
ব্যথা
১
বুকের ভিতর অনিশ্চয়তা যেমন ওঠে নামে, চিল্কার রাশি রাশি জল তেমনই দরিয়ায় দুলছিল। নৌকো দুলছিল এপাশ ওপাশ। সঙ্গে দুলছিল অনিমেষের ব্যথার জগতটা, অফিসের দশটা- পাঁচটা, বড় সাহেবের কাঁচের ঘর, বাচ্চাদের নার্সারি রাইমের একঘেয়ে সুর, শ্রেয়ার বিছানা, সব।
নৌকোয় অনিমেষ শ্রেয়াকে দেখছে না, বাচ্চাদের দেখছে না। যে নিয়মে মাথা নিচু করে ও অফিস কর্তৃপক্ষের অর্ডারের কপি পড়ে, সেই নিয়মের বেড়াগুলো দুলে দুলে উঠছে। যে কর্তব্যে প্রতি সকালে ঘুম কচলে থলে নিয়ে বাজারে ছোটে , সেই বোধ আজ খড়কুটোর মত উথাল পাথাল। কোথা থেকে একটা ডাক আসছে। সব ব্যথা পেরিয়ে যেতে মনটা ছটফট করছে।
তারপর একসময় মাঝির শক্ত চোয়ালের রেখা ধীরে সহজ হয়ে এল। জলযান তরতরিয়ে এসে ঠেকল বালিরাশির কিনারায়। অনিমেষের আর তর সয় না, শ্রেয়া বাচ্চাদের নিয়ে নেমেছে কোনরকমে, অনিমেষ ওদের ছাড়িয়ে দৌড়ে এগোল।
ঐ দেখো।
চিল্কার অনাবিল সমুদ্র-সঙ্গম! ঐখানে দিগন্তে বিছিয়ে আছে নীল; কে রেখেছে? নীল আর নীল; হাজার সাদা ফেনার হাসি; কটা মানুষ এমন করে হাসতে জানে? শ্রেয়া জানে? ওই হাসিটা ওর চাই!
শরীরটা পালক হয়ে গেছে। অনিমেষ একটা লাফ দিল। কিন্তু ও কোথাও পৌঁছল না। শ্রেয়া ওকে পিছন থেকে টেনে ধরেছে।
পাগলামো করো না। জলে পড়ে মরতে চাও, নাকি?
অনিমেষ ঘাড় ঘোরাল, দেখল বাচ্চারা বালিতে দৌড়চ্ছে, পা ঢুকে যায়, তবু হৈ হৈ করে দৌড়চ্ছে।
২
হোটেলে ফিরে শুয়ে বসে পরের দিনটা গড়িয়ে গেল। সন্ধ্যায় শ্রেয়ার পিছন পিছন পুরীর বাজারে; শাড়ি পাঞ্জাবি বিছানার চাদর কোটকি পাড় ঝিনুকের হার, থোর বড়ি খাড়া…।
ক্লান্ত শরীর। চাবি ঘুরিয়ে হোটেলের ঘরে ঢুকতেই চমক। ঘরের সব আলো পাখা চলছে। কে যেন আগে থেকেই বুঝেছে মে মাসের পুরীর এই গরমে ক্লান্ত শরীর আরাম চাইবে। শ্রেয়া বলল, দূর পাগল, সন্ধ্যায় যখন বেরোলাম, লোডশেডিং ছিল, মনে নেই? তাড়াহুড়োয় সুইচ নেভাতে ভুলে গিয়েছিলাম হয়ত !
অথচ অনিমেষের মনে হল, ও আলো পাখার সুইচ বন্ধ করেছিল।
সারাদিনের ক্লান্তির পর এমন ফুরফুরে হাওয়ার আদর পেলে কার না ঘুম আসে! অনিমেষের ঘুম ঘুম আসছিল।
কিন্তু ঘুম সবার সহ্য হবার নয়। পৃথিবীতে এক কর্মযোগী সম্প্রদায় আছে, ব্যবসায় আরও উন্নতির নেশা তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। তারা হলেন ক্লান্ত ট্যুরিস্টের বিশ্রাম-নাশী উদ্যোগপতি। তাই অনিমেষদের দরজায় টোকা পড়ল।
নমস্কার।
সাদা দাড়ি, সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা। রোগা ছিপছিপে চেহারা।
আমি এই হোটেলের মালিক।
আসুন আসুন, অনিমেষ ঘুম চোখে দরজা হাট করে খুলল।
না, শুধু জানতে এলাম কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?
