পাখির চোখ
কী দেখছো সামনে?
পৃথিবীতে প্রথম এই প্রশ্ন করেছিলেন অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য – একশো পাঁচজন ছাত্রের উদ্দেশে, যে পরীক্ষায় একজন সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছিলেন দু’টি শব্দে – পাখির চোখ – আমরা জানি সেই ছাত্রের নাম অর্জুন – এবং অর্জুনের দেওয়া উত্তরটাই নাকি সঠিক –শুধু পুরাণেই নয়, ত্রেতা-সত্য-কলি সহ যুগ কাল নির্বিশেষে গুরু-শিক্ষক-বাবা-মা-অভিভাবকেরা ছাত্র-ছাত্রী-সন্তান-সন্ততিদের মুখ থেকে এই উত্তরেই যারপরনাই তৃপ্ত ও গৌরবান্বিতবোধ করেন। যদিও পাখির চোখ ব্যাপারটা এই শতাব্দীতে নিতান্তই প্রতীকী – এখনকার শহুরে ছেলে ছোকরাদের তো পাখি দেখতে একমাত্র ভরসা গুগুল, কারন শহর থেকে আমরা উন্নয়নের নামে যেমন কলেরা বসন্ত নির্মূল করেছি, পুকুর-খাল ভরাট করে ইয়াব্বড়োবড়ো কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়েছি, গাছপালা কেটে রাস্তা চওড়া করেছি, তেমনি পাখিদেরও দেশদ্রোহী বানিয়ে আধারকার্ড ইস্যু করিনি, আমরা পাখিহীন ডিজিটাল শহরের নামে গর্বোল্লাসে সোচ্চার হই –তাই এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ ‘পাখির চোখ’ বললে এখনকার ছেলেরা তার দিকে ভ্যাবলাকান্তিক হাঁ-মুখো ফ্রিজ শট্ – আজকের দ্রোণাচার্যও এই উত্তর লিখলে পাশনম্বর দেবেন না। বরং আজকের অর্জুন যদি এর উত্তরে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে ওঠে – ‘আমেরিকা’, অভিভাবকদের চোখও আনন্দে চকচক, আর বুকের ছাতি পঞ্চান্ন ইঞ্চি। একশোয় একশো।
বিজ্ঞান আমাদের শিখিয়েছে, ধ্রুব সত্য (সোজা বাংলায় যাকে আমরা absolute truth বলি) বলে কিছু নেই, যে কোনো সত্যের গায়ে বন্ধুর মতো লেপ্টে থাকে কিছু শর্ত – স্থান কাল বা পাত্রের পরিবর্তনের সাথে সত্যেরও বদল ঘটে। একই সময়ে পৃথিবীর কোথাও দিন, অন্য কোথাও রাত – দুটোই সত্য, কিন্তু দুটির সঙ্গে কাল ও স্থানের যুগপৎ শর্ত আছে।
কুয়াশা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে – মনে খচ্খচ্ – অর্জুন ছাড়া বাকিরা উত্তরে যা বলেছিলো, অর্থাৎ – গাছ পাখি আকাশ মানুষজন ইত্যাদি অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছে – এর মধ্যে ভুলটা কোথায়? আদৌ কি ভুল?
আসলে যে কোনো প্রশ্নেরই একাধিক উত্তর হতে পারে। উত্তরদাতাকে বুঝতে হবে, প্রশ্নকর্তা কোন্ উত্তরটা চাইছেন। হাঁ-মুখের সামনে সন্দেশ হাতে যদি কেউ প্রশ্ন করেন – খাবো? – উত্তরদাতাকে বুঝতে হবে – উনি গলাধঃকরনের জন্য বড়োই উদগ্রীব, প্রশ্নের মাধ্যমে শুধুমাত্র সম্মতি চান – এখন যদি আপনি হঠাৎ হাঁ হাঁ করে ডায়াবেটিসের ওপর একটা সিধুজ্যাঠতুতো বক্তৃতা শুরু করেন – ত্রেতা বা সত্য যুগে কী হতো জানিনা, তবে কলিযুগে যে আপনার কপালে নির্ঘাৎ চোদ্দপুরুষ উদ্ধারকারী অনভিধানিক শব্দাবলী অথবা বাংলা প্যাঁদানি জুটতো, এটা বলার জন্য আমাকে জ্যোতিষশাস্ত্রে ডিলিট হওয়ার দরকার নেই।
কী দেখা যাচ্ছে সামনে?
