প্রায় চল্লিশ বছর একটানা উত্তর ভারত, দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় চাকরী করে শেষ অবধি রিটায়ার করলেন অমরেশবাবু। বাল বাহুল্য নামী-দামী কোম্পানিতে উঁচু পদে অনেকদিন চাকরী করার সুবাদে মাসিক পেনশন ছাড়াও প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্যাচুরিটি, আরোও অনেক রকম মিলিয়ে যা টাকা পেলেন তা খুব বিলাসিতা না করে খরচা করলে আগামী চল্লিশ বছরের জন্য যথেষ্ট। আর বেশী খরচাটাই করবেন কিভাবে। এক মেয়ে চাকরী থাকতেই তার বিয়ে দিয়েছেন মেয়ে জামাই আমেরিকাতে থাকে আর অমরেশ বাবুর স্ত্রী অরুণা সংসারে হিসাবের খাতাটাকে বিয়ের পর থেকেই এমন করে চালিয়েছেন নিজেদের কলকাতার বড় ফ্ল্যাট কেনা মেয়ের বিয়ে কিছুতেই অমরেশবাবুকে কোন ধার দেনা করতে হয়নি।
অমরেশবাবু সস্ত্রীক রিটায়ার করে কলকাতায় এসে কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে গেলেন। মার সামনে হাত জোড় করে বললেন মা মাগো চাকরী জীবনে কত ছল চাতুরী করেছি, কত মিথ্যে কথা বলেছি, ডান হাতে বাঁ হাতে টাকা নিয়েছি এবার একটা প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দাও প্রত্যেক দিন আমি যেন কোন গরীব-দুঃখীকে নিঃস্বার্থভাবে দান করতে পারি তার ব্যবস্থা করে দাও। মা কি শুনেছিলেন তা আমরা জানিনা, তবে অমরেশবাবু প্রতিবেশী হিসাবে ওঁদের ফ্ল্যাটে উনি আর ওনার স্ত্রী গলার দাপটে অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের জীবন কিছুদিনের মধ্যেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। স্বাভাবিকভাবেই একজন প্রতিবেশী একদিন অমরেশবাবুকে আবাসনের গেটে ঢোকার মুখে ডেকে বললেন, “দাদা, একটু লো ভলুমে রেডিও না চালালে তো আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হবে। অমরেশবাবু প্রথমটায় বুঝতে পারেন নি পরে খুব লজ্জিত হয়ে বললেন কিছু মনে করবেন না, আমরা অনেক বড় বাড়ীতে থাকতাম তো তাই একটু চেঁচিয়ে কথা বলার অভ্যাস। ঠিক হয়ে যাবে এখন আমাদের খাট আলমারি গুলোকে যেমন কাটিয়ে ছোট করে ফ্ল্যাটের সাইজে করে নিয়েছি – গলাটাকেও সেইরকম মিট করে দেবো।” প্রতিবেশী মজুমদার বাবু বললেন ‘না মিউট করতে বলছি না তবে গুলিডমের স্কেলটা যদি এখন কুড়ি থাকে তবে ওঠাকে দশে নিয়ে আসবেন তাহলেই বাধিত হবো।”


অমরেশবাবু আর কথা না বাড়িয়ে হনহন করে তিন তল্লার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেখলেন অরুণা যথারীতি ওয়াশিং মেশিন চালিয়ে টিভিতে সিরিয়াল দেখছে। এই সময় এক কাপ চা চাইলে জবাব মিলবে চল্লিশ বছর চা করে আমি খাইয়েছি এখন তুমি করবে আর আমি খাবে।” অমরেশবাবু খবরের কাগজটা তুলে চোখ বোলাতে বোলাতে একটা বিজ্ঞাপনে নজর পড়লো। বিজ্ঞাপনে লিখেছে একজন শিশু পয়সার অভাবে চিকিৎসা করতে পারছে না। নীচে একটা কোন নম্বরও দেওয়া আছে যেখানে যোগাযোগ করে সাহায্য