতা। এক পরম বিশ্রাম চাইছিলেন নিবেদিতা। চিঠিটি শেষ করেন দ্রুত। ভ্যাপসা গুমোট গরম। সদ্য পোশাক পরিবর্তন করে এসেছেন। তাও ঘামে ভিজে গেছে। কিন্তু দ্রুত শেষ করতে হবে চিঠিটা। পৌঁছে দিতে হবে কবির কাছে।
“But I hope that the greatest ends may be better served by my going than by my staying – and if that is so I know that you will feel with me that personal considerations simply do not count.
My Au Revoir includes a great many wishes for your good health and happiness until we meet again. Please give my kind regards and respects to Mrs. Tagore and my love to your charming children.
And believe me dear Mr. Tagore.
Sincerely Yours,
Nibedita

চিঠিটি লেখা শেষ করে তাকিয়ে রইলেন নিবেদিতা জানালা দিয়ে বাইরে। পায়রার বকবকম্ এতক্ষণে যেন কানে এল। নারকেল গাছের পাতায় হাওয়ার সরসর শব্দ যেন এইমাত্র শুরু হল। এইমাত্র যেন চারপাশ জেগে উঠল। যতক্ষণ চিঠি লিখছিলেন ততক্ষণ কিছু ছিল না চারপাশে। শুধু তিনি আর কাগজ ও কলমের সরণে কিছু অক্ষরমালা। চিঠিটি লেখা শেষ হতেই এই ঘর, দেওয়াল, জানালা, দরজা নিয়ে বাগবাজারের এই গলি জেগে উঠল ধীরে ধীরে। বিকালের উনুনে আঁচ দিয়েছে অনেক বাড়িতে। ধোঁয়ার গন্ধ আসছে। গলি দিয়ে হেঁকে চলে যায় নানান ফেরিওয়ালা। বিশ্বাস করুন কবি – And believe me dear Mr. Tagore.

‘স্বামীজি মঠ যে ফাঁকা হয়ে গেল!’ ডুকরে উঠলেন নিবেদিতা। মঠে তরুণ সন্ন্যাসীদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না ইদানিং। মঠ কেমন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ‘অল্পবয়সীদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা কষ্ট সহ্য করতে পারবে না। পোক্ত হয়ে ওঠেনি।’ স্বামীজি গম্ভীর। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ‘মঠের ভান্ডার খালি মার্গট। সন্ন্যাসীরা ভিক্ষায় বেরিয়েছেন বিভিন্ন জায়গায়। সঞ্চয় যা ছিল সব শেষ। এখন একমাত্র উপায় যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ভারতের জন্য কাজ করা। অর্থ সংগ্রহ।’ নিবেদিতা চুপ। বসে থাকেন। খুব হতাশ লাগে। বেশ কিছুদিন যাবৎ মনে হচ্ছে কোথাও কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। একে তো অসম্ভব গরমে নেতিয়ে পড়ছে শরীর ও মন। অত্যধিক গরমে মানসিক অবসাদ আসতে বাধ্য। আসলেই। শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে ঘাম হয়ে বেরিয়ে আসে যেন! ‘আমি কী চেষ্টা করতে পারি স্বামী!’ নিবেদিতা খুব ধীরে দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করলেন। ‘আমাদের আর টাকা নেই, টাকা পাবার আশাও নেই। মার্গট, সব ভেঙ্গে পড়বার আগেই আমাদের সংস্রব ত্যাগ করো। তুমিও চলে যাও।’ ‘আপনার ডাকে আমি এসেছি। আপনি যদি বলেন আমি চলে যাবো, কিন্তু স্বামীজি, আমি কি অযোগ্যতার কোনো রকম পরিচয় দিয়েছি?’ ‘না মার্গট, তুমি তোমার কাজ ভালোই করেছ। যোগ্যতার সাথেই করেছ। আমরাই পারলাম না। কৃচ্ছসাধন করেও সম্ভব নয়। কষ্ট করেছি আমরা অনেক। পারলাম না।’ ‘স্বামীজি একটা প্রশ্ন মনে উদয় হয়েছে। বলব?’

‘বলো! নির্দ্বিধায় বলো।’
‘স্বামীজি আপনি অপারগ হতে পারেন, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের কি পরাজয় হতে পারে কখনও!’
‘এভাবে আমি তাঁকে দেখি না। দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে তাঁকে দেখেছি আর দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। কিন্তু আর্থিক অসহায়ত্বের কাছে হার মানতে মন চাইছে না মার্গট।’
‘স্বামীজি, আমার ছ’শো কুড়ি টাকা জমানো আছে, ওটা আমি খরচের কথা ভাবিনি এতদিন। মনে হয়, কাজ করবার যথেষ্ট সামর্থ্য আমাদের আছে। না হয় একসাথে সবাই ডুবব। আপনি যে ভাবেন মাথা উঁচু রেখে বাঁচতে হবে, এ তো লোক দেখানো ব্যাপার। আমাদের লোক দেখানোর কিছু নেই। আমার কী করে চলবে মোটেই ভাববেন না, স্বামীজি। আমার যা আছে তাতে সেপ্টেম্বর অবধি আমায় চালাতে দিন। এমনভাবে কাজ করে যাব যেন ক্ষয়-ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা নেই। কেন জানি না, মনে হয় যা করছি ঠিক করছি, শাশ্বতকালের জন্য করছি।’ নিবেদিতা একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে পেরে যেন ভারমুক্ত হলেন।
‘মার্গট, আমার পূর্ণ আস্থা আছে তোমার কাজ ও তোমার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে। কিন্তু মঠ, সংগঠন এবং সমস্ত কাজগুলি একযোগে পরিচালিত করতে যে অর্থ দরকার তা এই দেশে ভিক্ষা করেও জুটবে বলে মনে হয় না। আমাদের বিদেশে যেতেই হবে। আমার শরীর ভালো নয়। সেটা নিয়ে তোমরা যথেষ্ট উদ্বেগে আছো জানি। কিন্তু শেষবারের জন্য বিদেশে যেতেই হবে। আমি স্থির করেছি, তুমি আর তুরিয়ানন্দ আমার সঙ্গী হবে। তৈরি হও।’ স্বামীজি উঠলেন। ঘামে ভিজে গেছেন স্বামীজি। কপাল থেকে গাল,গাল থেকে থুতনিতে ঘামের বিন্দু ফোঁটা মুক্তোদানার মতো ঝুলছে। গলায় জড়ানো গেরুয়া উত্তরীয় দিয়ে মুছে নিলেন। নিবেদিতা তালপাতার পাখা হাতে নিয়ে হাওয়া দিতে থাকেন। অসম্ভব গরম। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। শেষ বিকেলের ম্লান আলো জানালা দিয়ে স্বামীজির মুখে এসে পড়েছে। ক্লান্ত লাগছে স্বামীজিকে। নিবেদিতা স্বামীজির সাথে বেরিয়ে এলেন বাড়ির বাইরে। বোস পাড়া লেনের আশেপাশের বাড়ির বৌ-ঝিরা একগলা ঘোমটা দিয়ে এসে স্বামীজির পা-ছুঁয়ে প্রণাম করে গেলেন। স্বামীজি প্রতি নমস্কার করে আশীর্বাদ করলেন। কেউ কেউ ফল-মিস্টি নিবেদন করলেন। সন্তোষিনী সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি তুলে গুছিয়ে দিলেন। নিবেদিতা পায়ে পায়ে এগিয়ে দিতে গেলেন বাগবাজারের ঘাটের দিকে। নৌকায় উঠলেন স্বামীজি। নিবেদিতা নৌকায় তুলে দিলেন ফল-মিস্টি। মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল। লগি ঠেলে ঠেলে, লগি ঠেলে ঠেলে
