মরুভূমির দিনরাত্রি
সত্য কাহিনি
জানালার বাইরে হাওয়া উত্তপ্ত টিনের উপর দিয়ে ভেসে আসছিল; এই আবহাওয়ায় শরীরের সামান্য অঙ্গ সঞ্চালন চেষ্টা করে করতে হয়। পোলিশ সাংবাদিক রাইকার্ড এবং লিসবনের ফিল্ম ইউনিট যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকলো। কম্যান্ডান্ট মন্টি নীচে গিয়ে একজন সৈন্যকে জাগিয়ে দিল এবং তাকে শহরে পাঠিয়ে দিল গাড়ির জন্য। একটি সিট্রোয়েন ডিএস এবং একটি ফোর্ড মাস্তাং এসে পৌঁছল। মন্টি যাত্রার সুরক্ষার জন্য এসকর্ট হিসাবে কার্লোটা নামে একজন নারী সৈনিককে মনোনীত করেছিলেন।
কার্লোটা তার কাঁধে একটি স্বংক্রিয় রাইফেল নিয়ে এসেছিল। তার পরিহিত কমান্ডো ইউনিফর্ম শরীরের তুলনায় খুব বড় ছিল, এক বাক্যে স্বীকার করতে হবে তাকে খুব আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিল। তরুণ যাত্রীরা কার্লোটার সাথে ঘনিষ্ঠতা দেখাতে শুরু করলো। মনে হলো, কার্লোটার উপস্থিতি ফিল্ম ক্রুদের লিসবনের বাইরে তাদের বাড়ির কথা ভুলে যেতে প্রভাবিত এবং গাড়ির সামনে বসতে প্ররোচিত করেছিল।
মাত্র বিশ বছর বয়সী, কার্লোটা ইতিমধ্যেই কিংবদন্তি ছিলো। দুই মাস আগে, হুয়াম্বোতে বিদ্রোহের সময়, সে একটি ছোট এমপিএলএ দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলো। এই দল এক হাজার শক্তিশালী ইউনিটা বাহিনী (জোনাস সাভিম্বির বাহিনী) দ্বারা বেষ্টিত ছিল। কার্লোটা আবেষ্টনী ভেঙ্গে তার লোকদের বাইরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মেয়েরা সাধারণত দুর্দান্ত সৈনিক হয় – ছেলেদের চেয়ে ভাল, যারা কখনও কখনও সংঘর্ষের সামনের দিকে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করে। শ্যামবর্ণা কার্লোটাকে যাত্রীদের কাছে দুর্দান্ত সৌন্দর্যময়ী মনে হয়েছিল। রাইকার্ড কার্লোটার অনেক ছবি তুলেছিল। তার মধ্যে অবশিষ্ট মাত্র একটি ছবি অনেক পরে দেখে তার মনে হয়েছিল যে সে এত সুন্দর ছিল না। তবুও সুন্দর বিকেলের উষ্ণ অনুভূতি যাতে না ফিকে হয়ে যায় তাই কেউ উচ্চস্বরে বলেনি যে কার্লোটা সুন্দরী নয়।
রাইকার্ড ফিল্ম ইউনিটের আলবার্তো, কারভালহো, ফার্নান্দেজ এবং বারবোসাকে কার্লোটার ছবি দেখিয়েছিলো। তখন সবাই ছবিতে কার্লোটাকে দেখে নীরবতা বেছে নিয়েছিল। শুধু একে অপরের দিকে পলক ফেলেছিল। এসবের মধ্যে কোন অর্থ খোঁজা অর্থহীন। ততক্ষণে কার্লোটা চলে গেছে। সে অগ্রবর্তী সৈন্যদের কাছে রিপোর্ট করার আদেশ পেয়েছিল, তাই সে তার ইউনিফর্ম পরে, এলো চুল চিরুনি দিয়ে সামলে, কাঁধে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ঝুলিয়ে চলে গেল।
চার পর্তুগিজ এবং একজন পোলিশ কমান্ড্যান্ট মন্টির স্টাফ হেডকোয়ার্টার্সের সামনে কার্লোটাকে দেখেছিল, তখন তাকে তাদের সুন্দর মনে হয়েছিল। কেন? কারণ যুদ্ধবিধ্বস্ত অ্যাঙ্গোলার মরুদ্যান বেনগুয়েলা শহরে পাঁচ ইউরোপীয় তরুণের কাছে কার্লোটা এক কল্পনার মানবীতে পরিণত হয়েছিল। তরুণদের এর প্রয়োজন ছিল, কারণ তারা সেভাবেই কার্লোটাকে চেয়েছিলো। পুরুষ সর্বদা নারীর সৌন্দর্য তৈরি করে এবং সেই দিন তরুণদল কার্লোটার সৌন্দর্য তৈরি করেছিলো। অন্য কোন ব্যাখ্যা বাহুল্যের সামিল।