সবে তো দুদিন হল ঢুকলাম।
চিল্কা কেমন লাগল?
আপনি জানেন, আমরা চিলকা গিয়েছিলাম! অনিমেষ অবাক হল।
একটা আলতো হাসি যেন সাদা দাড়ির মধ্যে মিলিয়ে গেল। কিছু অসুবিধা থাকলে বলবেন , লোকের কথায় কান দেবেন না।
লোকের কথা! কে আবার কী বলবে? অনিমেষ আবার অবাক হল।
অনেকেই অনেক কথা বলবে। বিসনেস রাইভালরি আছে তো! লোকে কান ভাঙ্গায়। আচ্ছা আসি।
চারতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠেই অনিমেষদের ঘর। ফাঁকা করিডর। সাদা পাঞ্জাবী এগিয়ে গেলেন সিঁড়ির দিকে । দরজা বন্ধ করে অনিমেষ বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাবতে লাগল, কী অন্তরঙ্গ! কটা মানুষ এমন হয়?
কিন্তু আগ বাড়িয়ে লোকটা ঐ কথাগুলো বলতে এল কেন? শ্রেয়ার গলায় সংশয়। ক্ষুদ্র মানুষের এই সব প্রাত্যহিক সংশয়কে আমল দিতে অনিমেষ আর চাইছিল না। সে পাশ ফিরল।

৩
যেমন খুশি বেড়ে ওঠা পুরী শহর এখন বাঙ্গালী সুখীদের দ্বিতীয় ঘর। হরেক কিসিমের হানিমুনের নির্ভরযোগ্য ঠিকানা। ক্রাইম লেগেই আছে। রাতে খেতে খেতে এমনই কত কথা বলছিল শ্রেয়া। এই সব হোটেল ফোটেল কতটা সেফ কে জানে!
অন্য ঘরে বোর্ডার আছে? এতবড় হোটেল, লম্বা করিডর, কেমন যেন শুনশান। শ্রেয়া বাচ্ছাদের সামলাতে সামলাতে কথাগুলো বলছিল। বাইরে অন্ধকারে সমুদ্র গজরাচ্ছিল। বুকে যেমন ব্যাথা গুমরায়। অনিমেষ কান খাড়া করে শুনতে লাগল।
বাইরে বালিতে ছড়িয়ে থাকা দোকানপাটে জনতার মিলনমেলা ততক্ষণে ভাঙছে। মেলা; কিন্তু মিলন কোথায়! মানুষগুলো নিজের নিজের কাজ গুছিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে এদিকে ওদিকে। জানালা দিয়ে বিলক্ষণ চোখে পড়ে। ভিতরে শ্রেয়ারা অকাতরে ঘুমোচ্ছে। অনিমেষ দরজা একটু ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিল। রাত বাড়ছে। করিডরে অচেনা নিস্তব্ধতা অজানা ব্যথার মত ছমছম করছে। অনিমেষ বিছানায় ফিরে বাচ্চাদের ডিঙ্গিয়ে শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরে বড্ড ঘুমোতে চাইছিল।
৪
কখন যেন ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। মনে হল পিঠের নিচটা ভেজা। ছোটটা বাচ্চাটা তবে বিছানা ভিজিয়েছে! ঘুমটা চটকে যেতেই ও বুঝতে পারল, লোডশেডিং, আবার। ঘরের একমাত্র জানালাটা পুবে। সমুদ্রকে তেরছা দেখা যায় বটে, তবে হাওয়া ঢোকে না। হাঁসফাঁস হোটেলে জেনারেটার চলবে না কেন?
অনিমেষ কলকাতার রাস্তায় জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন দেখেছে, মিছিলে আটকে থাকা বাসে সেদ্ধ হয়েছে অনেক। তাই ওর রক্তে চিৎকার আছে।
দরজার ছিটকিনি খুলে ও এক ঝটকায় ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কর্মচারীদের কোন দায় নেই! জেনারেটর চালাতে এতো দেরি কেন? উলটো দিকের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে আরো একজন বোর্ডার। অনিমেষ যুদ্ধক্ষেত্রে সহযোদ্ধা পেয়ে গেল।
আরে দাদা, বেরিয়েছেন!