জ্যোতিষশাস্ত্রর কথা এলোই যখন, এই প্রশ্নটির সম্পূর্ণ অন্য একটি মাত্রা উদ্ঘাটিত হলো –মনে পড়ে গেলো – একমাত্র জ্যোতিষীরা এই প্রশ্নে যার পর নাই আহ্লাদিত হন, কারণ, ওনাদের দাবি যে, সামনে যা যা দেখা যাচ্ছেনা, মানে আমরা সাদাচোখে যা দেখতে পাইনা অর্থাৎ আমাদের সেই ভবিষ্যতের ছবি ওনারা পরিষ্কার দেখতে পান – যা আমরা চেষ্টা করেও পারিনা।
জ্যোতিষীরা মানুষকে তার ভবিষ্যৎ দেখান, এবং এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমার ভবিষ্যৎ আমি ঠিক যেমনটি দেখতে চাই, মোটামুটি জ্যোতিষীর গণনাও সেই পথই নির্দেশ করে, কিন্তু এই পথে অনেক লোমহর্ষক ঘটনা-টটনা ঘটাতে হয় তাঁদের, জীবিকার খাতিরেই – নইলে আমাদের অন্ধ বিশ্বাসের সুতো আলগা হয়ে যেতে পারে। এটা ঘটনা যে, সুতোটা বাস্তবিকই যথেষ্ট আলগা। অবশ্য আলগা বলিই বা কি করে – যেখানে সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে জ্যোতিষীদের রমরমা বিজ্ঞাপণ ক্রমবর্ধমান? আসলে জ্যোতিষ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এখনও অপ্রতিষ্ঠিত। তাতে অবশ্য ইদানিং কিছু যায় আসেনা। কারণ, খুব সুচিন্তিতভাবেই জড়িবুটি যজ্ঞমন্ত্র অথবা গরুর সিঙে বা গলায় কুঁজে হাত বুলালে জটিল সব মারণরোগের নিরাময়, অমুকদিকে মাথা রেখে ঘুমোলে অর্থাগম, অমাবস্যারাতে তেত্তিরিশবার হ্রিং হ্রিং করলে প্রেমে বশীকরণ ইত্যাদির ওপর মানুষের আস্থা ফেরানোর ভয়ঙ্কর কৌশলকে মানবকল্যাণকর হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে সর্বত্র। ছোটবেলায় জানতাম – সাধু-সন্ন্যাসীরা মূলত হিমালয়ের দুর্গম গুম্ফাবাসী ও গঞ্জিকাসেবক – ইদানিং দেখছি দেশের এবং বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানীতেই শাসনক্ষমতার শিখরে ও আশেপাশে এই সব জটাজুটধারী সাধু সন্ন্যাসীদের ভীড় ক্রমবর্ধমান। এবং জ্যোতিষশাস্ত্রকে(Astrology) জ্যোতির্বিজ্ঞানের(Astronomy) সাথে গুলিয়ে দিয়ে জ্যোতিষের গায়ে বিজ্ঞানের পোষাক পরানোর একটা গভীর চেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলছে গোপনে গোপনে। ইদানিং তো টুথপেস্ট থেকে পায়খানার প্যান পরিষ্কারের লোশন সবকিছুতেই জড়িবুটির পরিমাণে মানুষের বিশ্বাস আদায়ের কর্পোরেট প্রতিযোগিতা চলছে। বৃষ্টি আনবার জন্য, বা বন্যা অতিমারী রুখবার জন্য যজ্ঞ – এসব আবার আমরা সামাজিক আচার অনুষ্ঠান হিসেবে দেখতে শুরু করেছি।
আমরা শক্তিদেবীর পুজো করি বিপুল আড়ম্বরে, কিন্তু শক্তিদেবীর মন্দিরে তাঁর মুর্তির সামনে একটি আট বছরের মেয়েকে কয়েকজন শক্তিপুজারীর উপর্যুপর ধর্ষণ ও হত্যার পরেও সেই দেবীর শক্তির প্রতি আমাদের কোনো প্রশ্ন জাগেনা।
কী দেখা যাচ্ছে সামনে?