স্বামীজিকে নিয়ে নৌকা এগিয়ে গেল তীর থেকে দূরে। নিবেদিতা তীরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ভারতে আসার পর যে দু-তিনজনকে বন্ধু হিসেবে কাছে পেয়েছেন নিবেদিতা বা বলা ভালো যাঁদের সান্নিধ্য পছন্দ হয়েছে তাঁর, তাঁদের মধ্যে অন্যতম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কন্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি, কথার গভীরতা, মনন, দর্শন, চিন্তার গভীরতা, গান, কবিতা সব সবকিছু নিয়ে তিনি বিরাজিত বৃক্ষের মতন। যেখানে দু’দন্ড বসে থাকা যায় শরণাগত হয়ে।
একদিকে নিবেদিতা ভারাক্রান্ত ‘crusade’ এর অভাবনীয় বিফল পরিণতি, এবং ‘make inroads into brahmos’ এর ব্যার্থ পরিসমাপ্তি নিয়ে। অপরদিকে মঠ পরিচালনায় নিদারুণ অর্থ সংকট। স্বামীজির শরীর ভালো নয়। সবকিছু নিয়েই দ্বন্দ্বদীর্ণ নিবেদিতা। তার সাথে যুক্ত হয়েছে মে মাসের চূড়ান্ত গরম। শ্রান্ত ও ক্লান্ত নিবেদিতা চেয়েছিলেন একটু বিশ্রাম। বন্ধু জগদীশচন্দ্রের কাছে শুনেছেন শিলাইদহের কথা। পদ্মাবোটে থাকার কথা। এপার ওপার দেখতে না পাওয়া বিশাল তরঙ্গায়িত পদ্মা নদীর কথা। অপূর্ব ছবির মতন গ্রামে ছবির মতন সুন্দর কুঠিবাড়ি। শুনেছেন আধুনিক কৃষিবিজ্ঞান অনুযায়ী চাষাবাদ শুরু করিয়েছেন কবি। সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদ। আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় কবি রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে নতুন নতুন লেখা গান শোনা। নতুন নতুন কবিতা পাঠ কবি কন্ঠে। আর পদ্মার উদ্দাম হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া দর্শণালোচনা। সমস্ত বিরোধাভাষ ও সংঘর্ষ স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে এক অখন্ড বিশ্বমানবতার পরমকে স্পর্শ করার অনুভূতি রবীন্দ্রনাথের মৃদু শান্ত উচ্চারণে উচ্চারণে। শান্ত হয় উৎকেন্দ্রিক হৃদয়। চেয়েছিলেন নিবেদিতা একটু প্রশান্তি। কিন্তু বিদেশে যেতেই হবে।
ঠিক হয়েছে আমেরিকা যাবেন স্বামীজি, নিবেদিতা এবং তুরিয়ানন্দজি।

কহিল কাঁসার ঘটি, খন খন স্বর,
‘কূপ, তুমি কেন, খুড়া, হলে না সাগর
তাহা হলে অসংকোচে মারিতাম ডুব,
জল খেয়ে লইতাম পেট ভরে খুব।’
কূপ কহে, ‘সত্য বটে ক্ষুদ্র আমি কূপ,
সেই দুঃখে চিরদিন করে আছি চুপ।‌‌‍
কিন্তু, বাপু, তার লাগি তুমি কেন ভাবো
যতবার ইচ্ছা যায় ততবার নামো;
তুমি যত নিতে পার সব যদি নাও
তবু আমি টিঁকে রব দিয়ে-থুয়ে তাও।

‘শেষ দু’টি লাইন আরেকবার পড়ুন দয়া করে!’ নিবেদিতা শিশুর মতন আনন্দিত।
রবীন্দ্রনাথ পান্ডুলিপির পাতা উল্টিয়ে আবার পড়লেন ‘শক্তির সীমা’ কবিতাটি। নিবেদিতা শেষ লাইন দু’টি আওড়ালেন –
‘তুমি যদি নিতে পার সব যদি নাও
তবু আমি টিঁকে রব দিয়ে-থুয়ে তাও।
অপূর্ব। সহজ অথচ কী গভীর কথা বলেছেন কবি! বই মুদ্রিত হবে কবে! দেখে মনে হচ্ছে পান্ডুলিপি তৈরি হয়ে গেছে।’
‘হ্যাঁ। পান্ডুলিপির কাজ শেষ। আশাকরি আগামী অগ্রাহয়ণ মাসে কবিতার বইটি প্রকাশ পাবে।’
রবীন্দ্রনাথ চোখ তুলে তাকালেন নিবেদিতার দিকে। আশ্চর্য এক সহজিয়া মননের ছোঁয়া দেখা যায় নিবেদিতার চোখে। সহজ কিন্তু দৃঢ়তার এক যুগলবন্দি সুর আছে নিবেদিতার উপস্থিতির ছন্দে। ব্যাক্তিত্বে যেমন আছে সহজ অর্থাৎ সঙ্গ করার সুর তেমনই একই সাথে আছে বাধার কাঠিন্য। এই গভীর, সহজ, ব্যাক্তিত্বের গভীরে যে যোদ্ধৃত্ত আছে তার আকর্ষণে বারবার আসতে হয়।


রবীন্দ্রনাথ এসেছেন। নিবেদিতা চেয়েছিলেন সান্নিধ্য। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভেতরে এক শান্তিময় ছায়া ছায়া বৃক্ষতলে ক্ষণিক অবগাহন চেয়েছিলেন নিবেদিতা। বিশ্রাম দরকার বিক্ষুব্ধ তার এই সময়ে।
‘থামলেন কেন কবি! বিঘ্ন ঘটছে কিছু? ছোট ছোট কবিতাগুলো আমাদের নিত্যদিনের বিষয় নিয়ে অনিত্য সত্যের কথা বলে চলেছে। পড়ুন।’ নিবেদিতা নিজের হাতের তালুতে থুতনি রেখে বসে থাকলেন।
‘ভালো লাগছে জেনে প্রীত বোধ করলেম। আর একটি শুনিয়ে ক্ষান্ত হবো। অধিকন্তু পীড়িত করে কোনো কোনো সময়ে!’ রবীন্দ্রনাথ লাল-মাটি রঙের জোব্বাখানি গুছিয়ে বসলেন। সাদা নকশা পাড়ের উত্তরীয় একটু টেনেটুনে গুছিয়ে নিলেন। বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের তাপ কমে এলেও গরম ভাবটি রয়েছে ঠিক। আলো এসে জানালা দিয়ে তির্যক পড়েছে তাঁর ঢেউ খেলানো চুলে। রবীন্দ্রনাথ পড়া শুরু করলেন। নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন তাঁর প্রিয় বন্ধুটির দিকে। কোথায় যেন একটা বাধা আছে খুব ভেতরে। সে কি ধর্ম-বিরোধ! দু’জনেই উপনিষদ অনুসারী পথে চলা মানুষ। অথচ সামান্তরাল পথ। সমদূরত্বে চলেছেন। মাঝখানে নিবেদিতা। ভারতের যা কিছু মহান, যা কিছু ভালো তা কি বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়া যায় না! দেখানো যায় না বিশ্ববাসীকে এইসব প্রতিভার স্ফুরণ! তাকিয়ে থাকেন নিবেদিতা। রবীন্দ্রনাথ আত্মস্থ তাঁর কণাসম ক্ষণিকের কবিতা পাঠে। ছোট ছোট কবিতা। মণিমুক্ত যেন!