উপায় কী। ঘন্টাখানেক হতে চলল সেদ্ধ হচ্ছি। নিচে রিশেপসনে একহাত নিতে হবে।
আপনি কোত্থেকে?
দুর্গাপুর। আপনি?
কলকাতা। হানিমুন নাকি?
হ্যাঁ দাদা। মাঠে মারা যাচ্ছে।
ভিতর থেকে নারীকন্ঠে আহ্বান আসায় দুর্গাপুরী আবার ভিতরে সেঁধিয়ে গেলেন। অনিমেষ একা পা বাড়াল। পিছনে লম্বা করিডর, আর শ্রেয়ার গায়ে লেপটে থাকা বাচ্চারা। ওরা গরমে ঘেমে ঠাণ্ডা হয়ে ঘুমিয়ে পড়ছিল বুঝি।
সিঁড়ি দিয়ে নিচে উঁকি দিতেই দপ করে একটা আলো জ্বলে উঠল, অনিমেষ দেখল আলতো হাসির রেশ, আর এক মহিলার অবয়ব। পালকের মত হাল্কা উঠে আসছেন সিঁড়ি বেয়ে। আলো নিবে গেল মুহুর্তেই। সে অবয়ব কী সব আলো শুষে নিল? অনিমেষকে কে যেন সতর্ক করল, তোমার দরজার আড়ালে সেঁধিয়ে যাও। লুকিয়ে দেখ তাকে। ওটা কে? এতো রাতে একা! কেন?
লুকোবে কী, অনিমেষ তো আসলে মুখোমুখি দেখতে চাইছে। এই হিসেব কষে কষে পাতলা করে ফেলা জীবনটাকে ডিঙ্গিয়ে গিয়ে, এতদিন বাদে, দেখতে চাইছে, অন্ধকার কেমন আলোর সঙ্গে লুকিয়ে খেলে, ব্যথার সঙ্গে উচ্ছ্বাস। ঢেউএর গোঁ গোঁ স্নায়ুকে শিথিল করে দিচ্ছে। পিছন ফিরেও শেষ পর্যন্ত অনিমেষ পিছোতে পারল না। মন্ত্রমুগ্ধের মত সিঁড়ির দিকে ঘুরল।
অথচ, সিঁড়িতে কেউ নেই! শুধু একটা আলতো হাসি হওয়ায় ছমছম করছে। বুকের ভিতরে চুম্বক টানছে। তবে কী সেই আলতো হাসি সিঁড়ি দিয়ে উপরে গেল? অনিমেষ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। পালকের মত। শ্রেয়ার বুকে ঘুম তো অনেক হল। ঐ ছমছম হাসিটা ওর চাই। যে কোন মূল্যে!
৫
ছাদে তারায় ভরা আকাশের নিচে লোকজন শ্রেয়াকে ঘিরে আছে। টর্চের আলোয় অনিমেষকে খোঁজাখুঁজি চলছে। ভিড় টপকে শ্রেয়ার কাছে এসে দাঁড়াতে এখন অনিমেষের কেমন লজ্জা হচ্ছিল। তবু অনিমেষ এগোল। বায়বীয় হাসিটাকে ধরেও তো শেষমেষ ধরতে পারে নি; দৌড়ে না, লাফিয়েও না। এখন শ্রেয়ার মুখে একবার হাত বুলিয়ে দেখলে কেমন হয়! যদি ও একবার হাসে! বাচ্চারা কী নিচে একা একা ঘুমোচ্ছে? অনিমেষ কাছে এসে বলতে চাইছিল, এই তো আমি! চিল্কায় কী জানি কী ঘোর লেগেছিল, এবার আর বাচ্চাদের হাত ছাড়ব না। তোমার পাশে পাশে থাকব। অনিমেষ বলতে চাইছিল, কিন্তু ওর গলার আওয়াজ বাষ্প হয়ে উবে যাচ্ছিল।
অনিমেষ দেখল, শ্রেয়া ছাদ থেকে ফিরে যাচ্ছে, চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। সঙ্গের লোকজন ছাদের এদিক ওদিক টর্চের আলো ফেলছে। কিছু আলো অন্ধকার চিরে সপাং সপাং অনিমেষের উপরও এসে পড়ছিল। কিন্তু অনিমেষকে ওরা কেউ দেখতে পারছিল না। বিমূঢ় লোকজন থানা পুলিশ করতে চাইছে। অনিমেষ চিৎকার করে ডাক দিল, শ্রেয়া দাঁড়াও। আসছি। কিন্তু শ্রেয়া কিছুই শুনতে পেল না। অনিমেষ দৌড়ে গেল, কিন্তু শ্রেয়া যেন অন্য জগতের মানুষ হয়ে গেছে, আস্তে আস্তে দুরে সরে যাচ্ছে!