গাড়িগুলি বেনগুয়েলা থেকে ১৬০ কিলোমিটার পূর্বে বালোম্বোর দিকে যাওয়া রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো। সত্যি কথা বলতে, চড়াই উতরাই পূর্ণ রাস্তায় অনিশ্চিত যুদ্ধের পরিবেশের মধ্যে যে কোন দুর্ঘটনা হয়নি তার জন্য তরুণেরা ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানালো।
কার্লোটা ড্রাইভারের পাশে বসেছিল এবং যেহেতু সে এই ধরণের ড্রাইভিংয়ে অভ্যস্ত ছিল, সে তরুণদের সাথে একটু মজা করল। বেপরোয়া বাতাসে কার্লোটার চুল অগোছালো হয়ে যাচ্ছিল। বারবোসা বললো,“বল, আমি তোমার চুল ধরে রাখবো?” কার্লোটা ঘাড় ফিরিয়ে মৃদু হেসেছিল। অন্য তরুণদের বারবোসার প্রতি হিংসা হলো। গাড়ি একবার থামলে ফার্নান্দেজ প্রস্তাব দিলো যে কার্লোটা তাদের সাথে পিছনের এসে বসুক। এটা বুঝতে কারোর অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে ফার্নান্দেজ কার্লোটাকে তার কোলে বসাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অন্য সবাই ফার্নান্দেজের পরাজয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো- যেন কার্লোটা তরুণদের সবার সৃষ্টি, তাই ফার্নান্দেজ একা তাকে পেতে পারে না।
কার্লোটার জন্ম নামিবিয়ার সীমান্ত থেকে খুব দূরে রোকাডাসে। সে এক বছর আগে কাবিন্দা বনে তার সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। তার স্বপ্ন যুদ্ধের পর সে নার্স হবে। এই মানসসুন্দরীর সম্পর্কে তরুণেরা এতটুকুই জানে যে সে এখন গাড়িতে বসে হাঁটুতে অটোমেটিক ধরে আছে এবং যেহেতু খুনসুটির শেষে সবাই শান্ত হয়েছে তখন সে গুরুতর এবং চিন্তাশীল হয়ে উঠেছে। সবাই জানে যে কার্লোটা আলবার্তো বা ফার্নান্দেজের হবে না, কিন্তু তারা এখনও জানে না যে সে আর কখনো কারোর হবে না।
সামনে একটি ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ। তাই সবাইকে নামতে হলো। ড্রাইভারকে পার হওয়ার উপায় বের করতে হবে। হাতে কয়েক মিনিট সময়, তাই রাইকার্ড তার একটি ছবি তোলে। রাইকার্ড তাকে হাসতে বলে। কার্লোটা ব্রিজের রেলিংয়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে ক্ষেত, তৃণভূমি সম্ভবত। কিছুক্ষণ পর সবাই গাড়িতে উঠে বসলো। রাস্তায় তরুণদের চোখে পড়লো এক পুড়ে যাওয়া গ্রাম, এক পরিত্যক্ত শহর এবং আনারস ও তামাকের বাগান। এছাড়া তেঁতুলের ঝোপঝাড় এতই বেশি যেন এক বনের সাথে তুলনা করা যায়।
রাস্তার পরিবেশ ক্রমশ খারাপ হয়ে গেল, কারণ বোঝা গেল যে এই রাস্তাতেই যুদ্ধ হয়েছিল। রাস্তার উপর এবং পাশে সৈন্যদের মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মনে হয় যে মৃত সৈনিকদের কবর দেওয়ার রীতি এখানে নেই বা কবর দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের আর্দ্রতার ফলে মৃতদেহগুলিতে সহজেই পচন ধরে গেছে। চারদিকে ভয়ানক তীব্র গন্ধ। রাইকার্ডের গা গুলিয়ে উঠে বমির ভাব এসেছিল। গাড়িতে অতিরিক্ত পেট্রল ভর্তি জেরিক্যান ছিল, তাই গাড়ি থামানো হলো। জেরিক্যান থেকে পেট্রল লাশের উপর ঢেলে দেওয়া হলো। সবাই মিলে কয়েকটি শুকনো ডাল এবং রাস্তার পাশের ঝোপ দিয়ে মৃতদেহগুলি ঢেকে দিলো। তারপর ড্রাইভার তার স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে এমন কোণে অ্যাসফল্টে গুলি ছুঁড়েছিল যে তার স্ফুলিঙ্গ লেগে শবগুলি জ্বলে উঠলো। গন্তব্য বালোম্বোর পথে অভিযাত্রীরা আগুনের চিহ্ন এঁকে দিলো।।