‘মহাভারতের মধ্যে ঢুকেছেন কীট,
কেটেকুটে ফুঁড়েছেন এপিঠ-ওপিঠ।
পন্ডিত খুলিয়া দেখি হস্ত হানে শিরে,
বলে, ‘ওরে কীট, তুই এ কী করিলি রে!
তোর দন্তে শান দেয়, তোর পেট ভরে
হেন খাদ্য কত আছে ধূলির উপরে।’
কীট বলে, ‘হয়েছে কী! কেন এত রাগ।
ওর মধ্যে ছিল কী বা, শুধু কালো দাগ।’
নিবেদিতা পড়ার মাঝেই শিশুর মতন হেসে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের পড়ার ঢঙে, ‘ খুব সুন্দর! অবশ্যই কীটের কাছে ঐ লেখাগুলো তো কালো কালো দাগ ছাড়া কিছুই নয়! খুব সুন্দর! ইউ আর জিনিয়াস পোয়েট, ইউ আর আ জিনিয়াস!’
রবীন্দ্রনাথ থামলেন। গোঁফ দাড়ির ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ল মৃদ হাসি। শেষ করলেন কবিতাটি –
‘আমি যেটা না বুঝি সেটা জানি ছাড়,
আগাগোড়া কেটেকুটে করি ছাড়খাড়।’
নিবেদিতা হাততালি দিয়ে ওঠে, মারভেলাস মারভেলাস হোয়াট আ হিউমার!’
রবীন্দ্রনাথ মৃদু হাসলেন, ‘আসলে আমরা যা জানি না, যা বুঝি না তার গুরুত্ব দিই না, কীটের মতো কেটেকুটে ছাড়খাড় করে ফেলি অজান্তেই। কত কত দর্শণ, পথ এ’ভাবেই ছাড়খাড় হয়ে গেছে, হচ্ছেও!’
‘আজ আমার কোনো বিষয়ে তর্ক করতে ইচ্ছে করছে না কবি। তোমার শিলাইদহের পদ্মাবোটে তোমার সঙ্গে তর্ক করার মতন অনেক রসদ নিয়ে যাবো!’
‘সুস্বাগতম। আমি খুব শীঘ্রই শিলাইদহ যাবো। ওখানে কৃষকদের মধ্যে নতুন চাষ-পদ্ধতি শুরু হয়েছে। চেষ্টা চলছে সমবায় ব্যাঙ্ক গড়ে তোলার কাজ! এসো একদিন।’
‘যাবার খুব ইচ্ছা। হয়তো সুযোগ পাবো দ্রুত। তুমি সম্প্রতি যে গান লিখেছ তার থেকে যদি একটি শোনাও এখন।’
‘ আজ থাক অন্যদিন না হয়!’
‘একটি ছোট্ট কোনো গান! এই গোধূলির সময়টা আমার ঐশ্বরিক মনে হয় ভারতে আসার পর থেকে! চারিদিকে যেন সুরের ছ’টা!’ নিবেদিতা খোলা জানালায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
রবীন্দ্রনাথ গান ধরলেন খেয়াল অঙ্গের গান আশাবরী রাগের উপর লেখা –
বিমল আনন্দে জাগো রে
মগ্ন হও সুধাসাগরে।।
হৃদয়-উদয়াচলে দেখো রে চাহি
প্রথম পরম জ্যোতিরাগ রে ।।

গোধূলির রাঙা সূর্য যেমন ঢলে পড়ে সন্ধ্যার কোলে তেমনই রবীন্দ্রনাথ খুব শান্ত কন্ঠে গানটি শেষ করলেন। টানা টানা চোখের তারায় তারায় আশ্চর্য তন্দ্রাতুর ঘোর। নিবেদিতা তাকিয়ে আছেন। বিমল আনন্দে তিনি যেন জেগে উঠছেন। মগ্ন তিনি সুরসুধা সাগরে।
‘উপনিষদে যেন একই কথা আছে বলে মনে হচ্ছে!’ নিবেদিতা সঙ্কোচে প্রকাশ করলেন।
‘ঠিকই বলেছেন। আমাদের সমস্ত অন্তর-কথা উপনিষদ আহৃত। আমাদের বোধী উপনিষদ সিক্ত যদি গভীরভাবে ভাবা যায়।’
‘মগ্ন হও সুধাসাগরে বলছেন, তারমানে পরম ব্রহ্মে মগ্ন হতে বলছেন!’ নিবেদিতা অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকিয়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথের দিকে।
রবীন্দ্রনাথ তাকালেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘পরম ব্রহ্ম হলেন Author and Preserver of the Universe একম্।’
‘ধর্মের বিভিন্নতা আপনি স্বীকার করেন!’
‘ধর্ম আসলে একম্, অনুষ্ঠান বিচিত্র। শুধু বিচিত্র নয় অনুষ্ঠানের বিভিন্নতা সমগ্রের ঐক্য বিনষ্ট করে। মানব কল্যাণ পরিপন্থী বিভেদ তৈরি করে।’
‘আপনি বলছেন মানব ঐক্য বিনষ্টকারী শক্তি ধর্মানুষ্ঠানের বিভিন্নতা! আশ্চর্য! আমি এমন কথাই ভাবছিলাম কিছুদিন ধরেই। আপনাদের কালী সম্পর্কে বিরূপ ধারণা কী ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যের বিপরীতে অবস্থান করে না!’
‘ভারতবর্ষ সম্পর্কে আপনার আগ্রহ আমাকে বিস্মিত করে। ধর্ম এক কিন্তু অনুষ্ঠানের ভিন্নতা বা ধর্মাচারণের বিভিন্ন রূপকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে দেবমূর্তি, গুরুবাদ। মানুষের উপর দেবত্ব আরোপ করার প্রথা শুরু হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বিচিত্র রূপ ঘিরেই গড়ে ওঠে সম্প্রদায়। সম্প্রদায়ের গুরু। সম্প্রদায়-সম্প্রদায়ে সৃষ্টি হয় অনিবার্য পার্থক্য। পার্থক্য থেকে বিভেদ, দ্বন্দ্ব। দেবমূর্তি ও প্রতিক উপাসনা আসলে একেক সম্প্রদায়ের এক একটি বৈশিষ্ট্য মাত্র। চিহ্ন।’
‘কিন্তু প্রতিকহীন কিছু আকার কল্পনা করা কি সম্ভব যেখানে নিবেদন করা যায়। পুরাণে তো সেই প্রতিকের কথাই বিবৃত আছে!’