শ্রেয়া, অন্তত একবার আকাশে হাজার হাজার তারার হাসিটা দেখ, অনিমেষ মরীয়া চেষ্টা করছিল, শ্রেয়া যাতে শুনতে পায়।
কলকাতার ধুলোয় এ হাসি তো দেখতে পাবে না! এ আকাশ আমার। তোমারও তো! দেখ শ্রেয়া, এস।
কিন্তু হায়, শ্রেয়া শুনতে পায় নি। অনিমেষও শ্রেয়াকে আর কিছুতেই ছুঁতে পারে নি। হাপুস ছায়ায় দাঁড়িয়ে সেই জমে থাকা ব্যথাটা সেদিন শ্রেয়ার চলে যাওয়া দেখেছিল। অভ্যস্ত ব্যথা অনিমেষের শরীরকে ছেড়ে আজও সেই রাতের ছাদে জমে আছে।
খুব ভালো লাগলো ।
ধন্যবাদ, আইভি দি।
একটা সাংকেতিক ও মনস্তাত্ত্বিক গল্প। রাতের অনিশ্চয়তা ও আহ্বান সামনে রেখে শেষ পর্যায়ে পরিণতি হঠাৎ করেই একটা ধাক্কা দেয়। শ্রেয়ার কাছে শরীরের অস্তিত্ব নিয়ে ফিরতে না পারার বেদনা পাঠক হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
আমার এই গল্পটা বেশ ভালো লেগেছে।
অনেক ধন্যবাদ, অরিন্দমবাবু।
একটা সাংকেতিক ও মনস্তাত্ত্বিক গল্প। রাতের বেলা লোডশেডিংকে উপলক্ষ্য করে অনিমেষের দোলাচল শেষ পর্যন্ত দুর্দান্ত এক পরিণতি পেয়েছে। শেষ অধ্যায়ে বর্ণিত সেই পরিণতি পাঠকের কাছে একটা চমক হিসেবে হাজির হয়। গল্পটা আমার বেশ ভালো লেগেছে।
খুব ভাল লাগল। বিষয় এর অভিনবত্ব এক কথায় অসাধারণ। মনে অনেকটা সময় ধরে রেশ রেখে যায়।
ধন্যবাদ, অদিতি।
ব্যথা গল্পটি বেশ ভালো লাগলো , বিষয়বস্তুর মধ্যে স্বতন্ত্রতা আছে …..
ধন্যবাদ, শ্রাবন্তী।
গল্পটি পড়লাম । খুব ভালো লাগলো । নিটোল বাঁধুনি আছে গল্পে। অবশ্যই ভাবনায় অভিনবত্ব ও মুন্সিয়ানা প্রাপ্য গল্পকারের।
অনেক ধন্যবাদ, শরদিন্দুবাবু।
গল্পটি আমার ভালো লেগেছে।চিন্তা ও বিষয় ভাবনা মৌলিক।গতিময়।এক মুহূর্তের জন্যেও গল্প পাঠক কে থামার অবকাশ দেয়নি। মানব মনের গভীরে যে কত অজানা গভীর খাদ আছে, সে সন্ধান সাহিত্য সৃষ্টি ছাড়া সম্ভব নয়।লেখক আমার শিক্ষক আমার জীবনের অনেক দর্শন গড়ে তোলার কারিগর।সেগুলো মাথায় রইলেও সম্পূর্ণ ভাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়েই বলছি sir, আপনার এই গল্প খুব ভালো হয়েছে।একটা রহস্যের জাল বুনে গেছেন নিপুণ মুন্সিয়ানা নিয়ে অথচ অনর্থক শব্দ জালের আড়ম্বর নেই। শেষ হয়েও হইলো না শেষ। ওপেন ended। আদর্শ ছোট গল্পের গুণ ।
ধন্যবাদ, রুমা।
Very fine blend of surreal with the real .
Something very unique indeed!
Thank you, sir.