পাঁচ বছর বাদে বাদে এক একজন দ্রোণাচার্য এই প্রশ্ন করেন কোটি কোটি ছাত্রের উদ্দেশে – প্রথম দ্রোণ দেখিয়েছিলেন কাঠের পাখি, সাম্প্রতিক দ্রোণেরা দেখান ‘উন্নয়ন’ কিম্বা ‘অচ্ছে দিন’ – তফাৎ, প্রথমবারের পরীক্ষায় পাশের হার ০.৯৫, এক শতাংশেরও কম, নিরানব্বই শতাংশ ফেল – আর এখন? – এখন পাশ-ফেল উঠে গেছে, পুরোটাই শপিং মল – সবাই পাশ। সবাই পাখি দেখছে এবং আরো নির্দিষ্টকরে বললে ‘পাখির চোখ’ ছাড়া অন্য কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। অন্তত খাতায়-কলমে তো তাই।
সত্যি কি তাই?
একদল সামনে দেখছে উন্নয়নের সুনামি, আর এক দল কিন্তু দেখছে আধপেটা কৃষকদের বিক্ষোভমিছিল – এক দল দেখছে লণ্ডন, অন্য দল দেখছে ভাগাড় – এক দল সংরক্ষণ বলতে বোঝে গরু, অন্য দল বোঝে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর মানুষ – এক দল দেখছে সামনে ‘অচ্ছে দিন’, অন্য দল দেখছে ধর্ষিতা কন্যাশ্রী।
তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়লগ – মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি। মাস্টারমশাইয়ের চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই ভাঙাচোরা ভয়ার্ত মুখের ক্লোজ-আপ আমরা ভুলতে পারছি না – কারণ, আজ ঘরে ঘরে আমাদের সকলের মুখের ক্লোজ-আপে অবিকল সেই একই আতঙ্ক। সেই সিনেমার গল্পে ঘটনাচক্রে রাস্তার মাঝখানে ভর সন্ধ্যাবেলায় দ্রোণাচার্য যা দেখাতে চাননি, মাস্টারমশাই সেটাই দেখে ফেলেছিলেন – তাই সেটা আদৌ ঘটেইনি, অর্থাৎ উনি ভুল দেখেছিলেন। মাস্টারমশাইয়ের বোঝা উচিৎ ছিলো যে, দ্রোণাচার্যের ইচ্ছেমতো ওনার ওইসব কৃষকমিছিল, ভাগাড়, অনগ্রসর মানুষ, কাজ-হারানো পরিযায়ী শ্রমিক, মূল্যবৃদ্ধি, ধর্ষিতা কন্যাদের দেখতে পাওয়াটা মোটেই উচিৎ কাজ নয়, বরং ওতে জান-প্রাণ-মান সংশয়ের যথেষ্ট আশঙ্কা আছে – পরীক্ষায় যদি একশোয় একশো পেতে হয়, তবে ওনাকে দেখতে হবে –
শুধুই পাখির চোখ
অর্থাৎ
উন্নয়ন আর অচ্ছে দিন
যা কোটি কোটি আমরা সবাই বেমালুম দেখতে পাচ্ছি।
রাজশেখর বসুর অপবিজ্ঞান প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে গেলো। যথার্থ লিখেছেন । এবং এ লেখা মুক্ত গদ্যেই সম্ভব।
তোমার মতামতকে আমি বরাবর সমীহ করি। ধন্যবাদ রুনা। ভালো থেকো। ভালো রেখো আগামী পৃথিবীকে।
অনেক মানুষের মনের কথা। পাখির চোখে ভুবন । অসাধারণ । আরেকটা কথা না বললেই নয় । অপরূপ গদ্য। মন ভরে গেল ।
তোমার মতো খ্যাতিসম্পন্না গদ্যলেখিকার আমার গদ্য ভালো লেগেছে জেনে বুক ছাপ্পান্ন ইঞ্চি হয়ে গেলো। ভালো থেকো আইভি।
যথার্থ লিখেছেন দাদা । শতকরা একশো ভাগ সহমত ।
ধন্যবাদ মিষ্টি। ভালো থাকবেন।
লেখার বাঁধন টি চমৎকার লাগলো!
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
পল্লববরন।
চমৎকার লেখা।
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
পল্লববরন