‘মানুষ প্রকৃতি পূজা থেকে নিরাকার নিবেদন থেকে প্রতিক পূজায় এসেছে। নিরাকার থেকে সাকার পূজার এই পথ দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে কন্টকাকীর্ণ। সুধা সাগরে মগ্ন হতে পারেনি। সম্প্রদায় সম্প্রদায়কে আঘাত করেছে বিনাশ সাধনের চেষ্টায়। এত রক্ত পাতে প্রেম বিসর্জিত হয়েছে মিস্ নোবেল।’
‘আপনি কত সুন্দর করে সবকিছু ব্যাখ্যা করেন কবি! তবুও আমার প্রতিকোপসনা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন আছে। কালী নিয়ে আমার ব্যাখ্যায় আমি অবিচল।’
ঠিক এই সময়ে নিচের সদর দরজার কড়া নাড়ে কেউ! ঠক্ ঠক্ ঠক্। নিবেদিতা উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে নিচে তাকান। সন্তোষিনীকে দেখা যায় উঠোন পেরিয়ে সদর দরজার দিকে যেতে। দরজা খুলেছে সন্তোষিনী। সাদা ধুতি ও চাদর পরে মঠের এক ব্রহ্মচারী এসেছেন। উপরে তাকালেন তিনি।
‘রবিবাবু, মঠ থেকে কোনো সংবাদ নিয়ে ব্রহ্মচারী এসেছেন। আমি এক্ষুনি আসছি। আপনি বসুন।’ নিবেদিতা দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে নিবেদিতা এলেন তাঁর ঘরে। রবীন্দ্রনাথ তখনও বসে।
‘ক্ষমা করবেন। স্বামী একটি খবর পাঠিয়েছেন।’ নিবেদিতা হাতে লেখা চিঠিটি যত্নে রাখলেন ডায়রির ভেতরে। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছেন নিবেদিতার মনযোগ বিঘ্নিত হয়েছে। তিনি এই ঘরে কবির সামনে শারীরিকভাবে থাকলেও মানসিক ভাবে রয়েছেন বেলুড় মঠে স্বামীজির কাছে। অস্থির হয়ে উঠেছেন বেশ। কথার সুর ও ছন্দে বিঘ্ন ঘটছে নিবেদিতার। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছেন নিবেদিতার স্বামীজির প্রতি নিবেদিত প্রাণ।
‘আমি আজ উঠি মিস্ নোবেল!’
‘চলুন। আমাকে এখনই যেতে হবে মঠে।’

‘মার্গট তুরিয়ানন্দের সঙ্গে আলাপ আছে?’ স্বামীজির আচমকা প্রশ্নে থতমত নিবেদিতা তাকালেন সন্ন্যাসীর দিকে। হয়তো দেখেছেন। কিন্তু তেমন আলাপ হয়েছে বলে মনে পড়ে না।

‘না। গুরুদেব!’
আমাদের সঙ্গে আমেরিকা যাচ্ছে। এতদিন বাইরের কাজ থেকে ও নিজেকে সরিয়ে রেখেছিল। ধ্যান ও যোগে দিন কাটাতেই ও পছন্দ করে বেশি। এইজন্যই ওকে নিয়ে যাচ্ছি। ও’দেশের লোকেদের ঢের বিদ্যে-বুদ্ধি! কঠোর বৈরাগ্যের আদর্শকে জীবনে ফলিয়েছেন, এমন একজন সাধু ওরা দেখতে চায়। তুরিয়ানন্দ সেক্ষেত্রে আদর্শ।’
নিবেদিতা নমস্কার করলেন সন্ন্যাসীকে হাত জোড় করে। সন্ন্যাসী ধীরে হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন নিবেদিতাকে।
‘সবাই ভাবছে বুঝলে এই যাওয়াই আমার শেষ যাওয়া। আর বেটা ফিরবে না। সবার চোখে মুখে আমি এই একটাই কথা আমি দেখতে পাচ্ছি!’ বিবেকানন্দ বলতে বলতে হাসছেন।
‘আরে বাবা রামকৃষ্ণ যখন মৃত্যুশয্যায়, সময় হয়ে এসেছে ব্রহ্মাকাশে লীন হয়ে যাবার। বসে আছি পা ধরে। ধীরে তাকালেন। ঠোঁট দুটি নড়ে উঠল। কানটা নিয়ে গেলাম মুখের কাছে। কী যেন বলতে চাইছেন! স্পষ্ট শুনতে পেলাম। কী বললেন জানো!’ বিবেকানন্দের চোখে এক ধরণের দুষ্টুমি ঝলকে ওঠে। মুখে মৃদু হাসি।
‘কী বললেন! খুব আগ্রহ হচ্ছে শোনার!’ নিবেদিতা উদগ্রীব।
‘বললেন, আমি নিজে এসে তোকে বলব, বাবা এবার তোর কাজ শেষ হয়েছে, তোর জন্য যে আমটি রেখেছি সেটি খাবি আয়!’ বলেই স্বামীজি হো হো করে হেসে উঠলেন।
নিবেদিতা মাথা নিচু করে বসে আছেন। ভালো লাগছে না তাঁর এইসব হেঁয়ালি। মনে মনে বলেন, মা গো, সত্যি যদি ওঁর চিরশান্তির দিন এসেই থাকে কাছে তবে যাবার আগে ওঁকে স্বস্তি দাও, বিশ্রাম দাও। যে কষ্ট ওঁকে দিতে চাও আমায় দাও মা…’।
‘মার্গট’।
বিবেকানন্দের ডাকে তাকালেন। সংযত করলেন নিজেকে।
‘মার্গট, আজ খুব ভারমুক্ত লাগছে। আজ আমি মুক্ত, অনেকটাই প্রথমদিন যেদিন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এসেছিলাম তেমনই মুক্ত আমি। মঠের সমস্ত দায়িত্ব আমি বুঝিয়ে দিয়েছি। এখন আমি ভিক্ষা পাত্র নিয়ে গাছতলায়ও বসতে পারি।’
নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন শিশুর মতো মুক্তির আনন্দে মাতোয়ারা স্বামীর দিকে। কয়েকদিন ধরেই স্বামীজি মঠের সব দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। মঠ পরিচালনায় তাঁর আর আগ্রহ নেই। নেই আসক্তি। তিনি হালকা বোধ করছেন। চোখে মুখে প্রসন্নতা।
‘আমাদের অনেকটা যেতে হবে।
আমাদের অনেকটা যেতে হবে।
এবার আমরা যাবো, এবার আমরা যাবো।’ বলতে বলতে ধ্যানমগ্ন হলেন স্বামীজি। চারিদিকে আশ্চর্য নরম রোদের খেলা। গাছে গাছে গোধূলির আলপনা। গঙ্গায় ছড়িয়ে আছে লাল। আকাশ রক্তাভ। কিছুক্ষণ সব স্তব্ধ হয়ে আছে যেন। নিবেদিতা চোখ বুজলেন – ঠাকুর, যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন আর এদেশে থাকবেন, আমি তাঁকে ছেড়ে দূরে যেতে পারব না। তিনি যে আমার ঠাকুর, আমি যে তাঁকে ভালোবাসি। আমাকে তাঁর দরকার অথচ আমি তাঁর কাছে থাকব না – এত বড় ঝুঁকি আমি নিতে পারব না।’
আজ নিবেদিতার একাদশী। সারাদিন উপোস করেছেন। সাদা গাউন পরেছেন। রুদ্রাক্ষের মালা তো আছেই। বাড়িতে লাল পাড় সাদা শাড়ি পরেছিলেন। এখানে আসবেন বলেই গাউন পরে নিয়েছেন। বাইরে গাউন পরেন। কমলা হলুদ রঙের গাউন বা সাদা। এই গাউন পরা নিয়েও কী কম কথা হয়েছে! মহিলারা পছন্দ করেননি।
ধ্যান ভাঙল বিবেকানন্দের। চোখ মেলে তাকালেন। ব্রহ্মচারীরা প্রণাম করল একে একে। সবাইকে আশীর্বাদ করার সাথে সাথে তাদের কাজের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। সদানন্দ আর মোহিনীবাবু এসেছেন। এক তরুণ সন্ন্যাসী ট্রে করে চা এনে রাখলেন সামনে। সবাই চা গ্রহণ করল। সবাই চুপ। এমনিতেই স্বামীজি বিদেশে যাবার কথায় সবাই শঙ্কিত।
ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে গেল পশ্চিমে। আশ্চর্য নরম আলোর আভায় স্বামীজিকে ঈশ্বরের মতন লাগছে। নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন। মন্দিরে মন্দিরে শঙ্খধ্বনি শুরু হয়ে গেল। বিবেকানন্দ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন মন্দিরের দিকে। নিবেদিতা, সদানন্দ আর মোহিনীবাবু ফিরে আসছেন নৌকায়। কাস্তের মতো চাঁদ উঠেছে আকাশে। চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। সন্ধ্যা নেমেছে। শিয়াল ডাকছে। নৌকায় হারিকেনের আলো। মোহিনীবাবু একটি পাকা আম নিবেদিতার দিকে বাড়িয়ে দিলেন, ‘আপনি আমি পছন্দ করেন, আর সারাদিন তেমন কিছু খাওয়া হয়নি তো আপনার!’ নিবেদিতা ধন্যবাদ বলে আমটি হাতে নেন। মোহিনীবাবু বিবেকানন্দকে ভালোবাসেন আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। নিবেদিতার স্কুল চালানোর ক্ষেত্রে অনেক সময় আর্থিক সহায়তা করে থাকেন। ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত। ঠাকুরবাড়ির আত্মীয়জন। সজ্জন ভদ্রলোক। নিবেদিতা খুব সহজেই মিশতে পারেন মোহিনীবাবুর সাথে। মোহিনীবাবু তাঁর ক্যাম্বিসের ব্যাগ থেকে আরেকটি আম বার করে সদানন্দকে দিলেন। নিবেদিতা ও সদানন্দ আম খাওয়া শুরু করতেই নিবেদিতা নজর করলেন, ‘আপনার জন্য আম নেই মোহিনীবাবু!’ নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন মোহিনীবাবুর দিকে। মোহিনীবাবু মাথা নাড়েন, ‘না না আপনাদের জন্যই এনেছিলাম আর স্বামীজিকে কিছু দিয়ে এসেছি।’ গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় গঙ্গার মাঝখানে খুব সুন্দর হাওয়ায় নৌকায় ভেসে ভেসে চলতে খুব ভালো লাগে নিবেদিতার।
‘এই বছরে যেন গরম অত্যধিক!’ মোহিনীবাবু আলগোছে রূমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছলেন।
‘একটা জিনিস আমি বুঝতে পেরেছি যে, ভারতবর্ষের নৈরাশ্যমূলক মনোভাবের জন্য তার জলবায়ু অনেকাংশে দায়ী।’ নিবেদিতার গালে হারিকেনের আলো পিছলে যাচ্ছে ঘামে।
‘কেন এই কথা বলছেন!’ মোহিনীবাবু তাকিয়ে থাকেন উত্তরের জন্য।
‘গতকাল শুধু প্রচন্ড গরম ও শারীরিক অবসন্নতার জন্যই আমার যেন মরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল।’ মোহিনীবাবু চমকে ওঠেন, ‘গতকাল গরম অত্যধিক ছিল এ’কথা ঠিক। তবে এমন চিন্তা কখনও না করাই শ্রেয়। আপনার বিদ্যালয় কবে ছুটি দিচ্ছেন!’
নিবেদিতা মৃদু হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আগামী ১৬ মে থেকে ছুটি দেওয়া হবে। ভাবছি বিদ্যালয়ের অপেক্ষাকৃত বড় মেয়েদের কলকাতা মিউজিয়াম দেখাতে নিয়ে যাবো। এই পরিকল্পনা যদিও সদানন্দের মস্তিষ্কপ্রসূত।’
সদানন্দ হেসে মাথা নাড়ে, ‘না না তেমন কিছু নয়, একটু বেড়ানো হয় ওদের আর ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি দেখানো হয়।’
নিবেদিতা মোহিনীবাবুর দিকে তাকায়,’সরলা যাবে বলেছে সেদিন মিউজিয়ামে, আপনিও চলুন না!’

শেষ অবধি ৩ জুন রবিবার নিবেদিতা ও সদানন্দ দুটি ঘোড়ার গাড়ি করে বাগবাজার থেকে রওনা হলেন মিউজিয়ামের দিকে। সঙ্গে গুটি কয়েক ভিরু কাজল-কালো চোখ নিয়ে রোগারোগা মেয়ের দল শাড়ি পরে গুটিশুটি বসে আছে। তারা এতদিন বাগবাজারের নিজেদের বাড়ির বাইরে এখনও বেড় হয়নি। কলকাতা দেখছে অবাক বিস্ময়ে। ওদের সামলাতে নিবেদিতার’ঝি’ সন্তোষিনী ও তার মা ছিল সঙ্গে। মিঃ পার্কার, সংরক্ষণাগারের কর্তাব্যক্তি নিজে উপস্থিত ছিলেন। সরলা ঠিক সময়ে মিউজিয়ামে এসে হাজির। বেশ বড় টিম। খুব গরম হলেও মিউজিয়ামের চওড়া চওড়া দেওয়াল আর সুউচ্চ বড় বড় ঘরের ভেতর কিছুটা আরামদায়ক লাগছে নিবেদিতার। সরলার সঙ্গে ভারতীয় সুপ্রাচীন সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করতে করতে অতীতের অন্দরে চলেছেন নিবেদিতা।
এইসব কথা নিবেদিতা লিখে চলেছেন চিঠিতে চিঠিতে। লিখে চলেছেন বিদেশে যাবার আগে তার নানা অনুভূতির কথা। এ’কথা ঠিক যে, স্বামীজি বিদেশে যাবার কথা ঠিক করেছিলেন শেষ ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু শরীর খারাপ হবারই কারণে বারবার বিদেশ যাওয়া পিছোতে পিছোতে জুন মাসের মাঝ বরাবর। ২০ জুন যাবেন বিদেশে।
৭ জুন প্রিয় ম্যাকলয়েডকে লিখছেন – “On Sunday Sadananda and I took the big girls to the museum… Sarala met us there.” (Letters 7th June,1899) দুপুর একটার সময় শেষ হয় মিউজিয়াম দেখা। অসম্ভব গরমে মিসেস পার্কার সবার জন্য বরফ-জল, ডাব, আমি ইত্যাদি ব্যবস্থা করেন। ফিরে আসেন সবাই বিকেলে।
স্বামীজির সাথে সরলার সংঘাত ও বিরোধাভাষের পরেও নিবেদিতার সাথে সরলার সম্পর্কে তথা ঠাকুরবাড়ির সাথে সখ্যতায় কোনো শীতলতা দেখা যায়নি। যদিও তার কিছুদিন আগেই ২৪ মে সরলার সঙ্গে বেশ কিছু ঘন্টা কাটিয়েছেন নিবেদিতা। প্রায় সারাদিন কথা হয় দু’জনের মধ্যে।
“I spent several hours with her ( Sarala) yesterday. But she could not dream of going within a month or two of Swami. (Letters date, 21 May,1899)
‘তোমাকে দেখে আমি বিস্মিত হই নিবেদিতা। যদিও তোমার মাতৃভাষা বাংলা নয়। স্বামীজির কর্কশ কিছু অংশে কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ কথায় কথায় বেশ অস্বস্তি তৈরি করে। বিশেষ করে মহিলাদের কাছে তো বটেই!’ ( “Swami’s Bengali is the language of ‘loose set’, vulgar and so on.”)