দিতে হবে। অরুণাকে বললেই এমন যুদ্ধক্ষেত্র হবে তাই মোবাইলটা আর খবরের কাগজটা নিয়ে ছাদে গিয়ে নম্বরটা লাগালেন ও প্রান্তে একজন সুকণ্ঠী মহিলা বললেন, গুড মর্নিং স্যার, আপনার নম্বরটা কি নামে সেভ করবো? “অমরেশবাবু এ প্রশ্নের জন্যে তৈরি ছিলেন না বললেন লিখুন বসাক গড়িয়া, “ঠিক আছে একটু পরে আপনাকে ফোন করবো। “অমরেশ-বাবু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন কারণ কাজের কথা তো হলই না উল্টে ফোন নিয়ে ঘরে কথা বললে অরুণা হাজারটা কৈফিয়ত চাইবে আর তারপর ওনারও বি.পি. বেড়ে গিয়ে ওলিউম স্কেল কুড়ি পেরিয়ে চল্লিশ পৌঁছে যাবে। এদিকে কালীঘাটে মায়ের কাছে বলে এসেছেন গরীব দুঃখীর উপকার করবো, একটু প্রায়শ্চিত্ত করবো আর এত ভালো সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। নীচে গিয়ে অরুণাকে বললেন” আমাকে একটু বেরোতে হবে।” অরুণা কোন কৌতূহল না দেখিয়ে না শোনার ভান করে বলল- কটায় ভাত খাবে? খেয়ে বেরোবে না খেয়ে বেরোবে?” অরুণার এই উদাসীনতা এই অবজ্ঞা রিটায়ার পর থেকে অমরেশকে আরও বিরক্ত করে। কিন্তু কথা বলতে গেলেই নতুন বিতর্কের সূত্রপাত হবে তাই কোন কিছু না ভেবেই বললেন, ‘খেয়ে বেরবো।” তা হলে রান্নার লোকতো জানোই বেলা এগারোটার আসে আসবে না বারোটার আগে যেতে পারে না কতবার বলেছি বেরোনোর থাকলে একদিন আগে জানাবে এখনতো তুমি অফিসের সাহেব নও যে মুখের কথা বেরোলেই কর্মচারী কাজ সেরে দেবে।” এ সব অবান্তর কথার জবাব দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। অমরেশবাবু বাথরুমে কলে গেলেন বারোটা নাগাদ খাওয়া দাওয়া করে ঘর থেকে বেরলেন। রাস্তায় বেড়িয়ে বিজ্ঞাপনের নম্বরটায় ফোন করলেন ও প্রান্তের মহিলা বললেন “বসাক গড়িয়া, শুনুন আপনি কালীঘাট মেট্রোর কাছে দেনা ব্যাঙ্কের কাছে এসে আমাকে এই নম্বরে ফোন করুন। অমরেশবাবু কিছু কথা বলার আগেই লাইনটা কেটে দেওয়া হল। অমরেশবাবু বর্তমান কলকাতার প্রতারক লোকেদের সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনেছেন কিন্তু একটা শিশুর চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে কাগজে এরকম রহস্যের ব্যাপারটা কিরকম আশ্চর্য লাগলো। তাও ভাবলেন আরে চল্লিশ বছর চাকরী জীবনে কত লোককে চড়িয়ে এসেছি, কিভাবে কত বসকে টুপি দিয়েছি আর আমাকে ধুর বানাবে, দেখি কি হয়। দেনা ব্যাঙ্কের সামনে এসে ফোন করলেন মহিলা উত্তর দিলেন “আপনার জামার রঙটা বলুন অমরেশ-বাবু বললেন “নীল-জামা/সাদা প্যান্ট” জামাটা কি হাফ না ফুল না টি সার্ট? অমরেশবাবু বললেন “টি সার্ট”। ঠিকাছে পাঁচ মিনিট দাঁড়ান আমাদের লোক আপনাকে পিক আপ করবে।” কিছুক্ষণ পরে একটা ষণ্ডা মার্কা ছেলে বাইকে করে এসে তার সামনে থামলো শুধু বলল “শিশু চিকিৎসার সাহায্যের” অমরেশবাবু বললেন ”হ্যাঁ।” ”বাইকে বসুন” বলে অমরেশবাবুকে পিছনে বসিয়ে ছেলেটি লেক মার্কেটের ভিতর