বালোম্বো বনের মধ্যে একটি ছোট্ট শহর যা যুযুধান পক্ষগুলির মধ্যে হাত বদলাতে থাকে। কোন পক্ষই বনের কারণে ভালভাবে বসতি স্থাপন করতে পারে না। যার ফলে শত্রুকে আড়াল করার যথেষ্ট ব্যবস্থার অভাব দেখা যায় এবং এর ফলেই যে কোন পক্ষই অতর্কিত হামলা করতে পারে। রাইকার্ডরা যেদিন বালোম্বোতে এলো সেই দিন সকা্লে একশ’ জনের একটি এমপিএলএ-র বিচ্ছিন্ন দল দখল করে। আশেপাশের জঙ্গলে এখনও গুলি চলছে কারণ শত্রুরা পিছু হটেছে, কিন্তু খুব বেশি দূরে নয়। বিধ্বস্ত বালোম্বোতে একজনও অসামরিক লোক অবশিষ্ট নেই – কেবল এই শতাধিক সৈন্য। তবে দুষ্প্রাপ্য জল সেখানে আছে। তাই, বাহিনির মেয়েরা সদ্য স্নান করে ভেজা চুল নিয়ে তরুণদের কাছে এসে দাঁড়ায়।
কার্লোটা তাদের উপদেশ দেয়: তাদের এমন আচরণ করা উচিত নয়; তাদের সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। মেয়েদের অভিযোগ, ছেলেরা অগ্রসর হতে আগ্রহী না হওয়ায় তাদের অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে আক্রমণ করতে হয়েছে। ছেলেরা কপালে হাত দিয়ে বলে মেয়েরা মিথ্যা বলছে। তারা সকলেই ষোল থেকে আঠারো বছর বয়সী। এদের সবারই উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ার বয়স। ইউনিটের একটি অংশ একটি আটক ট্রাক্টর নিয়ে প্রধান রাস্তায় উল্লাস করছে।
(২)
বালোম্বোতে আবহাওয়া বেশ শীতল কারণ এটি পাহাড়ে অবস্থিত; একটি হালকা বাতাস সর্বদা বয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে জঙ্গলে যুদ্ধের গুড়গুড় আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ফিল্ম ক্রুদের সাথে রাইকার্ড হাঁটছে, নিজের ক্যামেরায় ছবি তুলছে। কার্লোটা অনেক পরিণত মননের পরিচয় দিয়ে এক বিবেকবানের মত আচরণ করছে এবং জয়ের উচ্ছ্বাসে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে দেয়নি। কারণ, সে জানে যে যে কোনও সময় পাল্টা আক্রমণ শুরু হতে পারে, অথবা আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্নাইপাররা মাথার দিকে লক্ষ্য করতে পারে। তাই সে দলের মাঝে সর্বদা হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত। সে মনোযোগী এবং শান্ত। ক্যামেরাম্যান কারভালহো এমন ভাবে ছবি তুলছে যে কার্লোটা পুড়ে যাওয়া বাড়ির পটভূমিতে হাঁটছে। পরের ছবিতে সে আকর্ষণীয়ভাবে উচ্ছ্বসিত মরুভূমির গোলাপ অ্যাডেনিয়ামের পটভূমিতে। এই সব ছবি পর্তুগালে দেখানো হবে, এমন একটি দেশে যা কার্লোটা কখনোই দেখতে পাবে না। অন্য দেশ পোল্যান্ডেও তার ছবি দেখা যাবে, যেগুলি রাইকার্ডের ক্যামেরাবন্দী।
হঠাৎ বারবোসা কার্লোটাকে জিজ্ঞেস করে সে কখন বিয়ে করবে। কার্লোটা গম্ভীর ভাবে জানায় যে সে এখন যুদ্ধে আছে এবং তাই তার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়। গাছের আড়ালে সূর্য ডুবে যায়; গোধূলি ঘনিয়ে আসছে এবং দলকে অবশ্যই চলে যেতে হবে। সবাই প্রধান রাস্তায় অপেক্ষারত গাড়িগুলিতে ফিরে আসে। সবাই সন্তুষ্ট কারণ তাদের অভীষ্ট ফিল্ম এবং ছবি তোলা হয়েছে এবং তারা সবাই বেঁচে আছে।