‘কি বলছ তুমি সরলা!’
‘শুধু আমি নয়। শিক্ষিত জন এই বিষয়ে একই অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে, বিশেষ করে মহিলারা।’ সরলা বেশ জোরের সঙ্গে কথাগুলো উচ্চারণ করে।
‘আমার তো তেমন বোধ হয় না! এক ধরনের কথ্য ভাষা প্রয়োগের ফলে প্রান্তবাসীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে যা সমাজের উচ্চশ্রেণীর কাছে বিরক্তিকর হতেই পারে? এটা আমি লক্ষ্য করেছি। স্বামীজির কথ্য ভাষা তোমাদের মতো মোলায়েম নয় বটে।’ নিবেদিতা বেশ বিরক্তির সাথে বললেন।
‘দেখো মার্গারেট তোমার জীবন দেখে আমি বিস্মিত হই। সুরেন অবশ্য স্বামীজির কাজের প্রতি বিশেষ করে মানুষের উপর দেবত্ব আরোপের ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী নয়। কিন্তু তোমার মানুষের জন্য কাজের ধারার প্রতি আমাদের বেশ আগ্রহ আছে। বিশেষ করে স্ত্রী শিক্ষার জন্য তোমার চিন্তা ভাবনা আমাকে উৎসাহিত করেছে।’
‘ধন্যবাদ সরলা, আমি লক্ষ্য করেছি স্বামীজি সম্পর্কে তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। সত্যি কথা যদি বলি – “this mushroom of Brahmo interest is really worth very little.” ( Letters date 21/05/1899) কিছু মনে করো না।’
‘না, মনে করার কোনো যথেষ্ট কারণ থাকলেও করছি না কিছু মনে কারণ আমি জানি স্বামীজির প্রতি তুমি উৎসর্গকৃত প্রাণ। তুমি ধর্ম পরিবর্তন করে আজ তুমি হিন্দু!’
‘হ্যাঁ, আমি গর্বিত সেই কারণে।’
‘খুব ভালো। আমি বলি কি বন্ধু, একজন হিন্দুকে বিবাহ করে এখানেই থেকে যাও এবং সমাজ সংস্কারের কাজগুলি করে যাও!’
‘ধন্যবাদ সরলা তোমার আমাকে নিয়ে এই স্বপ্ন দেখার জন্য। আমি কি মহর্ষির কাছে যাবো তোমার বিলেত যাওয়ার বিষয়ে বলতে! তুমি বলছিলে কুচবিহারের মহারানীর সাথে এই বছরে তোমার বিদেশে যাওয়ার সুযোগ ঘটতে পারে!’
সরলা হেসে ওঠেন, ‘মার্গারেট তুমি স্বপ্নেও ভেবো না যে তোমাদের সাথে আমার কোনোভাবে বিদেশে দেখা হচ্ছে! আর ঐ রামকৃষ্ণের ছবির সামনে বিবেকানন্দের নৃত্য আমি দেখতে পারব না, বেদান্ত শিখতে ওটা দরকার হয় না। আমি তোমার নিষ্ঠা, একাগ্রতা, মানুষের প্রতি কাজের সুতীব্র মানবিকতা আমাকে বিস্মিত করে আমি বারবার ছুটে আসি সেই কারণেই, তোমার ডিভোশনের জন্য।’
‘বুঝলাম সরলা। আমিও তোমার বুদ্ধিমত্তা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চেতনাকে শ্রদ্ধা করি।’
এত কিছুর পরেও নিবেদিতা ঐ একই তারিখের চিঠিতে লেখেন – “Of course you know all about the reactions of discipleship and so on – but S.(Sarala) is difficult to understand.”
তারপরও সরলার সাথে সখ্যতা বজায় থাকে নিবেদিতার। বিদ্যালয়ের মেয়েদের নিয়ে মিউজিয়াম বেড়াতে যান সরলার সাথেই। সখ্যতা সমান ভাবে বজায় থাকে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গেও নিবেদিতার। চূড়ান্ত বিরোধাভাষ থাকা সত্ত্বেও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটি অটুট ধরে রাখাই মহানুভবতা। চূড়ান্ত বিপরীতে অবস্থান করেও নিবেদিতা ভাবেন শিলাইদহের কুঠিবাড়ি ও পদ্মাবোটে কবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবিতায় গানে আলোচনায় দিন কাটাবেন কয়েকটা। সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন না হওয়ায় তাঁর আক্ষেপ প্রকাশ করে কবিকে চিঠি লিখেছেন একদম বিদেশে যাবার শেষ লগ্নে। ২০ জুন জাহাজ ছেড়েছে খিদিরপুর থেকে। ১৬ জুন শুক্রবার বাগবাজারের বাড়ি থেকে চিঠিটি লেখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। বিদেশে যাবার ঠিক চার দিন আগে। একদম শেষ মুহূর্তে কবির কাছে অক্ষরে অক্ষরে বলেছেন তাঁর মনের কথা। বিদেশে যেতে হচ্ছে বলে তাঁর আক্ষেপের প্রকাশ সে চিঠিতে। কবির সাথে গল্পে, কবিতায়, গানে কাটাবেন কয়েকটা দিন – এমন আকাঙ্ক্ষা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বিদেশে যাবার জন্য। কবির কাছে যেতে পারছেন না।
My dear Mr. Tagore,
You have heard long ago, I fancy, that I must go to England this summer and that therefore I shall not be able to accept that fascinating invitation to your river-house, towards which I had been steadily pressing for so long!
মাঝারি মাপের চিঠির শুরু এই ভাবেই। তিনি কবির fascinating invitation গ্রহণ করতে পারছেন না বিবেকানন্দের সাথে বিদেশ সফরে যাচ্ছেন বলে!