দিয়ে সোজা রাস্তা দিয়ে গিয়ে ডান দিকে গিয়ে একটা সরু গলির সামনে দাঁড়ানো। বলল আসুন বলে একটা ছোট ঘরের ভেতর নিয়ে গেলো। “বসুন” বলে ঘরের ভেতর দিয়ে পেছনের প্যাসেজের দিকে চলে গেলো। বসে আছেন অমরেশবাবু কারর কোন দেখা নেই প্রায় দশ মিনিট পরে প্রায় চার পাঁচ জন যুবতী মহিলা প্রত্যেকের কোলে একটা করে বাচ্চা এসে দাঁড়ালো। বলা বাহুল্য যুবতীদের পোশাক একটু বেশী খোলামেলা অমরেশবাবু লজ্জায় তাদের নিকে তাকাতে পারছিলেন না। “আরে কাকু এতো লজ্জা পাচ্ছেন কেন? দেখুন আমরা আমরা এই সমাজের আবর্জনা এই শিশুগুলির বাপের নাম জানা নেই বাবাগুলো মজা লুটে কেটে পড়েছি কিন্তু এদের নানারকম অসুখ বিসুখ ভালো করে খাওয়া পরা তো দূরের কথা অসুখ করলে ডাক্তার দেখানোর পয়সা নেই।

তাই আপনাদের মতো লোক যারা দুনম্বরী পয়সা কামিয়েছেন তাদের আমরা সাহায্য করছি। আপনারা যে টাকা দান করবেন সেটার বিনিময়ে রেজিস্টার্ড এন. জি. ওর রসিদ পাবেন ব্যাগ সরকারী নিয়ম অনুযায়ী আপনি পাবেন ট্যাক্সের ছাড় আর আমরা পাবো সেই এন. জি. ও থেকে কমিশন।” অমরেশবাবু “আমি চেক দেবো।” মেয়েটি বললেন ”ও তাহলে আপনার টাকা রঙ কালো নয়। অমরেশবাবুর মনে হল বলেন টাকার কোন রঙ হয় না। কিন্তু কিছু না বলেই ব্যাগ থেকে চেক বুক খুলে দু-হাজার টাকার একটা চেক লিখলেন জিজ্ঞেস করলেন”চেকটা অ্যাকাউন্ট পেয়ী হবে- আর কি নামে হবে।” মেয়েটি বলল- কেন আমাদের এন. জি. ওর নাম “সুন্দর শিশু” বলে মুচকি হেসে ওই সচ্ ভারতের মতো “সুন্দর শিশু”। অমরেশ বাবু মেয়েটার কথার ব্যাঙ্গের ইঙ্গিতটাতে সাড়া না দিয়ে চেকটা লিখে মেয়েটার হাতে দিয়ে একটা রসিদ নিয়ে বেড়িয়ে এলেন। গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্তু দানের পরে যেমন দক্ষিণা না দিলে দান অপূর্ণ থেকে যায় তাই অমরেশবাবুও দু পা হেঁটে কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে গিয়ে আরেকবার মাকে দর্শন করলেন, মাকে ভক্তিভরে প্রণাম করার পরে মনে হোল মা অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছেন বলছেন “তুই যা চেয়েছিলি তাই তো হোল তুই অন্তত প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ পেলি। অমরেশবাবু বললেন মা আমি তো নিঃস্বার্থভাবে করে প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ প্রার্থনা করেছিলাম। কোন উত্তর পেলেন না তবে মা একটু তির্থকদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আর বলছেন “আরে বোকা, এযুগে স্বার্থ ছাড়া কিছু হয় নাকি রোজ লোকে আমার এত প্রণামী দেয় শুধু তো নিজের স্বার্থ পূরণের প্রার্থনা করে, তুই তাদের থেকে আলাদা হলে, এরা তোকে বাঁচতে দেবে না- এটা বুঝে চল্।”

[পরম্পরা ওয়েবজিন, অক্টোবর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

0 0 ভোট
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য