আসার সময় যেমনটি হয়েছিল: সামনে কার্লোটা, বাকিরা পিছনে। ড্রাইভার মোটর চালু করে এবং গাড়িটি গিয়ারে রাখে।এবং তারপর- আচমকা কার্লোটা গাড়ি থেকে নেমে আসে এবং বলে সে বালোম্বোতে থাকছে। ‘কার্লোটা,’ আলবার্তো বলে, ‘আমাদের সাথে চলো। আমরা তোমাকে রাতের খাবার খেতে নিয়ে যাব, এবং আগামীকাল আমরা তোমাকে লিসবনে নিয়ে যাব।’ কার্লোটা হেসে, হাত তুলে বিদায় জানায় এবং ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সংকেত দেয়। পরিস্থিতির এই আকস্মিক পরিবর্তনে সবার মুখ ম্লান হয়ে যায়।
বেনগুয়েলা তখন অনেক দূরে। অন্ধকার হয়ে আসছে এবং রাতের অন্ধকারে গাড়ি এগিয়ে চললো। বেনগুয়েলায় দেরিতে পৌঁছে দেখা গেলো একটি রেস্তোরাঁ তখনও খোলা আছে। আলবার্তো সেখানে সবাইকে চেনে, খোলা বাতাসে একটি টেবিলে সবাইকে বসতে বলে। সুন্দর এক পরিবেশ – বাতাস শীতল এবং আকাশে তারার সমুদ্র যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত সবাই বসে গল্প করতে থাকে। অনেকক্ষণ খাবার আসে না। আলবার্তো ডাক দেয়, কিন্তু এতই কোলাহলপূর্ণ যে কেউ তাদের কথা শুনতে পায় না।
দূরে এক কোনে আলো দেখা যায়। একটি গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে এবং রেস্তোরাঁর সামনে সজোরে ব্রেক করে দাঁড়ায়। অপরিষ্কার মুখ নিয়ে একজন ক্লান্ত সৈনিক গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে। সে বলে যে রাইকার্ডদের প্রস্থানের পরপরই বালোম্বোতে আক্রমণ হয়েছিল এবং তারা শহর ছেড়ে দিয়েছে। একই বাক্যে সে জানায় যে কার্লোটা আক্রমণে মারা গেছে। তড়িদাহত পাঁচমূর্তি টেবিল থেকে উঠে নির্জন রাস্তায় চলে আসে। প্রত্যেকে আলাদাভাবে হেঁটে চলে, একা; কথা বলার কিছু ছিল না। আলবার্তো প্রথমে গেল, তার পিছনে কারভালহো এবং রাস্তার অপর পাশে ফার্নান্দেজ, বারবোসা এবং শেষে রাইকার্ড। তাদের পক্ষে সেইভাবে হোটেলে পৌঁছে একে অপরের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়াই ভাল ছিল।
শত্রুর আক্রমণের ভয়ে সবাই পাগলের মতো বালোম্বো থেকে বের হয়েছিল এবং তারা কেউই পিছনে গোলাগুলির আওয়াজ শোনেনি। তাই কেউ অভিযোগ দিতে পারবে না যে তারা পালিয়ে এসেছে। কিন্তু তারা যদি গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেতো এবং ড্রাইভারকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিতো তাহলে কি তারা কার্লোটার সাথে থাকতে পারতো? তারা কি তাকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতো, যেমন কার্লোটা বালোম্বোতে তাদের রক্ষা করার জন্য তার জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করেছিল?
বালোম্বার চিত্রটা সবাই মনে করার চেষ্টা করলো। বাহিনির ছেলেরা ট্র্যাক্টরের চারপাশে হুল্লোড় করছিল এবং মেয়েরা তাদের চুল শুকোচ্ছিল, যখন শত্রু আচমকা আবির্ভূত হয়েছিল। কার্লোটার মৃত্যুতে সবাই নিজেদের দোষী মনে করে, যেহেতু তারা তাকে পিছনে থাকতে দিতে রাজি হয়েছিল; তারা তাকে ফিরে আসার আদেশ দিতে পারতো। কিন্তু কে এই দুর্ঘটনা আঁচ করতে পারে?