ধর্মীয় বিরোধিতা, দর্শনগত সংঘাত ও সংঘর্ষ থাকা সত্ত্বেও এক সুন্দর সহজ সম্পর্ক নিবেদিতা বহন করে চলেছেন শ্রদ্ধার সাথে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাথে সাথেই ঠাকুরবাড়ির সঙ্গেও। মতোবিরোধ, মতানৈক্য শ্রদ্ধারসহ মান্যতা পেলে সম্পর্কের নৈকট্য ক্ষুন্ন হয় না, বরং অহং বিসর্জিত হয়ে এক শুদ্ধ সৃষ্টিশীলতার স্ফুরণ ঘটে, যার অপর নাম মুক্তি – আলোয় আলোয়, ঘাসে ঘাসে।
আজ একাদশীর উপোস। নিবেদিতা সকাল সকাল স্নান করে সাদা শাড়ি পরেছেন। সন্তোষিনীর আজ কাজ নেই। উনুনে আঁচ পড়বে না। সন্তোষিনীও চান-টান করে তৈরি। নিবেদিতা শাড়ি পরে নেমে আসতেই সন্তোষিনীর হাসি শুরু হয়ে গেল। নিবেদিতা অপ্রস্তুত। সন্তোষিনী এসে শাড়ি ঠিকঠাক করে পরিয়ে দিল। তারপর দু’জনে দরজায় তালা দিয়ে চলল মায়ের বাড়ি। মায়ের বাড়িতে একাদশীর পুজোর আয়োজনে সবার খুব ব্যস্ততা। মাদুরের উপর মায়ের পাশে বসে আছেন নিবেদিতা। শাড়ি পরে বসতে একটু জড়সড় হয়েপড়েন। পবিত্রতম এই ঘর নিবেদিতার কাছে। ধুপ-ধুনোর গন্ধ, ঘন ঘন শঙ্খের আওয়াজ। মহিলারা সবাই সাদা শাড়ি লাল পাড়। দ্রুত পায়ে এদিকে ওদিকে সব আয়োজন করছে। নিবেদিতা মায়ের দিকে তাকালেন, ‘আমাকে আশীর্বাদ করুন মা আমি যেন আপনার সন্তানের মনস্কামনা পুরণে সাহায্য করতে পারি।’
‘আমার আশীর্বাদ সবসময় তোমাদের সঙ্গেই আছে মা!’ তিনি নিবেদিতার থুতনিতে ডান হাতের আঙ্গুল ছুঁয়ে নিজের ঠোঁটের কাছে আনলেন। ‘চুক চুক’ আওয়াজ করলেন। নিবেদিতার মন দ্রবীভূত হয় এখানে এলেই। এই মাদুরের স্পর্শ, এই ধূপ-ধুনোর গন্ধ, এই মায়ের আঙ্গুলের ছোঁয়া, এই এই সবকিছু নিয়েই এক আশ্চর্য মা মা গন্ধ পান তিনি। সারাদিন সেই মায়ের গন্ধ সারা শরীরে ও মনে মেখে নিয়ে থেকে যেতে চান নিবেদিতা। সারাদিন পুজো পাঠের পর সাবুদানা, মুগ ভেজানো, ফল খাওয়া হল। মা নিজের হাতে সাবুদানা, ফল, ইত্যাদি মেখে সবাইকে দিলেন। নিবেদিতাকে আলাদা করে দিলেন। পশ্চিমের জানালা দিয়ে সূর্যের নরম আলো এসে পড়েছে মাদুরের উপর। এক ঢালা কালো চুল বিছিয়ে শুয়ে আছেন মা মাদুরে। লালপেড়ে শাড়ি। নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন একদৃষ্টে। লাল পাড়ের ঘের নিয়ে দুটি ছোট্ট পা বেড়িয়ে আছে। নিবেদিতা বসে বসে প্রণাম করলেন। সারদা মা উঠে পড়লেন।
‘কি হলো! তুমি একটু বিশ্রাম করো!’ নিবেদিতাকে বললেন সারদা দেবী।
‘আমাকে একবার মঠে যেতে হবে মা। আমাদের যাবার দিন এগিয়ে আসছে। অনুমতি দিন মা মঠে যাবো আমি এখান থেকেই।’
‘যাও। সাবধানে থাকবে। সবার শরীরের যত্ন নিও। তোমার উপর অনেক ভার খুকি!’

বেলুড় মঠে গঙ্গার ধারে মাটির সেই বেদি ঘিরে ছোট্ট লোক সমাগম। মঠের সকল সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারীরা এবং মঠের সাথে বিভিন্ন কাজে যুক্তরা উপস্থিত। নিবেদিতার প্রিয় গোধূলির সময়। গরম থাকলেও গঙ্গার সুন্দর হাওয়া আর অস্তমিত সূর্যের নরম রক্তাভ রঙ। আর তার মাঝে গৈরিক রঙের সন্নসীরা ভিড় করেছে। অপূর্ব লাগছে। গাছে গাছে পাখিরা ফিরে আসছে। কলকাকলিতে সুরের মূর্ছনা। স্বামীজিকে আজ খুব তেজবান লাগছে। বেশ কিছুদিন ধরেই নানান অসুস্থতা চেপে ধরেছিল। আজ সোজা হয়ে বসে আছেন। মুখে মৃদু হাসি। উদাসী চোখে সমগ্রের আভাস। নিবেদিতার খুব ভালো লাগছে। অশান্ত মন ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো। এক তরুণ সন্ন্যাসী নিবেদিতাকে উদ্দেশ্য করে এক সুন্দর অভিনন্দন বার্তা পাঠ করলেন। নিবেদিতা অধোবদনে বসে আছেন। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। এইসব স্তুতি বাক্য কি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য! তরুণ সন্ন্যাসী অনেকটা চিঠির ধরনে অভিনন্দন পত্রটি বেশ ভাবগম্ভীর কন্ঠে পড়া শেষ করে তুলে দিলেন নিবেদিতার হাতে। প্রণাম করলেন। নিবেদিতাও করজোড়ে প্রতি নমস্কার করে পত্রটি মাথায় ঠেকাবেন। এ তাঁর অন্তরের পুরস্কার। এক তরুণ ব্রহ্মচারী গোলাপ ফুলের গুচ্ছ নিয়ে এগিয়ে এলো। গোলাপ ফুলের গুচ্ছটি গেড়ুয়া কাপড়ের টুকরো দিয়ে বাঁধা। বেশ সুন্দর ও অর্থবহ ঠেকেছে – বিপ্লব এর তেজদীপ্তি ত্যাগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা প্রয়োজন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সবাই একে একে এসে স্বামীজির পায়ে ফুলের অর্ঘ্য রাখছে আর প্রণাম করছে। নিবেদিতা দিলেন ফুল স্বামীজিকে। স্বামীজি আশীর্বাদ করলেন হাত তুলে – জয়ী হও তুমি।
স্বামীজি দাঁড়িয়ে রইলেন হাত দুটি বুকের উপর আবদ্ধ রেখে টান টান। চিবুক তুলে ঘাড় শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি দূরে। সন্ধ্যা এলো। আকাশের শেষ রঙ মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। স্বামীজির মাথা যেন আকাশ ছুঁয়েছে। স্বামীজি ধীরে ধীরে সবার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। ‘আমি আজ মুক্ত। আমার শরীর নিয়ে তোমাদের উদ্বেগের চিন্তা নেই। শরীর বেশি ধকল আর বোধহয় নিতে পারবে না। হয়তো এটাই আমার শেষ বিদেশ সফর। আমার দুই নির্ভরযোগ্য সহযোদ্ধা এবারে আমার সাথে যাচ্ছে – মার্গট আর তুরিয়ানন্দ এবারে আমার সাথী। ফলে যে কোনো সংকট মোকাবিলায় আমাদের কোনো সমস্যা হবার কথা নয়।’ পুনরায় সবাইকে সবার দায়িত্ব পালনের কথা বলে থামলেন তিনি। সবাই এসে স্বামীজির পা-ছুঁয়ে প্রণাম করল। স্বামীজি আশীর্বাদ করলেন সবাইকে। তারপর তিনি হাঁটতে হাঁটতে নৌকায় গিয়ে বসলেন। নিবেদিতা, স্বরূপানন্দ, ব্রহ্মানন্দ, সদানন্দ, রাখাল মহারাজ, তুরিয়ানন্দদের নিয়ে বেশ বড় একটি দল নৌকায় চলল অন্ধকার গঙ্গার বুক চিরে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের দিকে।
