পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়

২০০৫ সালে ফ্রান্সের মিডল স্কুল পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় পাঠ্য হিসেবে প্রথম কোন জীবিত কবির কবিতার বই গৃহীত হয়। কবি হলেন ইভ বনফোয়া এবং বইটির নাম ‘লে প্লঁশ কুরবে’ (বাঁকা তক্তা)। এর ফলশ্রুতিতে দুই বছরে বইটির ১,৪০,০০০ কপি বিক্রয় হয়। এই নির্বাচনই জানিয়ে দেয় ফরাসিরা কী চোখে বনফোয়াকে দেখেন। প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্সের সীমা ছাড়িয়ে বনফোয়ার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর প্রকৃষ্ট প্রমাণ প্রতি বছর নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম মনোনীত হতে থাকে। ১৯২৩ সালে ত্যুরে তাঁর জন্ম। গণিত এবং দর্শন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য গবেষক এবং শিল্প ঐতিহাসিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে তিনি ১৯৮১ সালে বিখ্যাত ‘কোলেজ দ্য ফ্রঁস’-এ নিয়োজিত হন। তথাপি জাগতিক অভিজ্ঞতার সর্বোত্তম প্রকাশ তিনি কবিতার জগতেই করতে সক্ষম হন।

মানুষ এবং বিশ্বের মধ্যে মিলনের তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতাকেই তিনি কবিতার চরণে বিধৃত করতে চাইতেনঃ ‘এমন এক বিশ্ব যা উদাসীন না হয়ে বিনয়ী হবে, বস্তু এবং বিষয়ের মধ্যে বিভেদহীন, শব্দহীন। শুধু বস্তুর উপস্থিতিতে শব্দকে অতিক্রম করে উদ্ভাসিত হবে।’ বর্তমান বিশ্বে এই হারিয়ে যাওয়া ঐক্যকে প্রতীয়মান করার সম্মুখীন হয়েছিলেন কবি নিজের লেখনীর মাধ্যমে। তাঁর ধারণায় বর্তমানে কবিরা বিশ্বের অভিজ্ঞতার থেকে নিজেদের এমন ভাবে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন যে প্রয়োজনীয় মুহূর্ত তাঁরা আর সেখানে ফিরতে পারেন না। তাই কবিরা যখন লেখেন তখন তা পাঠক এবং বিশ্বের মধ্যে এমন এক জটিলতায় জড়িয়ে পড়েন যে পাঠক এবং বিশ্বের মধ্যে আবার প্রভেদ সৃষ্টি হয়।

বনফোয়া কবির নৈতিক দায়িত্বের উপর জোর দিয়েছেন, বার বার। তাঁর লেখাতে শুধু মানুষ আর মহাবিশ্বের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হয়নি, মানুষ আর মানুষের মধ্যেও ঐক্যের অনুরণন ঘটেছে। এখানে কবি এক অন্তরায়ের মুখোমুখি হয়েছেন যেখানে সমাজের কাছে এমন কোন প্রতীক নেই যা সর্বজনগ্রাহ্য। তখন বনফোয়া নিজের জীবন থেকে নতুন প্রতীক চয়ন করে ব্যবহার করেছেন।

২০১৬ সালের ১ জুলাই বনফোয়া প্রয়াত হয়েছেন।

ইভ বনফোয়া’র কয়েকটি কবিতার অনুবাদঃ

১) স্ফুলিঙ্গ

স্ফুলিঙ্গ,
ভুল, আলোর প্রতিক্রিয়া ছাড়াই।
একজন অন্যকে অনুসরণ করে এবং এখন অন্যরা, যেন
উপলব্ধির আর কিছু যায় আসে না, না হাসির।

আর এরিস্টটল খুব ভালো বলেছেন,
তাঁর “পোয়েটিকস”-এর কোথাও, যা আমরা খুব খারাপভাবে পড়ি,
স্বচ্ছতার মূল্য,
মৌমাছির গুঞ্জনের মত বাক্যাংশে,
স্বচ্ছ জলের মত।

২)ভোর হওয়ার ঠিক আগে

ভোর হওয়ার ঠিক আগে
আমি জানালা দিয়ে তাকাই, এবং আমার মনে হয় আমি বুঝতে পেরেছি
যে তুষারপাত বন্ধ হয়ে গেছে। একটি নীল পুকুর
ছড়িয়ে, একটু ঝকঝকে, গাছের সামনে,
রাতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

আমি বাইরে যাই।
আমি সাবধানে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাই
যেখানে তাজা তুষার ধাপগুলোকে সমান করে দিয়েছে।
শীতলতা আমার পায়ের গোড়ালিকে আঘাত করে,
মনে হয় আমার মনটা পরিষ্কার হয়ে গেছে,
যা চারিদিকের নীরবতাকে ভালভাবে উপলব্ধি করে।

সে এখনো ঘুমাচ্ছে
কাঠের স্তূপের বিভ্রান্তিতে
জানালার নীচে চাপা পড়ে,
কাঠবিড়ালিটি, আমাদের সরল প্রতিবেশী,
নাকি সে ইতিমধ্যেই কনকনে ঠান্ডায় ঘুরে বেড়াচ্ছে?
আমি দরজার সামনে ছোট চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি।

৩)তুষার

তুষার
ক্ষণস্থায়ী স্কার্ফের উপর, দস্তানার উপর
মায়ার মত, পোস্ত,
সেই হাতে যে স্বপ্ন দেখেছিল, গত গ্রীষ্মে
রাস্তায় শুকনো পাথরের মাঝে,
পরমত্ব বিশ্বের নাগালের মধ্যে আছে।

এই জলের সূক্ষ্ম স্পর্শে
কোথায় প্রতিশ্রুতি, কারণ সে ছিল,
এক মুহূর্তের জন্য, আলো! গ্রীষ্মের আকাশে
খুব কমই কোন মেঘ থাকে
যার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসবে অন্ধকার গর্ভের মধ্যে
এক অর্ধ উন্মুক্ত উজ্জ্বলতর পথ

মনমোহিনী,
তার ছায়ার প্যাগোডার নীচে, স্বপ্নদর্শী,
কোন লাল ফল দেখে না।

৪)বস্তুর প্রকৃতির বিষয়ে

লুক্রেটিয়াস এটা জানতেন:
বক্ষ উন্মুক্ত করো
আর তুমি দেখতে পাবে সেখানে আছে ঘূর্ণায়মান
তুষার।

কখনও কখনও দুটি খণ্ড
কাছে আসে, একত্রিত হয়,
অন্যথায় একজন সদয়ভাবে সরে যায়
তার ক্ষুদ্র মৃত্যুতে।

ধারণা কোথা থেকে আসে এটি পরিষ্কার
হয়ে যায় অল্প কথায়
যখন একজন শুধু রাত,
অন্য জন কি শুধুই স্বপ্ন?

কোথা থেকে আসে সেই দুই ছায়া
হেসে হেসে চলে যায়,
এবং একটি আচ্ছাদিত হয়
লাল উলের মধ্যে?

[পরম্পরা ওয়েবজিন, আগস্ট ২৪, সূচিপত্র]