রাইকার্ড মনে করে সবচেয়ে দোষী সে এবং আলবার্তো: কারণ রণাঙ্গনের অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাদের। তাদের সুরক্ষার জন্য মন্টি তাদের একটি এসকর্ট দিয়েছে – সেই মেয়েটিকে। কিন্তু তারা কি এখন কিছু পরিবর্তন করতে পারে, সময়কে পিছনের দিকে নিয়ে যেতে পারে?
কার্লোটা চলে গেছে। কে ভেবেছিল যে তারা তাকে তার জীবনের শেষ প্রহরে দেখছে? আর সবই কি তাদের হাতে ছিল? কেন আলবার্তো ড্রাইভারকে থামালো না। তাকে নির্দেশ দিলো না যে সে গিয়ে কার্লোটাকে বলুক তাদের সাথে বেনগুয়েলাতে ফিরে আসতে; তা নাহলে তারাও সেখানে থেকে যাবে এবং তার জন্য কার্লোটা দায়ী থাকবে। তারা কেউ তা করেনি কেন? এবং এই অপরাধ কি সহ্য করা সহজ কারণ এটি তাদের পাঁচজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে?
অবশ্যই এটি একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এভাবেই, মিথ্যা বলে, পরবর্তীকালে তারা গল্প বলবে। তারা এটাও বলতে পারে যে এটা ভাগ্যের একটি পরিহাস ছিল। কার্লোটার সেখানে থাকার কোন কারণ ছিল না, তাছাড়া শুরু থেকেই সম্মত হয়েছিল যে সে দলের সাথে ফিরে আসবে। শেষ সেকেন্ডে তাকে গাড়ি থেকে নামতে কিছু অজানা সহজাত প্রবৃত্তি কাজ করেছিল, এবং কিছুক্ষণ পরে সে মারা গিয়েছিল। রাইকার্ড ভাবে যে এটা বিশ্বাস করা ভালো যে ভাগ্যের পরিহাসেই কার্লোটার মৃত্যু। এই ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ এমনভাবে কাজ করে যা পরে ব্যাখ্যা করা যায় না।
হয়তো এটাই ঘটনা যে কার্লোটা তাদের দলের সবার চেয়ে যুদ্ধ ভালো ভাবে চিনতো; সে জানতো যে আক্রমণের প্রথাগত সময়, সন্ধ্যা, ঘনিয়ে আসছে। তাই সে যদি সেখানে থাকে এবং অতিথি দলের সুরক্ষিত প্রস্থানের জন্য যথাসম্ভব ব্যবস্থা করে তবে আরও ভাল হবে। এটাই নিশ্চয়ই তার সিদ্ধান্তের কারণ। রাইকার্ডরা এ নিয়ে পরে চিন্তা করেছে, যখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
সবাই ইতিমধ্যে তালাবন্ধ হোটেলের দরজায় টোকা দেয়। একজন বিশাল চেহারার মালিক দরজা খুলে দেন। সবার কুশল সংবাদ নিয়ে ঘরের চাবি দিয়ে দেন। কার্লোটার সংবাদে তাঁকে মর্মাহত মনে হয়। পাঁচমূর্তির প্রত্যেকে নিজেদের ঘরের চাবি নিয়ে উপরে উঠে যায়, এবং নিজেদের ঘরে দরজা বন্ধ করে দেয়। “কার্লোটা নেই”- এই ভাবনা সবার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
[সূত্রঃ রাইকার্ড কাপুচিনস্কির লেখা “অ্যানাদার ডে অফ লাইফ”। সময় ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাস। সেই বছরের ১০ নভেম্বর স্থির হয়েছে যে পোর্তূগীজরা পাঁচশ বছরের উপনিবেশ অ্যাঙ্গোলা ত্যাগ করবে। দেশের ভার বর্তাবে বিদ্রোহী গোষ্ঠি জোনাস সাভিম্বির ইউনিটা এবং কম্যুনিস্ট গোষ্ঠি হোল্ডেন রোবের্তোর এফএনএলএ-এর যৌথ অধিকারে। তার আগে লড়াই চলেছে সরকার পক্ষের এমপিএলএ বাহিনির সঙ্গে ঐ দুই বাহিনির। রাজধানী লুয়ান্ডা এবং অন্যান্য শহর জনশূন্য হয়ে গেছে। পোলিশ সাংবাদিক রাইকার্ড কাপুচিনস্কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে স্বাধীনতা অনুষ্ঠান দেখতে লিসবনে যাবেন। তার পূর্ব পর্যন্ত লুয়ান্ডাতে থাকবেন।]
[পরম্পরা ওয়েবজিন, ডিসেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]