নিবেদিতার দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ঢোকার উপর নিষেধাজ্ঞা আছে। নিবেদিতা এই নিষেধাজ্ঞা মেনেই চলেন। সবাই মন্দিরে যান পুজো দিতে। নিবেদিতা এগিয়ে যান রামকৃষ্ণের ঘরের দিকে। ঘরে রাখেন সাতটি গোলাপ, যা তিনি সঙ্গেই এনেছিলেন। সাতটি প্রস্ফুটিত গোলাপ।
সাত। নিবেদিতার প্রিয় সংখ্যা সাত। ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে সংখ্যার প্রভাবকে নিবেদিতা বিশ্বাস করেন শুধু নয় তিনি চর্চা করেন। ভাগ্য গননা চর্চা করেন। হস্তবিদ্যা, ঠিকুজি-কুষ্ঠি তৈরি ও বিচার ইত্যাদিও তাঁর বিষয়। এই যে অশক্ত শরীর নিয়ে বিবেকানন্দ বিদেশে যাচ্ছেন, নিবেদিতা গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান প্রভাব বিচার করে দেখেছেন বিবেকানন্দের কোনো রকম ক্ষতি হবে না। উপরন্তু এই বিদেশযাত্রার প্রভাব ভালো হবে। আর আজ এই শান্ত সন্ধ্যায় চারিদিকে গাছপালায় ঢাকা এই বাগানের এক নিভৃত ঘরে নিবেদন করলেন নিবেদিতা সাতটি গোলাপ। হিন্দু মতে এবং খ্রিস্টান মতেও সাত খুব শুভ সংখ্যা। হিন্দুদের সাত ঋষি, সপ্তর্ষি – কাশ্যপ, অত্রি, ভরদ্বাজ, বিশ্বামিত্র, গৌতম, জমদগ্নি এবং বশিষ্ঠ। মনে করা হয় এই সাত ঋষি বৈদিক ধর্মকে রক্ষা করে চলেছেন। সপ্তপদী, সপ্তপুরী ইত্যাদি শুভ বিষয় হিন্দুদের কাছে। বাইবেলে আছে সাত সংখ্যার উল্লেখ। জেনেসিস অনুসারে ঈশ্বর ৬ দিন ধরে বিশ্বকে সৃষ্টির কাজে যুক্ত থেকে সপ্তম দিন বিশ্রাম নেন। তাই ৭ সংখ্যাটির সঙ্গে ঐশ্বরিক যোগসূত্র লক্ষ্য করেছে গোটা বিশ্বের সমাজ।

গোলাপ সাতটি রামকৃষ্ণের ঘরে রেখে প্রণাম করলেন ভক্তিভরে – ঠাকুর তুমি ওনাকে রক্ষা কোরো। ওনার সকল দুঃখ কষ্টের ভার যেন আমি বহন করতে পারি সেই ক্ষমতা আমাকে দাও। ঘরের কাছেই গাছের তলায় বেদিতে বসলেন নিবেদিতা। পদ্মাসনে বসলেন। চোখ বুজলেন। ধ্যানে ডুব দিলেন গভীরে।
চারিপাশ অন্ধকারের নির্জন স্তব্ধতা। গঙ্গার বয়ে চলা। মৃদু হাওয়া। মাথার উপর তারার চাঁদোয়া। পূর্ণিমা নয়। তবুও অর্ধচন্দ্রের আলোয় মৃদু দেখা যাচ্ছে এক শ্বেতশুভ্র পাথরের মূর্তির মতো নিবেদিতা ধ্যানে বসে আছেন। একা।
সবাই মন্দির থেকে পুজো দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় নিবেদিতার ধ্যান শেষ হয়। শেষ হয় প্রার্থণা। তন্ময়তা কাটেনি তখনও। চুপচাপ আছেন। স্বামীজিও চুপচাপ। নৌকা সবাইকে নিয়ে ভেসে এলো বেলুড়ে। নিবেদিতা বসে রইলেন নৌকায়। আর কয়েকটা দিন। এইসব ছেড়ে চলে যেতে হবে। যেতে হবে ফিরে আসার জন্যই। সদানন্দ থেকে গেল নৌকায়। নিবেদিতার সঙ্গে যাবে বাগবাজার। নৌকা ছেড়ে দিল। বিবেকানন্দ দাঁড়িয়ে রইলেন তীরে যতক্ষণ নিবেদিতাকে দেখতে পাওয়া গেল। অন্ধকার ঢেকে দিল চরাচর।
‘হঠাৎ মেঘ করেছে খুব!’ সদানন্দ আকাশের দিকে তাকায়।
‘বৃষ্টি হবার লাগি, দেখেন বাতাস থম্ মারি আছে!’ মাঝিও আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে নেয়।
নিবেদিতা লক্ষ্য করে মানুষের কাছে প্রকৃতি বার্তা পাঠায় ঠিক। ধরা না ধরা সম্পর্কের উপর। প্রকৃতির সাথে যার সম্পর্ক যত নীবিড় তত সে বার্তা পায় তীব্র। এই বাহিত বার্তাই প্রাণের দ্যোতক! চৈতন্য! চেতনা! যা সর্বত্র বিরাজমান। যা বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য প্রমাণ করার জন্য প্রিয় ডাঃ বোস জীবনকে বাজি রেখে সংগ্রাম করছেন! এই বার্তার কথাই কি কবির কাছে বিশ্বজাগতিক সুর! এই বাহিত বার্তাই কি স্বামীজির কাছে অদ্বৈত বাদের বাণী! নিবেদিতা অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘ ভারি হয়ে আসে।
অন্ধকার রাতে রাস্তায় উপচে আসা বস্তির সংসার ডিঙিয়ে বোস পাড়া লেনের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সদানন্দ মায়ের বাড়ি চলে গেল। সন্তোষিনী এসে দরজা খুলল। হাতে হারিকেন। সদানন্দ ফিরে গেছে অন্ধকারে। নিবেদিতা ভেতরে ঢুকে আসে। সন্তোষিনী দরজা বন্ধ করতে না করতেই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি এলো। হঠাৎ পাগল করা জলস্রোত। নিবেদিতা উঠোনের মাঝে গিয়ে দাঁড়ালেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত প্রসারিত করলেন। ভিজছেন নিবেদিতা। অনন্ত আকাশ থেকে নেমে আসা জলধারায় শীতল হচ্ছেন নিবেদিতা।
সন্তোষিনীর ডাকাডাকিতে সম্বিত ফেরে নিবেদিতার। তাড়াতাড়ি উঠে আসেন বৃষ্টি থেকে। ঠান্ডা জলজ বাতাসের স্পর্শে তিনি সেই পরম পুরুষের স্নেহ অনুভব করেন। “And the air all damp and cold and the beating of rain without. And this was where He lived!” ( Letters 18th June,1899)

পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন নিবেদিতা। নৌকার ছন্দে ছন্দে মৃদু দুলছেন। চরাচর জুড়ে এক আশ্চর্য নীরবতা। শোক ছড়িয়ে পড়েছে যেন! ছিঁড়ে গেছে নোঙর। ভারতবর্ষের করে যিনি গড়ে তুলেছিলেন তিনি আর নেই। আবছা লাগছে তাঁর সবকিছু। কত কাজ ছড়িয়ে আছে এই দেশের মাটিতে। সম্পন্ন করার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন তিনি। নৌকা এগিয়ে চলে ছলাৎ ছল জলের শব্দ তুলে। ভেসে চলে ভূমির দিকে। যে ভূমি থেকে তাঁর যাত্রা শুরু।

[পর্ব- ৭]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, ডিসেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]